হৃদ গগনের বুকে দণ্ডনীতি খুঁজে নেয় মানে।
অশ্রুহীন বিচারক অনিকেত হন সবখানে!
বেঁচে থাক সুখে থাক যাপিত এ হর্ষ বিষাদ।
ছোট ছোট চুপ কথা,অযাচিত দায়িত্বের স্বাদ!
চাঁদনী যত শুনছিল অবাক হয়ে যাচ্ছিল ততই! সে নাকি মস্ত এক সরোবর! পাহাড়ের ছায়া বুকে নিয়ে! রতন স্টোন চিপস আনতে যায় নিজের লরি চালিয়ে। পিচের রাস্তা সোজা চলে গেছে চৌমোহনা ছাড়িয়ে ডান দিকে, দুপাশে জঙ্গল নিয়ে। কি তার সুগন্ধ!ডান দিকে নীল পাহাড়ের ঢেউ চলে সাথে সাথে। লেকের উপরে লম্বা ড্যাম, শীতকালে মেলা বসে যায়। ছেলে পুলে নিয়ে লোকজন লেকের জলে শিকারা চড়ে, চ্যাংড়া চেংড়ি প্রেমিক যুগল সব হাত ধরাধরি করে ঘোরে। হরেক পশরা সাজিয়ে দোকানদার বসে, থাকে চাউমিন চিল্লি চিকেন, মোগলাই,ভুট্টা পোড়া আরো কত কি! গয়নাগাটিও থাকে কিছু রূপ দস্তার, থাকে ছোট ছোট চুবড়ি, ব্যাগ।বর্ষায় অবশ্য অন্য রূপ। থমথমে। একেকদিন এদিক থেকে ওদিকে যাওয়াই যায়না কারণ নীচু ব্রিজের উপর জল উঠে পড়ে। জল নামলে আসা যাওয়া। রতন কোনো কোনোদিন রাতের দিকে গিয়ে বসে থাকে। পাহাড়ের পেছন থেকে অদ্ভুত চাঁদ ওঠে, অথবা উঠে আসে মেঘের পরে মেঘ। চাঁদনী শুনতে শুনতে চা করে, পাউরুটি ও হয়তো সেঁকে দু পিস। যত্ন করে প্লাস্টিকের একটু বড় প্লেটে পাউরুটি চা এগিয়ে দেয়। আধ শোয়া ক্লান্ত রতন চা খায় পাউরুটি ডুবিয়ে। তারপর উঠে পড়ে। আজই ফিরেছে, লরিতে স্টার্ট দেয়, বাড়ির পথে। কোনো একদিন চাঁদনীকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে যায় রতন। রাতে চাঁদনী স্বপ্ন দেখে পাহাড়ের ছায়া বুকে নিয়ে গভীর সরোবরের।
চাঁদনী দিলদার ছেড়ে কখনো কোথাও যায়নি। মামাবাড়ি মাসিবাড়ি পিসিবাড়ি ---কোত্থাও না। আসলে ওর বাপের সাথে তার ছাপরার বাপের বাড়ির তেমন আর কোনো যোগাযোগ ছিলোনাতো! আবার মায়ের বাড়িও সম্পর্ক রাখেনি বেজাত বিয়ে করায়। শিবশঙ্কর সাউ জাতে তেলি। শেফালীর পদবি বিশ্বাস । নিজের কোনো দোকানদারি ছিলোনা তার। রাস্তায় ঘুরে কেরোসিন বিক্রি করতো সেই চোদ্দো বছর বয়স থেকে, গ্রামতুতো মামার সঙ্গ। রেশনের কেরোসিনে কুলোতে পারা যেতোনা, এদিকে রাতে আর উনুন ধরানোর ঝামেলাতে যেতে না চাওয়া গেরস্তের মুশকিল আসানদের মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠছিলো ও আসতে আসতে। কিছু টাকা জমলে ছোট মোট গোলদারী দোকান দিলে বাজারের মুখে। বেশ জমে উঠলো ব্যবসা। চাঁদনীর অল্প সল্প মনে পড়ে, খুব ছোট বেলায় মা দুপুরের ভাত পাঠাতো। বাবা ফিরত একেবারে রাতে দোকান বন্ধ করে। ওর জন্য একটা করে পপিনস বরাদ্দ থাকতো।লাল হলুদ কমলা ---গোল গোল লজেন্স গুলি মুখে পোরার আগে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতো, বিছানার উপর সাজাতো। মা বসে বসে ঠোঙা বানাতো আর ওর রকম দেখে হাসতো। টালির চাল সিমেন্টের মেঝে, দেড় কামরার ঘরের বাইরে একটু বারান্দা বানাতে পেরেছিলো শিবশঙ্কর সাউ। একটি সিলিং ফ্যান আর একটি টেবিল ফ্যান ও কিনেছিলো।
চাঁদনী ভর্তি হয়েছিল রাজনারায়ণ ইস্কুলের শিশুশ্রেণী তে। খুব সকালে যেতে হত, দুপুরে বড়োদের ক্লাস হয়। সেখানে ছিলেন সুষমাদি। সাদা রঙের লাল নকশা পাড়ের শাড়ি, ছোট্ট সিঁদুরের টিপ পরা মোটাসোটা দিদিমনি কি ভালোই না বাসতো ওদের সব্বাইকে! বকতেন না একদম ই। কিন্তু সাদা হয়ে যাওয়া চুলের দুগ্গা দিদিমনি কে দেখলে পেট খালি হয়ে যেত! আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল ঢুকিয়ে চাপ দিত দিদিমনি। যাই হোক, সুষমা দিদিমনি গল্প বলতেন কত। অনেক সময় ইস্কুল ছুটি হয়ে যেত কেউ মরে গেলে। প্রার্থনা লাইনে তাঁর সম্বন্ধে বলতেন সেই সুষমা দিই। অনেক সময় চোখ মুছতেন, নাক টানতেন। বোধহয় চেনা জানা ছিল।
