“যা, যা বলে গেছিলে সব”। রান্নাঘরে ঢুকে শুভময়ীদেবী ঢাকনা তুলে দেখতে লাগলেন সব বাটিগুলি। খুব খুশি হলেন সব কিছু দেখে। সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, প্রত্যেকটি রান্না সযত্নে ঢাকা দেওয়া। তিনি হাসি মুখে ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, “দারুণ রেঁধেছিস মনে হচ্ছে? কেমন হয়েছে রে”?
“কেমন হয়েছে, তা তো জানিনা, তুমিই তো খেয়ে বলবে কেমন হয়েছে”।
“এ বাবা, তুই চেখে দেখিস নি? একটু একটু চেখে দেখবি তো, নুন মিষ্টি ঠিক হল কিনা”?
“না, না। তুমি খাওয়ার আগে আমি খাবো? সে আমি কক্খনো পারব না”।
“পাগলি কোথাকার। তোর মা আর দিদুকে বলেছিলি তো? কখন আসবে?”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছবি বলল, “এসে যাবে এখনই। ততক্ষণ তুমি চানটা করে নাও না”।
“সেই ভাল – চট করে চানটা সেরে আসি।
সকলের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর, শুভময়ীদেবী মালতীদের নিজের ঘরে ডাকলেন, বললেন, “মালতী তোমাদের সঙ্গে ছবির ব্যাপারে কিছু কথা আছে”। ওদের সঙ্গে ছবিও এসেছিল, শুভময়ীদেবী ছবিকে বললেন, “আমাদের বড়োদের কথার মধ্যে তোর তো থাকা চলবে না, ছবি। সকাল থেকে তোর অনেক খাটনি গেছে, তুই বরং, যা, একটু বিশ্রাম করে নে…”।
ছবির মোটেই ইচ্ছে হচ্ছিল না এঘর থেকে যাওয়ার, তবু মামীর আদেশ তাকে মানতেই হবে। বেরিয়ে গিয়ে শুভময়ীদেবীর ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিল। বন্ধ দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিট্টুর ঘরে গেল। এ বাড়িতে কাজে ঢুকে থেকে, বিট্টুর বিছানার পাশের মেঝেতেই সে বিছানা পাতে। রাত্রে সেখানেই সে শোয় – মাঝে মাঝে দুপুরেও। বিট্টু “একান্ত সহায়”-এ চলে যাওয়ার পর – এ ঘর এখন শূণ্য, শূণ্য বিট্টুর বিছানাও। বিছানার পাশে একটা টুল নিয়ে খোলা জানালার সামনে বসল ছবি। এদিকের জানালা দিয়ে কমপ্লেক্সের ছোট্ট পার্কটা চোখে পড়ে। ওখানে স্লিপ আছে, আছে দোলনা, দুটো সি-স। আছে বেশ কিছু সিমেন্টের বেঞ্চি। আর পার্কের চারপাশ ঘিরে চওড়া বাঁধানো পায়ে চলার পথ আছে। সকাল সকাল বড়োরা ওই পথে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে…। বিকেলে বাচ্চারা আসে খেলতে। সন্ধের দিকে মহিলারা আসে বেঞ্চে বসে গল্প করতে। এই মধ্য দুপুরে পার্কটা নির্জন, কেউ নেই।
শূণ্য এই ঘরে বসে, শূণ্য ওই পার্কের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, ছবির দুশ্চিন্তাটা আরও বাড়ল। তাকে আড়াল করে, তার মা আর দিদুকে কী বলতে ডাকল মামী? সে কথা এত গোপনই বা কেন? তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথাই যদি হয় – তার জন্যে এত ঢাকঢাক-গুড়গুড় কেন? কেনই বা এত আদর করে তার মা আর দিদুকে খাওয়ানোর আয়োজন? কথাটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না ছবি। মামী কী ভাবছে – এই বাড়ীর কাজ থেকে তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে – একথা শুনলে সে ডুকরে কেঁদে উঠবে? ছবির প্রতি তার মামীর এতটাই সহানুভূতি? নাকি…
