৬
প্রতিষ্ঠা স্কুল যাবে বলে রেডি হচ্ছিল, তাই ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল। বিমলামাসি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল মালতী আর ছবিকে নিয়ে। মালতীর হাতে একটা পুরোনো ব্যাগ। বিমলামাসি ঘরে ঢুকে বলল, “অ বউদি, এই লাও, তোমারে বলেচিলাম, এই সেই মেয়ে, আর এই হতেচে মেয়ের মা, মালতী। বুজে শুনে লাও, বউদি, আমারে তাড়াতাড়ি ছাড়, আমারে আবার ওর মারে লয়ে যেতে হবে কাজের বাড়ি চেনাতে...”।
প্রতিষ্ঠা টেবিলে বসে খাচ্ছিল আর প্রতিষ্ঠার মা পাশের চেয়ারে বসেছিলেন। তাঁকে খুব সুস্থ নয় মনে হল, ম্লান হেসে বললেন, “ওমা, বেশ মেয়ে তো। কি নাম রে তোর”?
“ছবি, ছবি পোল্লে”। ছবি দেখছিল ঘরদোর। খাবার টেবিল। টিভি। সোফা। আর বার বার দেখছিল প্রতিষ্ঠাকে। প্রতিষ্ঠাও খেতে খেতে দেখছিল ছবিকে।
প্রতিষ্ঠা বলে উঠল, “তোমার নাম ছবি? আমার নাম প্রতিষ্ঠা, ডাক নাম মিঠু। আমাকে মিঠুদিদি বলতে পারো। কি কিউট আর ইনোসেণ্ট, না, মা”?
“ঠিক আছে, ছবি থাক, বেলার দিকে তোমরা এসে খবর নিয়ে যেও। হ্যাঁরে, কান্নাকাটি করবি না তো? এর আগে যে মেয়েটি এসেছিল, বাপ রে তার কি কান্না! দুদিন রইল, তারপর আর থাকতে পারল না। মন খারাপ তো লাগবেই, মা”।
বিমলামাসি দরজার দিকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল, “সেই ভাল বউদি, আমরা দুজনেই বিকেলের দিকে আসব খন, তুমি ততক্কণ বুঝে শুনে লাও”।
বিমলামাসি দরজার দিকে এগিয়ে গেল, মালতী ছবিকে বুকে জড়িয়ে ধরল, কান্নামাখা ধরা গলায় বলল, “ভালভাবে থাকিস মা। আমি বিকেলে আসব, তোকে দেকে যাব। মন খারাপ করিস নি। কোন ভয় নেই, এই তো দিদি আছে, মামীমা আছে”।
মালতী কাঁদলেও ছবি কিন্তু কাঁদল না, বরং তার মুখে অদ্ভূত এক ম্লান হাসি। আর মায়ের সব কথায় সে ঘাড় নেড়ে সায় দিচ্ছিল। ছবিকে ছেড়ে মালতী প্রতিষ্ঠার মাকে বলল, “বৌদি, ছবি আমার একটিমাত্র মেয়ে, বেধবার সম্বল। তোমার হাতে তুলে দিলাম, বড়ো ভাল মেয়ে, একটুকুন দেকো...”।
প্রতিষ্ঠার মা বললেন, “মালতী, তুমি চিন্তা করো না। আমার কাছে ও আমার আরেকটি মেয়ের মতোই থাকবে, ভেবো না। মন খারাপ করো না”।
ওরা চলে গেল। প্রতিষ্ঠার খাওয়া হয়ে গেছে, ওরাও বেরোবে এবার। প্রতিষ্ঠার স্কুলের বাস গলির ভিতর ঢোকে না, তাই প্রতিষ্ঠাকে ওর মা রোজ গলির মোড় অব্দি ছেড়ে দিয়ে আসেন। আজ তিনজনেই বের হল। আজ প্রথমদিন ছবিকে সঙ্গে নিলেন প্রতিষ্ঠার মা, সব চিনিয়ে দিতে এবং বুঝিয়ে দিতে।
