ডাবলিন ৩
ফিনিক্স পার্ক, ডিউক অফ ওয়েলিংটন এবং অন্যান্য
স্পেন থেকে ফিরে লন্ডনে তাঁর পাড়ার পাবের আড্ডায় বসে জন বললেন, চাকরি থেকে অবসর পেলে মালাগায় বাড়ি বানিয়ে থাকব ভেবেছিলাম কিন্তু মনে হচ্ছে সে দেশে বাস করা যাবে না।
আইরিশ বন্ধু কনর বললেন, কেন?
জন বললেন, একে তো স্পেনে মিস্ত্রি পাওয়া শক্ত, মেলেও যদি তাদের দিয়ে কাজটা করানো মহা ঝকমারি। কবে আসবে, কদিন লাগবে জিজ্ঞেস করলে মিস্তিরি বলে, মানিয়ানা (Mañana, আগামী কাল) সেটা কোন দিন? যতো বলি আমার তাড়া আছে, ঠিক করে বলো কোনদিন, সে বলে মানিয়ানা। পরের দিন আবার জানতে চাই, সে বলে মানিয়ানা!
কথাটা শুনে কনর খানিকক্ষণ ভেবে বললেন, দেখুন আমাদের আয়ারল্যান্ডে তো সবই হয় ধীরে সুস্থে। একটা কাজ কোনদিন শুরু বা শেষ হবে তা কারো জানা নেই। সেক্ষেত্রে মানিয়ানা বা আগামীকাল তো একটা ফার্ম কমিটমেন্ট! সেটা আমরা দিই না।
‘ভাববেন না’, ‘কাল হবে’, ‘করে দেব সার’, ‘কাজটা ঠিক হয়ে যাবে’ আমাদের দেশে এ ধরনের আলগা প্রতিশ্রুতি শুনতে এবং সেটা বিশ্বাস না করতে আমরা অভ্যস্ত। স্পেনের মানিয়ানা, ইতালির দোমানি, ফরাসির দোমাঁ (আমরা এ বিষয়ে নিদারুণ ভুক্তভোগী) সেই পর্যায়ে পড়ে। আইরিশ আর এক কাঠি সরেশ – সে যে কবে কাজে হাত দেবে তারই কোন হদিশ নেই। আগামীকাল শেষ হবে বলে সে বিপদে পড়বে কেন? সেটা তো বিপদজনক!
তাঁর গাড়িতে ডাবলিন পরিক্রমা চলছে; এক সময় গল্পটি শোনালেন সিটি ব্যাঙ্ক ডাবলিনের মেজো কর্তা লিয়াম। ফিনিক্স পার্কের এক কোণে খুব উঁচু স্টিলের পিলারের মাথায় বসানো একটি ক্রস দেখিয়ে বললেন, ১৯৭৯ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পলের ডাবলিন সফরের স্মারক এটি। অনুমান করতে পারেন এই কাজটি শেষ হতে কতদিন লেগেছিল?
ইতিহাসের প্রথম পোলিশ পোপ, দ্বিতীয় জন পলের সেই আয়ারল্যান্ড ভ্রমণ একটি সাড়া জাগানো ইভেন্ট –ফ্রাঙ্কফুর্টে থাকি তখন; ডিরেক্ট টেলিকাস্ট নয় কিন্তু সরকারি জার্মান টেলিভিশনে তার রিপর্টাজ দেখেছি। প্রায় দশ লক্ষ মানুষ (ডাবলিনের তৎকালীন জনসংখ্যার সমান) পোপকে দেখতে এই ফিনিক্স পার্কে সমবেত হয়েছিলেন, সে যাবত পৃথিবীতে পোপ দর্শনের রেকর্ড। তাঁর সম্মানে ঐ দেড়শ ফিট উঁচু স্টিলের পিলারের ওপরে ক্রসটি বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল আগস্ট মাসের গোড়ায়। পুরো সাত সপ্তাহ লেগে যায় পিলারটি খাড়া করে ক্রস বসাতে। দু ঘণ্টা ব্যাপী পোপ কথিত সুসমাচারের সময়ে ডাবলিনের শহর কর্তৃপক্ষ নাকি গভীর শঙ্কার সঙ্গে পোপ নয় সেই উঁচু চকচকে ক্রসটির ওপরে লক্ষ রাখছিলেন – সেটি অধঃপতিত হলে পুণ্য প্রভুর আরেক ভক্তের ক্রুশবিদ্ধ হবার সম্যক সম্ভাবনা ছিল।
ফিনিক্স পার্ক ক্রস
“আইরিশ কর্ম তৎপরতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! মানিয়ানার আইরিশ ভার্সন!”, বলে লিয়াম একটু বিরাম নিলেন।
