ছবিঃ এশাম্পল, বার্সেলোনা
সমুদ্র হতে নগর দর্শন ও রক্তিম মদ্য
টোমাস মান লিখেছেন, ট্রেনে ভেনিস আসা যেন খিড়কি দরোজা দিয়ে সুরম্য প্রসাদে প্রবেশ। তাঁর নায়ক গুস্তাভ ফন আশেনবাখ আসেন জাহাজে চড়ে, দূর থেকে দেখেন লিডোর সান্তা মারিয়া গিরজের চুড়ো, আরও দূরে সান মার্কো (ভেনিসে মৃত্যু – ডের টোড ইন ভেনেডিগ)।
চার দশক আগে প্রথমবার বার্সেলোনা আসি তার সত্তর কিলোমিটার উত্তরে কাতালুনিয়ার বিচ রিসর্ট ইওরেত দে মার হতে। ইংল্যান্ডে বুক করা স্প্যানিশ প্যাকেজ হলিডে - আহা কি দিন ছিলো, আমাদের টাকায় আসা যাওয়া দু সপ্তাহ থাকা খাওয়া সহ খরচ মাথা পিছু পাঁচ হাজার টাকা, তার সঙ্গে কিছু বাড়তি ব্যয়ে সাইট সিইং - যেমন বার্সেলোনার বাস ট্রিপ, সে অনেক রুক্ষ পাহাড় পেরিয়ে। উড়ে এসেছি কয়েকবার, দক্ষিণে এল প্রাত হাওয়াই আড্ডা থেকে ট্যাক্সিতে আধ ঘণ্টায়, ডান দিকে সমুদ্র, বাঁ দিকে মনসেরাতের পাহাড়, মন্তইয়ুইকের (ইহুদি পাহাড়) বিস্তৃত সমাধিক্ষেত্র পেরিয়ে, যেখানে দশ লক্ষের বেশি মানুষ চিরনিদ্রায় শায়িত। কোনদিন এক পারিবারিক সফরে ফ্রান্সের উত্তরে ক্যালে থেকে সিধে দক্ষিণে, পিরেনিজ পাহাড় পেরিয়ে দেড় হাজার কিলো মিটার গাড়ি চালিয়ে থারাগোথা, সেখান থেকে পুবে বার্সেলোনা।
মন্তইয়ুইক
সমুদ্র থেকে নগর দর্শনের সুযোগ এলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে।
বড়ো আম্বানি, মুকেশ ভাইয়ের রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের প্রিয় খদ্দের আর তার ট্রেজারার এক্স ব্যাঙ্কার (ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা, তার আগে আই আই টি কানপুর) অলোক আগরওয়াল আমার পছন্দের মানুষ। বেশ কয়েক বছর আগে লন্ডনে অলোকের সঙ্গে আলাপের প্রথম দিনেই তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সিলেবাস বহির্ভূত সন্ধ্যায় থিয়েটার দেখাতে – এ আর রহমানের বম্বে ড্রিমস! ব্যাল্যান্স শিট, প্রোজেকটেড ক্যাশ ফ্লো পরে হবে, আপাতত ড্রিমস, বম্বে ড্রিমস! আত্মপ্রবঞ্চনা করে লাভ নেই, কর্পোরেট জগতের সকল বন্ধুত্ব, গলে মিলনা, সৌজন্য নিতান্ত ব্যবসা ভিত্তিক তবু তারই মধ্যে যে ক’টা দিন হেসে খেলে কাটে!
