দিলদারে স্বপ্নগুলি যায়নাতো ফাঁকি।
ঘটে যাওয়া সত্যিগুলি ফিরে ফিরে বলে যায় ---
জীবনের আছে আরো বাকি !
হাতির খুকু মা ছাড়া হয়ে গেছিল। বন দপ্তর তাকে রেখেছে। কতই না আদর যত্ন তার! এই সময় হাতির পাল হানা দেয় পাকা ফসলের লোভে। শহরের গা ঘেঁষেই তো জঙ্গল। ঢুকেও পড়ে। বাচ্ছা গুলো মা ছাড়া হয়ে যায় প্রায়ই।মস্ত বড় কাঁচের ফিডিং বোতলে সে এখন দুধ খাচ্ছে। ফরেস্ট অফিসের নিচু পাঁচিলের বাইরে এখন মানুষের মেলা। বেলুন ওয়ালা, লজেন্স ওয়ালাও পৌঁছে গেছে। হালকা শীতের মিঠে রোদে বেশ একটা উৎসব যেন! রাস্তার উল্টো দিকে বন সাহেবের বাংলো, চারপাশে কাঁচা সবুজ ঘাসের লন, বাগান, দোলনা, গেটে সিকিউরিটি। অন্য দিন গোমড়া মুখ করে বসে থাকে। স্কুলের পাজি মেয়েগুলো সাইকেলে যেতে যেতে ন্যাকা আধো আধো গলা করে “এই পুলি…ই..শ” বলে ডেকে দিয়ে যখন হাসতে হাসতে পালায়, ওর আরো রাগ হয়। দাঁত কিড়মিড় করে, কিন্তু একটাকেও ধরতে পারেনা!একই রকম দেখতে যেন সব কটা। আজ সেও নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে এক মুখ হাসি নিয়ে হাতির দুধ খাওয়া দেখতে চাইছে, কিন্তু সামনের লোকজন কে ভেদ করে, উঁকি ঝুঁকি মেরেও তেমন সুবিধা হচ্ছেনা। শনিবার বলে স্কুলের মেয়েগুলো ও এসে পৌঁছে গেছে, বাড়ি যাবার নামটি নেই। তবে ওদের সব মন এখন হাতিতে।
শনিবারের শেষ দুপুর টা ওদের কাছে যেন একটা ঝলমলে মুক্তির দুয়ার। সপ্তাহের পরীক্ষা থাকে সেদিন, আগের দিন আবার কামাই চলেনা সেই অজুহাতে। তাই খুব চাপের শুক্রবারের পর শনিবারের পরীক্ষা টা দিয়েই মন উড়তে থাকে। আজ আবার ওদের ইউনিফর্ম থেকেও মুক্তির দিন। রঙ্গিন অন্য ফ্রক, ইলেভেন টুয়েলভ শাড়ী। মা, মাসি, দিদি র থেকে ধার করা শাড়ী পরে, একটু পাউডার,কাজল এর ছোঁয়ায় ওদের অন্য রকম লাগে। চুরি করে হাল্কা লিপস্টিক ও বুঝি ছোঁয়ায় কেউ। ব্লাউজ অবশ্য লাল, সাদা, মেরুন ---সোজা সাপ্টা, সব শাড়ির সাথে চলে যায় এমন রঙেই ঘোরাফেরা করে। স্কুলের বাইরে আর শাড়ী কোথায়? কালো ব্লাউজ পরায় অনেকের বাড়িতে কেন যেন আপত্তি থাকে। যারা পরে তাদের খুব স্টাইলিশ লাগে অন্যদের চোখে। শ্যাম্পু সেদিন ই করে ফেলে অনেকে । স্কুলে আসার আগের তাড়াহুড়োর মধ্যেই! আলগা করে একটা ক্লিপ দিয়ে ছেড়ে আসে, পথেই শুকিয়ে যায়। ঢোকার আগে তাড়াতাড়ি বিনুনি বা হর্সটেল। গুটি কয়েক বব বা বয় কাটও থাকে। ইস্কুলে আসতে আসতে ওদের মন পেণ্ডুলামের মত একবার পরীক্ষা আরেকবার ইতিউতি ঘোরাফেরা করে। চোখ গুলি ঘোরে ফেরে পথের দু পাশে! চিরকুট ---ব্রেক ---নেমে চেন ঠিক করা ---ফুরফুরে চুল ওড়ে ----গান ওড়ে ---
“দিল কি পতঙ্গ মেরি উড়ি উড়ি যায় ---!”
