দেখা না দেখায় মেশাঃ পর্ব ১১
চা-পান পর্ব শেষ হলে ওসি সিনহার ইশারায় হালদার তাঁর রেকর্ডার অন করলেন। মোহিনী সামনে দাঁড়িয়ে।
--আপনি বসুন মোহিনী দেবী।
মোহিনীর ভাবটা যেন সেই আমাদের মার্বেল খেলার কোড মেনে—নট নড়ন চড়ন, নট কিস্যু!
সিনহা সাহায্যের আশায় আমার দিকে তাকালেন।
আমি বলি—শোন, মোহিনী, তুমি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সাহেবের মুখোমুখি বসে পড়। ইনি কিছু প্রশ্ন করবেন, তখন উত্তর দেবে।
--আপনার নাম, বাবা মা’র নাম, জন্মস্থান?
মোহিনী কোন উত্তর দেয় না, ওর চোখের পাতা ফরফর করে। সিনহা ফের আমার দিকে তাকান।
--আগেই বলেছি, এ প্রশ্নগুলো ওর জন্যে অর্থহীন। একটি যন্ত্রমানবীর বাবা-মা বা জন্মস্থান বলতে কী জানতে চান?
ও তো কোন মায়ের গর্ভে জন্মায় নি।
--তাহলে কী লেখা উচিত, আপনিই বলুন।
--লিখুন নাম—মোহিনী, পরিচয় রোবো, পিতামাতা নন- বায়োলজিক্যাল, তাই নট অ্যাপ্লিকেবল।
ও হ্যাঁ, জন্মস্থান বলতে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির নাম লিখতে পারেন।
--ওকে, সেটাই বলে দিন।
--আশ্চর্য প্রদীপ? মানে আলাদিনের?
--বটেই তো, আর কার হতে পারে? ওয়েবসাইট খেয়াল করুন।
--তা এদের কারখানা বা অফিস কোথায়?
এবার আমার একটু অস্বস্তি হয়। সেটা মিঃ সিনহা খেয়াল করেন।
--কী হোল সমাদ্দার, অফিস বা ল্যাব বা কারখানার ঠিকানা?
--আমার জানা নেই।
--মানে? আপনি অনেক টাকা পেমেন্ট করে মোহিনী দেবীকে আপনার বাড়িতে আনিয়েছেন।
অথচ কাদের পেমেন্ট করলেন, তারা কারা? তাদের ঠিকানা কী—এসব জানেন না। এটা কী রকম পাজল্?
আমি কিছু বলার আগে সুপ্রিয় মুখ খোলে।
--মিঃ সিনহা, আপনি কখনও বিট কয়েন কিনেছেন বা সেটা দিয়ে কাউকে পেমেন্ট করেছেন?
--হঠাৎ এই কথা?
---যাঁরা বিট কয়েন কেনেন তাঁরা কি সঠিক জানেন যে আসল মালিক কে? কয়েন কোন কারখানায় তৈরি বা তাদের অফিসের ঠিকানা?
আমেরিকা এবং ইউরোপের অনেক দেশে এটা সম্পূর্ণ আইনি ব্যাপার। মনেরো বলে ক্রিপ্টো কারেন্সি আছে, যার বাবা-মা চেনা মুশকিল।
--কেন কথা ঘোরাচ্ছেন উকিল মশায়? এটা আমেরিকা নয়। কাজেই আমার বিট কয়েন কেনার বা ক্রিপ্টো কারেন্সিতে লেনদেন করার প্রশ্ন অবান্তর।
বন্ধুকে হেল্প করতে হলে বলুন আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে। সোজাসুজি। আমি খুব সাধারণ বুদ্ধির প্রশ্ন করেছি।
সমাদ্দার বাবু মোহিনী দেবী নামক, থুড়ি একটি নারীর মত দেখতে রোবোকে বাড়িতে এনেছেন। অর্ডার দিয়ে এবং পেমেন্ট করে।
তা উনি কোত্থেকে কিনলেন, কাকে পেমেন্ট করলেন সেটা বলতে পারছেন না? কেন?
