১
লক্ষ্মীকান্তপুরের মালতী পোল্লে রোজ সকালের লোকাল ট্রেন ধরে টালিগঞ্জ স্টেশনে নেমে প্রায় দৌড়ে চলে তার গন্তব্যে। মালতী পোল্লে একা নয় তার সঙ্গে থাকে আরো অন্ততঃ জনা পনেরো। একটু এগিয়ে, পিছিয়ে - নানান বয়সের - বুড়ি, মাঝবয়সি, ছুকরি। কেউ মুখরা - সব কথাতেই তেতে ওঠে – কেউ বাচাল – সব কথাতেই হেসে ওঠে। কেউ কেউ একটু আলাদা রকম - চুপচাপ উদাসীন নির্লিপ্তিতে দু একটা মন্তব্য করেই থেমে যায়। দুজন কমবয়সীর পরনে শালোয়ার-কামিজ ছাড়া প্রায় সকলেরই পরনে আটপৌরে সস্তার শাড়ী। পায়ে পেলাস্টিকের স্যান্ডেল – সস্তা কিন্তু বেশ টেকসই।
মালতী পোল্লেদের এই দলটা একসঙ্গেই আসে রোজ। কোনদিন এক আধ জন কেউ বাড়তি কাজের চাপে আটকা না পড়লে, তারা ফিরেও যায় মোটামুটি একই সঙ্গে। এরা সকলেই ঠিকে ঝি। একটু ভাল করে বললে কাজের মাসি – কিংবা কাজের মেয়ে। বাবুদের বাড়ি তারা বাসন ধোয়, ঘর মোছে। কেউ কেউ কাপড়ও কাচে। এরা সকলেই কাজ করে এক বিশাল হাউসিং কমপ্লেক্সে। সে কমপ্লেক্সে কত যে ফ্ল্যাট আর কত যে বাসিন্দা তার হিসেব ওরা রাখে না। কিন্তু তাদের কাজের অভাব হয় না। এক বাড়ি ছাড়িয়ে দিলে অন্য বাড়ি থেকে ডেকে নেয়। তারা অর্থনীতি বোঝে না, বোঝে না মার্কেটের সাপ্লাই - ডিম্যান্ড রেশিও। পরতায় না পোষালে ওরা নিজেরাও এক বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্য বাড়িতে কাজ পেয়ে যায় নিশ্চিন্তে।
সাধারণ ভাগচাষী ঘরের মেয়ে মালতীর বিয়ে হয়েছিল হলধর পোল্লের সঙ্গে। হলধর ছিল মহাজন সাঁপুইয়ের গুদামে রাতের সিকিউরিটি। মহাজন সাঁপুই বেশ পছন্দ করতেন হলধরকে আর ভরসাও করতেন। কারণ হলধরের ছিল ডাকাবুকো লম্বাচওড়া চেহারা আর বিস্তর গায়ের জোর। ডেকে হেঁকে কথাও বলতে পারত বেশ।
বিয়ের পর পরই মালতীর মনে আছে, একদিন শেষ বিকেলে তারা দুজন রথের মেলা থেকে ফিরছিল। হঠাৎ মাঝরাস্তায় কি বৃষ্টি, কি বৃষ্টি। আকাশ জুড়ে একখান বিশাল পাথরের মতো নিরেট মেঘ আর তেমনি জলের ধারা। দুপাশে ফাঁকা ক্ষেতের মধ্যে রাস্তার কোথাও মাথা বাঁচাবার উপায় নেই। ভেজা শাড়িতে ঘোমটাতে মালতীর একে জবুথবু অবস্থা, তার ওপর পেছল কাঁচা রাস্তায় হাঁটা দায়। পিছিয়ে পড়া মালতীর জন্যে বারবার দাঁড়াতে দাঁড়াতে হলধর ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল।
তারপর আচমকা মালতীকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল, “এত হাল্কা তুই, য্যাঃ, য্যান এত্তটুকুন পাকি।...দ্যাক দেকি, এতটুকু গত্তি নেই শরীলে, আমার সঙ্গে পারবি ক্যানে - আজ থিকে আমার সঙ্গেরে খাবি”। মালতী অনেক অনুনয় - বিনয় - ঝটপট করেছিল ছাড়া পেতে, ছাড়েনি হলধর। আরো চেপে ধরে রেখেছিল আর হাসছিল হা হা করে। একসময় সেই বেহায়া ডাকাতটা অঝোর ধারায় নির্জন পথ চলতে চলতে মালতীর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়েছিল।
কতক্ষণ কেটে গিয়েছিল মনে নেই মালতীর। ভীষণ লজ্জা কিন্তু তার চেয়েও ভীষণ ভালো লাগায় সে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। ছাড়া পাওয়ার পরে মালতী বলেছিল, “তুমি একটা ডাকাত, মাঝ আস্তায় এমন করতি আচে? কেউ যদি দেকে ফেলে”?