তা সেই সুষমা দি বললেন পঁচিশে বৈশাখ রবি ঠাকুরের জন্মদিন হবে ইস্কুলে। রবি ঠাকুরের ছোটবেলা, বড়বেলা নিয়ে কত গল্প বললেন। সেদিন আর ইংরেজি পড়ালেননা। লাইব্রেরি থেকে দুটি বই এনেছিলেন, দেখালেন। মোটাসোটা হলুদ হলুদ ---বাবার আলোয়ানের মত রং। একটার নাম গীতবিতান, ওটাতে রবি ঠাকুরের গান আছে। আরেকটা সঞ্চয়িতা। তাঁর কবিতা আছে ওতে। ওরা গান করবে, কবিতা বলবে। বীরপুরুষ হবে সেজেগুজে নেচে। খোকা, ডাকাত, মা, দাদা ---সব পার্ট ভাগ হলো। বড় কবিতা, তাই ক্লাস ফোরের দাদা দিদিরা পেছনে কবিতা বলবে। ওরা স্টেজে অভিনয় করে দেখাবে। চাঁদনীকে খোকা সাজতে হলো, যেহেতু ও সবার চেয়ে ভালো করে দেখিয়েছিল ঘোড়া ছাড়াই কেমন ঘোড়ায় চড়ে টগবগিয়ে লাফিয়ে যাওয়া যায়। সেদিন অনুষ্ঠানে খুব হাততালি পেয়েছিলো ওদের বীরপুরুষ।
টগবগিয়েই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল ও, ক্লাস থ্রী ফোরের দাদাদিদিদের দলের সাথে। ওদের সাথেই ও ইস্কুলে যেত।সরকারি পাউরুটির সাথে একটা দরবেশ বা গজার রোজকার টিফিন নয়, সেদিন ছিল মানু ময়রার সাদা লুচি আর আলুরদমের প্যাকেট, সাথে ক্ষীরের গজা। বাড়ির কাছে এসে দেখে অনেক লোক তাদের বাড়ির বাইরে। ফিসফিস ভেসে আসে ---সঞ্চয়িতা…সঞ্চয়িতা! ওদের বাড়িতেও রবি ঠাকুরের জন্মদিন পালন হচ্ছে? মা বাবা আবার এসব জানতো নাকি? ওকে লুকিয়ে রাখলো কেন? রাগ হলো খুব। বাড়িতে ঢুকলো ঠেলে ঠুলে সব্বাইকে। কিন্তু এ কেমন জন্মদিন পালন? বাবা শুয়ে আছে এই সময় মেঝেতে? মায়ের কোলে মাথা, চোখ বন্ধ, মাথা থেকে সারা গা জলে ভেজা, শ্বাস পড়ছে আসতে আসতে। ডাক্তার ডেকে এনেছে কেউ। সবাইকে সরিয়ে বসে পড়লেন, চোখ টেনে,হাতের কব্জি ধরে কি বুঝলেন, বুকে নল বসালেন, আর কিকি সব। একটা ওষুধ লিখলেন, কেউ তাড়াতাড়ি নিয়ে এলো, খাইয়ে দিলেন। ধরাধরি করে খাটে শুইয়ে দেওয়া হলো বাবাকে। ডাক্তার লিখে দিয়ে গেলেন আরো ওষুধ। মাকে বললেন খুব জোর ধাক্কা লেগেছে একটা। বেঁচে গেলো যাহোক। খুব সাবধানে রাখবেন। টাকা এগিয়ে দিলে কেউ, নিলেননা। “আগে নিজেরা বাঁচুন”---বলে মাথা নেড়ে বিড় বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেলেন---"কেন যে ব্যাংক থাকতে এসব গজিয়ে ওঠা জায়গায় টাকা পয়সা রাখতে যায় এরা!” ভীড় আসতে আসতে পাতলা হয়ে এলো, গুন গুন করে আলোচনা চললো সঞ্চয়িতায় কার কত টাকা গেছে, কেইবা গলায় দড়ি দিলো!
বর্ষা কি একটাই ঋতু? দিলদার নগরে বোধ হয় ঠিক তা নয়। তিনটে বর্ষা আছে দিলদারের। প্রথমটা আসে গুমগুম করে খর রোদে পুড়তে থাকা আগুনের এক ধুঁয়াধার শত্রু হয়ে। মানুষ ও জ্বলতে জ্বলতে ডাকে- আয় আয়! বাজারে ঘড় ঘড় করে শাটার নামে ঝুলন্ত জামাকাপড়, পশরা বাঁচাতে, পথের মানুষ হাহা করে দৌড়োয় আশ্রয়ের খোঁজে, লাল ধুলোর সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটার খুব লড়াই চলে! তারপর আর কিছু দেখা যায়না। সব থেমে যায় এক সময়, কিন্তু কালবৈশাখী র পরের মিতালি আর হয়না, বৃষ্টির পর নীল আকাশে চাঁদ উঠে আর তেমন করে বলেনা :এইতো সব মিটমাট হয়ে গেল! একটা হালকা জলবিন্দুর ওড়না যেন ঢেকেই রাখে কদিন শহরকে। কপিশায় জল বাড়ে, লোকে আমোদ করে জল দেখতে যায়! এরপর রোদ আর জলের সমঝোতা হয়ে যায়। রোদ ওঠে একদিন তো বৃষ্টির জন্য তিন দিন ছেড়ে দেয়। তবে বৃষ্টি দিনদিন আবদেরে হয়ে ওঠে, রোদ কে হয়তো এক সপ্তাহ কাছেই ঘেঁষতে দেয়না। কালচে সবুজ হয়ে ওঠে উত্তর আর পশ্চিম সীমার গড়, জঙ্গল। অতিথি বৃষ্টি ততদিনে আটপৌরে হয়ে গেছে, গরম তেমন নেই আর,তাই লোকে তার খুঁত ধরা শুরু করে তখন। রোদের জন্য একটু একটু মন কেমন করে। রোদ ও বলে বোঝ ঠেলা! তারপর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে যায়! রোদ বলে: আমি না থাকলেই আরাম? কে বলেছে? মেঘের দিনেও লোকে ঘামে, আর মেঘ ও জেদ করে গোমড়া মুখে বসে থাকে মাথার উপর, জল ঝরায় না! দম আটকানো ব্যাপার। তারপর হয় অঝোর বৃষ্টি বা কড়া রোদ ---আবার সেই আগের দিনের পুরোনো শত্রুতা, আর সেটা ক্রমশ বাড়তেই থাকে,ঘন ঘন,যখন তখন। লোকে দিন গোনে এই খামখেয়ালিপনা থেকে মুক্তির। ঝোড়ো দিনে ঝুলন সাজায় পাড়াগুলি। নানা রং এর দোপাটি আলো করে রাখে শ্রাবন ভাদ্রের সন্ধিক্ষণ। জুঁই বেলির গন্ধে বাতাস তখন ভারী! এদিকে মানুষ ঝুলনের চল আছে। যারা রাধা বা কৃষ্ণ সেজে পাতা ঘেরা দোলনায় বসে, তাদের মধ্যে অনেকেই দু তিন দিন একটু গুমোর দেখায় ক্লাসে। জন্মাষ্টমী আবার যার যার তার তার। অন্ধকার মেঘের গর্জনে রাত আসে, পরদিন নন্দ উৎসব।কীর্তনের ছেলেরা বাড়ি ঘুরে গান গায়। গৌড়ীয় মঠে এ কদিন মানুষের মেলা। কৃষ্ণ গোপালের নানান লীলা মূর্তির আকারে সেজে ওঠে যে! এদিকে রোদ পেলেই সবার অলক্ষ্যে জঙ্গলের মাটি ফুলে ওঠে, কুড়কুড়ি ছাতু মাথা তোলে মাটি ফুঁড়ে। শহরের রাস্তার দুপাশে ঝুড়ি নিয়ে বসে সাদা সাদা ছাতুর পশরা, বেশ একটা সাড়া পড়ে যায়।
তারপর একদিন ঝলমলে রোদ টা কেমন জানি কমলা হয়ে আসে, আকাশে মেঘ ও শান্তি পতাকা ওড়ায়। বাতাস টা যেন অন্য দিক দিয়ে বইতে থাকে, আর শেষ বিকেলের দিকে আকাশে অন্য রকম কিছু পাখি ক্যাঁ ক্যাঁ করে উড়ে যায়, পাখায় শেষ আলোটুকু শুষে নিয়ে। লোকে বোঝে শিশিরের দিন আসতে আর দেরী নেই।এরকম সময়েই এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়া, অন্য নগরে শরীর সাধন করা লোকজনের মন বলে :চলো চলো ঘুরে আসি মদিনা নগর! তারা এ শহরের রাস্তায়, অলিতে গলিতে ঘোরাঘুরি করে বিস্তর নস্টালজিয়া নিয়ে! আর এ নগরের লোক তাদের দেখে যেন স্বপ্নপুরীর হাতছানি! দু পক্ষই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নদীর ওপারের জন্য!
এমনই এক দিনে, যখন পুজোর প্যান্ডেলের বাঁশের কাঠামোর উপর কাপড় লাগানো চলছে, রাজনারায়ণ ইস্কুলের বড়োদের বিভাগের বছরে তিনটে পরীক্ষার মাঝেরটা, মানে যেটা সবচে শক্ত, সেটা শেষের দিকে এসে পৌঁছয়। জ্বরজারি, পরীক্ষা ভয় অনেক সময়েই এই পরীক্ষা দিতে দেয়না অনেককে। তারা ডিসেম্বরে তিন নম্বর পরীক্ষার পর এই পরীক্ষাটা দিতে বসে। চাঁদনী ইংরেজি পরীক্ষা দিতে পারেনি, বাকিগুলো দিয়েছে। আসলে সেদিন বাবার একটু বাড়াবাড়ি হয়েছিল। সেই দিনের পর থেকে বাবা আর স্বাভাবিক হয়নি। হিসেব করে দেখে ও ---প্রায় সাত বচ্ছর! এখন ও সপ্তম শ্রেণী। বাবা চুপচাপ শুধু বসে থাকে আর থেকে থেকে দোলে। কিছু দরকার হলে মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ করে মাথা নেড়ে নেড়ে, দু একটা শব্দ বেরোয় কখনো কখনো, তবে ইশারাই বেশী। মা আর ও এখন বুঝে যায়। ওষুধপত্র যতটা সম্ভব চালানো হয়েছে, পিঠে হাতে মালিশ। মা কাজ করতে করতে উঠে এসে হয়তো পিঠে একটু তেল ঘষে দিয়ে যায়। বাবার চোখে কখনো ভাষা থাকে, কখনো শূন্য। দোকানটা বাঁচানো যায়নি। মা কাজ নিয়েছে কয়েকটা। সকাল সন্ধ্যা তাই বাবার দায়িত্ব ওর।ইস্কুলে ফ্রি হয়ে গেছে, বুক ব্যাংক থেকে বইও দেওয়া হয় দুস্থ ছাত্রীদের। আজ শেষ পরীক্ষা ছিল, মৌখিক, এরপর পুজোর ছুটি।
যে যেমন মনের অবস্থাতেই থাক, ঋতুর পরিবর্তন অনেক সময়েই সেই অবস্থা টাকে একটু এদিক ওদিক করে দেয়। কারোর কম, কারোর বা বেশী। এই যে সোনালী রোদে পরীক্ষা শেষে ওরা হাঁটছে বাড়ির পথে, ওদের মুখের মধ্যে একটা আনন্দ আভা একটু হলেও ফুটে ওঠার কথা তো ছিল। কিন্তু তা নেই। গুমোট মুখে ওরা হাঁটছে চাঁদনীসহ। কেন? কারণ এই উৎসবের মুখে একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে গেল আজ। বড় কষ্টের, বড় অপমানের!