মধ্যযুগীয় ডাবলিন দেওয়াল সীমার বাইরে, লিবার্টিজের প্রায় লাগোয়া ফিনিক্স পার্ক আয়তনে নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কের ডবল, কলকাতার ফুসফুস গড়ের মাঠের তিন গুণ, লন্ডন হাইড পার্কের পাঁচগুণ বড়ো। এগারো কিলোমিটারের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা পরিসীমার ভেতরে এই ফিনিক্স পার্কের কোন তুলনা ইউরোপে নেই। কোথাও নাগরিক জীবনের মাঝখানে এমন সবুজের সৌরভ দেখিনি; এটি একাধারে নেচার পার্ক, বনস্থলী, এখানে দিগন্ত বিস্তৃত শান্তি, প্রসন্ন উদার। কোথাও ফুটবল রাগবির গোল পোস্ট দেখবেন না, হাঁটতে পারেন এ মুড়ো হতে ও মুড়ো (ঘণ্টা তিনেক লাগে) দিনে রাতে যখন খুশি। হরিণের আনাগোনা আছে, সাক্ষাৎ হবে পথে, লন্ডনের রিচমন্ড পার্কের মতো। এই শান্ত নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে বোঝার উপায় নেই মাত্র দশ মিনিট দূরে রাজধানী ডাবলিনের জন ও যানযাত্রা চলছে অবিরাম। পার্ক মানে সবুজ উদ্যান, সেখানে কোন পাকা বাড়ি বানানো সাধারণত বারণ; যেমন আমাদের কলকাতা ময়দানে যত দূর জানি ইট পাথর গাঁথা যায় না (আমার সময়ে তাই ছিল), ইউরোপের পার্কেও মোটামুটি একই নিয়ম। লন্ডনের হাইড পার্কের ভেতরে পাকা বাড়ি নেই কিন্তু সেই একই ইংরেজ প্রভু তাদের উপনিবেশে অন্য আইন জারি করে ফিনিক্স পার্কের মাঝে বানিয়েছিল দুটি বিশাল বাস ভবন; একটি তাদের রাজশক্তির প্রতিভূ ব্রিটিশ লেফটেন্যান্টের স্থায়ী বসতবাড়ি অন্যটি ব্রিটিশ চিফ সেক্রেটারির। এই কলোনির দুই প্রধান পরিচালক শলা পরামর্শ করেছেন একত্রে। ব্রিটিশ লেফটেন্যান্টের বাড়িটি এখন আইরিশ রাষ্ট্রপতির সরকারি আবাস (যেমন আমাদের ময়দানের একধারে গভর্নর জেনারালের অট্টালিকা এখন রাজ্যপালের বাড়ি)। ব্রিটিশ চিফ সেক্রেটারির সাবেক বাসভবনটি বর্তমানে এ দেশের আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের আবাস। তার হয়তো একান্ত ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আছে – আমেরিকার দু ডজন প্রেসিডেন্টের বাপ ঠাকুরদা বা ঊর্ধ্বতন কোন পুরুষ একদা আয়ারল্যান্ড থেকে ভাগ্যের সন্ধানে নতুন মহাদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। আইরিশ হেরিটেজ সম্বলিত রাষ্ট্রপতির তালিকাটি দীর্ঘ - যেমন ইউলিসিস গ্রান্ট, অ্যান্ড্রু জ্যাকসন, উড্রো উইলসন, হ্যারি ট্রুম্যান, জন কেনেডি, লিন্ডন জনসন, রিচার্ড নিক্সন, জেরাল্ড ফোর্ড, জিমি কার্টার, রোনাল্ড রেগান, বুশ পরিবার, জো বাইডেন। এই ছোট দ্বীপ থেকে গিয়ে আইরিশরা আমেরিকাকে দিয়েছে কেবল তাদের মুখের বুলি নয়, বহু রাষ্ট্রপতিও।
বড়ো মানুষদের বাড়ির সদর দেউড়ি পার হবার অনুমতি নেই। দূর হতে দেখে নমস্কার করবেন।
তবে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নিরীক্ষণ করতে পারেন।