-- কারণ, ভারতে বিট কয়েন বা ক্রিপ্টো কারেন্সিতে লেনদেন বে-আইনি নয়। কাজেই আপনি বা আপনার চেনা কেউ লেনদেন করে থাকতে পারেন।
তবে আমেরিকার মত অমন ঢিলেঢালা নয়। বেশ কড়া নিয়মকানুন এবং শর্ত আছে। তাই, আমার কথাগুলো অপ্রাসংগিক নয়।
--সেটাই তো কথা। উনি ক্রিপ্টো দিয়ে পেমেন্ট করেছেন? এতক্ষণ বলেন নি কেন? কোন কারেন্সিতে? বিট-কয়েন কি অন্য?
তাহলে আমাকে ওনার লেনদেন দেখতে হবে।
অর্থাৎ ভারত সরকার বিরোধী কোন সংস্থাকে পেমেন্ট করেছেন কিনা, ট্যাক্সের কোন নিয়ম ভেঙেছেন কিনা সেটা দেখাও আমার কাজ।
চিন্তা করবেন না। আপনার মত আইনজানা বন্ধু থাকতে উনি কি জেনেশুনে কোন আইনবিরোধী কাজ করবেন?
আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে আমি সেগুলো চেক করে রিপোর্টে ওনাকে ক্লিনচিট দিয়ে দেব।
উঃ সুপ্রিয় মাঝখানে ডাইভ মারায় হিতে বিপরীত হচ্ছে মনে হল। নাঃ আর না পেঁচিয়ে সুতো গুটিয়ে আনা উচিত।
আমি একটু গলা চড়াই।
--শুনুন সিনহা সাহেব। আমি একবারে আপনার সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিচ্ছি। আর আপনার কাল সন্ধ্যেতে থানায় তোলা প্রশ্নগুলোরও।
এক, আমি পেমেন্ট করেছি অনলাইনে, পুরো একনম্বরে। আমার ব্যাংক ট্রানজাকশনের স্টেটমেন্ট দেখলেই বুঝতে পারবেন। কত টাকা এবং প্রাপকের নাম সবই।
হ্যাঁ, আমার লেনদেন ভারতীয় টাকায়, কোন ক্রিপ্টোতে নয়। আমি ফাটকা খেলি না। এখনই পাসবুক এনে দেখিয়ে দিচ্ছি।
দুই, প্রাপকের নাম ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ যাদের মূল অনলাইন রেজিস্টার্ড নাম ‘আলাদিন’।
পেমেন্ট গেছে ব্যাংকের অনলাইন ট্রানজাকশনের মাধ্যমে। মূল দাম ছিল ১০০০ ইউরো।
তবে পেমেন্টের দিনের বিদেশি মুদ্রার বিনিময় দর, ব্যাংকের কমিশন ইত্যাদি বাবদ একলক্ষ টাকার সামান্য বেশি লেগেছে।
টাকাটা আমার সেভিংস ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এসেছে আমারই একটা লাখটাকার পুরনো ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে।
সেই ডিপোজিট আমার রিটায়ারমেন্টের সময় পাওয়া গ্র্যাচুইটি ফান্ড—
--ব্যস ব্যস। টাকা পয়সা নিয়ে আর কিছু জানার নেই। তবে আপনার পাসবুকের সামনের পাতা এবং ওই লেনদেনের পাতার স্ক্যানড্ কপি দিয়ে দেবেন।
কিন্তু অফিস বা ফ্যাক্টরির ঠিকানা?
ফের সুপ্রিয় মাঝখানে ডাইভ মারে। আমায় ডুবিয়ে ছাড়বে দেখছি!
--সিনহা স্যার, আপনি অ্যামাজন থেকে অনলাইনে জিনিস কেনেন? কেনার আগে কী দেখেন আর কীভাবে পেমেন্ট করেন?
