১৯
বিজনের কথা
আমার মাথা ঝিমঝিম করে ।
বিছানায় ধপ করে বসে পড়ি। তারপর দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলি—তুই এবার যা, রমেন। আর আসিস না । আমি পাপ করেছি। আমি আর কোন ভাল কাজে হাত লাগানোর যোগ্য নই।
ওরা এমনভাবে তাকায় যেন মাথায় কেউ ডান্ডা মেরেছে।
শংকর চেঁচায়—গুরু, মাথাটাথা সব গেছে? যাও, বাথরুম গিয়ে মাথায় দু’মগ জল ঢেলে এস। তারপর ঝেড়ে কাশো।
হয়েছেটা কী? মদ খেয়েছ? নাকি রেসের মাঠে হেরে গেছ?
আমি মাথা নাড়ি। ওসব কিছু না । খুব লজ্জার ব্যাপার।
আমি নষ্ট হয়ে গেছি, এর বেশি কিছু বলতে পারব না ।
রমেন আমাকে কেমন একটা অদ্ভূত দৃষ্টিতে দেখছে। আমি চোখ সরাই।
শংকর উঠে এসে কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। তারপর বলে—দেখ গুরু, মনের অগোচর কোন পাপ নেই।
আর স্নানঘরে আমরা সবাই ন্যাংটো! বলে ফেল, বলে ফেল। নিজের মুখে বলে টেনশন-ফ্রি হও।
বুঝতে পারছ না ? আরে তোমার অবচেতন মন ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুলে বলতে চাইছে। নইলে পাপ কথাটা মুখ দিয়ে কেন বেরিয়ে এল?
নাও, জলটা খেয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে ‘কনফেশন’ শুরু কর। আমিই তোমার পাদ্রীবাবা।
“ এ আমার এ তোমার পাপ”!
তোরা তো জানিস যে আমার নেশা বলতে সিগ্রেট আর চা। অন্য কোন কিছু ছুঁয়ে দেখতেও ইচ্ছে হয় নি ।
তবে গত দশবছর ধরে একটা ব্যাপার হয়েছে , চুল কাটতে গেলে সেলুনে গিয়ে ভাল করে মালিশ করাই।
একটু অবাঙ্গালী নাপিত দেখলে খুশি হই। ওদের হেড ম্যাসাজ, হাত ও পিঠ ম্যাসাজ আমার গায়ের ব্যথা দূর করে দেয়।
এরা আজকাল একটা ইলেক্ট্রিক ম্যাসাজার দিয়ে মাথা, গাল চমৎকার ম্যাসাজ করে । আবার কানের ভেতর দু’ফোঁটা জল ঢেলে তার উপর ওই যন্ত্রটা চালিয়ে দারুণ আরাম দেয়।
শুনেছি পার্লারে নাকি ভাল ম্যাসাজ করে । মল-টলে অনেক্ শপ আছে। কিন্তু ওগুলোতে খুব খরচ হয়, আমার সিলেবাসের বাইরে।
হল কি, গতমাসে বেহালার পর্ণশ্রী ছাড়িয়ে একটা নতুন এলাকায় একজন স্টুডেন্টের বাড়ি গেছলাম। ওর ভাইরাল হয়েছিল।
ওদের বাড়িতে খাইয়ে দিল; মাসের মাইনেটাও হাতে হাতে দিয়ে দিল।
ফেরার সময় বাসরাস্তায় পৌঁছানোর জন্যে হাঁটছি প্রায় পনের মিনিট। বেলা তিনটে হবে। রোদের তাপ কমে নি । ক্লান্ত লাগছে।
চোখে পড়ল একটা ছোটখাটো সেলুন মত, এসি আছে।
আমি ঢুকে একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। পা ধরে গেছে। ঘাম শুকিয়ে যাচ্ছে। ভিড় নেই।
চুল কাটতে কাটতে চোখে পড়ল ওই ঘুপচি মত লম্বাটে ঘরটায় দেয়ালের দিকের বেঞ্চিতে দুটো মেয়ে বসে আছে।
সামনের আয়নায় চোখে পড়ছে ওদের একটু অবাঙালি ভাব। এখানে মেন্স- ওনলি সেলুনে ওরা কী করছে?
