৫
বড়ো রাস্তা থেকে ঢুকে যে পিচঢাকা গলিতে মালতীদের বাসা, সেটা ধরে আরো অনেকটা ভেতরে চলে গিয়ে গলিটা শেষ হয়ে গেছে এক পুকুরের পাড়ে। তারপরে আর রাস্তা নেই, পুকুরের পাড় ধরে লোকজনের চলাচলে তৈরি হয়েছে মেঠো পথ। সে পথে বেশ কিছুটা গিয়ে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বিমলামাসির বাড়ি। কাদার গাঁথুনি দিয়ে ইঁটের দেওয়াল, মাথায় টিনের চাল। দুটো ঘর, একটা রান্নার চালা। ঘরের সামনে ছোট্ট টানা বারান্দা মতো – সিমেন্ট বাঁধানো। সামনে, চারপাশে কিছুটা জমি, আগাছায় ভরে আছে। তার মধ্যেও চোখে পড়ে ইঁটের ভাঙাচোরা তুলসীমঞ্চ, তুলসীগাছেরই ঝাড় ঘিরে ফেলেছে পাশের অনেকটা জায়গা। আর ডানদিকের কোণায় জঙ্গুলে লঙ্কাজবার ঝোপ, ঝাঁপিয়ে ফুল এসে রক্তারক্তি করে দিয়েছে জায়গাটাকে।
রাত্রি সাড়ে আটটা নাগাদ মালতী তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল বিমলামাসির বাড়িতে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ভাঙা ইঁট বিছোনো পথে এসে দুজনে যখন ঘরের বারান্দায় উঠল, ঘরের ভেতর থেকে কেরোসিনের বার্নার স্টোভের আওয়াজ আসছিল। ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে মালতী ডাকল, “ও মাসি, কি রাঁধতেচ, গো”?
মালতীর গলা পেয়ে টেমি তুলে এগিয়ে এল বিমলামাসি, বলল, “কে এলি রে, এত রাতে? অ মালতী, আয় মা আয়, হঠাৎ কী মনে করে? কোন বিপদ-আপদ নয় তো”?
“না, না, বিপদ আপদ নয় কো, বিপদের আর বাকি কী আচে বলো, মাসি। তোমার কাচে এসেচি দুটো পরামর্শ করতে”। বিমলামাসি ছবির হাত ধরে ঘরে এনে মেঝেয় বসল। সামনে জ্বলতে থাকা স্টোভে ছোট্ট হাঁড়ি চাপানো, ভাত রান্না হচ্ছে, হাঁড়ির জল সবে ফুটব ফুটব করছে।
মালতী সামনাসামনি মেঝেতে বসে জিজ্ঞাসা করল, “কি রাঁধতেচ, ভাত?”
“হ্যাঅ্যাঅ্যা, দুটো ভাত একন ফুটিয়ে নি, রাতে চাট্টি খাই, খেয়ে হাঁড়িতে জল ঢেলে দি। বাকিটা কাল সকালের পান্তা।” বিমলামাসি কথা শেষ করে চুপ করে অপেক্ষায় থাকল মালতী কি বলতে চায় শোনার জন্যে, মালতীও কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু ভাবল। মনের কথাগুলো কিভাবে বলবে সেটাই চিন্তা করল হয়তো। তারপর বার্নারের নীলচে শিখার দিকে তাকিয়ে মালতী খুব গম্ভীর আর চিন্তিত স্বরে বলল, “মাসি, আমি কাজ করব, আমারে কাজ দ্যাও”।
বিমলামাসি একটুও আশ্চর্য হল না, শুধু মালতীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্যান, মহাজন সাঁপুইয়ের গদি তে কিচু করল নি? তোরে কতা দে ছেল - কাজ দিবে”? মাথা নেড়ে জবাব দিল মালতী। তারপর বিমলামাসির কাছে মালতী সব কথা বলল – মহাজন সাঁপুইয়ের অফিসের কথা, তার সিদ্ধান্তের কথা। বলা শেষ করে মালতী অপেক্ষা করতে লাগল বিমলামাসির উত্তরের জন্য। বিমলামাসির ভাত কিছুক্ষণ আগেই ফুটে উঠেছিল, হাঁড়ির ঢাকনা ঠেলে উঠে আসছিল বাষ্প আর ফোঁটা ফোঁটা ভাতের ফ্যান, দ্রুত আঙুলের টানে বিমলামাসি তপ্ত ঢাকনাটা খুলে নিতেই, গরম ভাতের মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগল।
বিমলামাসি বলল, “কাজ তো হয়ে যাবে, বাছা, কাজের অভাব হবেনি, দুটো তিনটে দিন টাইন দে কাজ পেয়ে যাবি। কিন্তু ছবি কি করবে?”
