এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ফেরারি ফৌজঃ পর্ব ১১

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ২৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • ১১
    মরফিনের পলিটিক্যালি কারেক্ট ডোজ

    বাড়িতে এসেছি। কিছুদিনের জন্যে ; একটু পরিবত্তোন! তা বেশ। সাতদিন পরে রক্তপরীক্ষা, হ্যানো ত্যানো, প্লেটলেট কাউন্ট।
     তারপর রিপোর্ট দেখে পরের কেমোর জন্যে দিনক্ষণ রাশিনক্ষত্র দেখা। 
    তারপর "এ শুভলগনে জাগ গগনে " গেয়ে আবার এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া।
     

    আমার এক দাদা আছে। সে এক জিনিস। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা, নার্সের সঙ্গে কথা ওসবের ধারে কাছে নেই। 
    সব ব্যাপারে বৌদিকে এগিয়ে দেয়। নিজে দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।
    নাঃ, কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। স্পেসিফিক দায়িত্ব এড়িয়ে যায় বটে, কিন্তু আমার দায় তো ওই বইছে, হাসপাতালের খরচাপাতি সব ওই মেটায়। 
    কী করে করছে কে জানে। হয়ত ধারকর্জ করছে আবার। বাড়ির লোন তো মাত্র গত বছর শেষ হল।
    বৌদি বলে-- তোমাকে এসব ভাবতে হবে না। ঠিকমত কথা শুনে ওষুধ খাও আর তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ। ব্যস্‌!

    দাদা আবার আমার কোন প্রশ্নের উত্তর দেয় না, বৌদির হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধগুলো কিনে এনে ওর হাতে তুলে দেয়। 
    বাড়িতে বৌদি ওদের নিজের ঘরটা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। সময়মত ওষুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব, পথ্য দেওয়া সব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

    টিভিতে দেখাচ্ছে শচীন বলে একটা বাচ্চা ছেলে পাকিস্তানে গিয়ে ফাস্ট বোলারদের উদোম কেলিয়ে দিল। আবার নাকে লিউকো-প্লাস গোছের কিছু লাগিয়ে। 
    দাদা তো ক্রিকেটের পোকা। সবার ঠিকুজি কুষ্ঠি জানে। ছোট বেলার থেকে দেখেছি--ও ছিল আমাদের পাড়ার উইসডেন। 
    কিন্তু দাদা আমার ঘরে আসে না কেন? একটু ক্রিকেট নিয়ে আড্ডা দিলেও তো পারত!
     

    বৌদিকেই জিগ্যেস করলাম-- একটা কথা বল। দাদা কেন আমার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকায় না? কেন এই ঘরে এসে আড্ডা মারে না?
    --- আমি কী বলব কেন? তোমাদের ভাইদের মধ্যের ব্যাপার আমি কী জানি?
    ---এড়িয়ে যাচ্ছ?
    বৌদি চুপ।
    --- আমি জানি কারণটা। দাদা জেনে গেছে আমি আর বাঁচব না। দিন ঘনিয়ে এসেছে। তাই--! আমি এখন বাতিলের দলে?
    বৌদি কোন কথা না বলে উঠে চলে গেল।

    দিন যে ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পারছি। আজকাল ডাক্তার রোজ রাত্রে মরফিন ইঞ্জেকশন নিতে লিখেছে। কমন পেইনকিলার আর কাজ করছে না।
    রাত সাড়ে আটটা নাগাদ পাড়ার কমল ফার্মেসি থেকে কম্পাউন্ডার নুরুদ্দীন বা নুরু এসে মরফিন লাগিয়ে দেয়। 
    বৌদি ওকে বকে।
    -- নুরু! আবার তুমি ফুল ডোজ লাগাচ্ছ? বলেছি না হাফ ডোজ দেবে? ফের!
    কিন্তু ওই মিনি ডোজে ঘন্টা তিনেক পরেই আমার ঘুম ভেঙে যায়।
    ক'দিন ধরে বৌদিকে জপাই--- পুরো ডোজ মরফিন দিতে দাও বৌদি, নইলে ঘুম হচ্ছে না।

    --- শোন অলক! তুমি তো অবুঝ নও। বেশি নিলে অভ্যেস হয়ে যাবে। পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অসুবিধে হবে। 
    সাইড এফেক্টে অনেক সময় পার্শিয়াল প্যারালিসিস হয়ে যায়। তুমি কি তাই চাও?
    --- তুমি কি ডাক্তার? বেশি ওস্তাদি কর না। উনি লিখে দিয়েছেন , তুমি কে হরিদাস পাল?
    --- অলক, রাগ কর না। একটু কোঅপারেট কর। আমি যে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। তোমার দাদাও দেখে। তুমি একদিন সম্পূর্ণ সেরে উঠে আবার--!
    আমি আর থামতে পারি নি।

    -- অ্যাই ফালতু সেন্টু দেবে না। খোদার ওপর খোদকারি ফলিও না। তবু যদি মেডিক্যালের জয়েন্টটা পাশ করতে!
    বৌদির মুখটা কেমন যেন হয়ে যায়। তারপর উঠে অন্য ঘরে চলে যায়। ওর সবচেয়ে বাজে জায়গায় খোঁচা দিয়েছি। 
    আচ্ছা, আমি কেন এত খিটখিটে হয়ে গেছি?
    --- বৌদি! শোন। আমার আর বেশি দিন নেই। তাই হাতে গোণা যে ক'টা দিন আছি, একটু ঘুমিয়ে নিতে দাও। তোমার পায়ে পড়ি।
    বৌদি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল; কিছু বলল না। তারপর উঠে চলে গেল।

    প্রায় আধঘন্টা পরে ফিরে এসে ওষুধ রাখার ছোট টেবিলে একটা প্যাকেট রেখে বলল-- এতে ছ'টা ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ আর মরফিনের অ্যাম্পুল আছে। 
    নুরু এলে পুরো ডোজ লাগিয়ে নিও। আমি আর কিছু বলব না।

    রবীন্দ্ররচনাবলী মাটিতে ছুঁড়ে ফেললে!