অনেক সময় ছোট বাচ্চার চুল ছাঁটাতে সঙ্গে বাড়ির মহিলারা আসে। কিন্তু সেরকম কিছু দেখছি না ।
তারপর দেখলাম ওরা থালিতে করে ভাত ডাল আর তরকারি খাচ্ছে। তাহলে এটা বোধহয় ওদের বাড়ি।
ভেতরের ঘুপচি ঘরে গরম, হাওয়া ঢোকে না , তাই খালি দেখে এখানে এসি কামরায় বসে খাওয়াটা সারছে।
আয়নায় তাকিয়ে বুঝলাম মেয়েগুলো আমাকে খেয়াল করেছে। ওদের জন্যে চা এল।
ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি একটু নেব কি না ? লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়লাম।
চুলকাটা হলে ম্যাসাজ করে দিতে বললাম।
লোকটা বলল, খালি মাথা কেন? ফুট ম্যাসাজ, ফুল- বডি ম্যাসাজ করিয়ে নিন। ফ্রেশ হয়ে যাবেন। আপনাকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে তো, তাই বলছি ।
কত করে ? খালি হাত বা পা করালে দু’শো করে। পিঠ বুক চারশো। মাথা তিনশো। ফুল বডি একহাজার।
এত? এ’রকম কোথাও শুনি নি । এত বেশি কেন?
লোকটা কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল—মেয়েরা করে দেবে বলে! ওই কোনায় একটা পর্দা টানা আছে না? তার পেছনে চলে যান।
তবে এদের আলাদা করে বখশিস দিতে হবে। সে তিনশো চারশো পাঁচশো—আপনি খুশি হয়ে যা দেবেন।
আমার মাথায় বাজ পড়ল। খালি হাবার মত তাকিয়ে আছি। আস্তে আস্তে বললাম—অনেক টাকা। আমার কাছে নেই। আজ চুলকাটার পয়সা দিয়ে দিচ্ছি।
লোকটা নাছোড়বান্দা।
--শুনুন, তাহলে খালি পায়ের ম্যাসাজ করিয়ে যান। মেয়েটাকে একশ দিলেই হবে। আপনি নতুন, আপনার চুলকাটার পয়সা ছেড়ে দিচ্ছি।
আমি মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর ওয়ালেট বের করতে গিয়ে টের পেলাম যে পকেটে অনেক টাকা আছে, ছাত্রের বাড়ি থেকে পাওয়া এ’ মাসের মাইনে!
আমি লোকটার দিকে তাকালাম।
ও হাসল। তারপর ওর ইশারায় একটি মেয়ে আমাকে বলল -- আসুন।
ও কালো পর্দাটা সরিয়ে দিল। আমি দেখলাম ছোট্ট একটু জায়গার মধ্যে একটা রিভলভিং চেয়ার, একটা বড় দেয়াল আয়না ও একটা বেসিন মত।
মেয়েটি আবার বলল -আসুন।
আমি যন্ত্রের মত ওখানে গিয়ে চেয়ারে বসলাম। ও পাখা চালিয়ে দিয়ে পর্দাটা টেনে দিল। আমি অনেক ইতস্ততঃ করে বললাম—শুধু ফুট ম্যাসাজ।
ও হাতটাত ধুয়ে কি একটা লোশন হাতে লাগিয়ে নিল। তারপর একটা তেল এনে আমার পায়ে মালিশ করতে করতে বলল—ব্যথা লাগলে বলবেন।
চমৎকার মালিশ। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল, আবার ভালও লাগছিল। মালিশের তেল লেগে নষ্ট হবে বলে প্যান্ট খুলে শুধু আন্ডারওয়ার পরে বসতে বলল।
নিজেও জামা খুলে কাজ করছে। মাঝে মাঝে ওর হাত এবং আঙুল ক্যাজুয়ালি আমার থাই ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার ভয় করছিল।
একটা সময়ের পর ও থেমে গেল। বলল ফুল বডি করে দেবে কি না?