হালদারবাবু মুখ খোলেন।
--হ্যাঁ, আমি কিনি—জামাকাপড়, রান্নাঘরের দরকারি জিনিস, দেওয়ালির সময় চাইনিজ আলো—এইসব।
কী দেখি? ওদের সাইটে গিয়ে ছবি দেখি। অন্য ক্লায়েন্টদের রেটিং ও মন্তব্য পড়ে ফাইনাল প্রোডাক্ট সিলেক্ট করি।
--বাঃ আপনি তো বেশ মডার্ন পুলিশ। পাড়ার দোকান থেকে কেনেন না?
-- আসলে আমি না, আমার বেটার হাফ। ও স্মার্ট ফোনে এইসব দেখে জিনিস পছন্দ করে।
তারপর আমি কার্ড দিয়ে অনলাইনে পেমেন্ট করে দিই আর বাড়িতে জিনিস ডেলিভারি হয়।
এইভাবে আমরা ফ্রিজ কিনেছি। কোম্পানির লোক বাড়িতে এসে চালু করে গেছে। আর আমাদের সুবিধের জন্যে গিন্নির হাতে একটা ম্যানুয়েল দিয়ে গেছে।
--কোন দোকান থেকে ফ্রীজ এসেছে সেটা জানেন? বা তাদের ঠিকানা?
--না তো। আমি আদার ব্যাপারী জাহাজের খোঁজ নিয়ে কী করব? জিনিস পছন্দ করে একনম্বরে অনলাইনে পেমেন্ট করেছি। মাল আমার ঘরে এসে দিয়ে গেছে।
কোয়ালিটি বাজিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হয়েছি। কখনও খুঁত দেখলে সেই অনলাইনেই কমপ্লেইন। লোক এসে বদলে দিয়ে গেছে ব্যস।
সুপ্রিয়র মুখে বিজয়ীর হাসি।
---দেখলেন তো সিনহা স্যার। আপনার হালদার বাবু যা করেন আমার বন্ধুও ঠিক তাই করেছে।
অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেছে, জিনিস পছন্দ করে অর্ডার দিয়েছে এবং অনলাইনে একনম্বরী পেমেন্ট করেছে—ভারতীয় রুপিয়াতে।
ঘরে লোক এসে জিনিস ফিট করে চালু করে দেখিয়ে দিয়ে গেছে এবং ম্যানুয়াল ধরিয়ে চলে গেছে।
আমি হাঁফ ছাড়ি, সুপ্রিয়কে মনে মনে ধন্যবাদ দিই, নিউ টাউনের সেই জাদু অফিস আর বিহারী ম্যানেজার অবধেশ কুমারের ব্যাপারটা চেপে দেয়া গেছে।
নইলে দুই বিহারী মিলে --।
অনেক হয়েছে, এবার দাঁড়ি টানা দরকার।
তাই বলি—গতকাল রাতের প্রশ্নগুলোর উত্তর আবার বলে দিচ্ছি, চাইলে মোহিনীকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
মোহিনী কে? একজন নারী রোবো।
কোত্থেকে এসেছে? অপ্রাসঙ্গিক, তবে সাপ্লায়ার কোম্পানির ওয়েবসাইট এবং ফোন নাম্বার দেয়া হয়েছে।
কোথাকার ভোটার? অপ্রাসঙ্গিক।
এখানে কার রেফারন্সে এসেছে? আশ্চর্য প্রদীপ সংস্থার অনলাইন বিজ্ঞাপনের রেফারেন্সে।
রাত্তিরে বাড়ি ফিরে যায়? অপ্রাসঙ্গিক, কারণ এখন এটাই ওর বাড়ি। আর ও হোল রোবো, নিজের থেকে কিছু করে না।
আমি যা কম্যান্ড দিই, তা পালন করে।
নাকি এখানেই রান্নাঘরে ঘুমোয়? ও যন্ত্রমানবী, ঘুমোনোর প্রশ্ন ওঠে না, রাত্রে চেয়ারে বসে দু’ঘন্টা রেস্ট নেয়।
তবে রান্নাঘরে নয়, ওর নিজস্ব ঘর আছে।
হাসছেন কেন? এত দামী যন্ত্র, বিশেষ যত্ন করে রাখবো না? অযত্নে হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে লোকসান কার?
