দেখা না দেখায় মেশাঃ পর্ব ৬
ঘড়ির দুইটি কালো হাত
আমার নিউ টাউনের বাড়িটি একতলা। ছেলের পয়সায় কেনা।
ভেবেছিলাম বুড়ো বয়সে কোন গেটেড কমিউনিটিতে থাকব। তাতে সিকিউরিটি থাকবে। মেন্টেন্যান্স স্টাফ থাকবে।
কিছু দোকানপাট, ক্লাব, হবে। সবচেয়ে বড় কথা জলের বা বিজলির লাইন খারাপ হলে প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিশিয়ান খুঁজতে যেতে হবে না।
হাউস সার্ভিসকে একটা ফোন করলেই, ব্যস।
কিন্তু রীমা ফ্ল্যাটে বন্ধ থাকতে চায় না। ওর ইচ্ছে একটু জমি হবে।
ও ফুল এবং সামান্য তরি-তরকারির চাষ করবে।
জাঠ পরিবারের মেয়ে। জমি আর চাষবাস ওদের রক্তে।
তাই ছেলে মাকে কিনে দিল এই বাড়িটা।
চারকাঠা জমি, পাঁচিল তোলা।
রীমার ছিল বাগানের শখ। এখন ও নেই, মালি রাখি নি। বাড়ির পেছন দিকটা জঙ্গল হয়ে রয়েছে।
ছ’মাসে একবার লোক ডেকে পরিষ্কার করাই। আমার বড্ড সাপের ভয়।
যাই হোক, গাছপালা আর পাঁচিলের উপর দিয়ে সূর্য আমার ঘরে উঁকি দেয় একটু বেলায়।
সকাল ছ’টার সময় টাইমপিসের অ্যালার্ম বেজে উঠল—ক্রি-রি-রিং! ক্রি-রি-রিং!
কোনরকমে হাত বাড়িয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে পাশ ফিরে শুই।
কিন্তু বুড়ো মানুষের ঘুম একবার চটে গেলে ফের আসে না।
একে তো মাঝরাত অব্দি ঘুম আসে না। আর আমি ঘুমের বড়ি খাই না।
একবার খেয়ে দেখেছি পরের দিন সারাক্ষণ কীরকম ভোঁতা ভোঁতা লাগে।
তাই শেষ রাত্তিরে গাঢ় ঘুমের মধ্যে ওই অ্যালার্ম শুনলে মাথায় খুন চেপে যায়।
না, না। ভুল বললাম। খুন-টুন করব কেন? আমি ভীতু লোক, কারও সাতে পাঁচে নেই।
কাউকে খুন করার কথা ভাবতেই পারি না।
বলতে চেয়েছিলাম রাগে মাথায় রক্ত চড়ে যায়।
যেটা বলেছি সেটা হিন্দি জুমলা ‘সর পে খুন সওয়ার হোতে হ্যায়’ এর আক্ষরিক বাংলা।
অনেকদিন হিন্দি বলয়ে কাটিয়েছি, আমার একমাত্র বৌ রীমা—সে হিন্দি বলয়ের।
অবশ্য সওয়া বছর আগে সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছে।
-- মাথায় খুন চড়ে যায় মানে কাউকে খুন করতে ইচ্ছে করে, সে তুমি যাই বল না কেন।
--কাকে খুন করব? বাড়িতে আছেটা কে? একা মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে, খুন নয়।
আর আমার এই রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণের পৃথিবী ছেড়ে এক্ষুণি চলে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই।
--তা থাকবে কেন? নইলে কি এই বয়সে বাড়িতে এক মোহিনীকে নিয়ে আসতে!
এখন তোমার বাড়িতে এমন দু’জন আছে যাদের মাঝে মাঝে খুন করতে ইচ্ছে হতে পারে।
--দু’জন? তোমার কি মাথা খারাপ? নাকি চোখে ভুল দেখছ?
