তিবেরিয়াসের সেতু, রিমিনি
রোমান রিমিনি
রুবিকন পেরুনো / টু ক্রস দি রুবিকন
কলুর বলদ, ডুমুরের ফুল, অগাধ জলের মাছ ইত্যাকার অজস্র বাংলা বাগধারা বা প্রবাদের সঙ্গে আমাদের প্রাত্যহিক পরিচয় আছে; সেটা শেখার জন্য স্কুলে যেতে হয় না। আমাদের স্কুলের বাংলা ইংরেজির শিক্ষক নগেন বাবু বলেছিলেন বাংলা লেখায় এমনি অলঙ্কার ব্যবহার করলে ভাষার সৌন্দর্য বাড়ে। কিন্তু শুধু লিখলেই হবে না, তুমি অমাবস্যার চাঁদ, কেন পূর্ণিমার নয়, সেটা বুঝিয়ে দিতে হবে।
ক্লাস নাইনে উঠে জানা গেল সেইসব বাংলা বাগধারাকে ইংরেজিতে বলে ইডিয়মস অ্যান্ড ফ্রেজেস, এবার সেগুলো শিখতে হবে। উলটো দিকের দোকান থেকে কিনতে হল হালকা সবুজ রঙের মলাটওলা একটি বই যা হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আগে টেস্ট পেপারের প্রশ্নবাণ সামলাতে ভীষণ কাজে লেগেছিল।
সেই বইতে পেয়েছিলাম ‘টু ক্রস দি রুবিকন’। সেটা কি বা কেন? বেড অফ রোজেস, স্টিচ ইন টাইম, চিপ অফ দি ওল্ড ব্লক এমনি কতো ইডিয়ম তো পেয়েছি, কিন্তু এটা আলাদা শোনায়। এক্ষেত্রে একটি ভৌগোলিক অবস্থানের উল্লেখ রয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা ছিল রুবিকন পার হওয়া মানে আপন অধিকারকে অতিক্রম করা,এমন জায়গায় পৌঁছুনো যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। যেমন লক্ষণ রেখা? সরহদ ছবিতে দেব আনন্দের মনের ভেতরে সুচিত্রা সেন স্থান পেয়েছিলেন, তাই বাড়ির উঠোনের দরোজায় দাঁড়িয়ে তিনি রাগিণীকে বলেন, গুলাবি, তেরি সরহদ য়হাঁ তক!
রুবিকন একটি নদী সেটা না হয় বোঝা গেল। আমরা তো আকছার নদী পার হয়ে থাকি, তা এই নদী পেরুলে কোন মহাভারত/বাইবেল অশুদ্ধ হবে? ক্রমশ জানলাম জুলিয়াস সিজারের নদী পার হওয়ার কাহিনি, সে কোন দূর দেশের গল্প।
রোম তখন প্রজাতন্ত্র। রাজা নয়, নির্বাচিত সেনেটররা দেশের নিয়ম নীতি নির্ধারণ এবং সেগুলি প্রয়োগ করার জন্য কনসাল নিযুক্ত করতেন। সেই কনসালের কর্মকাল এক বছরের, কেউ একাধারে রোমান রাষ্ট্রের চিফ একজিকিউটিভ অফিসার, সেনেটে পাস করা আইন জারি, তার তদারক করা তাঁর কাজ। রিপাবলিকের সীমানার বাইরে কনসালের ভূমিকা অন্য - এক সেনাপতি ও প্রশাসকের। ভদ্র মার্জিত রোমান সভ্যতার ধ্বজা তুলে ধেয়ে যাওয়া নয়, তাঁদের ছিল লাইসেন্স টু লুট। রোমের নামে অন্য রাজ্য জয় করে বিদেশে উপনিবেশ বানাবেন, নিজের খুশি মতন হাতে মাথা কাটবেন। রোমের আইন সেখানে খাটে না, এতা সে মোয়া! ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভের গুষ্ঠির পূর্বসূরি। উপনিবেশ থেকে নিজের শেয়ার এবং নিজস্ব রোমান লিজিয়নের খরচ খরচা বাদে বাকি লুটের লাভ পাঠিয়ে রোমের খাজানা ভরে দেবেন। কিন্তু কনসালের বর্বরতা, তাঁর বর্শার ভেল্কি চলবে রোমান রাজত্বের দাস, পরাজিত অত্যাচারিত প্রজাদের ওপরে, সেখানে কোন মানবিক বা সাংবিধানিক আইন মানার দায়িত্ব তাঁর ওপরে বর্তায় না।