আন্তর্জাতিক বাজারে দশটা বিশটা ব্যাঙ্ক একত্র হয়ে একই আইনে মতে (ইংলিশ ল) একই খদ্দেরকে যে ঋণ দেয় তাঁকে বলে সিন্ডিকেটেড লোন, খুব ভাল বাংলায় তাকে নাকি বলে গোষ্ঠী ঋণ। এই ধারের ওপরে দেয় সুদের এবং তজ্জনিত ফি দেওয়ার ব্যাপারে অলোক আগরওয়ালের কাছে এক পারসেন্টের শূন্য পয়েন্ট এক শতাংশ অসম্ভব সেখানে বম্বে বা হলিউড ড্রিমস দেখালে দু পয়সা বেশি মেলে না। সেই প্রফিট অ্যান্ড লসের লীলা! সুদ এবং ফিয়ের কম বেশি নিয়ে আমার জবাবদিহি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ফিলিপ ক্র্যাকনেলের কাছে; সুদে বা ফি খাতে ক পয়সা কমানো গেল সে ব্যাপারে অলোকের জবাবদিহি মুকেশ আম্বানির কাছে। তবু সেই মারকাটারি নিগোশিয়েশনের মধ্যেও কোথাও গড়ে ওঠে সাময়িক সখ্যতা।
আজকের হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য রিলায়েন্সের সেই দুশ কোটি ডলারের (২০০৭) দক্ষিণা বেশি মনে হতে পারে। তখন ছ মাসের লন্ডন ইন্টারব্যাঙ্ক রেট (লাইবর) ছিল পাঁচ পারসেন্ট, অনেক দর কষাকষির পরে রিলায়েন্স ১.২০% মার্জিন দিতে রাজি হয়েছে- অর্থাৎ কুল্লে ৬.২০% হারে সুদ দেয়। লাইবর হল তাই যে দরে আমরা ব্যাঙ্কেরা টাকা ধার করে থাকি, তার ওঠা নামা আছে, ছ’মাস বাদে সে রেট চার হতে পারে, দুনিয়ায় দু’চারটে অঘটন ঘটলে আট হতেও বাঁধা নেই। ঐ ১.২০% মার্জিন অনড় অটল, পরের পাঁচ বছর। তাই অলোকের ফোকাস মার্জিনের ওপরে।
কিছুটা রিলায়েন্সের নামে কিছুটা আমাদের মতন তুখোড় আয়োজকের হাতযশে আম্বানির ঈপ্সিত ঋণ একত্রিত করা গেল। এবারে সই সাবুদ কোথায় হবে? আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমাদের দ্বারা আয়োজিত আন্তর্জাতিক ঋণের স্বাক্ষর সর্বদা ভারতের বাইরে হতে দেখেছি, একমাত্র ব্যতিক্রম ২০০৩ সালের আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের লোন (শ্রীমতী ললিতা গুপ্তের আখ্যান লিখেছি ‘কিছুক্ষণ’ বইয়েতে) এবার রিলায়েন্সের ঋণ যাত্রার সফল সমাপ্তির পরে অলোক ফোন করে লোন উদ্যোক্তা বা অ্যারেঞ্জারদের জানালে সই সাবুদের কাজটা বার্সেলোনায় করলে কেমন হয়। এ ক্ষেত্রে আসা যাওয়া আমাদের খরচায়, থাকা খাওয়া সাইট সিইং রিলায়েন্সের অ্যাকাউন্টে। আরেকবার বার্সেলোনা যেতে আমার আপত্তি থাকার কথা নয় তবে জানিয়ে রাখলাম কেউ যেন কাম্প নু তে এফ সি বার্সেলোনার ফুটবল ম্যাচ দেখার আবদার না করেন, মে মাসে লা লিগার ছুটি! মুকেশ ভাইয়ের ইচ্ছা মাফিক রিহানা যে কোন দিন নাচতে গাইতে পারেন, এফ সি বার্সেলোনার খেলোয়াড়রা প্র্যাকটিসের মাঠেও নামবেন না।
এই ঋণ মেলায় ইভেন্ট একটা মাস্ট বস্তু। রিলায়েন্সের ইভেন্ট ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করে সাব্যস্ত হলো সইয়ের পরের দিনের ইভেন্ট হোক বার্সেলোনার অদূরে বোদেগা টোরেস ভিনিয়ারডে।