হলধরের পাটার মতো বলিষ্ঠ বুকের মধ্যে সংলিপ্ত মালতী, হলধরের হৃদয়ের শব্দ শুনতে শুনতে অবাক হয়ে দেখছিল তার মানুষটিকে। বড়ো ভালোবেসে ফেলেছিল সেইদিন। বিয়ের পর সেইদিনই প্রথম মালতী হলধরকে “তুমি” ডেকেছিল – তার আগে সে “আপনি” বলত। কোন কথা বলছিল না হলধর। মালতী অস্ফুটে বলেছিল, “আমারে ছাড়ি দ্যাও। নামায়ে দ্যাও আমারে”। হলধর নামিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়। দুজনে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছিল সেই নির্জন মেঠো পথে – মুষলধারে ঝরতে থাকা বরষার মধ্যে। তীব্র সুখে ডুবে থাকা শরীরি আবেগে মালতীর মনে হয়েছিল সে এক অদ্ভূত পথচলা – শেষ না হলেই বুঝি ভালো হয়।
সেই দিনের কথা আজও মালতীর মনে আঁকা হয়ে আছে একই রকম জীবন্ত হয়ে। কারণ সেদিন ঘরে ফিরে অস্বস্তির শীতল সিক্ত বসনমুক্ত হতে হতেই ঘটে গিয়েছিল এক পরম আনন্দের মিলন। জোৎস্নাপ্লাবিত সাগরবেলা নয়। মনোরম পর্বত শিখরের মায়াবী পরিবেশও নয়। কিন্তু এক মধুর মধুচন্দ্রিমায় তারা সেদিন ভেসে যেতে পেরেছিল নিটোল ভালোবাসায় সম্পৃক্ত আকুল মিলনে।
কোল আলো করে এসেছিল তাদের মেয়ে। শ্যামল বরণ, ডাগর চোখে দুষ্টু হাসি। ছবির মতোই দেখতে, তারা আদর করে তার নাম দিল ছবি। হলধর যখন নাইট ডিউটি সেরে ভোরে ফিরত - ওই একরত্তি মেয়েটাও ঘুম ভেঙে জেগে বসে থাকত বাপের অপেক্ষায়। এমন বাপ সোহাগী! সেই মেয়েও বড়ো হতে থাকল দ্রুত। মালতীর মনে হয় যেন এই তো সেদিন।
স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এল ওর বাপ। মেয়ের চুলে বেড়িবিনুনি বেঁধে দিত মালতী। “বুলু” স্কার্ট আর সাদা জামা, পিঠে ইস্কুল ব্যাগ। ডিউটি থেকে ফিরে ওর বাপ মুখ হাত ধুয়ে চা খেয়েই বেরিয়ে যেত মেয়েকে নিয়ে – মেয়ে থাকত কোলে আর বাপের হাতে ব্যাগ। ওইটুকু মেয়ে আবার বোঝা বইবে কি – হোক না কেন সে বিদ্যের বোঝা – এই ছিল হলধরের কথা।
সব চলছিল খুব সুন্দর - একদম মনোমত। কিন্তু এত সুখ সইল না মালতীর। তার সুখের কপাল পুড়ল সে এক গভীর রাত্রে।
মহাজন সাঁপুইয়ের পাইকারি ব্যবসা – নানান কারোবার, হরেক এজেন্সি। চারটে গুদাম বোঝাই থাকে মাল। রাত্রে যে মাল লোড হয় না, তা নয়। নিয়মিতই হয়। কিন্তু তার নিয়ম আছে। ডেলিভারি চালান, গেট পাস চলে আসে আগেই। কার গাড়ি, কোন গাড়ি লোড হবে সে সংবাদ সন্ধের আগেই চলে আসে অফিস থেকে। সেই অনুযায়ী মেন গেট খুলে লরি ঢোকে। মাল লোড হয়, চেক হয়ে - চালান সই হয়ে গাড়ি বেরিয়ে যায় নিয়ম মতো। যারা মাল নিতে আসে তারা নিয়মিতই আসে এবং তারা এই নিয়ম কানুন সবই জানে। কাজেই কোনোদিন অসুবিধে হয়নি - চেনা জানা অভ্যস্ত কাস্টমারদের সামলাতে।