বন অফিস আর বন সাহেবের বাড়ির মাঝ দিয়ে চওড়া পিচের রাস্তা। বন অফিসের পরেই ওদের ইস্কুলের পাঁচিল শুরু, বড়ো বড় শাল সেগুন, পিয়াল, অর্জুন…ঢাকা। এক সময় এ বাড়ি বন বিভাগের এর ই ছিল। ওপাশে কিচ্ছু দেখা যায়না! তবে রাস্তা টা বাঁ দিকে বাঁক নিলেই ইস্কুলের মস্ত গেট, সেখান থেকে পুরো ভিতরটা দেখা যায়। কিন্তু মুশকিল হল যতদূর চোখ যায় লাল রাস্তা, দুপাশে গাছ, আর শেষ প্রান্তে অতো বড়ো সাদা বিল্ডিং টাকেও পুতুল বাড়ি দেখায়! পুতুলদের দেখার ইচ্ছে থাকলে দূরবীন আনতে হয়। ইস্কুলের গেটের উপরে লোহার ফলকে লেখা :
দিলদার নগর ব্যাপটিস্ট মিশন গার্লস হাই স্কুল, স্থাপিত - ১৮৬৮।
গাড়ি বারান্দার সামনে খোলা আকাশের নিচে গোল করে ঘেরা ছোট্ট বাগান। গাড়ি বারান্দা পেরিয়ে তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে মোটা মোটা থাম নিয়ে ঢাকা বারান্দা, যার মাঝখানে বড়ো একটা দরজা দিয়ে ঢুকতে হয় সম্মিলনী ঘর টিতে। দুই পাশের আর আর সাধারণ দরজা গুলি হেডমিস্ট্রেস , টিচার্স কমন রুম, অফিস ইত্যাদির। বৃষ্টির দিনে গাছের তলায় প্রেয়ার করা যায়না, সেদিন সবাই জমা হয় পেল্লাই এই সম্মিলনী তেই। এছাড়া কিছু অনুষ্ঠান, যীশু র জীবন সংক্রান্ত ছবি, সিনেমা ও দেখানো হয় অবসর মত। প্রতি বছরে বড়দিনের আগে একবার নিয়ম করে -আ ক্রিসমাস ক্যারল --- সাদা কালো কোন যুগের ছবি। ছবির শেষে সবাই উদার হয়ে যায় ওরা, হাসি মুখে বাড়ি ফেরে। প্রতিবার ই সিনেমা শুরুর আগে সিনেমার গল্পটা --ছোট করে বলে দেওয়া হয়, সাথে সাথে লেখক চার্লস ডিকেন্স সম্বন্ধে দু চার কথা। তবে লাইব্রেরি র রেক্সিন বাঁধানো পুরোনো গন্ধ ওয়ালা বইগুলির গন্ধ শুঁকতে গেলে, চাইতে গেলে, পড়ার বই বেশী করে পড়ার উপদেশ ভেসে আসে। রোজকার প্রার্থনার সাথে একেকদিন একেকটা গান, তারপর খবরের কাগজের সেই দিনের কোনো একটা খবর পাঠ ---অবশ্যই বেছে বুছে! উঁচু ছাদের এই তকতকে আলো হাওয়ায় ভাসা ঘরের দুপাশে দুটি দরজা দিয়ে চলে যাওয়া যায় পেছনের করিডর বেয়ে বিভিন্ন ক্লাসে। মূল দরজার মুখোমুখি দেওয়ালে দু প্রান্তে বড় বড় দুটি জানলা দিয়ে আলোর ছটা মুখে এসে পড়ে। দুটি জানলার মাঝের সাদা দেওয়ালে একটা সোনালী ক্রস ঝোলে। সকালের দিকে সেটা ঝক ঝক করে সামনের দরজা দিয়ে আসা পুবের আলোয়। আর দুপুর গড়ালে দুপাশের জানলা দিয়ে আসা পশ্চিমের আলো সোজাসুজি দরজার দিকে ছুটে এলেও ত্যারচা ভাবে তার দুটি পাশেও পড়ে, ফলে ধার দুটি তার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষাতেই লেখা পড়া চলে এখানে।