ব্যবস্থা ভালোই। এই মাত্র একবার আম্বানির দৌলতে বার্সেলোনায় বিচের ওপরে থাকার সুযোগ – আমার ঘরের সি ভিউ চমৎকার। হোটেলের জানলায় দাঁড়িয়ে কবে পড়া টোমাস মানের নভেলের কথা মনে হল - এ শহরকে কখনো সমুদ্র থেকে দেখা হয় নি! সেদিনই বিকেলে একটা বোট নিয়ে আমরা বেরিয়েছি, সাগর হতে নগর দর্শন করবো। বিচ অত্যন্ত সমতল, শহরকে ঘিরে আছে অনেকটা দূরের পাহাড়ের সারি, যেমন মন্তইয়ুইক, ইহুদি পাহাড়। ইতিহাস অনুযায়ী এখানেই একটি নাব্য নদী (ইয়ুবরেগাত) এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝে বার্সেলোনা শহরের পত্তন। সিটিস্কেপের মাঝে সবচেয়ে উঁচু মাথাটি সাগ্রাদা ফামিলিয়ার। স্পেনের অন্যান্য বিচের মতন হাজার খানেক দশ তলা উঁচু হোটেল অন্তত তখন দেখি নি। জেনারেল ফ্রাংকোর হাজারটা খারাপ কাজের (কাতালান ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন) মধ্যে একটা সদ্গুণকে ইতিহাস খাতির করে – তিনি স্পেনের সমুদ্র সৈকতে আকাশচুম্বী হোটেল বানানোর বিরোধী ছিলেন। বর্তমানে সেটির বিভীষিকা স্পেন জুড়ে দৃশ্যমান।
রুম উইথ এ ভিউ! বার্সেলোনা
বোটের বেঞ্চে বসে, গায়ে ভূমধ্যসাগরের মন্দ মধুর বাতাস মেখে কল্পনা করেছি আজকের সান সালভাদর থেকে নিনা ও পিনতা জাহাজ নিয়ে দুমাস সমুদ্রে দাঁড় বেয়ে ভারত আবিষ্কারের শেষে কলম্বাস এইখানে নোঙর ফেললেন – কূলে অসংখ্য মানুষ সমবেত, বরণ করার জন্য বন্দরে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং রানি ইসাবেলা এবং রাজা ফারদিনান্দ – মার্চ ১৪৯৩। রানি এবং কলম্বাস সমবয়েসি, একচল্লিশ; রাজা এক বছরের ছোট!
লোনের কাগজে সই করতে ঋণদাতা ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে মাত্র একজনের উপস্থিতি প্রয়োজন, কিন্তু এহেন মোচ্ছবে (চলতি ইংরেজিতে ফ্রি বি) অনেকেই ঢুকে পড়েন। যেমন আমাদের ব্যাঙ্ক থেকে চারজন, মুম্বাই হতে কর্পোরেট ব্যাঙ্কিঙের কর্তা বালা, আমবানি গুষ্ঠির তদারক কর্তা কিশোর, লন্ডন থেকে আমার সহচর ভিভেক, আমি। আমার সময়ে সিটি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড দুই ব্যাঙ্কেই ভারতীয় উপমহাদেশের বিদেশি ঋণের বাণিজ্য লন্ডনে আমাদের হাতে ছিল – অন্য ব্যাঙ্ক এই কর্মটি ভারতের কাছাকাছি সিঙ্গাপুরে সরিয়ে আনেন, কাজেই আমি অড ম্যান আউট! এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে বলেছি তার কারণ ইংরেজ একদিন রাজা ছিল, ঋণের আইন ইংলিশ এবং আমি ভারতীয়! যেখানে বাস সেখান থেকেই ব্যবসা করি। এখন দুই ব্যাঙ্কই এ ব্যবসা সিঙ্গাপুরে নিয়ে গেছে।