এই কনসাল যখন রোমে ফিরবেন, তখন তাঁকে মানতে হবে রোমান আইন। তাঁর সৈন্য সামন্ত রেখে আসবেন উপনিবেশে বা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। রোম এক প্রজাতন্ত্র। অতএব তাঁর প্রবেশ হবে সাধারণ নাগরিকরূপে। সেনেট স্থির করবে তাঁর পরের পোস্টিং। কোনো শক্তিশালী রোমান কনসাল যাতে তাঁর লিজিয়নের শক্তিতে বলশালী হয়ে রোমের ক্ষমতা দখল করে রাজপাট না বসান, সেই কারণে তাঁর সবলে রোম প্রবেশের রাস্তাটি আইনত বন্ধ ছিল। বিদেশে কনসাল শের হতে পারেন, কিন্তু রোমে নয়। রোমে চলে রুল অফ ল, সেখানে কনসাল এক নাগরিক, সেনেটের আদেশে কাজ করেন।
সাল খ্রিস্টপূর্ব ৪৯।
দশ বছর ধরে কনসাল জুলিয়াস সিজার আজকের ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন এমনকি ব্রিটেন জয় করে ফিরছেন রোমে, তাঁকে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে আইন মোতাবেক তিনি যেন তাঁর সেনাদের রোমান সীমান্তে রেখে কেবলমাত্র দেহরক্ষী সহ রোম প্রবেশ করেন। অলিখিত ফরমান- সৈন্য বাহিনীর পুরোভাগে এলে সেটি বিদ্রোহ বিবেচিত হবে।
এক সময়ে তিনজন কনসাল ছিলেন রোম রিপাবলিকের রাইজিং স্টার, সিজার, ক্রাসুস এবং সিজারের জামাই পম্পেই (একমাত্র কন্যা জুলিয়ার স্বামী) – একত্রে তাঁদের বলা হতো ট্রায়ামভিরেট। বহু রাজ্য বিজয় করে সিজার আসছেন রোমে, খাতিরের কমতি হবে না। ক্রাসুস তখন বেঁচে নেই, এখন তাঁর জামাই কি সেনেটের সঙ্গে বসে কোনো প্যাঁচ কষছেন? আল্পস পর্বতমালার পাদদেশ ধরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে নয়ই জানুয়ারি সিজার পৌঁছুলেন রাভেন্না (পরে রোমান রিপাবলিকের শেষ রাজধানী), সেটি কনসাল সিজারের ট্রান্স আলপাইন উপনিবেশের প্রত্যন্ত শহর, সেখানে তিনি প্রশাসক। সিজারের ভাষ্যকারের বর্ণনা অনুযায়ী রাভেন্নায় নৈশ ভোজনের পরেই রাতের অন্ধকারে তাঁর লিজিয়ন নিয়ে সিজার বেরিয়ে পড়লেন দক্ষিণ দিকে, পরের শহর দুশ বছর আগের স্থাপিত রোমান আরমিনুম (রিমিনি)। সেখানে যাওয়ার পথে পড়ে একটি জলধারা।
এগারোই জানুয়ারি তাঁর ত্রয়োদশ লিজিয়ন সহ সিজার উপস্থিত হলেন রোমের উত্তর পূর্ব সীমানায়, শীতে ক্ষীণকায়া রুবিকন (ল্যাটিন/ ইতালিয়ানে রুবিকোনে) নদীর ধারে। সিজারের সামনে দুটি পথ– নিরস্ত্র হয়ে জনা কয়েক সঙ্গী-সাথি নিয়ে তিনি যেতে পারেন রোমে, সেনেটের সামনে হাজির হয়ে জানতে চাইবেন, অতঃ কিম? বোনাস? পদোন্নতি? অথবা শক্তিমান সিজার তাঁর অজেয় লিজিয়ন সহ অজস্র ঘোড়ার ক্ষুরের ধুলো উড়িয়ে সেনেটের মনে ত্রাস সঞ্চার করে রোম পৌঁছুবেন, ভিক্ষা নয়, দাবি করবেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান। তিনি হবেন ডিক্টেটর!