স্কুলের হোস্টেলে বিহার, ঝাড়খণ্ডের মেয়েরাও থাকে। বড়ো ছুটি না থাকলে ওরা বাড়ি যাওয়ার জন্য ছাড়া পায়না। শনিবার পরীক্ষা শেষে হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে ওরা শুকনো মুখে তাকিয়ে থাকে কলরব করতে করতে সাইকেলে ওঠা বা ইস্কুলের বাসের লাইনে ঠেলাঠেলি করতে থাকা বন্ধুদের। বন্ধুরা অপরাধ বোধে ভোগে।তবে কৈশোর বুঝি বড় স্বার্থপর, তা না হলে কয়েক মিনিট পরেই ওদেরকেই এখন কেন রাস্তায় হাসি ঠাট্টা করতে দেখা যাবে? নাকি ওরা আসলেই শরতের আকাশ?এই মেঘ ,এই বৃষ্টি--- চালচিত্র নির্মল আকাশ? এতো মায়া ভরা চোখে ওরা হাতির ছানার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েই আছে কেন? চোখ ও বুঝি চিকচিক করে কারো কারো! কতদূর থেকে থেকে আসে ওরা ---এতটা পথ চড়াই রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে!খিদে তেষ্টা ভুলে দাঁড়িয়েই থাকে আর নজর রাখে মা হারা ছানা পুরো বোতল শেষ করলো তো, নাকি মন খারাপে খাওয়া বন্ধ করে দিল ---যেমনটা ওদের মাঝে মাঝে হয়ে যায়!
পলিনকে এখানে রেখে গিয়েছিল রিচার্ড। ওরা এসেছিলো মুঙ্গের থেকে। ১৯৩৪এর জানুয়ারির সেই ভূমিকম্পের পর পর। কত মানুষ মরলো,কত বাড়িঘর ধুলোতে মিশে গেলো! হাহাকার চারদিকে! অনাথ হলো কত ছেলে পুলে!পৌষ সংক্রান্তির আগে পরে ছিল সেই দিন। বাতাসি মুর্মু এক মাথা সাদা চুল নিয়ে বসে বসে মনে করে পুরোনো কথা। ওদের ছিল বাঁধনা পরব।কিন্তু সে পরবে সে আর যায়না। ১৯৩৪সালেও যায়নি। কেন যায়না আর বাতাসী মুর্মু তার ভালুকপোতা গাঁয়ের বাঁধনা পরবে?
মেট্রোন তখন সে এই মেয়ে ইস্কুলের হোস্টেলের যখন পলিন এলো। পলিন নাকি ভূমিকম্পে তার মা হারিয়ে এসেছিলো এখানে। কার পাপে এ সর্বনাশ? ওর মনে পড়ে সেই মহা হই চৈ এর কথা! গান্ধী বললেন মানুষের পাপে! কেন? না উঁচু জাত নিচু জাত কে ঘেন্না করে, অত্যাচার করে---সেই পাপে! গান্ধীজিকে দেখেছিলো ও একুশ সালে, শহরের সেই মস্ত মাঠ খানায়। সবাই ঝেঁটিয়ে যাচ্ছিল দেখতে। ওরা ভালুকপোতা থেকে সওদা করতে এসেছিলো ক জন। ঢুকে পড়েছিল ঠেলেঠুলে। অনেক দূর থেকে দেখেছিলে তাঁকে, উদলা গা খাটো কাপড় ---ওদের মতোই! এমন মানুষ ঘিরে এতো রবরবা দেখেনিতো কখনো! পঁচিশ সালে আবার এলেন , ঘুরে ঘুরে জাত পাত নিয়ে, ছোঁয়াছানি নিয়েই কত কথাই বললেন ।