সমবেতা যুযুৎসবঃ অর্থাৎ এক দিকে কলমহস্তে ব্যাঙ্কার অন্যদিকে চার বান্ডিল ঋণপত্রসহ লন্ডনের দামি ল ফার্মের পোক্ত উকিলরা ঘরের মাঝে বিরাজমান - তাঁরা এ টেবিল থেকে সে টেবিলে আসীন ব্যাঙ্কারদের মাঝে ছুটোছুটি করে সই আদায় করার কর্ম সমাপ্ত হবার আগেই এক ভগ্নদূত জানালেন আমাদের মিনিবাস হোটেলের ড্রাইভে দেখা দিয়েছে। সেটি নিয়ে যাবে বার্সেলোনার অদূরে বোদেগাস টোরেস ওয়াইনারি বা ভিনিয়ারডে। টোরের অর্থ টাওয়ার, টোরেস তার বহুবচন। ভিলাফ্রাঙ্কা দেল পিনেদেস, তাঁদের কারখানা ও অফিস, এক ঘণ্টার ড্রাইভ।
সমবেতা যুযুৎসবঃ, বোদেগাস টোরেস ওয়াইনারিতে
প্রায় দেড়শ বছর আগে কাতালুনিয়ার খাইমে টোরেস ভাগ্য সন্ধানে কিউবা যান - ফ্লোরিডা থেকে নব্বই মাইল দূরের দ্বীপ কিউবার তখন ব্যবসা বাণিজ্যে এবং ট্যুরিজমে বিশাল রমরমা। হাভানা,ভারাদেরো বিচ ধনী আমেরিকানদের ক্রীড়াভূমি (প্লে গ্রাউন্ড), ওদিকে ক্যালিফোর্নিয়ার ন্যাপা ভ্যালিতে সবে ইউরোপ থেকে হাতিয়ে আনা আঙ্গুরের চারা লাগানো হচ্ছে। তাই মদ্য সরবরাহের একটি ভরসা স্পেন! সেখান থেকে কিউবায় ওয়াইন ইমপোর্ট দিয়ে খাইমের ব্যবসা শুরু। ক্রমে বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বসবাস শুরু হলে তিনি স্থির করলেন ওয়াইনের কেনা বেচা না করে নিজেই বানাবেন উচ্চস্তরের ওয়াইন। কাতালুনিয়ায় ফিরে এসে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে আঙ্গুরের চাষ শুরু করেন। টোরেস ব্র্যান্ড অচিরে এমনই খ্যাতনামা হল যে তাঁরা অন্য চাষিদের থেকে আঙ্গুর কিনে নিজেদের ব্র্যান্ড নামে ওয়াইন বিক্রি শুরু করেন। কাতালুনিয়ায় তাঁদের দ্রাক্ষাক্ষেত আকারে বিশাল নয় কিন্তু তাঁদের এস্টেট আছে স্পেনের অন্যত্র, চিলি এবং ক্যালিফোর্নিয়ায়। বার্সেলোনা শহর থেকে বছরে প্রায় ষাট হাজার টুরিস্ট আসেন। মনে হলো ওয়াইন এক্সপোর্টের চেয়ে হয়তো ওয়াইন মেকিং এবং তার বোতলের প্রদর্শনী থেকে বিক্রি বাবদ টোরেস ভাইয়েরা বেশি রোজগার করেন।
টোরেস দ্রাক্ষাক্ষেত
আমাদের মত অর্বাচীন গেঁয়ো লোকেদের কাছে দ্রাক্ষাক্ষেত, এই ওয়াইনারি পরিদর্শন একটি নতুন অভিজ্ঞতা। তাঁরা মহোৎসাহে তাঁদের কর্মকাণ্ড আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন, কোথায় ফারমেন্ট হয়, কোথায় বোতল স্টক করা হয়। কাতালুনিয়ায় রোমান পদচিহ্ন সর্বত্র - হানিবাল এই পথেই হাতির পাল নিয়ে রোম অভিযান করেছিলেন। রোমানরা দেশের নাম দিয়েছিলেন হিসপানিয়া (খরগোসের দেশ), তা থেকে এসেছে স্পেন। দু’হাত মাটি খুঁড়লেই এখানে পাওয়া যাবে দু হাজার বছর আগে কোন রোমান সৈনিকের ফেলে দেওয়া পানপাত্র। আজ সেটিকে মহা সম্মানে কাঁচের আলমারিতে সাজিয়ে রাখা হয়।
রোমান পানপাত্র
ওয়াইনের, টোরেস পরিবারের ইতিহাস তো শোনা হলো। অলোক খানিকক্ষণ ধরেই উসখুশ করছিলেন, এবারে ঝেড়ে কাশলেন, “আচ্ছা আঙ্গুরের ক্ষেত তো দেখালেন, কিভাবে ছেঁচে তার রস বের করা হয় সেটা দেখাবেন?” আমাদের বয়েসের অনেকেই কার্ক ডগলাসের ‘দি ভাইকিংস’ ছবিতে দেখেছেন কেমন ভাবে রমণীরা একটা কাঠের ব্যারেলের ভেতরে ঠাসা আঙ্গুরের ওপরে লম্ফঝম্ফ করছেন।