মিশর থেকে ডাকাতি করে আনা মাঝারি সাইজের ওবেলিস্ক আছে প্যারিসের প্লাস দে লা কনকর্ডে, খানিকটা ছোট আকারের আরেক চোরাই ওবেলিস্ক ইংরেজ বসিয়েছে লন্ডনে টেমসের ধারে, ‘ক্লিওপেট্রার ছুঁচ’ নাম দিয়ে। ইংরেজ বা ফরাসি তাদের চৌর্যবৃত্তির প্রকাশ্য পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করে না। কিন্তু ইউরোপের উচ্চতম, একেবারে আগ মার্কা মেড ইন ইউরোপ ওবেলিস্ক দেখবেন ফিনিক্স পার্কে। এক আইরিশ প্রটেস্ট্যান্ট পরিবারের সন্তান, বহু যুদ্ধ বিজেতা, সম্ভবত নেলসনের পাশাপাশি ইংরেজের সেরা সেনাপতি আর্থার ওয়েলেসলির সম্মানে নির্মিত। আমরা তাঁকে জানি ওয়াটারলু রণাঙ্গনের বিজয়ী যোদ্ধা ডিউক অফ ওয়েলিংটন নামে।
একটি ট্রিভিয়া শোনানোর লোভ সংবরণ করা গেলো না। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য কৃতজ্ঞ ইংরেজ তাঁকে যাবজ্জীবন ব্যবহারের জন্য যে বাসভবনটি দান করেছিল তার ঠিকানা একেবারে একক, অনন্য:
নাম্বার ওয়ান লন্ডন!
নাম্বার ওয়ান লন্ডন, হাইড পার্ক
হাইড পার্ক কর্নার টিউব স্টেশন থেকে বেরিয়ে পার্কে ঢোকার মুখে বাঁ হাতে অথবা ওয়েলিংটনের স্ট্যাচুর ঠিক উলটোদিকে দেখবেন সেই বাড়িটি! লিয়ামের সেটা জানা ছিল না। ধন্যবাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন , তাঁর আসল নামটা নামটা কি ছিল বলুন তো?
- ডিউক অফ ওয়েলিংটন খেতাব পাওয়ার আগে আর্থার ওয়েলেসলি নামে পরিচিত ছিলেন বোধহয়।
- তিনি জন্মেছিলেন আর্থার ওয়েসলি নামে, তবে সেটা বড়ো আইরিশ শোনায় বলে বদলিয়ে ওয়েলেসলি লেখেন। আয়ারল্যান্ডে ইংরেজের পিয়ারেজ (লর্ড শিপ) প্রথায় তাঁর বাবা ইংরেজের বদান্যতায় হয়েছিলেন ডিউক অফ মর্নিংটন। কেবল ওয়াটারলু নয়, আপনাদের দেশেও তিনি কিছু কীর্তিকলাপ রেখে এসেছেন। তাঁর ভাই বোধহয় আপনাদের দেশের গভর্নর হয়েছিলেন, ঠিক বলতে পারি না।
বরানগরের স্কুলে ইতিহাস বইতে পড়তে হয়েছে- হেস্টিংস, কর্ণওয়ালিস, ওয়েলেসলি, বেন্টিংক, কার্জন! সেই জ্ঞানটা কাজে লেগে গেলো।
- হ্যাঁ, লর্ড ওয়েলেসলি! ভারতের নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বাংলার গভর্নর ছিলেন। তিনি ডিউক অফ ওয়েলিংটনের ভাই? জানতাম না। ওয়েলেসলি স্কোয়ার আছে আমার শহরে, কলকাতায়!
- শুধু ওয়েলেসলি? ব্রিটেনের কথা বাদ দিলাম, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো আপনাদের দেশেও নিশ্চয় অনেক ওয়েলিংটন স্কোয়ার, স্ট্রিট, গার্ডেনস আছে?
ওয়েলিংটন স্কোয়ার! মনে আছে আমার স্কুল জীবনে পাইকপাড়া থেকে দু নম্বর বাসে চৌরঙ্গীর ভাড়া ছিল সতেরো পয়সা (তখন সিনেমার নিম্নতম টিকিট ৬৫ পয়সা); তার তিনটে ফেয়ার স্টেজ: শ্যামবাজার অবধি আট পয়সা, বিবেকানন্দ রোড এগারো পয়সা, হিন্দ সিনেমা, ওয়েলিংটন স্কোয়ার অবধি চোদ্দ পয়সা। বলতে হলো এই আইরিশ সন্তান আমাদের দেশে অনেক পথঘাটের সাইনবোর্ডে দেখা দিয়েছেন!