যেটুকু বুঝতে পেরেছিল,মনে হয়েছিল ওদের ঝামেলাগুলিও বুঝি অনেক কতক মিলে যায়! তবে সবটাই কি আর মেলে? এখানে এলো ও ছাব্বিশ সনে। ভাবতো মাঝে মাঝে তাঁর কথাগুলি।বানান করে বাংলা খবরের কাগজ পড়তে শিখে গেছে সে এখানে এসে। অত্যাচার যে হয় তাতো বাতাসী হাড়ে হাড়ে জানে। শুধু হিন্দুদের নিচু জাত কেন, ওদের সাঁওতালদের উপর, মুন্ডা শবর দের উপর কম অত্যাচার হয়?কে করেনা সেই অত্যাচার? উঁচু জাত করে,ইংরেজ রাজা করে, পয়সাওয়ালা বেনিয়া করে!আর? জাতের মধ্যে ও তো কত অত্যাচার। যার ক্ষমতা তার হাতেই লাঠি! নিজের জাতের লোক ও ছাড়েনা!মেয়ে হলে আরো বিপদ! বাতাসী এখানে এল কেমনে? ও তো মরেই যেত! মোড়লের মুরগি গুলো একে একে মরতে থাকলো আর ডাইন খোঁজা শুরু হলে বাতাসিই সেই ডাইন হয়ে গেল! স্বামী মরে গেছে কবেই,দশ বছরের ছেলেটা গেল আর বছর কলেরায়। একাই থাকতো ও ভালুকপোতা গাঁয়ে। একটু ধান জমি ছিল। ডাইন হবার যোগ্যতা তাই বুঝি ওর ছিল।পুরুষের সাথে যতই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খাটো, লড়ো, কাজটি হয়ে গেলেই সে মুখ মুছে ফেলতে দেরী করেনা!, দরকারে সরিয়েও দিতে পারে তোমায়! ও শুনে এসেছে সাঁওতালরা কেমন করে দিকুদের সাথে লড়েছিল। মেয়েরা ছিল পাশে। অথচ দেখো, ইংরেজের উপর গায়ের ঝাল মেটাতে যুদ্ধের মোড়লরা ঘোষণা করে দিলে ইংরেজ শাসনে নাকি ডাইন বেড়ে গেছে আর প্রমাণ মিলিয়ে দেবার উৎসাহে নিজেদের মেয়েদেরই পিটিয়ে, গায়ে আগুন ধরালে তারা! সিপাহীরাও কিছু কম করেনি! এই বেইমানি বর্ণনার ভাষা হয়তো পরে খুঁজেও পাবে কোনো মেয়ে --- ‘বিপ্লবের সেবাদাসী’! তবে তার তখনো ঢের দেরী। গাছে বাঁধা অবস্থায় মার আর ছেঁকা খেতে খেতে ও যখন প্রায় বেহুঁশ,যখন গুণীন সহ বাকিরা একটু গাছের তলায় জিরিয়ে নিচ্ছে, একটু চুটা ধরাচ্ছে তৃপ্তি করে, তখনই এসেছিলো মিশনের গাড়ি। পরে জেনেছে জ্ঞান ফিরলে। সেখানে কি কি হয়েছিল শুনেছে, মনে করতে চায়নি। আর তারপর থেকে ও এখানেই।কিন্তু ও ভেবে থৈ পায়না, ভূমিকম্প যাদের মারলো তাদের মধ্যেও তো নীচু জাত ছিল, সাঁওতাল মুন্ডা শবর ছিল! তাদের পাপটি জমলো কেমনে? নাকি পাপী যতবার শাস্তি পায় নিষ্পাপ কেও তার সাথে সাথে শাস্তি পেতে হয় নিজের দুর্দশা টি সহ্য করার সাথে সাথে ?যাকগে। ও ভাববে এখন পলিনের কথা।