স্কুলবাস কোথায় এসে রোজ দাঁড়ায় ছবি চিনে নিল। ফেরার পথে প্রতিষ্ঠার মা তাকে চিনিয়ে দিলেন, বাজার কোথায় বসে, মুদির দোকান, স্টেশনারী দোকান, দুধের স্টল – যেখান থেকে তিনি এতদিন বাজার করেন, মাসকাবারি, নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেন। কারণ প্রতিষ্ঠার বাবা রোজ সকাল ছটায় বের হয়ে যায় আর ফেরে রাত সাড়ে নটা-দশটার আগে নয়। রিষড়ার যে কারখানায় কাজ করে, সে কারখানায় কাজের নাকি খুব চাপ, রবিবারেও প্রায়ই কাজ পড়ে যায়। কিসের এতো কাজ, প্রতিষ্ঠার মায়ের কৌতূহল যে জাগেনি কোনদিন, তা নয়। তবে জিজ্ঞাসা করতেও প্রবৃত্তি হয়নি কোনদিন, কারণ তাঁর মনে হয় লোকটা যতক্ষণ বাড়িতে না থাকে – তিনি বেশ নিশ্চিন্তে থাকেন, ঘরে ফিরলেই একধরনের ভয় বাসা বাঁধে তাঁর মনে। এতদিন তিনি ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সবই একলা হাতে সামলাচ্ছিলেন, কিন্তু ইদানীং তিনি আর যেন পেরে উঠছেন না। মানসিক অবসাদ থেকেই কিনা কে জানে, ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করেন শরীরে। মুখ বুজে একা একা এই সমস্ত কাজ সারার মানসিক জোর তিনি হারিয়ে ফেলছেন দিন দিন।
বিকেল চারটের সময় প্রতিষ্ঠার স্কুলবাস ফেরার সময় একা একা ঠিক জায়গাতেই দাঁড়িয়েছিল ছবি। প্রতিষ্ঠা যখন বাস থেকে নামল, হাল্কা হাসি মুখে নিয়ে ছবি এগিয়ে গেল তার হাত থেকে ব্যাগ নিতে। প্রতিষ্ঠা খুশি হল ছবিকে দেখে, কিন্তু ব্যাগ দিল না, বলল, “অ্যাই, বেশী পাকামি করো না তো। আফটার অল তুমি আমার চেয়ে বয়েসে ছোট। সো ইউ আর নট মাই গার্জেন, অ্যাণ্ড নর মাই এসকর্ট। ইউ আর মাই সঙ্গী”।
হাসিমুখে ছবি বলল, “কি বললে তার আদ্দেক কথার তো মানেই বুঝলাম না, মিঠুদিদি, তবে সারাটাদিন স্কুলে লেখাপড়া করে তুমি নিশ্চই খুব ক্লান্ত, সেইজন্যেই বলছিলাম, ব্যাগটা দাও না”।
“না, যতদিন স্কুলে যাচ্ছি, আমি আমার ব্যাগ নিজেই বয়েছি, কাজেই আজও বইব”।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ছবি অস্ফুট স্বরে বলল, “ঠিক বলেছ, মিঠুদিদি, শেষমেষ সকলকেই বোধহয়, কোন একটা সময়, নিজের বোঝা নিজেকেই বইতে হয়”।
এত গভীর চিন্তা থেকে ছবি কথাটা বলল, প্রতিষ্ঠা অবাক হয়ে তাকাল ছবির মুখের দিকে, দেখল, ছবির মুখে এখন কোন হাসি নেই।
একটু সময় নিয়ে প্রতিষ্ঠা বলল, “এভাবে ভাবতে তোমায় কে শেখাল, ছবি”?