আচ্ছা, আপনার গাড়ির জন্যে কোয়ার্টারে গ্যারেজ আছে তো? নাকি খোলা আকাশের নীচে পার্ক করিয়ে রাখেন?
দু’ঘন্টা বিশ্রাম কেন? ওই সময় ওকে চার্জ করা হয়।
--কে চার্জ করে, আপনি? হালদার প্রশ্ন করেন। ওর চাউনিতে একটু অশ্লীল হাসির আভাস।
--কেউ করে না। ও নিজে নিজেই চার্জ হয়। মানে ওর নিজস্ব কামরায় স্পেশাল চার্জার ফিট করা আছে।
রাত দুটো নাগাদ ও নিজেই গিয়ে চেয়ারে বসে প্লাগ ইন করে নেয়। ফুল চার্জ হতে দু’ঘন্টা লাগে।
--মানে রাত দুটো থেকে চারটে অব্দি আপনার সুরক্ষা থাকে না, তাই তো? কারণ মোহিনী তখন অকেজো। কি? ঠিক বুঝেছি?
এ হেন ব্যাখ্যার সামনে আমি এবং সুপ্রিয় থতমত খেয়ে যাই। কথাটা ঠিক, এভাবে ভাবি নি । ধীরে ধীরে মাথা হেলিয়ে ওনার কথায় সায় দিই।
--আচ্ছা, আমরা কি মোহিনী দেবীর নিজস্ব ঘর এবং চার্জিং অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখতে পারি?
--নিশ্চয়ই। শোন মোহিনী, আমার বন্ধুরা এখন তোমার ঘরে গিয়ে চার্জিং ব্যবস্থাটা একটু দেখতে চান। ততক্ষণ তুমি এখানেই বসে থাকো।
আমরা চারজন মোহিনীর ঘরে ঢুকে যাই। না, হালদারের ছ্যাঁচড়া কৌতুহল সত্ত্বেও ওর ঘরে মেয়েলি কোন জিনিস দেখা গেল না। সেটাই স্বাভাবিক।
ও প্রসাধন করে না। জামাকাপড় বদলায় দিনে মাত্র একবার, স্নানের সময়। সামান্য কাপড় জামা যা আছে, সেসব গুছিয়ে ওয়ার্ডরোবে তুলে রাখা।
সবচেয়ে বড় কথা ওর ঘরে কোন খাট, ডিভান এসব নেই। বিছানা পাতা বা গদি নেই। শুধু একটা কাঠের চেয়ার চার্জারের সামনে রাখা।
হালদার তাঁর হতাশা গোপন করতে পারছেন না। এখানে কোন পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ নেই।
হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন—আচ্ছা চার্জারের প্লাগের সকেট মোহিনীর শরীরের ঠিক কোন অংশে লাগানো রয়েছে, মানে যেখানে উনি প্লাগ ইন করেন।
একবার ভাবলাম বলি সেটা মোহিনীকে জিজ্ঞেস করুন, ফের হ্যান্ডশেক হবে। কিন্তু পুলিশ বলে কথা, ইচ্ছে হলেই ওদের সঙ্গে কিছু করা যায় কি?
আমি ওঁর চোখে চোখ রেখে বললাম—কোমরে, ঠিক সায়ার দড়ির ওপরের জায়গাটায়। আপনি কি একটা ডেমো চান, মানে কীভাবে চার্জ হয় দেখতে চান?