রিমিনিতে জুলিয়াস সিজারের মূর্তি
রোমের সংবিধানে ডিক্টেটরের স্থান ছিল। ছ-মাস বা এক বছরের জন্য সেনেট কাউকে সে পদে মনোনীত করতে পারতেন। আইন অনুযায়ী নিযুক্ত তিনি কিন্তু নির্ধারিত সময়ের জন্য, তাঁদের কর্মকালে কনসালের কোন জবাবদিহির দায়িত্ব ছিল না। কাল পূর্ণ হলে ডিক্টেটর পদত্যাগ করতে বাধ্য হতেন। এখন সিজারকে সেনেটের দয়া ভিক্ষা করতে হবে, তার ওপরে তিনি জানেন না তাঁর অনুপস্থিতিতে পম্পেই কোন কলকাঠি নেড়ে রেখেছেন। কয়েক মাস আগেই সেনেট তাঁকে জানিয়েছেন সিজার যেন তাঁর অস্ত্রত্যাগ করে সত্বর রোমে ফিরে আসেন, গল প্রদেশ শাসনের জন্য আরেকজনকে গভর্নর পদে মনোনীত করা হবে।
সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়নি, সিজার খুব ভালোই জানতেন সৈন্য নিয়ে রোমের সীমানা অতিক্রমের অর্থ কী। রুবিকনের তীরে দাঁড়িয়ে তাই কোন ঐশ্বরিক ইঙ্গিত খুঁজেছিলেন। এমন সময় শুনলেন দূরে কোথাও কেউ একটি ভেঁপু বাজাচ্ছে। সেটি শোনামাত্র সিজার ট্রাম্পেট হাতে তুলে নিয়ে বলেছিলেন, এই ঈশ্বরের অভীষ্ট পথ, এদিকেই আমরা এগুবো। আলেয়া ইয়াক্তা এস্ত (দি ডাই ইজ কাস্ট, পাশার দান পড়ল)!
এত বলি সিজার সসৈন্যে রুবিকন নদী ও সেই সঙ্গে তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করলেন। তিনি জানতেন না তাঁর এই অ্যাকশন দুনিয়ার বহু দেশের বহু ভাষায় খ্যাত হবে – টু ক্রস দি রুবিকন; যার অর্থ আছে, যেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া, এস্পার ওস্পার, যা হয় হবে, পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন।
হঠকারিতা?
তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের পথ বেছে নিলেন। রিপাবলিক চুলোয় যাক, সিজার আর কনসাল নয়, সময়কাল বেঁধে দেওয়া ডিক্টেটর নয়, তিনি রোমের একছত্র অধিপতি হতে চান, রাজা নয়, একনায়ক হিসেবে, যেটা সংবিধানে স্বীকৃত।
রোমান ফোরাম, রিমিনি
আজ রিমিনিতে যেখানে উত্তর-দক্ষিণ পথ (কারদো) আর পূর্ব-পশ্চিম পথ (দেকামেনুস) এসে মিলেছে, সেখানে ছিল আরিমিনুম শহরের রোমান ফোরাম। রুবিকন পেরিয়ে সিজার তাঁর ফৌজ সহ ঘণ্টা দেড়েক বাদে সেইখানে পৌঁছুলেন। তিনি জানতেন রোমের আইন তিনি একা ভাঙেননি, তাঁর সঙ্গে ছ-হাজার লিজিওনেয়ার রোমের চোখে সেই একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে। রোমের শপথ নিয়ে তাঁরা সৈন্য বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, এবার সিজারের সাথি হয়ে রোমের বিরুদ্ধেই বিশ্বাসঘাতকতা করবেন (আমাদের আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল)। সেদিন আরিমিনুম ফোরামে পৌঁছে একটি প্রস্তরখণ্ডের ওপরে দাঁড়িয়ে তাঁর লিজিয়নকে সম্বোধিত করে বলেছিলেন, আমাদের অভিযান রোমের পানে, গৃহ যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী কিন্তু আমরা বিজয়ী হবো।