পলিন রিচার্ডের কে সেটা রিচার্ড বলেনি। পলিন কে রেখে সে মুঙ্গেরের কালেকটরেট এর চাকরি ছেড়ে চলে যায় ইংল্যান্ড।পলিন তখন চার বছরের। কথা বলেনা তেমন। যেটুকু বলে হিন্দি ইংরেজির মিশেলে ভাঙা বাংলা। প্রথম পলিনকে দেখে কেমন যেন অবাক লেগেছিলো সবার। সমুদ্রের নীল চোখ, কিন্তু গায়ের রং তো বেলাভূমির উজ্জ্বল স্বর্ণাভ নয়। অথচ সে কালো ও নয়। কেমন যেন লালচে গোধূলির লাবন্য তার সারা শরীর জুড়ে! বাতাসি সমুদ্র দেখেনি, তবে কপিশার বালি দেখেছে। নীল চোখের সাথে সেই বালু রং দেখতে অভ্যস্ত চোখে তারও মনে হয়েছে এ আলাদা। এমন গোলাপ পোড়া ছাই রং! সে পলিনের মা হয়ে গেলো তারপর। হোস্টেলে তার ছোট্ট মেট্রোনের ঘর টিতে ঠাঁই পেল পলিন। মিটশেফে সব সময়েই রাখতো কিছুমিচু। বিস্কুট, কেকের টুকরো হয়তো, ডিম সেদ্ধ ---নিজের ভাগেরটাও। ছুটির সময় পলিনের কোথাও যাবার ছিলোনা। রবিবার আর ছোট কোনো ছুটির দিনে আবাসগড়ের সাদা মাঠা চার্চ যেত ওরা,আবার দিলদারের রাস্তাগুলিতেও ঘুরে বেড়াতো দু জনে। রেল শহরের বড়ো চার্চ দেখাতেও নিয়ে যেত ওকে মাঝে মধ্যে। তবে শেখপুরার নির্জন রাস্তার পাশে পুরোনো পুরোনো সব কবরে ঘেরা সন্ত জোহনের চার্চ এ ওরা যেতোনা। স্টেশন মুখি চওড়া রাজপথের পাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে থাকা পবিত্র হৃদয় আশ্রম চার্চ এও ওরা প্রার্থনা করতে যেতোনা। তবে বড়দিনের সময় পবিত্র হৃদয়ের মাঠে খ্রিস্ট মেলা বসে। কত লোক কত দোকান---নাগরদোলা, বাজি ফাটানো। পলিন খুব বায়না ধরত সেখানে যাবার জন্য। বাতাসি ওকে নিয়ে যেত, কিন্তু ওর ভয় করতো খুব ওই ভিড়ে। চার্চ এর ভিতরে কত সব ছবি –যীশু –তাঁর শিষ্য, আর সন্তদের। যীশুর মূর্তি আছে এখানে, সাজানো হয় পুতুল দিয়ে যীশুর জন্মকাহিনী। পলিন মুগ্ধ হয়ে দেখতো আর বায়না করতো ওদের আবাসগড় চার্চ এও এমনটি কেন নেই ---এমনটি ওখানেও চাই! সেখানে যীশু নেই কেন? সেখানে শুধু ক্রস কেন? বাতাসী আদর করে বলতো: এখানে আছে তাই ওখানে নেই।
বড়দিনের মেলাতেই পলিন একদিন হারিয়ে গেলো হাতছাড়া হয়ে। সেই তিনটে ঘন্টা যতই মুছে দিতে চায় বাতাসি মনের থেকে ততই যেন ঝাঁপিয়ে আসে! সে সময় এমনিতেই শহর বড়ো উত্তাল। একটার পর একটা ম্যাজিস্ট্রেট গুলি খেয়ে মরেছে স্বদেশী দের হাতে আর ততই বেড়ে উঠেছে সরকারের উল্টো দাওয়াই! শাসক বা হানাদারের ধর্ম যদি শাসিতের ধর্মের থেকে আলাদা হয় তবে সেই ধর্ম, সেই ধর্মের সাথে যুক্ত ---সব কিছুর প্রতি ই একটা সন্দেহ, অবিশ্বাস তৈরি হয়। সাধারণের ভাবনার এই আলো আঁধারী কেই কাজে লাগায় আঁধার জগতের লোকজন, নিজেদের বিকৃত উদ্দেশ্য সাধন করতে! শিশুকেও ছেড়ে দেয়না!