সে রাতে ওরা চারজন এসেছিল। তাদের সঙ্গে ছিল খালি ট্রাক আর ট্রাক লোড করার লেবার। তারা কেউই চেনা নয়, সম্পূর্ণ অজানা। অফিস থেকে কোন খবর ছিল না। ওরা দেখাতে পারে নি কোন চালান বা গেট পাস। গেট খোলা হয় নি। হলধর কোনোমতেই অ্যালাউ করে নি তাদের। লোহার গেটের ভিতরে থাকা হলধর আর তার সঙ্গী সিকিউরিটির সঙ্গে বচসা শুরু হয়ে যায় গেটের বাইরে দাঁড়ানো ওই চারজনের। কথা কাটাকাটি, গালাগালি, হুমকি চলতে চলতেই গুলি চালায় ওদের মধ্যে একজন।
গুলির আওয়াজে এবং হলধর মাটিতে পড়ে যাওয়াতে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল সকলেই। হলধরের সঙ্গী সিকিউরিটি চেঁচামেচি করতে করতে সরে গিয়েছিল গেট থেকে – ফোন করে দিয়েছিল অফিসের বাবুদের। যে চারজন এসেছিল তারাও ব্যাপার সুবিধে নয় বুঝে উধাও হয়ে গিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। শুধু মালতীর কপাল পুড়িয়ে এবং তার জীবনের সমস্ত রঙ নিকিয়ে নিয়ে, মাটিতে শুয়েই রইল হলধরের বলিষ্ঠ, স্তব্ধ - নিথর শরীরটা। রাত তখন পৌনে একটা।
রাতে মেয়ের লেখা পড়া সারা হলে, মা আর মেয়ে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছিল নিত্যদিনের রুটিন মাফিক। হঠাৎ মাঝ রাত্রে ডাকাডাকি করে তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিল মহাজন সাঁপুইয়ের লোক। হলধরের শরীর খুব খারাপ, তাকে নাকি সদরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন তারা এসেছে গাড়ি নিয়ে হলধরের মেয়ে বউকে নিয়ে যেতে। দিশাহারা মালতী আর মেয়ে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থাতেই বেড়িয়ে পড়েছিল। কী হয়েছে। কখন হয়েছে। গাড়িতে যেতে যেতে অনেকবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও মহাজন সাঁপুইয়ের লোকটি কোন স্পষ্ট উত্তর দিচ্ছিল না।
যেন এক অনন্ত যাত্রা শেষে তারা সদর হাসপাতালে পৌঁছোলো। তাদের আসতে দেখে অনেক লোকজনসহ মহাজন সাঁপুইও এগিয়ে এসেছিল। ব্যাকুল হয়ে মালতী জিজ্ঞাসা করেছিল, “বাবু, এরা কেউ কিচু বললনি আমারে, কি হয়েচে আমারে বলেন না, মানুষটা বেঁচে আচে তো”? আধো আলো - আধো অন্ধকার হাসপাতাল কম্পাউন্ডে দাঁড়িয়ে মহাজন সাঁপুই অন্ধকার মুখ করে উত্তর দিয়েছিল, “ধৈর্য হারায়ো না, মা। শান্ত হও - তোমার সোয়ামি বীরগতি পেয়েচে – এসো, আমার সঙ্গেরে এসো”। অবাক মালতী কি বলবে বুঝতে পারল না, “বীরগতি” মানেই বা কি হতে পারে তার বোধে কোন সাড়া দিল না।
মহাজন সাঁপুই ওদেরকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকল। দীর্ঘ করিডর, প্যাসেজ পার হয়ে বারান্দার ধারে রাখা একটা বেডের সামনে তারা দাঁড়াল। সে বেডে মাথা থেকে পা অব্দি ময়লা সাদা চাদরে ঢাকা একটা শব। মহাজন সাঁপুইয়ের ইশারায় কেউ একজন মুখ থেকে সরিয়ে দিল সাদা চাদরের আবরণ। চোখ বুজে শুয়ে আছে হলধর পোল্লে। যেন ঘুমোচ্ছে। মুখে কোন বিকৃতি নেই, কোনো কষ্টের চিহ্ন নেই – শুধু কপালের বাঁদিক ঘেঁষে একটা গভীর ছিদ্র। আর তার পাশে শুকিয়ে যাওয়া অনেকটা রক্তের দাগ।
চলবে...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।