আমি দরকার নেই বলে ওয়ালেট বের করতে যাচ্ছি ও হাত বাড়িয়ে লাইট বন্ধ করে আমার গলা জড়িয়ে ধরে গালে কপালে চুমু খেয়ে কানে কানে বলতে লাগল
—এনজয় করুন, টাকাপয়সা দিয়ে কী হবে? এনজয় করুন। ----
আমি আর বলতে পারব না।
ওরা দুজন একদৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমি ওদের চোখে চোখ রাখতে পারছি না ।
আমার গলার কাছে কিছু একটা পাকিয়ে উঠছে।
এবার রমেন আমাকে একগ্লাস জল খেতে দিল।
আমি ধরা গলায় বললাম—জানি, তোরা এবার আমাকে ঘেন্না করবি। আর কখনও আমার বাড়ির ছায়া মাড়াবি না ।
রমেন একটা টুল টেনে এনে আমার সামনে বসল। বলল—ঘেন্না করব কেন?
--আমি নোংরা কাজ করেছি, কত নিচে নেমে গেছি।
--আচ্ছা, তুমি মদ ছোঁও না , কিন্তু আমি মাঝে মধ্যে খাই। এমনকি ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে থাকার সময় ওদের ঘরে তৈরি মহুয়ার মদও খেয়েছি।
তো তুমি কি আমাকে ঘেন্না করবে?
-- কিন্তু আমি যে –
রমেন হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দেয় ।
বলে বেশি আত্মকরুণা ভাল নয়, আসলে এগুলো সামন্তবাদী সমাজের ধ্যানধারণা। আজকের হিসেবে এই মেয়েরা শ্রমিক বা যৌনকর্মী।
আমরা চাইব ওদের জন্যে উন্নত জীবন। ততদিন ও যদি নিজের শ্রম বেচে পরিবারের খাওয়াপরার ব্যবস্থা করে তো ওকে ঘেন্না করব কেন?
কর্পোরেশনের যে মেয়েরা সকাল বেলায় ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নামে, নর্দমা সাফ করে তাদের কি ঘেন্না কর?
--তা কেন করব? ওই মেয়েটিকেও ঠিক ঘেন্না করি নি । কিন্তু--
-- আবার কিন্তু কিসের? তুমি ওকে ঘেন্না কর নি । জোরজবরদস্তি কর নি । ঠকাও নি । একটি পরিষেবা নেওয়ার জন্যে বাজার দরে দাম দিয়েছ।
ম্যাটার এন্ডস দেয়ার।
তুমি পচে যাওনি যে আলু-বেগুনের মত রাস্তায় ফেলে দিতে হবে।
-- আসলে কী জানিস? খুব লজ্জা করছিল। আমি একজন মাস্টারমশাই। এটা আমি কী করলাম!
-- নিজেকে পাপী পাপী বলে বুক চাপড়াচ্ছ কেন?
--দ্যাখ, পাপ তো মনে। যেই মনে হল ব্যাপারটা আমার কেমন অন্যরকম ভাল লেগেছে তখন খুব ঘেন্না হল । মেয়েটার জন্যে নয়, নিজের উপর।
--ভুল বলছ । আজ গ্লানিতে ভুগলে কাল মেয়েটাকে ঘেন্না করতে শুরু করবে। তোমার কথিত অধঃপতনের জন্যে ওকেই দায়ী করবে।
মহাভারতের পরাশর মুনি তোমার চেয়ে বেটার ছিল।
সত্যবতীকে ঘেন্না করে নি, শাপ-শাপান্ত করে নি । উলটে খুশি হয়ে মৎসগন্ধাকে বর দিয়ে পদ্মগন্ধা করে দিল।
যাক গে, ওসব ছাড়। ভেবে দেখ কী করবে, কোন তাড়াহুড়ো নেই। আমি আবার আসব।
--শোন, এলি আর হুড়ুম দুড়ুম করে চলে যাচ্ছিস; কোন মানে হয়? ভাতে ভাত বসিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে যা।
রমেন মাথা নাড়ে। বলে খেতে ইচ্ছে করছে না ।
--কেন?