- তিনি নিজেকে আইরিশ বলে পরিচয় দিতেন না। আর্থার ওয়েলেসলি ইংরেজের হিরো, আইরিশের নয়। তাঁর পরিবার ক্যাথলিক বিরোধী কট্টর প্রটেস্ট্যান্ট। ডাবলিনের কাছে তাঁদের পৈত্রিক দুর্গ, ডাঙ্গান, ইটন অক্সফোর্ডে পড়েছেন, লন্ডনে তাঁর ওঠা বসা, আয়ারল্যান্ডকে ব্রিটেনের একটা জেলা মনে করতেন। ডাবলিনের দুটো পাড়ায় তাঁর নামে কয়েকটা রাস্তা আছে, সেটাও ঐ কলোনিয়াল সময়ের প্রতীক। যেমন আপনার দেশে। অনেক কলোনিতে পুরনো রাজাদের নাম বদলানো হয়, ডাবলিন এ ব্যাপারে খানিকটা আলাদা – আমরা অপছন্দের আইরিশদের নামের নিশানা বদলে দিই - লিফি নদীর ওপরে হা পেনি ব্রিজটা দেখেছেন? ওটার পুরনো নাম ওয়েলিংটন ব্রিজ।
অদ্ভুত ব্যাপার! স্বাধীন দেশ তার রাস্তাঘাটের বিদেশি রাজার নাম বদলায়, কর্নওয়ালিস স্ট্রীট আজ বিধান সরণি। কিন্তু ওয়েলিংটন তো জন্মসূত্রে আইরিশ তবু তাঁর নামাঙ্কিত ব্রিজ অন্য নামে পরিচিত হলো!
ওবেলিস্কের পাদপ্রান্তে একদিকে লেখা তাঁর বন্দনা গীতির প্রথম লাইন, “এশিয়া এবং ইউরোপকে রক্ষা করেছ” -প্রশ্ন উঠতেই পারে, কার হাত থেকে? টিপু সুলতান? নেপোলিয়ন?
বিতর্কে না গিয়ে লিয়াম বললেন, এই ওবেলিস্ক প্রতিষ্ঠা করতে মোট চুয়াল্লিশ বছর লেগেছিল। ঐ মানিয়ানা!
ওয়েলিংটন স্মারক ওবেলিস্ক
ডাবলিনের প্রথম সন্ধ্যেয় জেমস জয়েসের প্রসঙ্গ তুলে চমকে দিয়েছিলেন লিয়াম, আজ ডিউক অফ ওয়েলিংটন! সাহিত্য-ইতিহাস-ব্যাঙ্কিং মিলে মিশে একাকার। আমার সোলমেট! নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ওয়াটারলু যুদ্ধ বিজয়ী বলেই ডিউক অফ ওয়েলিংটন খ্যাত, জানতাম না অল্প বয়েস থেকেই যুদ্ধের খেলা খেলেছেন – সে আমলে শৌর্য নয় বীরত্ব বা সিনিওরিটি নয়, স্রেফ টাকা দিয়ে আর্মিতে কমিশন বা পদ কেনা যেতো। মাত্র একুশ বছর বয়েসে পিতার অর্থে বা বাপের ব্যাকিং-এ এক রেজিমেন্টে অর্থের বিনিময়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের পদ প্রাপ্ত হন (আমাদের দেশের মতো কিছু শোনাচ্ছে কি?)! কোম্পানির আমলে ভারতে টিপু সুলতানকে শ্রীরঙ্গপত্তনমে পরাস্ত করেন, তাঁর ভাই রিচার্ড ওয়েলেসলি বাংলা শাসনের ভার পাওয়া মাত্র আইরিশ লর্ড শিপ পেলেন। ওয়েলিংটন কট্টর সাম্রাজ্যবাদী, আমাদের হিসেবে মির জাফর। নিজের দেশটাকে পোপ বিরোধী প্রটেস্ট্যান্ট, বিদেশির হাতে তুলে দিয়ে তাদের ইউনিফর্ম পরে লড়াই করছেন, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী অবধি হয়েছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রকল্পে