৯
ছবি দেখেছে, ব্যাপারটা হয়ে যাওয়ার পর, প্রত্যেকবারই তার মনে কেমন একটা যেন পাপবোধ আসে। আসলে খুব যে ভাল লাগে ব্যাপারটা তা মোটেই নয় – আবার মন্দও লাগে না। অনেকটা যেন নাছোড় নেশার মতো। নেশা করতে করতে মনে হয় আর কক্খনো করব না, কিন্তু আবার সময় এলেই মনে হয় - এইবারটাই শেষবার – এরপরে আর নয়। সত্যি বলতে সে মিঠুদিদিকে ঠিক এড়িয়ে যেতেও পারে না। তার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে, চোখে চোখ রেখে, তার ঠোঁটে যখন মিঠুদিদি ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়, ছবির সব বাঁধন যেন আলগা হয়ে আসে। মিঠুদিদির হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে ছবি তার সমস্ত শরীরে অনুভব করে এক অদ্ভূত আলোড়ন। তখন তার আর মনে থাকে না পাপবোধ, সংস্কার অথবা কোন সামাজিক নীতির ভ্রুকুটি।
ছবি একটা ট্রেতে দুটো চায়ের কাপ আর দুটো বিস্কুট নিয়ে এল। মিঠুদিদির হাতে একটা চায়ের কাপ দিল – সামনে রাখল একটা প্লেটে দুটো বিস্কুট। মিঠুদিদির সামনে বসল নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে, এটা অন্য ধরনের কাপ, অনেক সস্তা। সে জানে, যে সম্পর্কই গড়ে উঠুক না কেন মিঠুদিদির সঙ্গে, তাতে তার অবস্থানের কোন পরিবর্তন কোনদিন হবে না। ওই সময়টুকু ছাড়া তার আর মিঠুদিদির মধ্যে যে দুস্তর ফারাক, সেটা মুছে যাবার নয়। আর যাই ভুলে যাক, ছবি এ ব্যাপারটা ভুলবে না কিছুতেই।
চায়ে চুমুক দিয়ে মিঠুদিদি আনমনে বলল, “সেই দিনটা আজও আমার ভীষণ মনে পড়ে, জানিস ছবি”?
“কোন দিনটা গো”?
“যেদিন তুই আর তোর মা আমাদের বাড়িতে এলি-সাতসকালে, মনে আছে”?
“বারে মনে থাকবে না কেন? তুমি চান করে স্কুল ড্রেস পরে খেতে বসছিলে আর আমরা ঢুকলাম”।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রতিষ্ঠা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ছবির দিকে। প্রতিষ্ঠার এইভাবে তাকিয়ে দেখাতে ছবি একটু লজ্জা পেল, বলল, “কি দেকচ বলোতো? আর এত কি ভাবচো, সেই থেকে”?
ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসির একটা রেখা নিয়ে মিঠুদিদি বলল, “এই কলকাতায় তোর কতবছর হল, বলতো ছবি। প্রায় বছর ছয়েক, না? তুই আমাদের বাড়ি এসেছিলি যখন, একটা ছোট্ট পাখির মতো অসহায় ভিতু, আর কি ইনোসেন্ট ছিলি তুই। সো ইনোসেন্ট অ্যান্ড পিওর – আই জাস্ট কান্ট ইম্যাজিন। সে সময়ে আমিও বয়সে খুব একটা বড়ো ছিলাম না তোর থেকে। কিন্তু তবুও ফিল করেছিলাম আমার ক্লাসমেট বা চেনাজানা কোন মেয়ের মধ্যে এমন ইনোসেন্স দেখিনি। জানিসনা ছবি, আর তোকে বুঝিয়ে বললেও তুই বুঝবি না। তোকে সেই দেখাটা আমার জীবনে কি এক অসম্ভব রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল”।
“বাব্বাঃ। দিদি, তুমি বরাবরই দেকেচি আমার সঙ্গে এমন শক্ত শক্ত সব কতা বলো - কেন বলো তো? তোমার সব কতার মানে বুজি না বটে - শুনতে কিন্তু বেশ লাগে”।
অধৈর্যে মাথা নাড়ল মিঠুদিদি, তার ছোট করে ছাঁটা বয়কাট চুলে ঝাঁকুনি তুলে বলল, “ওটাই তো তোর গ্রেটেস্ট প্রবলেম, ছবি। কিংবা কে জানে ওই জন্যেই আমাকে তোর কাছে বার বার ফিরে আসতে হয় – এরপরেও আসতে হবে বারবার। কিছুই বুঝিস না তুই। অথবা সব কিছু বুঝেও কোন এক অদৃশ্য সীমারেখা তুই টেনে রাখতে পারিস তোর চার দিকে। যার বাইরে তুই নিজে কোনদিন বের হবি না। এবং কাউকে ঢুকতেও দিবি না সেই ঘনিষ্ঠ গন্ডীর ভিতরে। না হলে এতদিন কলকাতার জীবনে অভ্যস্ত হতে হতেও, তুই সেই আগের মতোই রয়ে গেলি কী করে? কি করে তুই তোর আদুড় বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারলি, তোর সেই ফেলে আসা গ্রাম-জীবনের মেঠো গন্ধ! শ্যাম্পু করা চুলের গভীরে শ্বাস নিলে কেন পাওয়া যায় বাসী নারকেল তেলের সোঁদা আঘ্রাণ”! একটু থেমে ঘাড় ঝাঁকিয়ে মিঠু বলল, “মাই গড, আজকে জানিনা কেন বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়ছি...। আজ চলি রে, ছবি”।
হঠাৎ করেই চেয়ার থেকে উঠে পড়ে, দরজার দিকে এগোলো মিঠুদিদি। ছবি খুব অবাক হল, মিঠুদিদির এই আকস্মিক ভাব পরিবর্তনে, পিছনে পিছনে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, “ওই দ্যাকো, চা-টাও শেষ করলে না। একটা বিস্কুটও দাঁতে কাটলে না – দিদি, তুমি না সেই একই রকম খামখেয়ালি রয়ে গেলে। আচ্ছা বেশ, সেই আসবেই যকন, “চলি” নয় - বলো “আসি”“। মিঠুদিদি ফিক করে হেসে ফেলল, খোলা দরজার বাইরে থেকে, ভিতরে দাঁড়ানো ছবির গালটা আলগা করে টিপে দিয়ে, বলল, “আদ্যিকালের পান্তি বুড়ি, আসি রে”।
উজ্জ্বল হাসিমাখা মুখে ছবি বলল, “এসো। আবার আসবে কিন্তু, সময় পেলে”।
মিঠুদিদি হাসল, বলল, “তুই না ডাকলেও আসব, পুরুষরাই বুঝি আজীবন ডাকাতি করে যাবে মেয়েদের ওপর, আমিই বা কম কিসে, শুনি”?
চলবে...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।