গাইড বললেন, সেটাই আমাদের নেক্সট স্টপ। অলোক বা আমি ঠিক এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না; শেড থেকে বেরিয়ে দেখি গাছের নিচে একটি ব্যারেল রাখা আছে। ওয়াইনারির কর্মীরা সেখানে দাঁড়িয়ে, বুঝিয়ে দিচ্ছেন প্রসেসটা কি।
‘যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম’, বলে মুনি ঋষিরা একদিন রাজসিংহাসনে পদাঘাত করে ঐশ্বরিক আনন্দ অনুভব করেছেন। আজ জানা গেল বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, জুতো মোজা খুলে একটা কাঠের ধাপে পা দিয়ে উঠে ব্যারেলের ভেতরে গাদা করা আঙ্গুরের স্তূপে পদাঘাত করলেই এক অমৃত রসধারার উৎপত্তি হবে, যাকে গেজালে পাওয়া যাবে ওয়াইন। সেই কঠিন কর্তব্য সমাপ্ত হলে আপনার মধুময় পদধূলি প্রক্ষালনের জন্য কলের জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে পাশেই। অলোক প্রথমেই নেমে পড়লেন, দেখাদেখি আরও অনেকে। সেই হই হই চলল অনেকক্ষণ, পরিশেষে এলাহি খাওয়া দাওয়া। সে সময়ে আফটার ডিনার স্পিকারের স্টাইলে এখানে একজন আফটার লাঞ্চ বক্তা আবির্ভূত হলেন, টোরেস পরিবারের কাহিনী শুনলাম, এঁরা ১৯৩০ সালে ১,৩০,০০০ গ্যালন ভরা যায় এমন একটি ভ্যাট বা ওয়াইন ব্যারেল বানিয়েছিলেন, বিশ্বের বৃহত্তম। ১৯৩৬ সালের স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে ফ্রাংকোর সেনারা ফ্যাক্টরিতে বোমা ফেললে সেই ভ্যাট বিনষ্ট হয়।
অলোক আগরওয়াল ও অন্যান্য - আঙ্গুর পেষার ছল
এটি একটি গুল্প, ফ্যাক্ট চেকিং করে কে। জার্মানি আসার অব্যবহিত পরেই হাইডেলবের্গের কেল্লায় দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো ব্যারেল দেখে এসেছি, তার ধারণ ক্ষমতা ২,২০,০০০ গ্যালন কিন্তু শুভ বুদ্ধির উদয় হল; সমাগত টুরিস্টদের সামনে বাহাদুরি দেখানো থেকে নিরস্ত রইলাম।
বিধাতা কোথাও যে কখন কি লিখে রাখেন। বোদেগা টোরেস প্রদক্ষিণের দুটো টুকরো প্রসঙ্গ নিবেদন করতেই হয়।
নিতান্ত ঘটনাচক্রে ঠিক পরের বছর জার্মানিতে রাইনের ধারে একটি ছোট্ট আঙ্গুরের ক্ষেত কিনেছি; সে আজ ষোলো বছর হয়ে গেলো। নিজের হাতে না করলেও দ্রাক্ষা চাষ ও ওয়াইন উৎপাদনের ব্যাপারটা খানিক বুঝি। জানি এককালে পা দিয়ে দুরমুশ করা হতো এখন আর সেটা হয় না। আমাদের গ্রামের আখের কল মাড়াইয়ের মতন কাঠের কল দিয়ে কাজ হয়েছে। বোদেগা টোরেসে সে কাজ পায়ে নয় যন্ত্রে সাধিত হয়। তবে সেদিন আমাদের সমবেত জনতা ব্যারেলের ভেতরে লাফিয়ে সাতিশয় আনন্দিত হয়েছিলেন।
বর্ষে বর্ষে সিংহরায় ওয়াইন। লোরেলাই। মিটেল রাইন ভিনিয়ারড
মাড়াইয়ের জন্য কাঠের কল