প্রসূত জমিদারের মতন কয়েকশ বছরের শাসনকালে ব্রিটিশ এক ধামাধরা গোষ্ঠী তৈরি করেছে আয়ারল্যান্ডে, যারা জন্মসূত্রে আইরিশ কিন্তু প্রটেস্ট্যান্ট এবং ইংরেজ-দরদি। গরিব আইরিশ চাষির কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে বিশাল সম্পত্তির মালিকানা ষোলোআনা ভোগ করেছেন অথচ লন্ডনের মেফেয়ার, ব্লুমসবেরির ভব্য সমাজে আইরিশ পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত থেকেছেন।
এমনই এক আইরিশ জমিদারকে পেয়েছিলাম সিটি ব্যাঙ্কে -আমার দ্বিতীয় বস নিল পাইক। সাড়ে ছ ফিট লম্বা, ক্ষীণ দেহ, ব্রিটিশ আর্মির প্রাচীনতম, সবচেয়ে উঁচু তলার পদাতিক বাহিনী গ্রেনাডিয়ার গার্ডসের সৈনিক ছিলেন, নিজেই জানিয়েছিলেন জিপ চালিয়ে ইউরোপ থেকে নাকি ভারত গেছেন একবার। তারপরে ক্র্যানফিল্ড কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জন করে সিটি ব্যাঙ্কে যোগ দেন, স্পেশ্যালিটি অয়েল অ্যান্ড গ্যাস। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ শুনে অফিসের অনেক খাঁটি ইংরেজ ভির্মি খেয়েছেন। নিল পাইক কারো সঙ্গে ঠিক বাক্যালাপ করতেন না, উদ্ধত আচরণে কথা ছুঁড়ে দিতেন, যাকে ইংরেজিতে বলে, হি টকস অ্যাট ইউ! পাইক যে আইরিশ, কাউন্টি কেরিতে তাঁর খাস মহল ছিল তা জানতাম না। একবার আমাদের দফতরের সকলকে, সে প্রায় জনা তিরিশ, কেন্টে তাঁর বিশাল ম্যানর হাউসে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেই অট্টালিকার সঙ্গে লাগোয়া দুটো ফুটবল ফিল্ডের চেয়ে বড়ো মাঠে তিনি যে খেলার আয়োজন করলেন, কেন কে জানে, সেটি ক্রিকেট নয়, ফুটবল নয়, বেসবল! আইন কানুন না জেনেই তাঁর আদেশে নেমে পড়লাম, কর্তার ইচ্ছায় ক্রীড়া। আইন কানুন না বুঝেই সেদিন জীবনে প্রথম ও শেষবারের মতো বেসবল ব্যাট হাতে ধরি। পরে পেল্লায় বাড়িতে ঢুকে চোখে পড়ল প্রায় চল্লিশ মিটার লম্বা, বিশ মিটার চওড়া বসার ঘরের দেওয়ালে মিউজিয়াম স্টাইলে বাঁধানো অজস্র ছবি, খোপে খোপে পিস্তল, রিভলভার, কুকরি। এলাহি ভোজনের পরে আমরা কৌতূহল প্রকাশ করলে মিসেস পাইক দেওয়ালের ছবিগুলি ঘুরে ঘুরে দেখালেন বললেন এই আমাদের ফার্ম, এই আমাদের বসতবাড়ি, বহু পুরুষের! লর্ড শিপ নেই, কি ভাগ্যে কাউন্টি কেরির জমি জমা থেকে গেছে।
আমাদের সহকর্মী হ্যাম্পস্টেডের জেরেমি বার্ডের স্ত্রী, মনস্তত্বের অধ্যাপিকা, শ্যারন বলেছিল, সব কিছুতেই পাইকের নিজের ইংলিশনেস প্রমাণ করার চেষ্টা বড়োই দৃষ্টিকটু মনে হয়! হি হ্যাজ এ চিপ অন হিজ শোলডার!