--হ্যাঁ, দু’জন—মোহিনী আর সিরি। এদের ব্যবহারে কখনও কখনও তোমার মাথায় খুন করার ইচ্ছে হতে পারে,
যেমন আজ সকালের অ্যালার্ম শুনে হোল।
--আবার ভাট বকছ! মোহিনী আর সিরিকে খুন করা যায় না। ওরা মেশিন, মানুষ নয়।
একজন রোবো, আরেকজন আদ্দেক রোবো—অ্যাপল কোম্পানির তৈরি।
ওদের অচল করে দেয়া যায়, বিকল করে দেয়া যায়।
ওরা আমার বাড়িতে আছে ঠিকই, তবে আমি চাইলেই ওদের ‘নেই’ করে দিতে পারি।
--এটাই খুন করা। একজনের অস্তিত্ব ছিল, তুমি তাকে ‘এই’ থেকে ‘নেই’ করবে, মানে খুন করবে।
--শুনুন একনম্বরী সমাদ্দার মহাশয়। কাউকে ‘নেই’ করে দিলেই ‘খুন’ বা ‘মার্ডার’ হয় না;
চাই জিঘাংসার বশে ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করে মেরে ফেলা।
অর্থাৎ খুন করার দৃঢ় ইচ্ছে এবং পরিকল্পনা , যাকে বলে Mens rea,
নইলে নরহত্যা বা হোমিসাইড হবে, মার্ডার বা খুন হবে না।
এমনকি আমি যদি হঠাৎ রাগের বশে মেরে ফেলি বা এমন আঘাত করি যাতে সে মরে যায়—
সেটা খুন হবে না, নরহত্যা হবে।
যেমন ঘুমের মধ্যে অ্যালার্ম শুনে মনে হয়েছিল টাইমপিসটা আছড়ে ভেঙে ফেলি!
--এসব দুনম্বরী তর্ক তোমার মতন দু’নম্বরকেই মানায়।
এগুলো তোমার ওই সবজান্তা ম্যানেকুইন মোহিনীকে বলে দেখ।
কার নাম দুন্দুভি কাকে বলে অরণি—সব বুঝিয়ে দেবে।
--কেটে পড় একনম্বর। এখনই ও এল বলে।
রীমার বাথরুমে ফ্ল্যাশ টানার আওয়াজ। কমোডে পূর্বনির্ধারিত খানিকটা অ্যাসিড বৃষ্টির পর ওর দিনচর্যা শুরু হয়ে যায়।
ঘরের রোজকার রুটিনে লেগে পড়ে। ওর যন্ত্রের মত ঘড়ি ধরে কাজ করা দেখে বাবার বলা কথা মনে পড়ে—
‘এইসব হইল নিত্যকর্ম, করলে পূণ্য নাই, না করলে পাপ’।
--মর্নিং স্যার, এখন আপনার থাইরোনর্ম ট্যাবলেট ৭৫ মিলিগ্রাম খাবার সময়।
এই যে জলের গ্লাস, আর এই ট্যাবলেট।
ওর হাতের ছোঁয়ায় কোন নরমসরম কোমল ভাব নেই, বরং ইস্পাতের কাঠিন্য।
আঙুল চামড়া ঢাকা, সে নেহাতই ওপর ওপর, যেন শীতের দস্তানা পড়ে আছে।
ওকে শাড়ি আর চারুলতা সিনেমার মত কনুই ঢাকা থ্রি-কোয়ার্টার হাতা ব্লাউজ পরানো হয়েছে।
নইলে হাত বাড়াতে গেলে ওর কনুই আর কাঁধের কাছে দুটো স্টিলের রিবেট আর স্ক্রু দেখা যাবে।
হাত বাড়ানোর কায়দায় কোন ‘লীলায়িত’ ভঙ্গিমা নেই।
বরং একটা খটখটে মিলিটারিদের মার্চ করার বা স্যালুট মারার স্টাইল।
--মোহিনী, অসময়ে ঘুম ভেঙে মাথা ধরে আছে। এক কাপ লিকার চা খেলে হত।
--অবিনাশ স্যার, ডাক্তারের লিখিত নির্দেশঃ
এক, থাইরয়েডের ওষুধ খালি পেটে। দুই, তার একঘন্টা পরে চা-বিস্কুট।
মাঝখানে শুধু জল খাওয়া যাবে।
তখনই টের পাই মোহিনী একটা মানবিক অনুভূতিহীন রোবো।
এর সঙ্গে রীমার তুলনা করার কোন মানে হয় না।
রীমা হলে মাঝে মধ্যে নিয়ম ভাঙা যেত।
একঘন্টা না মেনে পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরেও চা খাওয়া যেত।
এর কাঁধে মাথা রেখে কি কাঁদা যায়!