কথাটা হঠাৎ মনে আসতে ছবির শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এল হিমেল স্রোত। তার মাথা ঘুরে গেল। জানালার বাইরে পার্কের সবুজ ঘাস, বাচ্চাদের খেলার সরঞ্জাম সবই কেমন ঝাপসা হয়ে এল তার চোখের সামনে। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল চুপ করে…। মামী কি কোন ভাবে জেনে গেছে মিঠুদিদির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা? যে সম্পর্ক সে নিজেই চুকিয়ে দিয়েছে বেশ কয়েক মাস আগে? তার মা এবং দিদু এসব কথা শুনলে যে পাথর হয়ে যাবে। মামী কী করে জানল? আর যদি জেনেই থাকে তাকেই তো সরাসরি বলতে পারত। তা না করে মা আর দিদুকে ডেকে আনল এসব কথা বলার জন্যেই…! ভয়ে আর লজ্জায় তার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে এল।
মালতী খুব ধীরে ধীরে ছবির ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে এল। ভেবেছিল মেয়েটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথায় কি – জানালার ধারে চুপটি করে বসে আছে – দুহাতে মুখ ঢেকে…। খুব অবাক হল মালতী – ছবি এভাবে বসে আছে কেন? শরীর খারাপ নয় তো? নিঃশব্দে ছবির পাশে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত রাখল মালতী, মমতামাখা গলায় বলল, “কী হয়েছে রে, মা? মাথা ধরেছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
মাথায় হাতের স্পর্শে ছবি চমকে উঠেছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মা। ছবি মাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মালতী অবাক হল খুব – ছবিকে এতটা অসহায় ভাবে কাঁদতে বহুদিন দেখেনি। সেই ওর বাবা মারা যাওয়ার সময় ছাড়া। ছবির মাথাটা বুকে চেপে ধরে, মালতী কান্নাধরা গলায় বলল, “কী হয়েছে মা? কীসের কষ্ট তোর? হঠাৎ এভাবে কাঁদছিস কেন - একা একা বসে?”
দুজনে দুজনকে ধরে চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ। ছবির কান্নার বেগ কিছুটা কমতে, মালতী ছবির মুখটা ধরে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “পাগল মেয়ে, কী হয়েছে বলবি তো? কাঁদছিস কেন? ওঘরে তোর মামী তোকে ডাকছে – চল – খুব ভালো খবর আছে…”।
নিজেকে সামলে নিয়ে ছবি কান্নাধরা গলায় বলল, “তোমাদের গোপন কথাবার্তা সব হয়ে গেল?”
মালতী এবার হেসে ফেলল, বলল, “অ…ও ঘর ছেড়ে তোকে চলে আসতে বলার জন্যে তোর অভিমান হয়েছে? তার জন্যে এত মনখারাপ – কান্না, পাগলি কোথাকার? চ ওঠ, মামী ডাকছে, অনেক কথা আছে…”।
১৯
মেয়েকে নিয়ে মালতী শুভময়ীদেবীর ঘরে ঢুকতেই শুভময়ীদেবী হেসে বললেন, “ কি রে, ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি? চোখগুলো ফোলা ফোলা লাগছে। আয় বস”। মা আর দিদুর পাশেই বসল ছবি।
শুভময়ীদেবী বললেন, “তোর মা আর দিদুর সঙ্গে আলোচনা করে – আমরা তোর কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করেছি”। তার সঙ্গে মিঠুদিদির সম্পর্কের কথাটা যদি জানাজানি হয়ে গিয়েই থাকে, তার শাস্তির ব্যপারটা মামী নিশ্চয়ই হাসি হাসি মুখে বলবে না। খুব অবাক হয়ে মায়ের এবং মামীর মুখের দিকে তাকাল। “তোকে বিয়ে করতে হবে”, শুভময়ীদেবী হাসতে হাসতে ঘোষণা করলেন, “কোন ভাবেই তোর পরিত্রাণ নেই”।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ছবি, তারপর মাথা নীচু করে বলল, “বিয়ে আমি করব না, মামী”।
“বিয়ের আগে সব ছেলে-মেয়েই অমন বলে, ছবি। ওটা কোন কাজের কথা নয়, ছবি”।
“সবাই কী করে জানি না, আমি করব না”। ছবি বেশ জোরের সঙ্গে বলল।
“কেন বল তো? হঠাৎ এমন ধনুক-ভাঙা পণ করে বসলি কেন?” শুভময়ীদেবী স্মিতমুখেই জিজ্ঞাসা করলেন।