--পুরোটা তোমাদের এখনও বলি নি । দীপকদা কাল রাতে মারা গেছে। খবর পেয়ে আমি গেছলাম। শ্মশান থেকেই সোজা আসছি।
এবার চলি। ভাল থেকো।
উপসংহার
বনমালীপুরের আলবাঁধা পথ দিয়ে একটা মৌন মিছিল এগিয়ে চলেছে। অন্ততঃ দশজন জোয়ান ছেলে তাদের প্রিয় মাস্টারমশাইকে চালিতে শুইয়ে শেষ যাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে।
কাঁধ দিতে লাগে ছয় জন। আর বাকি চারজন রিজার্ভ, একটু পরে পরে কাঁধ বদল হচ্ছে, ওরা অদলাবদলি করে নিচ্ছে। আমরাও আছি।
আমরা মানে বিমলে, শংকর আর বিজন। আমরা পাশে পাশে হাঁটছি। মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দিচ্ছি সাদা কাপড়ে ঢাকা রমেনকে।
এবড়ো খেবড়ো পথে ঝাঁকুনিতে ফুলের মালা সরে গেলে হাত লাগিয়ে ঠিক করে দিচ্ছি।
ঠিক করেছিলাম কাঁধ দেব। ছেলেগুলো মানা করল; অনেকটা পথ উজিয়ে যেতে হবে। তারচেয়ে এই ভাল।
রমেন মারা গেছে পরশু। পুলিশ বডি আটকে রাখে। কাটাছেঁড়া করে । আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। কাউকে বডি না দিয়ে ওরাই জ্বালিয়ে দেবে এই মতলব।
কিন্তু গাঁয়ের লোকজন উত্তেজিত। ওরা গাছ ফেলে রাস্তা কেটে ব্যারিকেড করেছে।
বিমলের পুলিশের ওপরতলায় চেনাজানা আছে, বিজনেসম্যান বটে! ও খবর পেয়ে হাজির হয়ে দু’পক্ষের মাঝে মধ্যস্থতা করে।
বডি ওর ছাত্র ও গার্জেনদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে । কিন্তু মিছিল হবে নীরব, শান্তিপূর্ণ।
আজ সকালে ওর গাড়ি আমাকে এবং শঙ্করকে ঘর থেকে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে। গাঁয়ের বাইরে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি।
বিমলের কাছে জানতে পারি রমেন যখন একটা গাঁয়ে মুজিবর শেখের বাড়িতে বসে উচ্চ মাধ্যমিকের কিছু ছাত্রকে পড়াচ্ছিল।
তখন সাদা পোষাকের পুলিশ ও আন্দোলনবিরোধী গ্রুপের অ্যাকশন স্কোয়াডের কিছু ছেলে ওখানে ঢুকে মুজিবরের বড় ছেলে আবদুলকে তুলে নেবার চেষ্টা করে ।
বাড়ির কর্তা মুজিবর তখন বাড়িতে নেই। রমেন ওদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়ে।
ওরা বলে আবদুলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে—হাতিয়ার নিয়ে দাঙ্গা করা, পুলিশভ্যানে আগুন দেয়া ইত্যাদি।
রমেন ওয়ারেন্ট দেখাতে বলে। তখন ওরা জোর করে বাড়িটাতে ঢোকার চেষ্টা করে ।
ছাত্রছাত্রীরা রাস্তা আটকে শুয়ে পড়ে।
আশপাশের বাড়ী থেকে মহিলারা কাঁসার থালা পেটাতে ও শাঁখ বাজাতে শুরু করে।
এই ফাঁকে আবদুল সটকে পরে।
এবার চারপাশের পাড়া থেকে লোকজন ছুটে আসতে থাকে। বেগতিক দেখে সাদা পোষাকের পুলিশ ও গুণ্ডার দল পালিয়ে যায়।
কিন্তু তার আগে রমেনের পেটে ও পিঠে ঢুকে যায় দুটো রামপুরির ফলা।
আমাদের যেতে হবে আরও দু’কোশ পথ। এর মধ্যে যত গাঁয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছি সেখান থেকে ভিড় এসে মিছিলে পা মেলাচ্ছে। কেউ কেউ চালির উপরে ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে।
কাল রাত্তিরে বৃষ্টি হয়ে রাস্তায় একটু কাদা। এখন মেঘলা আকাশের ফাঁক দিয়ে কড়া রোদ্দূর । আমাদের পিঠে কপালে চিট চিট করছে ঘাম।
কিন্তু আমরা তোয়াক্কা করছি না । এখনও অনেক পথ বাকি।
আমার চোখে জল নেই। আমি জানি যে রমেনের আর কিছু চাওয়ার ছিল না ।
(শেষ)
==================================================
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।