কেন যে বিজ্ঞাপনের লাইনটা দেখে মুর্গি হলাম!
মোহিনী আমার দৈনন্দিন রুটিন জানে।
মানে একটা প্রিন্ট আউট আমার লেখার টেবিলের পাশে দেয়ালে টেপ দিয়ে লাগানো আছে।
আর সেটা একটা ছোট কম্যান্ড ফাইল বানিয়ে “আশ্চর্য প্রদীপ” কোম্পানি ওর মধ্যে ইনস্টল করে দিয়েছে।
এতে ওষুধ, খাবার, ব্যায়াম সবই বলা আছে।
এছাড়া আছে আর একটা ফাইল, সাম ডু’জ অ্যান্ড ডোন্টস্— ‘চলবে আর চলবে না’ লিস্টি।
এই নামটা রীমার দেয়া। ওর চোখে কোলকাতা কেবল “চলবে না” শ্লোগানের শহর।
আমার মোবাইলে একটা পিং হোল। মোহিনী এসে দাঁড়িয়েছে।
“স্যার, মর্নিং ওয়াক, ফর্টি ফাইভ মিনিট—নো লেস”।
আমি একটা টি শার্ট গলিয়ে জুতোর ফিতে বেঁধে ঘর থেকে বেরোই।
পকেটে মোবাইল রাখতে ভুলি না।
আর ঘরের বাইরে বেরিয়ে প্রথম ডু’ -- বাইরের দরজায় একটা ডাবল লিভারের তালা লাগিয়ে দেয়া।
কোম্পানি থেকে পই পই করে বলে দিয়েছে—যেন ভুল না হয়।
ভুলভাল পাবলিক এসে মোহিনীকে দেখে চমকে যেতে পারে।
দু’মাস হয়ে গেছে মোহিনী আমার এক অর্থে নিত্যসঙ্গিনী হয়েছে।
কোন সমস্যা হয় নি।
তালা লাগাতে একদিনও গাফিলতি করি নি। কাকপক্ষীও ঘুণাক্ষরে কিছু জানতে পারে নি।
আমার বন্ধু সুপ্রিয় একদিন বাড়িতে এসে আড্ডা দেবে বলেছিল।
আমি আগ্রহ দেখাই নি।
অজুহাত দিলাম—আমার বাড়ি এখন উদাসী বাবার আখড়া। এসে তোর ভাল লাগবে না।
কাজের লোক, রান্নার মাসি –কেউ নেই। ড্রাইভারও নেই।
তারচেয়ে আয় নিউ টাউনের ইকো পার্কে। জলের পাশে গাছের ছায়ায় বসে আড্ডা দেয়া যাবে।
আমি বাস এবং অটো ধরে চলে যাব। চা-কফি এবং খিদে পেলে সাঁটানোর নানারকম দোকান, রেস্তোরাঁ আছে।
ও বুঝল।
আজ ঘন্টাখানেক হাঁটলাম। ঘরের কাছে একটা পার্ক মতন।
ঠিক পার্ক না, কয়েকটা গাছের নীচে গোটা দুই বেঞ্চি পাতা। বসে পড়লাম।
একটু যেন হাঁফ ধরেছে। নাঃ প্রেসার বাড়েনি। বয়েস জানান দিচ্ছে বোধহয়।
একজন আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ আমাকে খেয়াল করে দেখল, থেমে গেল।
তারপর এক পা দু’পা করে এগিয়ে এসে বলল, ‘নমস্কার। আমি সুবিনয় বক্সী। আপনার পাড়াতে দুটো লাইন পেছনে থাকি।
একটু বসতে পারি?