পলিন কে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছিল সার্কাসের তাঁবুর পাশে। বাড়ি ফিরে গলা জড়িয়ে বলেছিলো :ওই চার্চ এ তোমার আমার মাঝে কত কত মানুষ ঢুকে পড়লো, তুমি হারিয়ে গেলে! বাতাসি ওকে বুকে সাপটে ধরে বলেছিলো :তুমি তোমার আমার মাঝে আর কাউকে ঢুকতে দিওনা।
সাত বছরের পলিন কে চান করাতে গিয়ে হটাৎ ই বাতাসির নজরে এসেছিলো গোল চাকা মত ফ্যাকাশে দাগটা। বাঁ হাতের উপরে, কাঁধের ঠিক নিচে। এ দাগ চেনে সে। মন তবু মানতে চায়না! স্নানের পর তাড়াতাড়ি একটা ছুঁচের ডগা ছোঁয়ায় সেখানে, পলিনের কিছু সাড় জাগেনা! তাড়াতাড়ি বাতাসি ছোটে এস্থারের কাছে, জানায় সব।তারপর মিশনের ডাক্তার –--পরীক্ষা ---পলিন কে চিকিৎসা ক্যাম্প এ পাঠানো। বাতাসি কাঁদে আঁধার ঘরে। ছুটে ছুটে দেখতে যায় তাকে। তারপর আলাদা ঘর ভাড়া নেয়, পলিন কে নিয়ে আসে। নিয়মিত ইনজেকশন, ওষুধপত্র সব নিজের কাঁধে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয় শেষ পর্যন্ত! পলিন সেরে ওঠে। স্কুল পাশ করে কলকাতা চলে যায় কলেজে পড়তে। ছুটিগুলি কিন্তু তার কাটে দিলদারেই, বাতাসির কোল ঘেঁষে। রেলে হাসপাতালে চাকরি পায়, বিয়ে করে। সেটা ১৯৫৩---সে শেষ এসেছিলো বাতাসির কাছে।চিঠি মাসে একটা করে লিখতে ভোলেনা।
বাতাসি অবসর নিয়েছে কিন্তু এস্টি দিদির সাথেই থাকে সবসময়। তার সুখ সুবিধা নিয়ে খুব চিন্তা করে। সেও তো ঘর ছাড়া সেই কাঁচা বয়স থেকেই! এই ইস্কুল তখন শহরের শেষ প্রান্তরে ছোট্ট একটা মিডল স্কুল মাত্র! তাকে একটু উঁচু মাপের ইংরেজি ইস্কুল করতে লেগে পড়েছে খ্রীষ্টান মিশনারীরা। মেয়েদের ও ইংরেজি শেখাটা যে খুবই জরুরী! এস্থার যখন এলো তখন এই কাজই চলছে।এস্থার ফিরে দেখে সেই দিনগুলিকে।
১৯১৪ সালের সেই হেমন্তের শনিবার। নিউ ইয়র্ক বন্দর থেকে ভোঁ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লে লুইসিয়ানা জাহাজ। এক ঝাঁক উজ্জ্বল মুখ মিশনারি রওনা দিলে বার্মা আসাম, পূর্ব আর দক্ষিণ ভারতের উদ্দেশ্যে। মনে এক রাশ স্বপ্ন আর কৌতূহল! আর কিছুটা বুঝি নির্মিত সাধারণীকরণ – উন্নসিকতা কিছুটা --- প্রচ্ছন্ন বা উচ্চারিত ---একটা অন্ধকারের ধারণা, ভবিষৎ কর্মক্ষেত্র ও তার মানুষ সম্পর্কে ---যার উদ্ধার কার্যে তারা সহায়ক!
“With hearts in love united,
By one high purpose moved,
Go ye to men benighted,
And show them they are loved…”
---The Missionary Helpers এর নভেম্বর ১৯১৪ সংখ্যায় সম্পাদকীয় পাতায় তাদের উদ্দেশ্যই বলা হয়েছিল। বিনাইটেড শব্দটি আজতো আর তেমন শোনা যায়না! শব্দ, বাক্যবন্ধ ---সবই তো ইতিহাসের পথ ধরেই উঠে আসে!এস্থার ভাবে, আর ভাবে!শাড়ী পরা এস্থার, ভাত তরকারি খাওয়া এস্থার এখন বেশ বোঝে অন্ধকারের কোনো বিশেষ দেশ কাল হয়না!সে থাকে সর্বদেশে সর্বকালে ---আলোর সাথে মেশামেশি হয়েই। বাতাসিকে জড়িয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে!
এস্থার ড্যানিয়েলস ছিল বাংলা উড়িষ্যার দলে। দিলদার নগরে এসে দুই বছর বাংলা শিখে সে লেগে গেল স্কুলের কাজে,কিন্তু দেশ থেকে বাপ মা খালি চিঠি লেখেন যে :আমরা খুব ভালো আছি, কিন্তু বড়ো একা। ফিরে গেলে সে দেশে, ছ বছর পর। মনের মধ্যে কিন্তু ততদিনে স্বপ্নের চারা গাছটি অনেকটাই বেড়ে উঠে ডালপালা মেলে দিয়েছে! একটা হাই স্কুল ---মেয়েরা পাশ দেবে! কিন্তু মা বাপের কাছে পাড়ে কী করে সে কথা?