রাজনারায়ণ হেডমাস্টার হয়ে এখানে এলেন ১৮৫১সনে। ছেলেপিলেকে বেতিয়ে সিধে করার ভিক্টোরিয় রীত তখন এখানেও বহাল তবিয়ত। হাতে পিঠে বেতের বাড়ি, দুহাতে ইঁট চাপিয়ে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে রাখা……। বয়স্ক মানব মনের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা নানান অব্যক্ত ইচ্ছা পূরণের বুঝি বা সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা! শরীরের উপর আক্রমণের পাশাপাশি মনের উপর আক্রমণ ও কি কম ছিল? ব্যক্তিগত জায়গাটি, বাড়ির নিভৃত আনন্দময় জীবনেও অনেকে ঢুকে পড়তো নানান অছিলায়, তারপর মানসিক নির্যাতন! ছোট বোনের সাথে রান্না বাটি খেলার অপরাধে একজোট হয়ে গিন্নি.. গিন্নি বলে নির্মম উপহাসের মজার উদ্ভাবন এই বিকৃত মনা বয়স্কদের মাথা ফুঁড়েই তো বেরিয়ে এসেছে অনেক সময়! শিবনাথ শাস্ত্রীকে তাঁর পাঠশালার মাস্টার মশাই জিগ্যেস করেছিলেন বাড়িতে কে পড়া শিখিয়ে দেয় যে সে এতো ভাল উত্তর দেয়? ছোট্ট বালক গর্ব করে বলেছিলো :আমার মা। পন্ডিত কাগজে কিছু লিখে বাড়িতে মাকে দিতে বলেছিলেন। বালক দারুণ খুশী মনে সে কাগজ নিয়ে এসে মায়ের হাতে দেয়, বুঝিবা মাস্টার তার কতই না প্রশংসা করেছেন মায়ের কাছে! মা সে চিঠি পড়ে রাগে জ্বলে উঠেছিলেন, তারপর কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেললেন, সব রোষ গিয়ে পড়লো নিরীহ বালকের উপর!
রাজনারায়ণ বুঝেছিলেন শাস্তির ভয় দেখিয়ে ছেলে মানুষ করা যায়না, নির্বোধ পশুর আনুগত্য আদায় করা যায় শুধু! তাই তাঁর ইস্কুলে বেত বন্ধ হলো, বন্ধ হলো শেখানোর নাম করে অত্যাচার। বেতের বাড়ির ভিক্টোরিয় আদর্শ থেকে মেয়েদের ও নাকি রেহাই ছিলোনা! তবে সেটা পায়ের গোছে। সেসব অবশ্য বিলেতের ব্যাপার স্যাপার। এদেশে মেয়েদের ইস্কুল ই তো তখন দূর স্বপ্ন! ইস্কুলে দুস্টুমি তো ব্যাটা ছেলের সমান সুযোগ! তার তখনো ঢের দেরী। সাবিত্রী বাঈকে কি হেনস্থাই না হতে হয়েছিল মেয়েদের ইস্কুলে পাঠাতে গিয়ে! কালীকৃষ্ণ মিত্র ভাই নবীন আর প্যারিচরণ সরকার কে নিয়ে ১৮৪৭ এ খুলে ফেললেন মেয়ে ইস্কুল তাও আবার কলকাতায় নয়, বারাসাত এর মত মফস্বলে! বাধা এসেছিলো অনেক, সামলেছিলেন বেথুন আর বিদ্যাসাগর মিলে। বেথুন ও উৎসাহ পেয়ে গেলেন, ১৮৪৯এ বেথুন ইস্কুল চালু হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ১৮৪৮এ পুনেতে সাবিত্রী বাঈ ও সফল হলেন মেয়ে ইস্কুল করতে। তাঁর পথ যে সবচেয়ে কঠিন ছিল তা তো বলাই বাহুল্য! একে তো মেয়েছেল, তাও আবার নীচু জাত! রাজনারায়ণের বড় ইচ্ছে হয়েছিল এই দিলদারে একটি মেয়ে ইস্কুল খুলতে। নাগরিক সাহায্য পাবেন আশা ছিল। এ নগরের নাগরিক প্রাচীর হাজার দুয়ারী --যে কেউ এলেই আপন করে নেয়। আর কাহা কাহা চলে যায় এ নগরের মানুষ! সহনশীল, নতুনকে নিতে সদা প্রস্তুত। তাই ইস্কুল হলো। ইস্কুল শুরু হলো দিলদারের দ্বিতীয় বর্ষায়, শ্রাবণের ধারার মত আশীষ ঝরে পড়লো শুভ বুদ্ধির মানুষের--- দিলদারি মেয়েগুলির মাথায়। জোড়াশাঁকোতে সে বছর বৈশাখে রবি জন্মেছে।