আমি অবাক, এবং কিঞ্চিৎ বিরক্ত। সাতসকালে গল্প করার ইচ্ছে নেই।
--আপনি মিঃ সমাদ্দার তো?
--হ্যাঁ, কিছু বলবেন?
--কিছু মনে করবেন না। একটা কথা। কাল রাত্তিরে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরছিলাম।
তখন বোধহয় দু’টো বেজে গেছে। উবের ট্যাক্সি আপনার কর্নার প্লটের পাশ দিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ মনে হোল আপনার পেছনের একটা ঘরে নীল আলো জ্বলছে নিভছে।
না মশাই, ভুত টুত মানি না। কিন্তু কেমন অস্বস্তি হোল।
নীল আলো, পেছনে একটা ছায়ামূর্তি, স্থির –নড়ছে চড়ছে না।
অথচ সবাই জানে স্ত্রীবিয়োগের পর থেকে আপনি একলা থাকেন।
--হয়ত আমাকেই দেখেছেন। আমার অনেক সময় রাতে ঘুম আসে না। উঠে বই পড়ি।
--না মশাই, আপনার বড় বেডরুমের আলো তো নেভানো ছিল।
এটা পেছনের ছোট রুমটার কথা বলছি। আর বই পড়তে নীল আলো?
আমি উত্তর না দিয়ে উঠে পড়ি । এসব খেজুরে কথার উত্তর হয় না।
---চললেন? রাগ করলেন নাকি?
--না না। আমার বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেছে। নাস্তা করে ওষুধ খেতে হবে।
বাড়ি ফিরে তালা খুলি। চারপাশে তাকিয়ে দেখি। লোকজন ব্যস্তসমস্ত হয়ে যে যার ধান্ধায় ঘুরছে।
আমার বাড়ি এবং নতুন সদস্যকে নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।
এই হচ্ছে দুনিয়া। এ সংসারে তুমি কার, কে তোমার!
টোস্ট, বয়েল্ড এগ, কিছু বেদানার কুচি, এক কাপ হট চকলেট বা কফি।
দু’তিন রকম মেনু, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।
--শোন মোহিনী। রাত্তিরে তোমার ঘরে জানলা ভেজিয়ে দেবে।
--ইয়েস স্যার।
এটাই সমাধান।
রাত দুটোর পরে মোহিনীর চার্জ হওয়ার সময় মেশিনের ডায়ালগুলোর নীল আলো ঠিকরে বাইরে কারও চোখে না পড়ে !
আর মোহিনীর ঠান্ডা বা গরম লাগে না।
জলখাবারের সময় মোহিনী দাঁড়িয়ে থাকে।
ও তো খায় না। তবে বসতে বললেও বসে না।
ওরকম কম্যাণ্ড দেয়া নেই যে।
আমার কেমন অস্বস্তি লাগে।
যেন বাড়ির রান্নার মাসি পারুলের মা দাঁড়িয়ে আছে। কিছু চাইলে এগিয়ে দেবে।
কিন্তু পারুলের মা ভরপেট নাস্তা করত। আমাদের হয়ে গেলে।
তবে হট চকলেটের জায়গায় দুধ দিয়ে ফোটানো চা।
বেদানা? প্রশ্নই ওঠে না।
ও কখনও চেয়ারে বসে নি, বললেও না। ওর কথা হোল অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে দাদাবাবু।
আমি আরও তিনটে বাড়িতে ঠিকে কাজ করি। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, নয়তো ঘরের মেজেতে বসতে হয়।
কেউ মাটিতে বসে খাচ্ছে দেখলে খারাপ লাগে, তাই উঠে নিজের কামরায় যেতাম।
সকালবেলায় একা একা নাস্তা করতে দেখলে রীমা হেসে বিদ্রূপ করত।
—আরে বাহ্ ! আকেলে আকেলে!