হালদার মাথা কাত করে। সিনহা হালদারের দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি ড্রয়ার থেকে একটা প্যাম্ফলেট বের করে ওনার হাতে ধরিয়ে দিই। এটা দেখুন, সব ডায়াগ্রাম এঁকে বোঝানো আছে।
লাইভ ডেমো সম্ভব নয়। মোহিনী রোবো হতে পারে, কিন্তু আমি নই। আমার রুচিতে বাঁধছে। চাইলে এটার স্ক্রীন শট নিয়ে যান।
খানিকক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপর আমরা বসার ঘরে ফিরে আসি। মোহিনী তেমনই বসে আছে, নিশ্চল পাথরপ্রতিমা।
কী ভাবে ওঁদের চলে যেতে বলি? মাথা এমন গরম হয়ে গেছে যে—
--কী সিনহা সাহেব, আরেক রাউন্ড চা হবে নাকি? দেখলেন তো, দশ মিনিটে চা এসে যাবে।
সুপ্রিয় ফের ডোবাচ্ছে, কোথায় ওদের চলে যেতে বলবে তা না! আমার স্নায়ুতন্ত্র এবার জবাব দেবে।
কিন্তু সিনহার উত্তর আমাকে আশ্বস্ত করে।
--নাঃ এবার আমরা উঠবো। বেলা হয়ে গেছে। থানায় গিয়ে রিপোর্ট লিখতে হবে।
কিন্তু হালদার যেন নাছোড়োবান্দা।
--একটা ছোট কাজ বাকি আছে—কোয়ালিটি চেকিং।
--মানে? কিসের কোয়ালিটি?
--আরে আপনি বললেন না যে মোহিনী দেবীর দুটো কোয়ালিটির জন্য আপনি কিনেছেন—সুরক্ষা এবং অবসর সময়ে বুদ্ধির চর্চা।
--হ্যাঁ, ওর বডিগার্ড কোয়ালিটি তো দেখে নিয়েছেন।
আমার গলায় বিরক্তি এবং বিদ্রুপ, সেসব হালদার গায়ে মাখলেন না।
হেসে জানতে চাইলেন উনি মোহিনীকে কিছু প্রশ্ন করলে আমার আপত্তি আছে কিনা।
ভাল জ্বালা! না কোন আপত্তি নেই।
আপনি প্রশ্ন করুন, তবে আমি সেটা দোভাষীর মত মোহিনীকে বলব—তখন সে উত্তর দেবে। ঠিক আছে?
শোন মোহিনী। আমার বন্ধুরা কিছু জানতে চান, তুমি যা জান তাই বলবে। মোহিনীর চোখের পলক দু’বার ওঠে নামে।
এরপর শুরু হয় আমাদের ত্রিপাক্ষিক কুইজ খেলা। তবে হালদারকে সরিয়ে ওসি সিনহা প্রশ্ন করতে শুরু করেন।
--প্রাচীনকালে একজন বিজ্ঞানী আপেক্ষিক ঘনত্বের মান বের করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর নাম?
--আর্কিমিডিস।
--কোথাকার লোক?
--গ্রীসের সাইরাকিউজ নগরীর।
--আবিষ্কারের মুহুর্তে উনি চিৎকার করে উঠেছিলেন কী বলে?
--ইউরেকা, ইউরেকা।
--তার মানে?
--পেয়েছি পেয়েছি।
সিনহা একটু থমকে গেলেন।
সেই সুযোগে হালদার শুরু করে।
--একজন বিখ্যাত বলিউডি নায়িকা বাথটবে স্নান করার সময় হার্টফেল হয়ে মারা যান। তিনি কে?
--শ্রীদেবী।
--ওনার সবচেয়ে বিখ্যাত নাচের কথাগুলো?
--হাওয়া হাওয়াই।
--ধক ধক করনে লাগা নায়িকা কে?
--মাধুরী দীক্ষিত।
আমার পারা চড়ছে দেখে সুপ্রিয় রাশ টানে।
--প্রথম দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার কে পেয়েছিলেন? কোন সালে?
--দেবিকা রাণী। ১৯৬৯।
--সত্যজিত রায় কোন সালে কান চলচিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ফিল্মের পুরস্কার পেয়েছিলেন?