এই ভবিষ্যতবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল; তৃতীয় কনসাল ক্রাসুস ইতিমধ্যে মৃত, সিজার তাঁর বাহিনী নিয়ে রোম অভিমুখে যাত্রা করেছেন শুনেই লক্ষণ সেনের স্টাইলে পম্পেই পলাতক, সেনেটররা আপাতত গা ঢাকা দিলেন। সর্বনাশ সমুৎপন্ন দেখে পরে রোমান সেনেট সিজারকে প্রথমে ছ-মাসের, পরে এক বছরের এবং আইন বদল করে আজীবন ডিক্টেটর পদে অভিষিক্ত করলেন। রোমান রিপাবলিকের মৃত্যুদণ্ডে সই করলেন তাঁদেরই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা।
আজীবন একনায়ক (ডিক্টেটর পারপেটুও) হবার অধিকার অর্জন করে রোমান রিপাবলিকের অন্তিম ঘণ্টিটি বাজিয়ে গেলেন জুলিয়াস সিজার। ইতিহাস এমন ঘটনা দেখবে বারবার, ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় এসেছিলেন সম্পূর্ণ সাংবিধানিক পদ্ধতিতে।
সিজার এই নবলদ্ধ ক্ষমতা, উচ্চাসন বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি। এক বছরের মধ্যেই ব্রুটাস ও তাঁর সাথিরা রোমের ফোরামে সিজারকে হত্যা করেন। এর পরের ঘটনাবলি দ্রুত– রিপাবলিকের রক্ষক ব্রুটাস যুদ্ধে হারলেন, সিজার ‘পুত্র’ অগাস্টাস হলেন সম্রাট।
পাঁচশো বছরের রোমান রিপাবলিকের অবসান হলো।
রুবিকন নদী অতিক্রম করে সিজার যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, তারই অবধারিত পরিণতি রিপাবলিকের অন্ত্যেষ্টি।
তাই সেই ফ্রেজ – টু ক্রস দি রুবিকন।
খ্রিস্ট পূর্ব ৪৯ সালের ১১ই জানুয়ারি সকালে জুলিয়াস সিজার রোমান ফোরামে তাঁর লিজিয়নের সামনে তাঁর ভবিষৎবাণী করেছিলেন, আজকের রিমিনির পিয়াতসা ত্রেই মারতিরে, ঠিক সেইখানে আছে একটি পাথরের পোডিয়াম। তাতে লেখা
তোমরা গৃহযুদ্ধে হবে বিজয়ী
CAESAR DICT RUBICONE SV PERATO CIVILI BEL COMMILIT SVOS HIC IN FORO
মোটামুটি অর্থ - সিজার বলেন রুবিকন পার হয়ে তোমরা গৃহযুদ্ধে বিজয়ী।*
জুলিও সেজারি ডিকট পারেপেটুও
রিমিনির পুরনো রোমান ফোরাম, আজকের পিয়াতসা ত্রে মারতিরির একধারে জুলিয়াস সিজার দাঁড়িয়ে আছেন, তার পেডেস্টালে লেখা
GIULIO CAESARI
DICT PERPETUO
সিজারের আজীবন ডিক্টেটরশিপ অনুমোদিত হয়েছিল রুবিকন পেরুনোর চার বছর বাদে। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে এই স্মারক পরবর্তী কালে স্থাপিত, কোন তারিখ অবশ্য দেওয়া নেই।
বরানগর থেকে এসে পৌছুলাম স্কটিশ চার্চ কলেজে। বাংলা স্কুল থেকে এসেছি, স্টেটসম্যান কাগজের পাঠোদ্ধার করাই দুঃস্বপ্ন। কলেজের বারো নম্বর ঘরে প্রয়াত অধ্যাপক সুশীল মুখার্জি আমাদের পড়ালেন জুলিয়াস সিজার, ছ-দশক পেরিয়ে আজও মনে আছে সেই অসামান্য পাঠ, কী অবলীলাক্রমে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন সিজারের রোমে, শেক্সপিয়ারের ইংরেজিতে। দৈনন্দিন জীবনে কাজে লেগেছে অজস্র সংলাপ- ব্যাঙ্কে কেউ কঠিন কোন প্রস্তাব নিয়ে এলে বলেছি- ইন টু হোয়াট ডেঞ্জার উড ইউ লিড মি? ইজ দিস মাই আইডস অফ মার্চ? কাওয়ার্ডস ডাই মেনি এ টাইমস বিফোর দেয়ার ডেথস।