শরতের সোনালী দিনেই বেরোয় ইস্কুলের ম্যাগাজিন। লেখা নেওয়া হয় জানুয়ারি তে, যখন পড়াশুনোর চাপ কম থাকে। আজ প্রেয়ার লাইনে প্রেয়ার শেষের পরেই নতুন বড়দি এসে দাঁড়ালেন চোখ কুঁচকে । আগের বড়দিকে ওরা পেয়েছিল ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। ওনার প্লিট করা শাড়ি, পামশু, হাঁটা চলা, এমনকি ঘরের দরজায় ঝোলা ডোরা কাটা ভারী পর্দাটা দেখলেও একটা হিম হিম ধরত ওদের। বকতেননা, তবুও। যেন একটা পাহাড়ের মত আগলে রাখা শৃঙ্খলা র প্রতি ছোট ছোট অর্বাচীন বিশৃঙ্খলদের ভয়। তারা জানে পাহাড়টাই আসলে সত্য। এনাকে দেখলেও ভয় লাগে, কিন্তু হিম হিম ভরসার সেই রকম ভয় হয়না। কেমন যেন সিঁড়ির খুব উঁচু ধাপের একেবারে কিনারায় রাখা এক পাঁজা কাঁসার বাসন--- যেকোনো সময় ঝন ঝন করে পড়ল বলে! কোথায় কী ভাবে পড়বে, কেউ জানেনা! উনি প্রতি বেস্পতিবার নতুন করে আলতা পরে আসেন, পাঁচ আঙুলের ডগায় আলতার ফোঁটা থাকে। আগের বড়দি হটাৎ ই স্ট্রোক হয়ে মারা গেলে ইনি সবচেয়ে বড় বলে বড়দি হলেন। উঁচু ক্লাসের দিদিরা বলে ওনার স্বামী নাকি বেজায় বুড়ো আর হেব্বি মেজাজ।! একটা লুচি শেষ হলে তবেই এবং সঙ্গে সঙ্গে পরের লুচিটা পাতে দিতে হবে , সেটাও আবার তখুনি সদ্য সদ্য ছেঁকে কড়াই থেকে নামানো হতে হবে!ওদের কার একটা বাড়ির ছাদের কোন থেকে বড়দির রান্না কাম খাবার ঘর দেখা যায়।
বড়দি দুটি মেয়েকে ডাক দিলেন। এতক্ষন ওরা দেখেনি যে এইটের দুটি মেয়ে মাঠের প্রেয়ারে না দাঁড়িয়ে বারান্দায় মুখ নীচু করে দাঁড়িয়েছিলো। বকুলদিদির বাবা ইস্কুলের বাইরে ঝালমুড়ি আলু কাবলি বেচে। আরেক জন পুষ্পলতা ---নদীর ওপারের গ্রাম থেকে আসে। বড়দি দুজনকে টেনে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দুজনের পিঠে ঠেলা মারলেন। ওরা কেঁপে উঠলো। তীক্ষ্ণ, কেমন জানি বিচ্ছিরি একটা গলায় চিৎকার করে বলতে লাগলেন ---মেয়েরা এদের চিনে রাখো, এরা চোর ---চোর! ম্যাগাজিনে গল্প চুরি করে দিয়েছে! কেমন জানি পাগলপারা হয়ে উঠলেন উনি, চোর--- চোর ---করে ওদের ধাক্কা দিতেই লাগলেন! আরতিদি ছুটে এসে থামালেন। অন্য দিদিমনি রা পাথরের মত অবাক চোখ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন । তাড়াতাড়ি সবাইকে ক্লাসে যেতে বলা হলো। বকুল দের ওখানে ফেলেই যেতে হলো ওদের মৌখিক পরীক্ষা দিতে। খানিক পর বকুল আর পুষ্পলতা টলমল পায়ে শূন্য চোখ নিয়ে ওদের ক্লাসে এসে দাঁড়ালো। উষা দি যেন কঁকিয়ে উঠলেন--- আবার কী রে? বিড় বিড় করে বললো ওরা :সব ক্লাসে ঘুরে ঘুরে ক্ষমা চাইতে বললেন বড়দি। উষা দি ভেজা চোখে বললেন যা যা ক্লাসে গিয়ে বস! বকুল নাকি পরে বলেছিলো ওর বাবার ঠোঙা বানানোর জন্য যে কাগজ আনে তাতে একটা খুব সুন্দর গল্প পড়েছিল। ইস্কুলে সুন্দর গল্প চাইতে ওর মনে হয়েছিল ওটা সবার পড়লে ভালো লাগবে। ও যেকোনো গল্প ভেবেছিল। বাড়িতেভাই কে মা কে পড়ে শুনিয়েছিল, মা র ও খুব ভালো লেগেছিলো। মাতো পড়তেই পারেনা! ওরা কেউ ওকে চোর বলেনিতো! পুষ্পলতা অবশ্য কিছু বলেনি, ইস্কুলেও আর আসেনি। স্রেফ ভেগে পড়েছিল ক্লাস নাইনের যমজ বোন রাবেয়া রাজিয়ার দাদা ইউসুফ এর সঙ্গে। ইউসুফের ও কাকা গুলমোহর এর মত কবিতা লেখার বদ অভ্যেস ছিল। ইস্কুলের লাইব্রেরীর বই এর আশা ঘুচলেও পুষ্পলতা তাই অক্ষরের আনন্দ থেকে বুঝি বঞ্চিত হয়নি! অক্ষর, আহা প্ৰিয় অক্ষর! কাঁচা নর্দমার বস্তি তেও চাঁদ এনে দিতে পারে। অক্ষরহীন আলিশান বাগান বাড়িও শ্মশান তুল্যগো! অক্ষরপ্রিয় ক্ষুদ্র অপরাধীর বিচার হইয়া গেল! অথচ জেনে বুঝে কত কুম্ভীলক দিব্যি পূজা পেয়ে যায়!