এবার মোহিনী আটকে যায়। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে, চোখের পাতা ফরফর করে চলে।
হালদার মুচকি হেসে বলেন—একলক্ষ টাকা একটু বেশি নয় কি সমাদ্দার বাবু? তাও চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরে?
আমি উত্তর দিই না। ব্যাটা বোধহয় মোহিনীর ইস্পাতকঠিন হ্যান্ডশেকের ব্যথা ভুলতে পারে নি।
হঠাৎ মোহিনী ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকায়।
--প্রশ্নটা ভুল, সমাদ্দার স্যার। সত্যজিত রায়ের কোন ফিল্ম কান উৎসবে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পায় নি।
হালদার উত্তেজিত। যা খুশি বললেই হল! তাও সত্যজিতকে নিয়ে?
সবাই জানে ওনার পথের পাঁচালী কান চলচিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ সিনেমার পুরস্কার জিতেছিল, সেই ১৯৫৬ সালে।
--ভুল জানে। পুরস্কার জিতেছিলেন সেরা মানবীয় দলিল বিভাগে।
সন্নাটা ! সন্নাটা!
ফের আসরে নামলেন সিনহা সাহেব। উনি বোধহয় বিজ্ঞান বা ম্যাথস নিয়ে পড়েছেন।
--একটি গ্রীক অক্ষর দিয়ে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত মাপা হয়। সেটি কী?
--মাপতে হয় না। কারণ এটা যে কোন বৃত্তের জন্যে সমান-- অর্থাৎ ধ্রুবক।
--সে তো বুঝলাম, কিন্তু অক্ষরটা কী সেটা বলুন, তার ধ্রুবক বা কন্সট্যান্ট ভ্যালু কত?
--গ্রীক অক্ষর পাই; ভ্যালু ৩.১৪১৫৯---
--আচ্ছা, একজন বাঙালী বিজ্ঞানীর নাম একজন বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদের সঙ্গে জুড়ে একটা সমীকরণ আছে, সেই বিজ্ঞানীর নাম?
-- অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বোস-আইনস্টাইন ইকোয়েশন।
--ঈশ্বরকণা কাকে বলে?
--বোসন।
সিনহা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে থাকেন। আমি হাঁফ ছাড়ি। হালদার মোবাইলে কিছু খুটখাট করছেন। মোহিনী নির্বিকার।
কিন্তু সুপ্রিয়ের কি আশ মেটেনি? মহা ফক্কুড়ি স্বভাব।
--আচ্ছা মোহিনী, একজন বাঙালী বিপ্লবীর নাম এক আন্তর্জাতিক রাশিয়ান নেতার নামের সংগে জুড়ে একটি রাজনৈতিক থিসিস আছে।
থিসিসের নাম ও বিপ্লবীর নাম বলতে পারবে?
আমি বিরক্ত হই। এ আবার কি প্রশ্ন? রোবো বলে কি যা খুশি আল-বাল প্রশ্ন করা যায়?
কিন্তু পুলিশ অফিসারদের চোখে নীরব সমর্থন। ওঁরা যন্ত্রমানবীর হেরে যাওয়া দেখতে চান।
--মোহিনীকে উত্তর দিতে বলুন সমাদ্দার বাবু।
প্রশ্নটা মোহিনীকে শোনাই—নিতান্ত অনিচ্ছায়। আর মনে মনে সুপ্রিয়র শ্রাদ্ধ করি।
সবাইকে অবাক করে মোহিনী বলে ওঠে—রয় লেনিন থিসিস, মানবেন্দ্রনাথ রায়।
হাততালি! হাততালি! যদিও এই উত্তরটা কট্টর বামপন্থী সুপ্রিয় ছাড়া আমরা কেউই জানতাম না।
হেরে গিয়েও সবাই খুশি, এমনকি হালদারও ক্ল্যাপস্ দিচ্ছেন! আমার বেশ গর্ব হয়।
ওরা উঠে দাঁড়িয়েছেন। সামান্য সৌজন্য বিনিময়।
হ্যাঁ, আজকের মধ্যেই কয়েকটা কাগজ, যেমন আমার পাসবুক এবং ইউজার ম্যানুয়েল ইত্যাদির ফোটোকপি বা স্ক্যানড্ কপি থানায় জমা করতে হবে।
তাহলেই ওরা কাল নাগাদ রিপোর্ট কমপ্লিট করে সিটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পোলিসের দফতরে পাঠিয়ে দেবেন।
কিন্তু চাইলেই কি রেহাই পাওয়া যায়! পুলিশে একবার ছুঁলে আঠেরো ঘা।
হালদার নিজের মোবাইল দেখিয়ে ওসি সিনহার কানে কিছু ফিসফিস করে। ওনার ভুরু কুঁচকে উঠে।
আমি প্রমাদ গুণি। এই হালদার ব্যাটা মহা হারামি তো! ফের কোন প্যাঁচ?