সুশীল বাবু বলেছিলেন দেখো, নাটকের হিরো জুলিয়াস সিজার। তিনি মারা গেলেন নাটকের ঠিক মাঝখানে, তৃতীয় অঙ্কে, অথচ সিজারের দীর্ঘ ছায়া (সিজার’স লঙ শ্যাডো) আচ্ছন্ন করে রাখে সকল চরিত্র এবং ঘটনাকে।
অনেক হেঁটেছি রোমে, মার্কাস অরেলিউসের প্রাচীর থেকে পান্থেওন, তেরমি দে কারাকালা। রোমান ফোরামে দাঁড়িয়ে দু-প্রস্থে তিন ছেলে মেয়েকে শুনিয়েছি, শোনো, লেনড মি ইয়োর ইয়ারস! এইখানে দাঁড়িয়ে মার্ক অ্যানটনি বলেছিলেন, আই কাম টু বেরি সিজার, নট টু প্রেজ হিম! দি ইভিল দে ডু লিভস আফটার দেম/দি গুড ইজ অফট ইন্টারড উইথ দেয়ার বোনস।
কিন্তু রোম শহরে জুলিয়াস সিজার খানিকটা পিছনের পাতায় চলে যান, তার ইতিহাসে আরও অনেক নাটক, নায়ক, খলনায়ক।
জুলিয়াস সিজার- একনায়ক চিরন্তন
জুলিয়াস সিজারকে একান্তে পেয়েছি রোমে নয়, রিমিনিতে।
একষট্টি নম্বর কাশীনাথ দত্ত রোডে নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরের দোতলায় পূজনীয় নগেন বাবুর ক্লাস থেকে স্কটিশ চার্চের বারো নম্বর ঘরে শ্রদ্ধেয় সুশীল বাবুর ক্লাস অবধি যিনি আমাকে ছেয়ে ছিলেন সেই জুলিয়াস সিজারের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা, এইখানে, রিমিনির এই রোমান ফোরামে।
আমার একটি বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হলো।
পুনশ্চ:
রোমান রুবিকন তার নাম হারিয়ে দীর্ঘদিন পরিচিত ছিল ফিউমিচিনো বলে (ইতালিয়ানে ফিউমে মানে নদী )। মুসোলিনি এই ঐতিহাসিক নামটি পুনরুদ্ধার করেন। রিমিনি থেকে রাভেন্না যাবার পথে পড়ে। প্রস্থে এটি আমাদের আদি গঙ্গার সমান।
জুলিয়াস সিজারের একমাত্র বৈধ সন্তান জুলিয়া। আপন ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য সিজার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পম্পেইর সঙ্গে জুলিয়ার বিয়ে দেন। পম্পেই জুলিয়ার চেয়ে তিরিশ বছরের বড়ো, বিবাহ সুখের হয়েছিল কিন্তু জুলিয়া সন্তান প্রসবকালে মারা যান, তাঁর বয়েস মাত্র কুড়ি। পুত্রহীন জুলিয়াস সিজার আপন উইলে মাতৃ কূলের হিসেবে প্রপৌত্র অক্টেভিয়ানকে তাঁর সম্পত্তি এবং সকল খেতাব দান করেন। বিধাতার এমন বিচিত্র লীলা, জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর দেড় দশকের মধ্যে অক্টেভিয়ান ডিক্টেটর থেকে হলেন সম্রাট অগাস্টাস, রিপাবলিকের অন্ত্যেষ্টি যজ্ঞ করে হলেন একচ্ছত্র রোমান সম্রাট, যা ছিল জুলিয়াস সিজারের স্বপ্ন।