দ্বিতীয় ঘটনা – ছ’বছর বাদে আমাদের সিন্ডিকেট ম্যানেজারদের বার্সেলোনা সফরে আবার বোদেগা টোরেস পরিদর্শন করেছি! সেই একই রুটিন একই গল্প, একটু আপডেটেড। তবে রাইন নদীর কূলে আমাদের ভিনিয়ার্ডে সদ্যলদ্ধ জ্ঞান ফলানোর জন্য বিজ্ঞের মতো দু চারটে টেকনিকাল প্রশ্ন করায় তাঁরা কিঞ্চিত বিস্মিত হলেও নিতান্ত ক্ষমাসুন্দর মুখে আমার কৌতূহল নিবারণ করেন।
আমাদের এবারের ভোজনটি লাঞ্চ নয়, ডিনার আর তার সঙ্গে ওয়াইন টেস্টিং। এক টেবিলে এতো রকমের কাঁচের গেলাস পানপাত্র একত্রে কখনো দেখিনি।
ওয়াইন টেস্টিং
ওয়াইন ভাঁড়ার
পুনশ্চ:
আঠারো বছর রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজে চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার সহ নানাবিধ পদ আলোকিত করার পরে অলোক আগরওয়াল এখন প্রাইভেট ইকুইটি সেক্টরে স্বাধীন তখত সামলাচ্ছেন। আমার পুরনো প্রভু, এক সময়কার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক ডিরেক্টর জসপাল বিন্দ্রার আংশিক মালিকানায় এবং পূর্ণ তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত সেন্ট্রাম ক্যাপিটালের অংশ মোডুলাস অলটারনেটিভ অ্যাসেট ম্যানেজারের ইকুইটি পার্টনার অলোক। আমাদের পথ অনেকদিন আলাদা হয়ে গেছে। তিনি আর ধার নেবার ধান্দা করেন না, ধার দিয়ে থাকেন।
মনসেরাতের কালো মাদোনা (লা মোরেনাতা)
বার্সেলোনার এল প্রাত এয়ারপোর্টে নেমে উত্তরপুব দিকে তাকালে একটি উঁচু শৈল সারির সিল্যুয়েট চোখে পড়ে, তার নাম মনসেরাত; ল্যাটিন শব্দ, আক্ষরিক অর্থ খাঁজকাটা পর্বত। কাছে পৌঁছুলে নামের তাৎপর্য বোঝা যায়। সাউথ ডাকোটার মাউন্ট রাশমোরে খোদিত চার আমেরিকান প্রেসিডেন্টের আবক্ষ মূর্তি চাক্ষুষ নয়, হিচককের নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট ছবিতে দেখেছি; সমতল থেকে চার হাজার ফুট উঁচু এই পাহাড়ের পদতলে এলে মনে হয় পাথরে পাথরে যেন কোনো বিশ্বকর্মা আপন খেয়ালে বিশাল মূর্তি গড়েছেন।
মনসেরাত
প্রভুর বন্দনার জন্য গিরজে স্পেনে অনেক, কিন্তু তাঁর মাতার নামাঙ্কিত এই মন্দিরকে ক্যাথলিক কাতালুনিয়ার পবিত্রতম তীর্থস্থান মানা হয়; সেন্ট জর্জের মূর্তির তলায় খুদে অক্ষরে লেখা, জেরুসালেমের শান্তিতে ধন্য – কাতালুনিয়া চিরতরে রবে ক্রিস্টিয়ান অথবা হবে অবলুপ্ত। নান্য: পন্থা বিদ্যতে অয়নায় । আজ সেখানে ট্রেনে বাসে গাড়িতে অনায়াসে পৌঁছুনো যায় স্বল্প সময়ে। মনে রাখতে হবে প্রথম কয়েকশ বছর মেরি মাতার দর্শনার্থীরা এসেছেন পাহাড়ের কঠিন পাকদণ্ডি পেরিয়ে। লাঠি হাতে বৃদ্ধ দুর্বল নারী পুরুষ হেঁটেছেন পাথরে পাথরে পা দিয়ে, শিশুকে কোলে বা কাঁধে রেখে। আমাদের দেশের চার ধামের মতো এই মঠ দাবি করেছে যাত্রীর নিষ্ঠা ও শারীরিক সক্ষমতা। কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না।