ইঁহা ভী ‘একলা চলো রে’? ভুলে গেছ যে ঘরে আরেকজন আছে!
ও পছন্দ করত সবকিছু তৈরি করে টিপট ভর্তি চা নিয়ে একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে নাস্তা করা।
কলকল করে কথা বলত।
কখনও বলত—আজকে দাড়িটা কেটে ফেলুন সমাদ্দারবাবু। তবে না কাটলেও আপনাকে একই রকম দেখায়।
কখনও কিছু পিএনপিসি। একবার শুরু হলে আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শি কাউকে ছাড়ত না।
তবে ওর কিসসাগুলোতে বিদ্বেষ থাকতো না। শেষে দুজনেই হেসে ফেলতাম।
ও চমৎকার অন্যদের নকল করে দেখাত, ভঙ্গী ও গলার স্বর সমেত।
একবার বলেছিলাম—তোমার উচিত ছিল ঘরকন্না ছেড়ে স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হওয়া। ভাল আয় হত।
কথাটা বেজায়গায় লেগে গেল। ও হাসল না, মুখটা কেমন মেঘলা হয়ে গেল।
সে কয়েক সেকন্ড মাত্র। তারপরেই হেসে উঠে বলল—আর তুমি অবু?
তোমার হওয়া উচিত সরকারি অফিসের কলমপেষা ক্লার্ক।
ব্যাংকের কাজে কাস্টমারদের সঙ্গে ভাল করে কথা বলা দরকার; তাদের টুপি পরাতে হবে তো।
সারাক্ষণ অমন দুখীরাম মুখের চেহারা !
খবরের কাগজ নিয়ে বসেছিলাম।
মোবাইলে পিং! মেসেজঃ ডিসকাশন টাইম।
এইসময় মোহিনী এসে ড্রইংরুমে আমার মুখোমুখি বসে। আমার নির্ধারিত ‘বুদ্ধিজীবী আড্ডা’।
ভুল বললাম, বরং বলা উচিত ‘বৌদ্ধিক’।
বিলাসপুরে আর এস এসের রোববার রোববার ‘বৌদ্ধিক’ প্রোগ্রাম হয়।
আমি দু’একবার বন্ধুদের সঙ্গে গেছি। তাকে আড্ডা না বলে ক্লাসরুম বলাই ভাল।
মাস্টারমশাই গোছের কেউ এসে টপিক ঠিক করে দেন। প্রশ্নটশ্ন বিশেষ হয় না, হলেও নিরিমিষ গোছের।
কোলকাতার বামপন্থী স্টাডি সার্কলও তাই—ক্লাসরুম মডেল।
আড্ডা কোথায়? বিতর্ক কোথায়?
আমার এখানেও তাই। টপিক আমি ঠিক করি। প্রশ্ন আমি করি, মোহিনী উত্তর দেয়।
সেই ক্লাসরুম।
টিচার আর স্টুডেন্ট একাসনে বসার যোগ্য নয়।
আমি আর মোহিনীও সমান নই, আড্ডা হয় সমানে সমানে। রোবো’র সঙ্গে আড্ডা?
কন্ট্রাডিকশন ইন টার্মস্! ল্যাঙটের বুকপকেট!
--সমাদ্দার স্যার, বলুন কী জানতে চান?