অগাস্টাসের আর্চ, তিবেরিউসের সেতু
নগরদ্বারে তোরণ নির্মাণ করে বিজয়ী বাহিনীকে অভ্যর্থনা জানানোর রীতি সুপ্রাচীন, কিন্তু মনে রাখা ভালো আরও অনেক কিছুর মতন এটি একটি নিছক রোমান অবদান। মিনিট পনেরো কি আধ ঘণ্টা কিছু অশ্বারোহী অথবা পদাতিক বাহুবলী একবার সেখান দিয়ে পেরুবেন বলে পেল্লায় গেট বানানোটা ফারাও এবং গ্রিকরা হয়তো অর্থের অপচয় বিবেচনা করেছিলেন। যেসব বিজয় তোরণ আমাদের খুব পরিচিত যেমন শঁজে লিজের আর্ক দ্য ত্রিউম্ফ, বার্লিন ব্রান্ডেনবুর্গারটোর বা ফোরো রোমানায় কনসটানতিনের আর্চ- তার নিচ দিয়ে কোন সৈন্য বাহিনী কখনো মার্চপাস্ট করে নি। বর্ধমানের বিজয় তোরণেও নয়।
ইতিহাসের প্রথম আর্চ কোন বিজয়ীকে স্বাগত জানায়নি।
অগাস্টাসের আর্চ
দু-হাজার বছর আগে রোম থেকে আদ্রিয়াতিক উপকূলের আরমিনুম পর্যন্ত পৌঁছুনোর রাজপথ ভিয়া ফ্লামিনিয়াকে সম্পূর্ণ সংস্কার করেন সম্রাট অগাস্টাস। এই উৎসব উপলক্ষে নগর প্রাচীরের দক্ষিণ প্রান্তে নির্মিত হয়েছিল আর্ক দা’গুসতো। সন খ্রিস্টপূর্ব ২৭।
মুসোলিনির সেনা রিমিনির প্রাচীন দেওয়াল ভাঙচুর করেছিল, তবে এটিকে দয়া করে অক্ষত রাখে। তাই শহরের দক্ষিণ সীমান্ত ও ভিয়া ফ্লামিনিয়াকে নির্দেশ করে আজও দাঁড়িয়ে আছে ইউরোপের প্রথম আর্চ।
রাজপথের প্রাথমিক উদ্দেশ্য আমাদের ক থেকে সিধে খ পৌঁছে দেওয়া। মেসোপতেমিয়া, মহেঞ্জোদারোয় আমরা পেয়েছি সিধে রাস্তা, গ্রিড সিস্টেম। সভ্যতার ইতিহাসে কোথায় যে এই সারল্য একদিন হারিয়ে গেল! আমাদের পদুমা গ্রাম থেকে খাগড়ার মোড়ে বাস ধরতে যাবার পথটি ছিল বাংলা দ এর আকারে, প্রথমে সিধে গিয়ে হঠাৎ সমকোণে ডাইনে মুড়ে আবার সমকোণে বাঁ দিকে ঘুরে গেছে, বাস স্টপের দূরত্ব বেড়ে হয় দ্বিগুণ। শুনেছি এই রাস্তা বানানোর সময়ে আমার জ্যাঠামশায় ইউনিয়ন বোর্ডের অধ্যক্ষ ছিলেন; অবশ্যই কিছু ক্ষমতাবান লোকের জমি বাঁচানোর চাপ এড়ানো তাঁর পক্ষে কঠিন হয়েছিল।
ইউরোপ এসে ইস্তক ভেবেছি রোমানদের টাউন প্ল্যানিং সিস্টেম বাকি ইউরোপ কেন যে শিখে উঠতে পারলো না! লনডিনিউম, আজকের লন্ডনের ভিত রোমানদের খোঁড়া কিন্তু ইংরেজ তার স্বভাবসিদ্ধ কুটিলতায় সেটিকে দিয়েছে জিলিপির আকৃতি। কোথাও না বেঁকে দু-মাইল সোজা চলে গেছে এমন রাস্তা বিরল। সারা যুক্তরাজ্যে গ্রিড দেখা যায় একমাত্র এডিনবরায়, তার কৃতিত্ব স্কটদের।
করসো দা গুসতো - দু-হাজার বছর কেটে গেলে পর