সেবার পুজোর ছুটির পর যেদিন ইস্কুল খুললো, তার ঠিক দু দিন পর পরীক্ষার খবর আনা এক হুহু বাতাস বওয়া সকালে চাঁদনীর বাবা আর চোখ খুললেনা । হেরে যাওয়া আর সব মানুষের মতোই সেও চুপচাপ বিদায় হলো চালাকের দুনিয়া থেকে! ভীড় করে আহা উহু করতে থাকা মানুষজন দেখে সাইকেল থেকে নেমে দেখতে এসেছিলো রতনলাল। দিলারামের মোটর গ্যারেজে কাজ করে তখন। বছর চব্বিশ বয়স। অচেনা মানুষের দাহকার্যে ভিড়ের মধ্যে সেও নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছিলো সেদিন। বোধ হয় দশ বছর বয়সে বাপের মুখে আগুন দেবার কথা মনে পড়েছিল।
শেফালী ঠিক করলো সেভেন শেষ হয়ে গেলে চাঁদনীকে হোম এ দিয়ে দেবে।রাজনারায়ণের হোস্টেল থাকলে সেখানেই রাখতো। তাতো নেই। তাই পরের বছর জানুয়ারি মাসের এক বৃষ্টি ভেজা কাঁপন ধরা দিনে শেফালী রেখে এলো চাঁদনীকে মেয়েদের হোমে। রেল লাইনের ওপারে ফরেস্ট বিট অফিস পেরিয়ে সেই পাহাড়ের নিচে হোম। শেফালী বুঝি আন্দাজ করেছিল তার পিদিমের ও তেল প্রায় শেষের মুখে!
এই হোম সরকারি হোম, আদিবাসী উন্নয়ন বিভাগের অন্তর্গত। শুধু অনাথ নয়, অপারগ মা বাপ ও মেয়েকে রেখে যান পরম ভরসায়। ক্লাস টেন অবধি পড়াশুনার পাশাপাশি নানান ট্রেনিং দিয়ে সাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা হয় মেয়েদের। ১৮র পর থাকবার নিয়ম নেই এখানে, তবে বিশেষ ক্ষেত্রে ২১পর্যন্ত থাকার অনুমতি মেলে। কখনো কোনো দম্পতি এসে দত্তক নিয়ে যান অনাথ মেয়ে। কখনো বা কর্তৃপক্ষ সুপাত্রে বিয়ে দেন অনাথ সাবালিকার। চাঁদনী নিয়েছিল নার্সিং ট্রেনিং, যা সবসময়েই কাজের। স্কুল স্তরের ওই ট্রেনিংই অনেক কাজে লাগে!
সেন্ট জন্স নদীর ধারে চোখের হাসপাতাল হলেও সাধারণ চিকিৎসা ও হয়। কাজ জুটলো সেখানে। শেফালী ঝরে পড়েছিল ক্লাস টেনের টেস্ট পরীক্ষা আর মাধ্যমিকের মাঝের সেই ফাল্গুনে। কেন জানি রতনলাল খোঁজ খবর রাখতো। লোকজন মারফত বা নিজেও কখনো বা, আসা যাওয়ার পথে। কাজ জুটিয়ে হোমের জীবন শেষ করে নিজেদের ছোট্ট বাড়ি মেরামতির কাজে ও রতন ও তার দলকে পেয়েছিল চাঁদনী। রাতের দিকে বাড়ির আসে পাশে খুক খুক কাশি, হাঁটা চলার খবর পেয়ে বারান্দার দরজায় শক্ত পোক্ত ঢাকা গ্রিলের দরজা বসিয়ে দিয়ে গেল ওরাই। মেয়েদের মেসে চাঁদনী কিছুতেই আর যেতে চাইলোনা। মা বাপের ছবি টাঙিয়ে ঘর সাজালো। ঘরের কোনে রাখলো আশ্চর্য পাতার গাছ, হৃদয়ের মত পাতা গুলি, কিন্তু গায়ে তাদের সরু লম্বাটে গর্ত। রথের মেলায় আম -নারকেল- বেলি জুঁইয়ের মধ্যে ওটা দেখে অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়েছিল চাঁদনী। দোকানি বলেছিল ও গাছের নাম নাকি ব্রোকেন হার্ট! কি ছিরির নাম! কিন্তু চাঁদনী ওটা কিনতে চেয়েছিল। রতনলাল ওকে দাম দিতে দেয়নি।
দিলারামের মোটর গ্যারেজে রতন ঢুকেছিলো দশ বছর বয়সে। বাপ গুলি খেয়ে মরেছিল পুলিশের। কোনো অপরাধ করেছিল এমন নয়। জঙ্গলে গিয়েছিল শালপাতা আনতে। এদিকে সকাল সকাল মাথায় করে কাঁচা শালপাতা বোঝা করে নিয়ে আসে গরীব গুরবো মানুষ। খাবারের দোকানগুলিতে লুচি, মিষ্টি, ভাজাভুজির খালা তৈরি হয় খড়কে কাঠি আটকে। মনীলাল প্যান্ট শার্ট পরেই গিয়েছিল, পাতার কাজটি সেরে সে চলে যাবে দিলারামের গ্যারেজে তার আসল কাজে। সকালেরটা একটু উপরি আয়। ছেলেকে ইস্কুলে পড়ায়, ক্লাস ফোর এখন। ও জানতোনা যে জঙ্গলে সেদিন লুকোনো মানুষ খুঁজতে পুলিশের আনাগোনা। ওর চেক শার্ট আর ফ্যাসফেসে কালো ফুল প্যান্ট পেছন থেকে অন্য কারোর সঙ্গে ওকে গুলিয়ে দিয়েছিলো! আইন রক্ষকদের এক জন সুযোগ হারাতে চায়নি কৃতিত্ব নেওয়ার! কাঁচা শালপাতার গায়ে টকটকে গরম রক্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