-- শোন মোহিনী, মার্ডার আর হোমিসাইড কি এক?
ওর চোখের পাতায় তিনবার ফরফর।
--হোমিসাইড জেনাস, মার্ডার স্পিসিজ।
--একটু সহজ করে বল—ম্যাথসের ভাষায়।
--হোমিসাইড ইউনিভার্সাল সেট, মার্ডার তার সাবসেট।
--আরেকটু সহজ? বোলচাল কী ভাষা মেঁ?
--সব মার্ডারই কাল্পেবল হোমিসাইড, কিন্তু সব কাল্পেবল হোমিসাইড মার্ডার নয়।
--অনেকটা বুঝেছি, সবটা নয়।
আচ্ছা, তুমি এই তিনটে সংজ্ঞার মানে গোদা বাংলায় বলে দাও।
পাঁচবার চোখের পাতায় ফরফরানি।
-স্যার, হোমিসাইড ইকোয়াল টু নরহত্যা।
কারও মৃত্যু তিনভাবে হতে পারে। অসুখে, দুর্ঘটনায়, বয়সকালে আয়ু ফুরোলে।
এগুলো একটাও হত্যা নয়।
হত্যা মানে কোন মানুষের হাতে মৃত্যু।
সেটা নিজে করলে আত্মহত্যা বা সুইসাইড। অন্যে করলে নরহত্যা বা হোমিসাইড।
--বুঝেছি; সুইসাইড আত্মনেপদী, হোমিসাইড হোল পরস্মৈপদী। আগে বড়ো।
--কাল্পেবল হোমিসাইড মানে এই আঘাতের বা বিষের বা ওষুধের ফলে লোকটা নিশ্চিত মারা যাবে জেনেও কাউকে সজ্ঞানে মেরে ফেলা।
মার্ডার বা খুন করা মানে বিদ্বেষ থেকে প্ল্যান করে মেরে ফেলার জন্যেই আঘাত করা এবং লোকটার মৃত্যু হওয়া।
আর এই সবগুলো হোমিসাইড বা নরহত্যা অবৈধ বা বেআইনি হতে হবে, তবেই।
--আবার প্যাঁচ খেলছ? বৈধ নরহত্যা বলে কিছু হয় নাকি?
--চারভাবে নরহত্যা বৈধ হতে পারে।
নিজের প্রাণ বাঁচাতে , আদালতের ফাঁসির আদেশে, পুলিশ বা মিলিটারি নিজের ডিউটি করার সময় বাধ্য হয়ে;
অথবা কোন অসুস্থ লোক যদি স্বেচ্ছামৃত্যুর সম্মতি দিয়ে কাউকে বলে আমাকে মরতে সাহায্য কর।
--বুঝলাম। কিন্তু অবৈধ নরহত্যা কখন খুন বলে ধরা হবে না?
-- এক, সজ্ঞানে না ঘটলে—যেমন পাগল বা নেশায় অচেতন অবস্থায় কাউকে মেরে ফেললে।
দুই, হঠাৎ অত্যন্ত বেশি প্রোভোকেশনে উত্তেজিত হয়ে হত্যা।
যেমন নেভির কম্যান্ডার নানাবতী নিজের চোখে স্ত্রীকে অন্যের সংগে বিছানায় দেখে গুলি চালিয়েছিলেন।
তিন, অ্যাকসিডেন্ট।
বন্দুক পরিষ্কার করতে গিয়ে গুলি ছুটে গেলে, গাড়ি চালাতে গিয়ে সামলাতে না পেরে কাউকে চাপা দিলে,
পাখি মারতে গুলি অন্য লোকের গায়ে লাগলে।
--সে কী, একজন নির্দোষ লোকের প্রাণ গেল—কোন শাস্তি হবে না?