একেই বোধ হয় আমরা সাহেব সাজা বলি।
টুরিস্টের ডাবলিন
স্টিভেন’স গ্রিন থেকে সেন্ট প্যাট্রিক’স, ট্রিনিটি কলেজ, পার্লামেন্ট স্কোয়ার, লিফি নদী, কলেজ গ্রিন, এমনকি হা পেনি ব্রিজ হেঁটে ঘোরা যায়। আর কাছেই গ্রাফটন স্ট্রীট, যে কোন সংসারের আর্থিক পরিস্থিতির পক্ষে একান্ত হানিকারক; কারণ সেটি ডাবলিনের অক্সফোর্ড স্ট্রীট ।
গ্রাফটন স্ট্রিট
শেলবোর্ন হোটেল থেকে বেরিয়ে গ্রাফটন স্ট্রীট যাবার সময়কার একটি ঘটনা আজও আমাদের বাড়িতে বিশেষ কৌতুকের উদ্রেক করে থাকে। মায়ার তখন বছর খানেক বয়েস, প্র্যাম বা পুশ চেয়ারে তার ঘোরাঘুরি। দ্রুত গ্রাফটন স্ট্রীট যাওয়ার মানসে রোদিকা সেটা ঠেলে হোটেলের সদর দরজা দিয়ে বেরুতে যাচ্ছে, আমি যথারীতি পিছনে। এমন সময়ে সেখানে চৌকাঠ মতো কিছুতে মায়ার পুশ চেয়ারে ধাক্কা লাগলো। এমনটা হতেই পারে চেয়ারটাকে আবার সিধে করে নিলেই হয় কিন্তু সেটা একমাত্র সামলাতে পারেন মাতা, আমার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন পিতা নয়। ঠিক পরের মুহূর্তে বাইরে হুলুস্থুল ব্যাপার, কমোশন! বেরিয়ে দেখি হোটেলের দরজার বাইরে একটি ছোট খাটো জনতা। মায়া ফুটপাথে পড়ে কান্নাকাটি করছে, নিতান্ত বিব্রত মুখে রোদিকা দাঁড়িয়ে। মজার মুখে কনসিয়ার্জ বললে, “স্যার, দি লিটল গার্ল ওয়াজ নট ওয়েরিং হার সিট বেল্ট!” অর্থাৎ ঐ চৌকাঠের চোটে মায়া তার পুশ চেয়ার থেকে সরাসরি ফুটপাথে গিয়ে পড়েছে। লোকজন দাঁড়িয়ে গেছে, কত যে হাসি ঠাট্টা হলো, রোদিকার বিড়ম্বনা বাড়িয়ে মায়াকে একজনের কোল থেকে অন্যজনের কোলে ট্রান্সফার হতে দেখলাম। পরে রোদিকাকে বলেছি যে দরোজা দিয়ে একদিন নতুন ভারতের সংবিধান রচয়িতা ডক্টর আম্বেদকার প্রবেশ করেছিলেন সেই দরোজা দিয়েই তুমি আমাদের পরিবারের নবীনতম সদস্যাকে দূরে নিক্ষেপ করলে!
হা পেনি মানে হাফ পেনি! ব্রিজ ছিলো না, লিফি নদী পার হতে উইলিয়াম ওয়ালশের খেয়া নৌকোর ভাড়া ছিল আধ পেনি। ওয়ালশ নিজেই যখন ব্রিজ বানালেন, তিনি স্থির করলেন এপার ওপার যাবার টোল হবে একই , হা পেনি! ওয়াটারলু যুদ্ধের পরে ইংরেজ যাকে ওয়েলিংটন ব্রিজ নাম দিয়েছিল, স্বাধীন আয়ারল্যান্ড সেটিকে ডাকে পুরনো নামে – হা পেনি ব্রিজ!
হা পেনি ব্রিজ
মলি ম্যালোন নামের কোন মেছুনি, লিফি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নাকি কোনদিন ঝিনুক বেচত; সেটি ঐতিহাসিক সত্য না ফেক নিউজ কেউ জানে না কিন্তু এই মহিলা এবং তাঁকে নিয়ে বানানো গান সুইট মলি ম্যালোন আজ ডাবলিনের সিগনেচার টিউন! সেখানে নেওয়া সেলফি হবে আপনার ডাবলিনের সিগনেচার ছবি!