--সমাদ্দার, একটু এদিকে আসুন। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের যে ফোন নাম্বার দিয়েছেন সেটা ঠিক তো? কোন ভুল হয় নি?
--না তো, একথা কেন বলছেন?
--দেখুন, মনে হচ্ছে কোলকাতার নাম্বার, ০৩৩ দিয়ে শুরু যখন। আপনার সামনে কল করছি, এবার স্পীকার অন করলাম। নিজেই শুনুন।
সবাই শুনতে পেলঃ This number does not exist.
আমি হতভম্ব, সুপ্রিয় অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়।
সিনহার চোখে দৃষ্টি খর, হালদারের চোখেমুখে একটা শিকার ধরার উল্লাস।
ওঁরা ফের সোফায় গ্যাঁট হয়ে বসলেন।
--তাহলে সমাদ্দারবাবু, এই ধাঁধার সমাধান আপনাকেই করতে হবে। তার আগে আমরা এখান থেকে নড়ছি না।
আমি কী বলব বুঝতে পারছি না।
ছোটলোক হালদার চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে—এমন একটা ফোন নাম্বার দিলেন পুলিশকে যার অস্তিত্ব নেই! ভাবা যায়?
আপনার বুকের পাটা আছে বলতে হবে।
হঠাৎ করে মাথায় টিউবলাইট জ্বলে ওঠে। ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স!
--দাঁড়ান, দাঁড়ান ! মনে পড়েছে। আগে আপনাদের কোন ফোন নম্বর দিয়েছি , 033-58132134 তো?
--হ্যাঁ। কেন, ওটা কি ভুল?
--না, ভুল কেন হবে? খালি ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স দিয়ে একটু বদলে নিতে হবে। তারপর সঠিক নম্বরটা হবেঃ ০১১—২৩৫৮১৩২১৩৪
সিনহার মুখের ভাবে মনে হোল উনি ভাবছেন ইয়ার্কি মারছি।
ওদের আর প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে কফি টেবিল থেকে ওনার মোবাইল তুলে নিয়ে সোজা ওই নম্বরে কল করি। রিং যাচ্ছে।
ওপাশে কেউ ফোন তুলতেই মোবাইল সিনহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি—নিন, কথা বলুন।
—হ্যালো!
--দিস ইজ ‘আশ্চর্য প্রদীপ” অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস্ । আপনার পরিচয়?
--আমি কোলকাতার পুলিশ অফিসার। কিছু ইনফর্মেশন আর ভেরিফিকেশনের জন্যে---
--সরি, এই নম্বর শুধু কাস্টমার সার্ভিসের জন্য। আপনি কি আমাদের কোন প্রোডাক্ট কিনতে আগ্রহী।
সবচেয়ে বেসিক মডেল শুরু হয় ১০০০ ইউরো থেকে।
--না না, এটা একটা ভেরিফিকেশন—
--সরি, তাহলে আপনাকে আমাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে স্পেসিফিক রিকোয়ারমেন্ট জানিয়ে মেইল করতে হবে।
গুড ডে, স্যার!
(চলবে
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।