“ক্যানো? ঘরে থাকবে – ইস্কুল যাবে...”। ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে একটা খুন্তি ডুবিয়ে বিমলামাসি দু-চারটে ভাত তুলে টেমির সামনে নিয়ে দেখল, আবার হাঁড়ির মধ্যে ডুবিয়ে দিল খুন্তিটা, তারপর বলল, “বলিস কি, মালতী? একলা ছেড়ে যাবি মেয়েডারে, সারাটা দিন? তা হয় না কি! দেশে কুলোকের অভাব নাই রে মালতী, সে হয় না। একন ছোটটি আচে, আজ বাদ কাল বড়ো হতে কতদিন? কতোয় পড়ল ছবি – বারোয় না? তবে? ভাত তো হয়েই এয়েচে, শুধু নামায়ে ফ্যান গালানো বাকি...”।
বিমলামাসি শাড়ির আঁচল দিয়ে হাঁড়ির কানা ধরে নামিয়ে নিল ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি। বার্নার স্টোভ নিভিয়ে, হাঁড়ির মুখে ঢাকনা চাপিয়ে, বাইরে গেল ফ্যান গালতে। স্টোভের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে শব্দহীন হয়ে গেল ঘরটা, বাইরে থেকে রাত্রির শব্দ কানে আসতে লাগল। ঝিঁঝিঁর ডাক, কুকুরের ডাক, গাছের পাতায়-পাতায় হাওয়ার মর্মর। মালতী দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল, তার মুখে টেমির কালচে আলো খেলে বেড়াতে লাগল, নতুন চিন্তায় তার কপালে নতুন ভাঁজ।
মায়ের নজরে তার মেয়ে ছবি এখনো ছোটই, কিন্তু জগতের চোখে? ভাবনার এ দিকটা তার মাথায় আসেনি। ফ্যান গালিয়ে বিমলামাসি ভাতের হাঁড়ি শাড়ির আঁচলে নিয়ে আবার ঘরে এল, ভাতের হাঁড়ি মেঝেয় নামিয়ে, টেমিটা সামনে এনে একটা থালায় দুহাতা ভাত তুলল, সঙ্গে একটা সেদ্ধ আলু। পাশেই মেঝেয় রাখা হরেক প্লাসটিকের কৌটো থেকে একটু সরষের তেল আর নুন রাখল থালার একপাশে, তারপর ছবির দিকে থালাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দিদুর ঘরে এলি, দুটো গরম-গরম ভাত মুখে দে, মা। তেল আর লুন দে’ মেকে নে আলুটা। কাঁচা নংকা নিবি? দিচ্ছি ডাঁড়া, শুরু কর। পেঁয়াজ কুচিয়ে দিই ডাঁড়া, গরম ভাতে ভাল লাগবে”।
টেমির স্বল্প আলোয় বিমলামাসি পাতবঁটি বার করে পেঁয়াজ কাটতে বসল। মালতি এতক্ষণ দেখছিল বিমলামাসিকে, অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “মাসি, কী উপায় থালে বল না”?