ডাবলিনের জনপ্রিয় মহিলা মলি ম্যালোন
ট্রিনিটি কলেজ চত্বরে নিখরচায় সারা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায় (ক্যান্টিনের কফির জন্য অর্থদণ্ড বাদে)। পয়সা লাগে আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে মূল্যবান, ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট, কাচের খাঁচায় বুক অফ কেলস দেখতে। রংচঙে শক্ত পারচমেন্ট কাগজে অষ্টম শতাব্দীতে লেখা ৬৪০ পাতার ক্রিস্টিয়ান বাইবেলের চারটি গস্পেল (ম্যাথু, জন, লুক, মার্ক), গ্রিক নয় ল্যাটিনে। রোমের পরেই চতুর্থ শতাব্দীতে আয়ারল্যান্ড প্রভু খ্রিস্টের বন্দনা আরম্ভ করে; বাকি ইউরোপের সেই ভজনালয়ে যোগ দিতে আরও অনেক বছর লেগে গেছে, সর্বশেষ এন্ট্রি লিথুয়ানিয়া ১৩শ শতাব্দীতে।
জার্মানিতে এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে গেলে খোঁজ করবেন হাউপটবানহোফটি (সেন্ট্রাল স্টেশন) কোথায় – সব ট্রেন ছাড়ে একই ঠিকানা থেকে। আমাদের হাওড়া শেয়ালদার মতো ডাবলিনে দুটি প্রধান স্টেশন, কনোলি থেকে ট্রেন যায় উত্তর মুখে-হাই স্পিড ট্রেন আপনাকে অন্য দেশ, বেলফাস্ট পৌঁছে দেবে সোয়া দু ঘণ্টায়, হাজার টাকা ভাড়া; হুসটন (লেখে Heuston) স্টেশন থেকে ট্রেন যায় দক্ষিণে ও পশ্চিমে সেখান থেকে শন ও আমি কর্কের ট্রেন ধরেছিলাম একদিন। আমাদের চেয়ার কার ইঞ্জিনের ঠিক পেছনে, পয়লা বগি। ট্রেন ছাড়বে বিকেল পৌনে ছটায়। শন আমাদের দুজনের মাঝের টেবিলে এক বোতল জেমিসন আর দুটি ছোট হুইস্কি গ্লাস রেখে বললে, একটু অপেক্ষা করতে হবে। আইরিশ রেলের আইন অনুযায়ী ছটার আগে মদ্য পান নিষিদ্ধ। তিন ঘণ্টার জার্নিতে ঠিক কতটা পান করেছিলাম জানি না কিন্তু মস্তিষ্ক ছিল পরিষ্কার। শন বলেছিল মনে রেখো অন্য হুইস্কি একবার পোড়ান হয়, জেমিসনের ভ্যাটে তিনবার!
ডাবলিন থেকে কর্ক প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার। গ্রীষ্মের দীর্ঘ অপরাহ্নের আলোয় দেখেছিলাম এক আশ্চর্য সবুজ দেশ। পাঁচশ বছরের নির্বিচার ইংরেজ লুণ্ঠনে, অত্যাচারে, দুর্ভিক্ষে (উনবিংশ শতাব্দীর আলু দুর্ভিক্ষ ইংরেজের আরেক কুকীর্তি) কঠোর দারিদ্র্যের কারণে আইরিশ তার সবুজ দ্বীপ, এমারেল্ড আইল ছেড়ে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান খুঁজেছে অন্যত্র। আইরিশ লোক সঙ্গীতে, পাবের গিটারে ছন্দ ও তালের সঙ্গে শোনা যায় এক অন্তহীন দুঃখের সুর। আয়ারল্যান্ড আমার জানা একমাত্র দেশ যেখানে গত দেড়শো বছরে জন সংখ্যা কমে গিয়েছে, আশি লক্ষ থেকে এখন পঞ্চাশ লক্ষ, বিদেশে বাস করেন আইরিশ মূলের এক কোটি মানুষ।
হয়তো তাই আয়ারল্যান্ড হালে পেয়েছিল এক মারাঠি প্রধানমন্ত্রী, লিও ভারাদকার!