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলোনা এস্থার! লস এঞ্জেলেস থেকে ট্রেনে চেপে মিশিগানে বাড়ি ফেরার পথে যখন বাবা ই বললেন: স্বপ্নের স্কুল তৈরি করতে আগে তোমায় নিজেকে তৈরি করতে হবে, আর সেই জন্য কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা নেওয়া জরুরী। নিজেকে তৈরি করে আবার ফিরে আসা স্বপ্ন সাধনে! পাশে পেলে স্নিগ্ধবালা দাশকে। এ শহরের ই সে, রেভারেন্ড সদানন্দ দাশের মেয়ে। এই স্কুলেই হাতে খড়ি। তারপর বেথুন হয়ে সোজা আমেরিকা। ফিরে এলে সে লাইব্রেরি র জন্য অনেক অনেক ইংরেজি বই নিয়ে।
কিন্তু বাধা ছিল অনেক। মিশন বালাসোর এর মেয়ে স্কুলকেই বেশী যোগ্য মনে করলো হাই স্কুলে উন্নতির জন্য। সভায় খানিকটা দাবিয়েই দেওয়া হলো এস্থার কে। কিন্তু কোন নির্দেশটা মানার আর কোনটা উপেক্ষা করার সেটা না বুঝলে তো এগোনোর পথই আটকে যায়! ছিপছিপে শ্যামলা রঙের স্নিগ্ধবালা হেড মিস্ট্রেস তখন। একই দৃঢ়তা তার মধ্যেও। নির্দেশ কে উড়িয়ে দিয়ে কাজ শুরু করে দিলে দুজনে। সবার আগে বন বিভাগের অনেকটা জায়গা নিয়ে পড়ে থাকা বাংলোটিতে স্কুলকে তুলে আনা। ছাত্রী সংগ্রহে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে সাইকেলে করে। শহরের মধ্যখানে একটি মেয়ে স্কুল ছেড়ে কে আসে এতদূর? প্রথমে গরু গাড়ি, তারপর ঘোড়া গাড়ি, তারপর বাস। বাসের ভাড়ার জন্য স্কুল ফি বেশী হওয়া নিয়ে, বাইবেল পড়ানো নিয়ে কতই আপত্তি! বড়ো পরীক্ষা দেবার আগেই মেয়েদের স্কুল ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়াতো আছেই। এতো পথ পেরিয়ে দিলদারের এই স্কুল এখন রত্ন--- অভিভাবকদের মস্ত লাইন। এস্থার ড্যানিয়েলস কে সবাই চেনে, সবাই মানে, তার ঘরে সদাই ভীড়। তবে কি তাঁর কাজ ফুরালো এখানে? ভাবেননি তো এমন করে আগে! মাও তো চলে এলেন শেষ বয়সে এখানেই, মাটি পেলেন এখানেই! এবার বুঝি তাঁর হাতের বাঁশিটি আরেকজনের হাতে তুলে দেবার সময় হলো।
অবন ঠাকুর একবার রানী চন্দকে বলেছিলেন ছবি আঁকতে আর নাকি ইচ্ছে করেনা। ডিফিকাল্টি ওভারকামের আনন্দ আর পাননা যে! । যা চান তাই এঁকে ফেলতে পারেন। সৃষ্টি সম্পন্ন হলে তাই বুঝি শিল্পী কে সরে যেতে হয়। নয়তো সৃষ্টি তাঁকে গ্রাস করে। তিনি আর শিল্পী থাকেননা তখন। জীবন হয় পুনরাবৃত্তি মাত্র!