“বোস না, বাছা, বোস। এসব কি হুটোপাটা করার কাজ, বাছা? ডাঁড়া মেয়েটা দিদুর বাড়ি এল, কিচু খেতে দিই।” ডুমো ডুমো কুচোনো পেঁয়াজ ছবির পাতে রাখল বিমলামাসি। তারপর টেমিটা ছবির থালার সামনে রেখে বলল, “ন্যাকাপড়া করে কী হবে বল দিনি? মেয়েকে কি ডাকতারের ঘরে বে’ দিবি, নাকি মোক্তারের ঘরে? আমি বলি, ছবিকেও কোন কাজে লাগিয়ে দে”।
মালতী চমকে ওঠে, “কী বলচ, মাসি? এইটুকু বয়েসে”? মালতীর চোখ থেকে উষ্ণ অশ্রুধারা নেমে এল, টেমির আধো অন্ধকারে দেখা গেল না।
বিমলামাসি উদাসীন গলায় বলল, “এত উতলা হস নি, বাছা। আমি কি বলচি, অরে এঁটো থালাবাসন ধোওয়ার কাজে লাগাতে, অন্য রকম কাজ। হাত নুরকুত, গিন্নীরা চায়। একটু চা করে দেওয়া।
ঘরটা ঝাড় দিয়ে দেওয়া। ছেলে-মেয়েকে বড় রাস্তার মোড়ে ইস্কুলের বাসে সকালে তুলে দিয়ে আসা, বিকেলে আবার ফিরিয়ে আনা। দোকান থেকে টুকটাক জিনিষ এনে দেওয়া। মানে ফাইফরমাশ খাটা আর কি...তেমন ভারি, কষ্টের কাজ কিছু নয়। তা পরে ধর, পারলে রান্নার যোগাড় করে দেওয়া, এইসব আর কি...”।
মালতী কোন কথা বলল না। মেয়েসোহাগি হলধর পোল্লে মেয়েকে কোনদিন নিজের ইস্কুলব্যাগও বইতে দেয়নি। বাপমরা মেয়েকে পেটের দায়ে এখন অন্য লোকের সংসারের বোঝা বইতে হবে? ভীষণ অবুঝ এক আক্রোশ তার বুকের ভিতর নাড়া দিতে থাকে। কী দরকার ছিল হলধর পোল্লের, নিজের প্রাণ দিয়ে মহাজনের গুদাম সামলানোর। কত ক্ষতি হত, গুদাম থেকে চুরি হলে? মহাজনের গুদাম রক্ষা করে “বীরগতি” পাওয়া হলধর পোল্লের মেয়ে বউ এখন বাড়ি বাড়ি ঝি গিরি করে পেটের সংস্থান করবে! হলধর পোল্লের ভালোমানুষীর জন্যে মালতীর যে গর্ব ছিল মনের মাঝখানে, সেই ভিত আজ নড়ে উঠল। আসলে হলধর পোল্লে কি আহাম্মক নয়?
ছবির খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বিমলামাসির দেওয়া নুন তার সেদ্ধ-আলু মাখতে একটুও লাগেনি। কারণ তার চোখের জলেই লোনা হয়ে যাচ্ছিল ভাতের গ্রাস। তার অসহায় শূণ্য বুকের মধ্যে বাবার হাসিমুখটি মনে পড়ছিল বারবার। আর মনে পড়ছিল তার বাবাকে শেষ দেখা, কপালে গভীর ছিদ্র নিয়ে বাবা ঘুমিয়ে আছে। “এত ঘুম তোমার কী করে আসে, বাবা? শুনচো বিমলাদিদু কি বলচে? মাকে, আমাকে কলকাতা যেতে হবে নোকের বাড়ি কাজ করতে। তাও তুমি ঘুমোচ্চো”?
খাওয়া শেষ করে ছবি এঁটো থালা নিয়ে বাইরে চলে গেল। বিমলামাসি পেছন থেকে বলল, “বাইরের বালতিতে দ্যাক, জল আছে, মুক-হাত ধুয়ে নে, থাল আমি ধুয়ে নোব খন তুই একে দে”। জলভরা বালতি খুঁজে নিল ছবি, উবু হয়ে বসে এঁটো থালাটা ধুয়ে নিল, মুখ-হাত ধুলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে কেঁদে উঠল – “বাবা...”।
ঘরের ভিতর বিমলামাসি মালতীর মাথায় হাত রেখে বলল, “কাঁদতে দে, মালতী, কাঁদতে দে। বুকটা হাল্কা হবে...”। রুদ্ধ হয়ে এল বিমলামাসিরও গলা, আঁচলে চোখ ঢাকল। মেঝেয় রাখা টেমিটা কিছুটা আলো আর অনেকটা কালো ছড়িয়ে জ্বলতেই লাগল কেঁপে কেঁপে।
চলবে...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।