চড়চাপাটির সাথে রতনকে লুচি মোহন ভোগ ও খাওয়াতো দিলারাম। মাইনেও ঠিক সময়ে বাড়িয়ে দিতে ভুল হতোনা। আসতে আসতে তার ডান হাত হয়ে উঠলো রতন। মাথা ছিল পরিষ্কার, খাটবার ক্ষমতাও বাপ মনীলালের মতোই। গ্যারেজ সমলানোর সাথে সাথে লরি নিয়ে মাল করতে যাওয়া ---সবই আসতে আসতে রতন লালের কাজ হয়ে দাঁড়ালো! দিলারামের চার মেয়ের তিনটির ই বিয়ে হয়ে গেছে, ছোট ছেলেটি সবে বারো। রতন লালের মা কৌশল্যা এবার একটা গোটা সোটা সংসার চাইছিলো। তাই দেখে শুনে সিজুয়ার দিক থেকে ছেলের বৌ আনলে। কোমলি ভারী শান্ত সংসারী মেয়ে। মনটি নরম।।পঁচিশেই রতনলাল পাক্কা সংসারী। দিলারাম সোনার দুল দিয়েছিলো বৌকে। দিলারামের ছেলে বড় হলো, দেশ থেকে ছোট শালাকেও আনালে, রতনলালের ও কিছু জমেছিল। সে শহরের উত্তর দিকে একটা ছোট্ট গ্যারেজ খুললে। হাইওয়ের ধারে, সাথে শুরু করলে পাথরের ব্যবসা। দিলারাম আশীর্বাদ করেছিল। দোকানের কর্মচারী বাড়লো রতনলালের।
মেয়েকে এবার রাজনারায়ণের ক্লাস ফাইভ এ ভর্তির করতে চায় রতন। এতদিন বাড়ির কাছে পিঠের একটা প্রাইমারি ইস্কলে ছিল, কিন্তু মেয়েকে এবার বড় ইস্কুলে দিতেই হবে! ভর্তির পরীক্ষা র জন্য তৈরি করতে ইদানিং রোজ ই সন্ধ্যার দিকে চাঁদনীর কাছে নিয়ে যাচ্ছিল রতনলাল। ওকে রেখে কিছু কাজ কম্ম সেরে বা আড্ডা মেরে ঘুরে এসে বসত চাঁদনীর ঘরে। পড়া তখন শেষের মুখে। কোনোদিন রাতের খাবার পাঠিয়ে দিত কোমলি চাঁদনীর জন্য। সারাদিন খেটে খুটে এসে আবার এতক্ষন পড়ানো! রাঁধতে আর ইচ্ছে করে! যাই হোক মেয়েটা ভালোই পরীক্ষা দিয়েছে। হয়েই যাবে হয়তো। এখন তাহলে যাওয়াই যায় আশ্চর্য সেই পাহাড়ের ছায়া বুকে নিয়ে শুয়ে থাকা হ্রদ দেখতে।
আকাশে চাঁদ থাকতেই ওরা বেরিয়ে পড়েছিল। বড় রাস্তার উপর লরি রেখেছিলো রতনলাল। শেষ রাতের চাঁদের আলো কুয়াশায় বাধা পেয়ে হাল্কা রুপোলি চাদরে মুড়ে দিয়েছিলো গাছপালা, মাঠ। গাড়ির হেড লাইটের আলো সেই চাদর কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছিলো। দিনের আলো ফোটার আগেই ডান দিকে পাহাড় শুরু হয়েছিল, তারপর দুদিকেই। সমুদ্রের ঢেউ এর মতন একটার পেছনে একটা। সকালের আলোয় শিশির ভেজা গাছগুলির পাতা চিকমিক করছিলো। এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওরা মালাই মারকে এলাচ দেওয়া ঘন চা খেলো, উনুনের আঁচে সেঁকা লম্বা পাউরুটি দিয়ে। তারপর আর থামলোনা। রতনলাল গাড়ি লোড করতে দিয়ে দিলো। তারপর ওরা হেঁটেই পেরোলো লেকের উপরের নীচু সেতু। বাঁ দিকে থৈ থৈ জলের উপর মধ্য সকালের রোদে ঝক ঝক করছে উঁচু লম্বা ড্যাম। উপরে রেলিং দেওয়া রাস্তায় রং বেরং এর মানুষ! রাস্তা আরো এগিয়ে পাহাড়ে গিয়ে মিশে গেছে ওদিকে। ওরা উঠলো গিয়ে পাহাড়ি রাস্তায়, সেটা ধরেই বামহাতি একটু চড়াই পথে হেঁটে হেঁটে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পড়লো একেবারে ড্যাম এর উল্টো দিকে পাহাড় তলায় সেই লেকের সামনে। পিছনের উঁচু পাহাড়, লেকের জলের আয়নায় ছায়া পড়েছে তার। লেক ডান দিকে চলে গেছে পাহাড় কে বেড় দিয়ে কত দূর, দেখা যায়না আর। বাঁ দিকে ড্যাম এর তলা দিয়ে জলের ধারা বয়ে চলেছে ----ওই পথেই ওরা এলো নীচু সেতু র উপর দিয়ে। সেতুর ওপারে যেন চওড়া নদীর মতো সে বয়ে গেছে বাঁ দিকে ভাঙা ভাঙা পাহাড় আর ডান দিকে জঙ্গল নিয়ে। সত্যিই মেলা বসেছে যেন! আহা এতো আনন্দ আছে? চাঁদনী নুড়ি কুড়োলো, চাঁদনী শিকারাতে বসবার জেদ করলো। নীল জল কেটে এগোয়, হাওয়া দেয় জল ছুঁয়ে, পৌষের। রতনের ফোন আসে, মাল রেডি। ওরা তীরে আসে। ফিরতেও হেঁটে সময় লাগে। এদিকে এসে গাড়ি তে ওঠে, একটু এগিয়ে হাইওয়ে র উপর ধাবা। বেশ ঝকঝকে, নতুন বোধ হয়। ভেজা সিমেন্ট আর চেয়ারের কাঠের পালিশের গন্ধ আসছিলো। বাথরুমের সারি সারি বেসিনের পাশে দেওয়ালে সাদা একটা বাক্স, চাঁদনী ভারী আমোদ পেলো যখন অন্য একজনের দেখাদেখি ওর তলায় হাত রাখতেই শব্দ করে গরম হাওয়া বেরিয়ে এসে হাত শুকিয়ে দিলে। ও বেশ কয়েকবার হাত বাড়ালো হাসিমুখে। ওর খুব আনন্দ হলো ---পরিচ্ছন্নতার নিরাপত্তা পেয়ে! যেন এই অচেনা পথেও কেউ তার কথা ভেবেছে। তারপর ফিরে এসে রতন কে বললো। রতন জানতো তাই মাথা নাড়লো। চাঁদনীর মনে হলো কোমলি থাকলে এই মজাটা অনেক ভালো ভাগ করে নেওয়া যেত! নরম নরম রুমালি রুটি আর চিকেন ভর্তা খেল ওরা, মোটা মোটা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা আর আচার দিয়ে। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হলো। পথে আর একবার থেমেছিল চা খেতে। বৃষ্টি নেমেছিল। আশ্চর্য অরণ্যের গন্ধ উঠে আসছিলো ভেজা রাস্তায়।রতনলাল বড় রাস্তায় গাড়ি রেখে ওকে পায়ে পায়ে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো।
গরম জল একটু করে নিয়ে, সোনালী শীতের সাবান মেখে স্নান সেরে ও গুছিয়ে বসলো চা নিয়ে। আর কিছু খাবেনা আজ। ব্যাগ থেকে নুড়ি পাথরগুলি বার করলো ---সাদা, কালচে, সোনালী। কয়েকটা আবার হাল্কা গোলাপী। ব্রোকেন হার্ট এর নরম পাতা ভরা ঈষৎ নম্র কান্ড গুলির চারপাশের ঝুরঝুরে মাটি ও ঢেকে দিলো ছোট্ট ছোট্ট সেই নুড়িগুলি দিয়ে। তারপর ঘুমোতে গেল জোনাকি জ্বলা অরণ্যে ---যার মাথার উপর তারায় ভরা আদিম আকাশ---গম্ভীর অথচ স্নিগ্ধ ---অভিযোগহীন, তিরস্কারহীন।
রতনলাল পরদিন একটু দেরী করেই ওঠে ঘুম থেকে। আজ ও আলস্যে কাটাবে। পুরোনো পাড়ায়, বাজারের দিকে যাবে, একটু আড্ডা মারবে। মনে পড়ে গ্যারাজে কুলেন্ট এর স্টক নেই। দিলারামের দোকান থেকে আপাতত গোটা কয়েক তুলে রাখবে। দিলারাম কমেই ছেড়ে দেয় ওকে। বাইরের খাটিয়ায় বসলো। দিলারামের শরীর একটু ভেঙেছে। চা বলে রতনের জন্য। ওদিকে টেবিলের সামনে চেয়ার নিয়ে একটা নতুন ছেলেকে দেখে রতন। বছর তিরিশের হবে ছিপছিপে শ্যামলা, এক মাথা কোঁকড়া চুল আর গোঁফে দক্ষিনী স্টান্ট ম্যান এর মত লাগে। দিলারাম বলে, এখন ওই সব হিসেব পত্তর দেখে। রেল শহরের ছেলে, বি.কম পাশ। দিদিমাকে নিয়ে এদিকেই চলে এসেছে। কথায় কথায় জানে, মা বাপ দুজনেই সার্কাসের দলে ছিল, দিদিমার কাছেই তাই মানুষ। মা বাপ রেস্টুরেন্ট চালায় এখন আলেপ্পি তে। রতনলালের হটাৎ চাঁদনীর কথা মনে হয়। বলে দেখবে নাকি একবার দিলারাম কে? চাঁদনী শুনলে রেগে যাবেনাতো আবার? রতনলালের আজকাল কেমন জানি ভয় হয়, যদি ওর কিছু হয়ে যায়? কত লরিই তো উল্টে, তুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে রাস্তার পাশে! দিলারাম বলে চলে :জোশুয়া রেল শহরে ইংরিজি ইস্কুলে পড়েছে ---ভারী স্মার্ট সে, কলকাতার ঝানু ব্যবসায়ীদের সাথে টক্করে কথা কয়। রতনলাল একটা দীর্ঘশ্বাস লোকায় বুঝি ---ঠিক কারণটা হয়তো নিজেও বোঝেনা।
জয়পুরের একটা লম্বা ট্রিপ আছে। রতনলাল দিলদারের ঘর গুলিতে গোলাপী মর্মর পাথরের ছোঁয়া দিতে চায়। ভাবে ফিরে এসে কথাটা পেড়ে দেখবে। সবার আগে চাঁদনীকেই।
দিন চার পাঁচ পরে, যেদিন ভোরে রতনলাল জয়পুর রওনা হয়, সেদিন দুপুরের দিকে চাঁদনীর পরিচয় হয় এক আশ্চর্য মানুষের সাথে। দিদিমার চোখ দেখাতে এসেছিলো সে। নীল অরণ্যের আলো তাকে ঘিরে রয়েছে। গভীর হ্রদের মত দুই চোখের দিকে তাকালে হাঁটু অবশ হয়! চাঁদনী যেন পথ চলতে চলতে এক নতুন থির থিরে ঝর্ণার দেখা পায় যা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাক দেয় উঁচু নীচু অচেনা পাথুরে পথ বেয়ে উজানে গিয়ে তার উৎসমুখ অনুসন্ধানে। এক রোমাঞ্চ, রোজকারের আবর্তন থেকে মুক্তি –একটি নতুন গতির আশা হয়তোবা! আর ঠিক তখুনি, তার পায়ের তলা থেকে রাশি রাশি পুঞ্জীভূত মেঘ যেন উঠে আসতে থাকে। অনন্ত বিষাদের সেই নীল মেঘ তাকে নরম কম্বলের মত ঘিরে ধরতে থাকে! এ বিষাদ তার আকৈশোর পরিচিত। এ বিষাদই তো তাকে পরম নিরাপত্তার আশ্বাসে আগলে রেখেছে এতদিন ---প্রতিদিন। তাই শিশুর মত পরম নিশ্চিন্তে সে নিজেকে সমর্পন করে সেই অনন্ত বিষাদের কোলে!
হয়তো শেষ বারের মত?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।