মালতী বলল, “ওর ভয় লাগে। আমাদের মতো কাজের লোকের সংসার অনেক দেখেছে কিনা, তাই ভয় পায়। সারাদিন এই কাজের মেয়েরা বাবু-বৌদিদের বাড়ি কাজ করে, রাত্রে বাড়ি ফেরে। তারা তখন ক্লান্ত, তাদের সারা গায়ে-গতরে ব্যথা। সারাদিন পর তাদের ছেলে-মেয়েরা মাকে পেয়ে খুশি হয় এবং ঘরে ফিরে তাদের জন্যেও সেই মাকেই দুটো ভাত-ডাল-তরকারি রান্না করে তাদের মুখের সামনে ধরতে হয়। যতই হোক মায়ের প্রাণ। কিন্তু এসবের পরেও, বহু পরিবারেই তাদের স্বামীরা অনেক রাত্রে বাড়ি ফেরে গলা অব্দি মদ গিলে। শুরু করে গালাগাল, মারধোর, বউয়ের চরিত্র নিয়ে নানান আকথা-কুকথা...” মালতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, “আমাদের মতো সংসারে মেয়েদের এমনই ঝ্যাঁটা-খাওয়া কপাল, বৌদি। এই জন্যেই ছবিকে আমি জোর করতে পারি না”।
ছবির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শুভময়ীদেবী, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “একটা কথা মানছি, ছবি। একটা ছেলে আর মেয়ের যখন বিয়ে হয়, তাদের মনে তো বটেই, তাদের দুজনকে ঘিরে দুই পরিবারের মনেও অনেক স্বপ্ন কাজ করে। খুব কম ক্ষেত্রেই সেই সব স্বপ্ন পূরণ হয়, নানান ভুল বোঝাবুঝিতে অধিকাংশ স্বপ্নও দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে। তা বলে স্বপ্ন দেখাটাই ছেড়ে দিবি, ছবি?
ধর আজ যদি তোর নিজের যোগ্যতায় একটা স্থায়ী চাকরি হয়ে যায়... লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করার বিড়ম্বনা থেকে তুই যদি মুক্তি পেয়ে যাস। সেই নতুন জীবনের জন্যে, নতুন একটা স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি?”
“আমার একটা স্থায়ী চাকরি হয়ে যাবে...কী বলছো, মামী?” এত অবাক জীবনে কোনদিন হয়নি ছবি।
“আমাদের স্কুলে একটি কেয়ার-টেকার, মানে বাচ্চাদের আয়ার কাজ খালি হয়েছে। স্কুলে একদম নীচু ক্লাসে যারা পড়ে – ক্লাস ওয়ান, টু, থ্রির বাচ্চারা – তাদের দেখাশোনা করার জন্যে। আমি তোর সব কথাই স্কুলের কর্তৃপক্ষকে বলেছি। স্কুলের দিদিমণিরা সকলেই তোর কথা জানে – মানে আমিই বলেছি আরকি। সকলেরই ধারণা এতদিন ধরে বিট্টুকে যে বুক দিয়ে সামলেছে, তার কাছে এ কাজ কিছুই না। কর্তৃপক্ষও মেনে নিয়েছে। তোর চাকরিটা হয়ে গেছে”।
অপ্রত্যাশিত এমন একটা সংবাদের জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিল না। ক্বচিৎ কখনও যেমন শোনা যায়, লটারির টাকা পেয়ে কেউ কেউ নাকি রাতারাতি বড়োলোক হয়ে গেছে। এও যেন সেইরকম। তবে এ ঘটনা ঘটেছে মালতীর অভাগী মেয়ে ছবির কপালে। মালতী ছবির দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। তার দু চোখ ভরে জল চলে এল।
“আগামীকাল তোর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা অফিসে চলে আসবে। কাল একবার স্কুলে গিয়ে তোকে ওটা নিয়ে আসতে হবে, ছবি...”।
“আমাকে কী আনতে হবে, মামী”?
“তোর চাকরির চিঠি। আমার সঙ্গেই যাবি, স্কুলের বড়োবাবুর সঙ্গে দেখা করলেই তোকে চিঠিটা দিয়ে দেবে। সকলের সঙ্গে কথাবার্তা হবে আর কিছু সইসাবুদও করতে হবে তোকে”।
চাকরি, স্কুল, অফিস, অফিসের বড়োবাবু...কথাগুলো ছবির চোখের সামনে নতুন এক দিগন্ত খুলে দিল। বহুদিন পর তারও চোখ জলে ভরে উঠল। তার হাতের সামনে কি তাহলে সত্যিই এসে দাঁড়াল নিশ্চিন্ত ও সুরক্ষিত একটা জীবন?
সমাপ্ত