অর্থোডক্স, ক্যাথলিক, লুথারিয়ান গিরজেয় প্রভুর মাতা মেরির (হিব্রু/আরামাইক মিরিয়াম, গ্রিক মারিয়া, পবিত্র কুরানে মরিয়ম) ভজনা চলে তাঁর পুত্রের পাশাপাশি। তিনি আমাদের মাতা, ইতালিয়ানে মাদোনা (মাই লেডি) ফরাসিতে নত্র দাম। কিন্তু তাঁর বর্ণ কি? নাজারেথের পবিত্র পরিবার ইউরোপিয়ান নন তাঁরা লেভান্তের, ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের, লোক। অথচ দু হাজার বছরের শিল্পকলায় ইউরোপের আর্টিস্ট মাতা ও পুত্রকে ইউরোপিয়ান চেহারা দিয়েছেন, গাত্র বর্ণ হয়তো অস্পষ্ট থেকেছে। পঞ্চাশ বছর আগে নির্মিত ফ্রাংকো জেফারেলির সুবিখ্যাত ছবির (জিসাস অফ নাজারেথ) নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জেরুসালেমের আড়াই হাজার মাইল পশ্চিমে জন্মানো, সলফোর্ড, ল্যাঙ্কাশায়ারের যুবক রবার্ট পাওয়েল। তিনিই হয়ে দাঁড়ালেন হলিউডি যিশুর চেহারার মাপকাঠি! একবার নাজারেথে ভুল জায়গায় বাস থেকে নেমে অলিতে গলিতে ইউরোপীয় চেহারার সাদা মানুষ দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
বাইবেল অনুযায়ী নাজারেথের মেরি, মারিয়া বা মরিয়ম প্রথম শতাব্দীর এক ইহুদি মহিলা, তাঁর গায়ের রঙ সাদা না কালো না মাঝামাঝি কিছু এ নিয়ে ধার্মিক বিতর্ক থাকতেই পারে। তাঁর মূর্তির কালো রঙ কেন, তাঢ় ব্যাখ্যায় বলা হয়ে থাকে সেটি আদতে কাঠের তৈরি; কালের প্রকোপে এবং নিত্যি জ্বলে থাকা মোমবাতির ধোঁয়ায় তার রঙ হয়েছে মলিন। ইউরোপের নানা দেশের প্রাচীন গাথা অনুযায়ী ক্রিস্টিয়ানিটির আবির্ভাবের অনেক আগে ধরিত্রী এবং প্রজন্মের প্রতীক রূপে এমনই এক দেবীর আখ্যান ইউরোপে প্রচলিত ছিল; যেমন লিথুয়ানিয়ার ভিলনিউসের গেটে আছেন দিইয়েভো (দেবী) মতিনা, এখন মাদোনা। পশ্চিম পোল্যান্ডে ইয়াসনা গুরা মঠে আমার পরিচিতা গ্রাতসিনার কল্যাণে ব্ল্যাক মাদোনা ‘চেসতোহোভা’-র দর্শন করেছি - ক্যাথলিক পোল্যান্ডে এই কৃষ্ণা মাদোনার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। আশ্চর্যের বিষয় এঁকে নিয়ে আসেন এক হাঙ্গেরিয়ান সাধু। দেশ শুদ্ধু লোক তাঁর অলৌকিক ক্ষমতায় আস্থা রাখে এবং বরপ্রাপ্তির বাসনায় হত্যে দিয়ে থাকে, একেবারে আমাদের গ্রামের পদ্মা কুমারীর মন্দিরের মতন, বারংবার আভূমি প্রণত হয়ে সেই যাত্রা। শ্যামা মা কেন কালো তা নিয়ে কোন অনুসন্ধিৎসা দেখিনি, দেখেছি গভীর অটল আস্থা, বিনম্র আত্ম নিবেদন, সারা দুনিয়ার সব তীর্থ স্থানের মতন। তাঁর সেই কালো রূপের পুজো চলে এসেছে হাজার বছর। ব্যাভেরিয়ার আলটোটিং এর শোয়ারতস মাদোনা মিট কিন্ড , কৃষ্ণবর্ণা মা মেরির ডান কোলে যীশু তাবৎ জার্মানিক জগতের সবচেয়ে বড়ো মাদোনা তীর্থ।
ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি মিলিয়ে বিভিন্ন গিরজেতে অন্তত একশ কালো মাদোনার দেখা পাওয়া যায়।
সান্তা মারিয়া ব্যাসিলিকা, মনসেরাত