আজ থেকে ঠিক ২২০০ বছর আগে তৈরি আরমিনিউমে অগাস্টাসের আর্চ থেকে সোয়া কিলোমিটার পথ সিধে চলে গেছে উত্তর-দক্ষিণ (কারদো)। রোমান ফোরামে তাকে অতিক্রম করে পুব-পশ্চিমের পথ (দেকামেনুস)। চারপাশে আজ আধুনিক দোকানপাট কিন্তু আপনি হাঁটেন রোমানদের পেতে দেওয়া পাথরের ব্লকের ওপর দিয়ে, দু-হাজার বছরে লক্ষ লক্ষ রথ, অশ্বারোহী, পথচারী তার কোন ক্ষয়সাধনে সক্ষম হয়নি। রোমান ফোরামে আজ কলোসিয়াম নেই তবে পাঁচশো বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে তোরে দেল অরোলগিও – তাতে আছে পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার, রাশিচক্র, দেখায় চাঁদের হ্রাস বৃদ্ধি। একাধিক ভূমিকম্প সত্ত্বেও পাঁচশ বছরে তার কাঁটা থামেনি কখনো।
পাঁচশ বছরের প্রাচীন ঘড়ি
আরমিনুম শহরের উত্তর প্রান্তে মারেকিয়া নদী, তার অপর তীরে বোরগো জুলিয়ানো। আর্চ নির্মাণের সময় শহরের উত্তর সীমান্তে সম্রাট অগাস্টাস একটি সেতু বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে পথে রথযাত্রার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। অগাস্টাসের মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় রোমান সম্রাট তিবেরিউস সেতুর কাজ সম্পূর্ণ হলে পাথরের গায়ে নিজের নামটি খোদাই করে গেলেন। রোমান ইতিহাসে প্রথম পাথুরে আর্চ ব্রিজ রোমে, তিবার নদীর ওপরে ফাব্রিচিউস সেতু তার দুটো খিলান। রিমিনির পাঁচটা খিলানওলা পন্তি দি তিবেরিউস দ্বিতীয় প্রাচীনতম রোমান ব্রিজ, মাইক্রোসফট গুগলের আগে বানানো এই ব্রিজ আজও দাঁড়িয়ে। হাঁটতে চোখে পড়ে পেল্লায় পাথরের ওপরে খোদাই করা আছে সেই ব্লকের নম্বর। পুরো দু হাজার বছর ধরে তার ওপরে মানুষ গরু ঘোড়া গাড়ি এবং হালে মোটরগাড়ি চলেছে।
নম্বর দেওয়া পাথর ২৭ বিসি
আমাদের দেশে প্রায়ই ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ার খবর পাই; মনে হয় এতো বছরে আমরা কি কিছুই শিখিনি?
পরিশেষে, ভাবী টুরিস্টদের সুবিধার্থে
রিমিনির জনসংখ্যা দেড় লক্ষ। তার আঠারো কিলোমিটার লম্বা বিচ বরাবর সাজানো কেদারা ও ছাতার সারি দেখলে মনে হয় আরেকটা শহরের হাট বসে গেছে। সেখানে সূর্য, উষ্ণতা ও বালুকা বেলার খোঁজে বছরে আসেন অন্তত ছ-লক্ষ মানুষ। সমুদ্রে লম্ফ ঝম্পের পরে টুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য নানান আয়োজন আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘ইতালি ইন মিনিয়াতুরা’। পুরো ইতালি না ঘুরে যদি শর্টকাটে একবার দেশের দ্রষ্টব্য বস্তুগুলি চাক্ষুষ করতে চান (তুষার রায় যেমন বলেছিলেন, সবেরই ছোট সংস্করণ হয় হে) যাবেন সেখানে। সমুদ্রতীরে মেরিনার মধ্যে ইতালির বিশিষ্ট আকর্ষণগুলির সংক্ষিপ্ত চেহারা যেমন ফ্লোরেনসের উফিজি, রোমের কলোসিউম; যারা রটারডাম গেছেন তাঁরা হল্যান্ডের শহরগুলির বনসাই ভার্শন নিয়ে সৃষ্ট মাদুরোদাম অবশ্যই দেখেছেন। ইতালি ইন মিনিয়াতুরা তারই সমগোত্রীয়।
রিমিনির দীর্ঘ বিচ - আঠারো কিমি
বিচে লক্ষ মানুষের ভিড় দেখে একটা কথা মনে হলো। ইতিহাসের রোমানরা আপন গৃহে ঠাণ্ডা গরম দুই প্রকারের জলে স্নানের ব্যাপক ব্যবস্থা করেছিলেন জানি, কিন্তু নেরো বা কালিগুলা কোন সৈকতে জলকেলির আসর বসিয়েছিলেন এমন বিবরণ পড়েছি বলে মনে হয় না।