বাতাসি আরো বুড়ো হয়, পলিন একদিন এসে তাকে নিয়ে যায় নিজের কাছে।সে সংসার পেতেছে অস্ট্রেলিয়ায়। এস্থারও একদিন মোটঘাট বাঁধে। দিলদারের কেউ বিশ্বাসই করতে চায়না,মানতে চায়না। কিন্তু সত্যিই এক রোদেলা শরতের দুপুরে—উৎসব মরসুম শুরুর ঠিক আগে , সে চলে যায় তার তেতাল্লিশ বছরের ভালোবাসার দিলদার নগর ছেড়ে। দিলদারের ছোট্ট ছিমছাম রেল স্টেশনে তাকে ছাড়তে কত মানুষ সেদিন! সে যায় বড়ো রেল শহরে, কপিশার বুকের উপরে ঝম ঝম ব্রিজ পেরিয়ে। বোম্বাই এর ট্রেন সন্ধ্যাবেলায় ---সেখান থেকেই জাহাজ ধরে সে ---জন্মভূমি আমেরিকার।
এবার শীত যেমন জাঁকিয়ে পড়েছে তেমনি বড়দিনের মেলাটিও জমে উঠেছে। ওরা এখন খ্রিস্ট মেলায়। রঙ্গিন সোয়েটার, স্কার্ফ, জিন্স, সালোয়ারে এক ঝাঁক ফুলের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে বিন্দাস! বয় ফ্রেন্ড ও আছে পাশে গুটি কয়েকের। ওরা পাপড়ি চাট খেয়ে নাগর দোলা চড়েছে। তারপর বাজি পোড়ানোর সময় হতে ওই দিকে চলে গিয়েছিল। এখন ভাবছে স্টাইলোষ্টার চড়বে কিনা। আসলে বুঝি স্টাইল অফ স্টারস। চড়া গোলাপীর উপর সবুজ রঙে লেখাটি একটু মাখামাখি হয়ে গেছে আরকি! কাট আউটের লাল চোলি আর বেগুনী ঘাগরার যুবতী দু হাত জোড় করে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে টিকিট কাটিয়েদের। দুটো প্রকান্ড নৌকোতে বসার সিট, ধরার হ্যান্ডেল। প্রবল বেগে দুটো দুদিকে রেল বেয়ে শূন্যে উঠে যাচ্ছে, আবার একটা করে পাক খেয়ে নীচে নেমে উল্টো দিকের আকাশে পাড়ি জমাচ্ছে। চড়িয়ালদের চিৎকার আর হাসিতে অন্যরাও ভাবছে চড়বে কিনা। এমন সময় মাইকে ঘোষণা ভেসে আসে : হ্যালো…হ্যালো…সবাই শুনুন ----
পলিন নামের একটি ছ বছরের মেয়ে হারিয়ে গেছে। মেয়েটিকে কেউ পেলে মেলাপ্রাঙ্গন অফিসে জমা করে দিয়ে যান। এখানে তার মা অপেক্ষা করছে!
ওরা অফিসের দিকে এগোয়। টান করে চুল বাঁধা এক মাঝ বয়সী মহিলা। শ্যামলা রং, গায়ে কোনো গয়না নেই, সাদা শাড়ী। ঝুরো চুলগুলি অবশ্য কানের দুপাশে, মাথার উপরে এখন উড়ছে। বিড়বিড় করে কি সব বলছে দুহাত এক করে। চোখ দিয়ে জল ঝরছে। ওদের হাতির খুকুর কথা মনে পড়ে। ওরা ঠিক করে স্টাইলোষ্টার এ পরে চড়া যাবে। এখন পলিনস্টার এর খোঁজে বেরোনো যাক।মায়ের কাছে তাকে ফিরিয়ে দেবে ওরা। ভাগ হয়ে যায় দলটা, দুই তিনজন করে। এর মধ্যেই পলিনের মায়ের চার পাশে ভীড় জমছে আসতে আসতে। ওদের কেমন যেন চেনা লাগতে থাকে ভীড়টা । কিছুটা পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া ছবির অ্যালবাম যেনো! কোথায় যেন ছবিতে দেখেছে! মনে করতে পারছেনা এখন। একজন ছোট ছোট কাঁচা পাকা চুল, সোনালী কান ওঠা চশমার ফ্রেমের উপরের দিকটা একটু বাদামি। পরনে সাদা শাড়ি, কিন্তু মেম মেম! পলিনের মায়ের পিঠে শান্ত ভাবে হাত রেখে যেন প্রার্থনা করছেন। ভাবতে ভাবতেই ওরা দৌড়োতে থাকে। কেউ যায় খেলনার দিকে, কেউ টয় ট্রেন, কেউ নাগিনী কন্যার গুহায়, কেউবা সার্কাসের তাঁবুর দিকে।
দিলদার নগরে একবার বসত গড়লে বুঝি আর কোথাও গিয়ে রওয়া যায়না! আসলে থাকা আর বেঁচে থাকার মধ্যে সম্পর্কটি বড্ড গোলমেলে। থাকলেই কি বেঁচে থাকা হয় নাকি? বেঁচে থাকতে গেলে যে থাকতেই হবে এমনটাও কি জোর গলায় দাবী করা যায়? কাজেই দিলদারের রাস্তায়, গলিতে, আলোতে, কালোতে ---কারা কারা এসে সব লুকোচুরি খেলে যায়--- তার হিসাব দেওয়া ভারী শক্ত! হয়তো অসম্ভবও বা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।