প্রবাদ অনুযায়ী জেরুসালেমে সন্ত লুকের নিজের হাতে বানানো কালো মাদোনার একটি কাষ্ঠমূর্তি কোনক্রমে বার্সেলোনা পৌঁছায়। অষ্টম শতাব্দীতে মুর আক্রমণের সময়ে তাঁকে রক্ষার জন্য কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, সেটি আবার এমনই গোপন যে তার অবস্থান জি পি এস কম্বিনেশান কি বা পাসওয়ার্ড অবধি লুপ্ত হয়ে যায়। দুশ বছর বাদে কিছু রাখাল বালক মনসেরাতের পাহাড়ে একটি অদ্ভুত আলোকে লক্ষ করে এক গুহার ভেতরে কালো মাদোনাকে খুঁজে পায়। বার্সেলোনার প্রধান পুরোহিত তৎক্ষণাৎ সেখানে হাজির হয়ে মেরি মাতার মূর্তিকে শহরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন, কিন্তু মাতা যেতে নারাজ। মূর্তি এমনই ভারি যে তাঁকে তাঁর স্থান থেকে তোলা গেলো না। অগত্যা বারশো বছর আগে এই দুর্গম গিরির হাজার দেড়েক ফিট উচ্চতায় সান্তা মারিয়ার (সন্ত মেরি) নামে মঠ মন্দির স্থাপনা সম্পন্ন হয়।
মনসেরাতের মঠে আশ্চর্য প্রশান্তি। একদিকে খাড়া পাহাড় সেখানে যেন অজস্র মুখ কে যেন খোদাই করে রেখেছেন, তাঁরা নিঃশব্দে চেয়ে আছেন আমাদের পানে। নিচে অনেক দূরে শহর, তার কলরব এই উচ্চতায় পৌছয় না। বাস ভর্তি টুরিস্ট আসেন বটে, সৌজন্য বজায় রাখেন। মা বলতেন স্থান মাহাত্ম্য!
দিনে দু’বার লা মোরেনাতার দর্শন মেলে, লাইন দিতে হয়। বাসিলিকার দোতলায় মাদোনা একটি কাঁচের ঘেরাটোপের মধ্যে বসে আছেন, তাঁর দক্ষিণ হস্তটি অভয় মুদ্রায় প্রসারিত। সে হাত স্পর্শ করে মনের অভিলাষ জানালে মাতা সেটি পূরণ করেন এমন কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
কাঁচের ঘেরাটোপের মধ্যে লা মোরেনাতা
সত্তর পেরিয়েছি অনেকদিন। এই জীবনে কোন বিশ্বাস বা অবিশ্বাসকেই শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরতে পারি নি। বাল্যকালে আমাদের পদুমা গ্রাম থেকে গরুর গাড়িতে দুবরাজপুর যাওয়ার পথে বিরুলি গ্রামের ঠিক আগেই পড়তো এক পীরের থান (স্থানের বীরভূম সংস্করণ); মা সেখানে গরুর গাড়ি থামিয়ে আদেশ দিতেন, যা তো আমাদের নাম করে গাছের ডালে সুতো খোলাম কুচি বেঁধে মাথা নুইয়ে আয়। তাতে নাকি ইচ্ছাপূরণ হয়। তাঁর মনস্কামনা কি সেটা জানাতেন না - ‘বলতে নেই!’ তবে সর্ব ধর্ম নির্বিশেষে যত্রতত্র মাথা নোয়ানোর এবং প্রার্থনার অভ্যেসটি তৈরি হয়ে গেছে বছর পাঁচেক বয়েসে।
মনসেরাতের ক্যাথলিক মাদোনা, লা মোরেনাতার হাত ধরে দু বার যা আমরা চেয়েছিলাম, করুণা বশত তিনি তা পূর্ণ করেছেন। প্রথম স্ত্রী ছিলেন ব্রাহ্মবালা, আমি অবসর মতো প্র্যাকটিসিং হিন্দু; ১৯৮৭ সালে আমরা পুত্র কামনা করেছিলাম; চৌদ্দ বছর বাদে অর্থোডক্স ক্রিস্টিয়ান ধর্মাবলম্বিনী দ্বিতীয় পত্নীর সঙ্গে লা মোরেনাতার কাছে কন্যা প্রার্থনা করি। ঘর আলো করে ইন্দ্রনীল এসেছে ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, মায়া আগস্ট ২০০২।
আভে মারিয়া।