ছবির মুখের হাসি আবার ফিরে এসেছে, স্বাভাবিক স্বরে বলল, “কি যে বলো, না, মিঠুদিদি। আমাদের আবার ভাবনা-চিন্তা, আমরা কি আর লেখাপড়া শিখেছি তোমাদের মতো? একে গ্রামের স্কুল তার ওপর আবার ক্লাস সিক্সের বিদ্যে, মনে এল, বলে ফেললাম। ওসব ছাড়ো, টিফিন খেয়েছিলে? এখন তোমার খুব খিদে পেয়েছে, না”? এইটুকু সঙ্গে আসতে আসতে প্রতিষ্ঠা রীতিমত আশ্চর্য হতে থাকল, ছবির কথায় আর আচরণে। প্রতিষ্ঠা একটা হাত ধরল ছবির, তারপর খুব আবেগের সঙ্গে, বলল “তুই ঠিক কী বলতো, ছবি, তুই মোটেই আর পাঁচজনের মতো না, একদম অন্যরকম”।
ছবির মুখে হাল্কা হাসি। দুজনে হাত ধরেই বাড়ি ফিরল, কেউ আর কোন কথা বলল না রাস্তায়।
ওরা দুজনে ফ্ল্যাটে এসে দেখল, দরজা খোলা, বিমলামাসি আর মালতী বসার ঘরের মেঝেয় বসে আছে। আর প্রতিষ্ঠার মা বসে আছেন চেয়ারে। ওদের দুজনকে দেখে প্রতিষ্ঠার মা বলে উঠলেন, “ওই তো, ওরা চলে এসেছে। ছবি, দ্যাখ, তোর মা বিশ্বাসই করছিল না, যে তুই একদম কাঁদিসনি – মন খারাপ করিসনি। সকাল থেকে সারাটাক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকে, আমার কত কাজ করে দিল, ছবি। সারাটা দুপুর কত কি গল্প করলাম। সাড়ে তিনটে নাগাদ আমার জন্যে এককাপ চা করে দিয়ে ছবি মিঠুকে আনতে গেল”।
মালতীর সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছিল না। অবাক হয়ে যাচ্ছিল ছবিকে দেখে। ছবির পরনে বেশ ভালো একটা ফ্রক, নিশ্চয়ই দিদিমণির পুরোনো ফ্রক। যদিও ছবির চেহারার তুলনায় একটু বড়োসড়ো, কিন্তু মানিয়েছে বেশ। সবচেয়ে অবাক হল ছবির মুখে হাল্কা হাসি দেখে।
ছবি হাঁটু গেড়ে বসল মায়ের কাছে, জিজ্ঞাসা করল, “কী দেখচ কি, অমন করে? আমি ভালো আছি, মা, আমার জন্যে একটুও চিন্তা করো না। মামীমা, মিঠুদিদি খুব ভালো, মা। সত্যি আমি ভালো আছি। তুমি সাবধানে থেকো মা। তিন তিনটে বাড়ির বাসন মাজা, ঘর মোছা, এত পরিশ্রম তুমি কোনদিন করনি। তুমি আর দেরি করো না, বাড়ি যাও, ফিরতে ফিরতে তোমাদের সেই রাত হয়ে যাবে, কাল আবার ভোরে উঠে বেরিয়ে পরতে হবে। তুমি এখন এসো, মা”।
মালতীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল নিঃশব্দে, মেয়ের কথায় অবাক হওয়া ছাড়া, তার আর কিছু বলার ছিল না। মালতী উঠে পড়ল, সঙ্গে বিমলামাসিও। প্রথমে সিঁড়ি দিয়ে, তারপর ব্যালকনি থেকে ছবি দুচোখ ভরে দেখতে লাগল তার মায়ের চলে যাওয়া। এই প্রথম ছবির মুখে কোন হাসি নেই, এখন তার দুচোখে গভীর মায়া আর বেদনা জমাট হয়ে রইল অনেকক্ষণ। প্রতিষ্ঠা দেখছিল, তার মাও দেখলেন সব, কিছু বললেন না। ছবির আচরণ তাঁদের মধ্যেও এক অদ্ভূত মায়ার সংক্রমণ ঘটে যাচ্ছিল।
চলবে...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।