আমার ভ্রমণ ডায়েরিতে ভোজন আলোচনাকে এড়িয়ে চলি বলে কেউ অভিযোগ করেছেন। এটি একটি সাতিশয় বিপজ্জনক এলাকা, বিবাদের ধূমকেতু। বলকানের সাতটি দেশে একই খাদ্যবস্তুর আট খানা নাম। সিরিয়া লেবানন ইজরায়েল তুরস্ক ইরাক হুমুসের পিতৃত্ব দাবি করে; সে লড়াই থামবার নয়। তবে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে যখন একটা দেশ বহুধা হয়ে যায় খাবারের নামে; শার্ল দি গল একবার বলেছিলেন যে দেশে চিজের সংখ্যা ২৪৭, সেই দেশকে কি শাসন করা সম্ভব? আজ অবধি সমস্ত ইতালিয়ান পাস্তার নাম ও বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত হয়নি। তবে তাজা এবং শুকনো মিলিয়ে মোটামুটিভাবে সেটা ৩০০র বেশি বলে মনে করা হয়, সিসিলিতে একজন বললেন হাজার। আমাদের মতন অগা লোকেরা পাস্তাকে তিনটে ভাগে ফেলবার চেষ্টা করে থাকি– রোগা লম্বা (স্পাঘেত্তি, ফেতুচিনি), রোগা শুকনো (রিগাতোনি), পুর ভরা (রাভিওলি, তরতেলিনি)। আমার মনে হয় এইটুকু বিদ্যে নিয়ে ইতালিতে খাবার অর্ডার করা যায়। তুরিনে একবার মেনু না দেখে, কিছু না ভেবেই বলে ফেলেছিলাম কী কী পাস্তা পাওয়া যায়। এমন একটি আস্ত গর্দভকে সামনে পেয়ে পরিবেশক প্রায় চোখ বন্ধ রেখে বিড়বিড় করে দু ডজন নাম বলে গেলেন। রোদিকা কোনমতে আমার আকাট নির্বুদ্ধিতার জন্য ক্ষমা চেয়ে স্পাঘেত্তি কার্বোনারা অর্ডার করে (তিরিশ বছর যাবত দেখে যাচ্ছি রোমানিয়ানরা মনে করে তাদের মাতৃভাষা খুব দ্রুত বললে সেটা ইতালিয়ান শোনায়)।
ভোজন আয়োজন
আপনারা জানেন রোমে পিৎজা রোমানা অথবা নেপলসে পিৎজা নাপোলিতানা পাওয়া যায় না; রিমিনি রাভেন্নাতে পেলাম নতুন কিছু, পিয়াদিনা, যা পিৎজা নয়, খানিকটা আমাদের নিজামের রোলের মতন। আপনার পছন্দ মতন পুর ভরে দিয়ে গোলাকৃতি পাতলা রুটিকে (ফ্ল্যাট ব্রেড) চার ভাঁজে আপনার টেবিলে হাজির করে। মরতাদেলা এবং পারমাজান চিজ অসাধারণ। আমার এক ইতালিয়ান খদ্দেরের কারণে সেটি জেনেছিলাম আগেই।
এমিলিও রোমানিয়া প্রদেশকে ভোজন বিলাসীর স্বর্গ বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আজকাল মূল ইতালিয়ান খাবার আমাদের দেশে বেশ পরিচিত তাই রিমিনিতে আপনার চেনা খাবারগুলি বীরদর্পে অর্ডার করতে পারেন, দামে লন্ডনের অর্ধেক, গুণে অতুলনীয়।
*জুলিয়াস সিজার মনে করতেন দিনপঞ্জি হওয়া উচিত নৈর্ব্যক্তিক, তাই তাঁর লেখায় কখনো উত্তম পুরুষ ব্যবহার করেননি, শিলালিপিতেও নয়। যদিও পন্তুসের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ জয়ের খবর পৌঁছে দেওয়ার সময়ে সেনেটের জন্য প্রস্তুত রিপোর্টে তিনি লিখেছিলেন
ভেনি ভিদি ভিচি!
এলাম দেখলাম জয় করলাম।