টুরিস্ট বই, ম্যাপ আপনাকে ডাবলিন কাসল যেতে উৎসাহিত করবে। সেটা একটু দূরে, আধ ঘণ্টার হাঁটা পথ। এর চেয়ে ঢের দাপুটে দুর্গ ইউরোপে দেখেছেন; স্বচ্ছন্দে বাদ দিতে পারেন। বাদ দেবেন না আইরিশ হুইস্কি মিউজিয়াম, সেটাও ঐ গ্রাফটন স্ট্রীটে। যদিও আয়ারল্যান্ডে আছে প্রায় শ-খানেক ডিস্টিলারি, এই মিউজিয়ামটি তাদের কারোর অধীনে নয়। সম্পূর্ণ দল নিরপেক্ষ ভাবে দেশের হুইস্কির গৌরব গাথা গাওয়া হয় এখানে; যেমন দেড়শ বছর আগে কোনো ডিস্টিলারিতে আগুন লাগে; বহু ভ্যাট ভেঙ্গে গিয়ে ডাবলিনের পথে হুইস্কির প্লাবন বয়ে গিয়েছিল; কোনো চোট বা আঘাতে নয়, ঐ মুফতে মুখের পানে ধেয়ে আসা অতিরিক্ত হুইস্কি পানের কারণে তেরো জনের প্রাণ যায়।
জগতের আনন্দ যজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ! আইরিশ হুইস্কি মিউজিয়ামের সিঁড়ি
ইউরোপিয়ান বিয়ারের পুণ্যভূমি যদি জার্মানিক ইউরোপ, হুইস্কির পীঠস্থান আয়ারল্যান্ড (কিছু লোকের ভ্রান্ত ধারনায় স্কটল্যান্ড, সেটি একেবারেই ঠিক নয়)। দুনিয়ার অনেকে মানুষের সান্ধ্য উপাসনার প্রধান উপচার সেই সোনালি তরল পদার্থটি প্রস্তুত করার প্রথম লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল ১৬০৮ সালে, অধুনা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বুশ মিলস ডিস্টিলারিকে (সেদিন দেখলাম বিশ হাজার টাকার বোতল বিক্রি হচ্ছে)। স্কটল্যান্ডের ‘জনি ওয়াকার’ হাঁটতে শুরু করেছেন এই মাত্তর ১৮২০ সালে।
বুশ মিলস ডিস্টিলারি
হুইস্কির অরিজিনাল বানানটা আইরিশ - Whiskey যেটা আমেরিকানরা উদ্বাহু হয়ে গ্রহণ করেছে, তা ‘বুরবন’ হোক আর আর ‘জ্যাক ড্যানিয়েল’স’ হোক। স্কটল্যান্ডের এক অর্বাচীন লিখেছিল Whisky, অন্য আরও অনেক কিছুর মতন ইংরেজের দেওয়া সেই বানানটাই আমরা নিয়েছি।
বুশ মিলস ডিস্টিলারির কিছু মহার্ঘ হুইস্কি
আমার আয়ারল্যান্ড: পরকে করিলে আপন
যখনই গিয়েছি, সে রিপাবলিক হোক আর উত্তর আয়ারল্যান্ড হোক, যেখানে যার সঙ্গেই কথা বলেছি, মনে হয়েছে সে যেন আমার খুব চেনা, তার মনে অপরিচয়ের অনিশ্চয়তা নেই, সে একেবারে একান্ত আপন। গলওয়ের পাবে একজন বলেছিলেন পৃথিবীতে অচেনা কোন মানুষ নেই, আছে সেই সব বন্ধু যাদের সঙ্গে আপনার এখনো দেখা হয়নি (ইন দিস ওয়ার্ল্ড দেয়ার আর নো স্ট্রেঞ্জারস -ওনলি ফ্রেন্ডস ইউ হ্যাভ নট মেট বিফোর)
মাটি পৃথিবীর টানে মানব জন্মের ঘরে সাতটা দশক কেটে গেলো। কাজে অকাজে পাঁচ মহাদেশের প্রায় একশোটা দেশে গিয়েছি। মনে হয়েছে একমাত্র আইরিশ পারে পরকে আপন করে নিতে; কারণ তার কাছে দুনিয়ার কেউ পর নয়।
স্লাঞ্চে আয়রা, চিয়ার্স আয়ারল্যান্ড!
মাঝে মাঝে আরেক দিগন্তের ডাক শুনি, জানি বিদায় আসন্ন। আমার অতি প্রিয় আইরিশ আশীর্বচনটি আজ তাই ভাগ করে নিতে চাই সবার সাথে
মসৃণ হোক তোমার পথ
সুমন্দ বাতাস হোক তোমার সাথি
আলোকে উজ্জ্বল হোক তোমার মুখ
ক্ষেত তোমার ভিজে যাক নরম বৃষ্টির ধারায়।
আবার দেখা হবে অন্য দিনে, জানি তাই
আজ তোমায় রেখে গেলেম ঈশ্বরেরই কাছে
আইরিশ প্রার্থনা
May The Road Rise To Meet You