--হবে; প্রাণদণ্ড হবে না। দশ বছর অব্দি জেল হতে পারে।
আমি ছটফট করি। নিজে উঠে গিয়ে এক গেলাস জল গড়িয়ে খাই। পায়চারি করি।
মোহিনী আগের মতই সোফায় স্ট্যাচু হয়ে আছে।
--শোন মোহিনী। মানুষের প্রাণ অমূল্য। আমরা চাইলেই একে অপরের প্রাণ নিতে পারি না।
নইলে আদিম শিকারের যুগে ফিরে যেতে হত। কারোর অধিকার আছে কি অন্যের প্রাণ নেয়ার?
--আছে। রাষ্ট্রের। বাট আফটার ডিউ ডিলিজেন্স।
উফ্ আমি অন্য কিছু বলতে চাইছি।
-- মোহিনী। মন দিয়ে শোন। ধর, একজন মানুষ, নারী বা পুরুষ, যদি তার খামখেয়ালিপনায় তার সঙ্গীর মৃত্যুর কারণ হয় সে কী অপরাধী?
মনে কর ফ্রিজে জল ঢুকছে, ইলেক্ট্রিক ইস্ত্রিতে বা টিভি সেটের তার শর্ট হয়ে গেছে বা গ্যাসের সিলিন্ডার ঠিক মত বন্ধ হয় নি।
সে তার পার্টনারকে সতর্ক করবে করবে ভেবেও করেনি।
এখন পার্টনারের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে সে কতটা দায়ী?
--নেগলিজেন্স; কালপেবল হোমিসাইড নট অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার।
একের অসাবধানতায় অন্যের মৃত্যু। পাঁচ থেকে সাত বছর, কেস বুঝে।
--শোন, তুমি এবার যাও। ডিস্মিস্!
সারাদিন কিচ্ছু ভাল লাগেনি। রাতের খাওয়ায় স্বাদ পাইনি।
মাঝরাত অব্দি ঘুম না আসায় উঠে জল খেলাম।
তারপরে পা টিপে টিপে মোহিনীর কামরার দিকে রওনা হলাম।
সত্যি কি ঘুমোয় না? নাকি বসে বসে ঝিমোয়?
এরকম ভাবে কতবার রাতে রীমার কামরায় গেছি। ঘুমিয়ে কাদা রীমাকে দেখতে বড় ভাল লাগত।
ধীরে ধীরে শ্বাস বইছে। বুক তালে তালে উঠছে নামছে।
কিছু একটা বিড়বিড় করে পাশ ফিরল, বোধহয় স্বপ্ন দেখছে।
মোহিনীর ঘরে জানলা বন্ধ। নীল আলো জ্বলছে। অন্ধকারে চেয়ারে বসে থাকা নারীমূর্তির আবছা অবয়ব।
দাঁড়িয়ে পড়ি। নাঃ এ তো একটা রোবো, কোন নারী নয়।
ফিরব বলে নড়তেই মোহিনী বলে উঠল—স্যার, কী চাই?
ভীষণ চমকে উঠে তোতলাতে থাকি।
--তু-তুমি মানে তোমার এখন চার্জিং শুরু হওয়ার কথা না?
--দুটো বাজতে এখনও তিন মিনিট বাকি। বলুন কী চাই?
আমি ভুলে যাই কেন এসেছিলাম। হ্যাঁ, একটা প্রশ্ন এখনও বাকি রয়ে গেছে।
--না, কিছু না।
বলার সঙ্গে সঙ্গে একটা খিক-খিক-খিক-খিক করে হাসি। হাসি আর থামে না।
আমি থরথর করে কেঁপে মাটিতে পড়ে যাই। হাসিটা অবিকল রীমার।
অজ্ঞান হই নি। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হতে পারত।
হুঁশ ফিরতে শুনতে পাই মোহিনী বলছে—হে সিরি! স্টপ ইট্। স্টপ ইট্! হে----!
ঘড়ি দেখি, দুটো বেজে এক। মোহিনীর চার্জ ফুরিয়ে গেহে।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।