    আরে কী আশ্চর্য!
    আমি কথা বলতে পারছি! একটু নাকে নাকে, একটু ফ্যাসফেসে। কিন্তু পারছি তো! আর ব্যথা কমে গেছে। শুধু রাত্তিরের দিকে হয়।
    বৌদি খুশি; সেদিন দাদা এল। এসে বিছানার পাশে একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসল। অনেকক্ষণ গল্প করল,-- সেই আগের সব দিনের মতন। 
    সচীনের নামের সঠিক উচ্চারণ, বানান সব বলল। উইসডেনই বটে!
    শুধু আমার অসুখ নিয়ে কোন কথা বলল না।

    তবে বৌদি মারফত খবর পেলাম যে ওরা মনে করছে আমি সেরে উঠছি। রেডিওথেরাপি আর কেমোতে নাকি অনেকটা ঘা শুকিয়ে গেছে, এক্স-রে প্লেটে দেখা যাচ্ছে। 
    ডাক্তার নাকি আশা করছেন যে কিছুদিন পরে টিস্যুগুলোর অবস্থা দেখে সেখানে একটা অপারেশন হবে। তাহলেই অন্ততঃ দশবছর আয়ুবৃদ্ধি।
    টাকাপয়সা?

    -- এসব নিয়ে একটুও ভাবতে হবে না। সব দাদা দেখছে।
    ---বৌদি, আমার ভাল লাগছে না।
    --- এত ঠুনকো আত্মসম্মান বোধ? আরে আমাদের কোন ছেলেপুলে নেই। তুমিই তো--!
    কিন্তু আর একটা ঘটনা ঘটেছে।
     

    দাদাবৌদির শোবার ঘর, মানে যেটা এখন আমার অস্থায়ী আস্তানা, সেখানে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে ফ্রেমে বাঁধানো এক যুগলের ফটো। 
    পুরুষের সাদা দাড়ি গোঁফ ও মহিলাটির বড় বড় দাঁত, হাসিমুখ ও মাথায় খানিকটা মাদার টেরেসার মত ঘোমটা। উনিও মাদার-- পন্ডিচেরির।
    সেরেছে!

    আমি তবে বালিশের তলায় রাখা লকেটের প্রভাবে সেরে উঠছি। সেই চিত্রার দেওয়া পন্ডিচেরির শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমার লকেট!
    বৌদিকে বললাম-- কেন এত টাকা খরচ করে আমার চিকিৎসা করাচ্ছ? সোজা পন্ডিচেরি থেকে আরও কিছু ছবি, জপমালা ও ধূপকাঠি কিনে আনলেই হয়।
    --রেগে যেও না, অলক। তুমি এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও দিকি! দেয়ালে ফোটো আর বালিশের তলায় লকেট, এতে তোমার গায়ে ফোসকা পড়বে কেন?
     যদি এগুলোর কোন প্রভাব না থাকে তাতে তোমার কি এসে যায়? চিত্রা দিয়ে গিয়েছে।
    -- মানে? চিত্রা এখানে আসে?
    --হ্যাঁ, পনের-কুড়ি দিন পরে একবার। বাইরের ঘরে বসে খোঁজখবর নেয়, উঁকি দিয়ে দেখে চলে যায়। তুমি রেগে গিয়েছিলে, তাই বলতে বারণ করেছিল।
    এর পর দু'দিন কেটে গেল।
     

    সেদিন বড় গুমোট; সন্ধ্যেয় ঝড়বৃষ্টি হল। কিন্তু গুমোট ভাবটা গেল না। পাখা ফুল স্পিডে চলছে।মাঝরাত্তিরে তীব্র যন্ত্রণায় ঘুম ভেঙে গেল। মুখের ভেতরে যেন কেউ আগুনে লাল হওয়া লোহার শলা ঢুকিয়ে দিচ্ছে! উঃ, আর পারছি না।
    রায়পুরের সিআইডি পুলিশের টর্চার এর কাছে কিছুই না। সিগ্রেট দিয়ে পেটে ছ্যাঁকা, হাতের মধ্যে ব্লেডের পাতি দিয়ে হ্যান্ডশেক!
    হাত-পা বেঁধে মাঝখানে একটা ডান্ডা ঢুকিয়ে দুটো টেবিলের ফাঁকে উল্টো করে শূন্যে ঝুলিয়ে পায়ের তলায় মার--- না, এর কোনটাই ধারে কাছে আসে না।
    হটাৎ মনে হল কেউ একজন এসে আমার পাশে বসেছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শরীরে এক অপরিচিত গন্ধ।
     আমি অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু টের পাচ্ছি যে আগন্তুক এক নারী। তার শরীরে সিল্কের পোষাক, ঢিলেঢালা। 
    উনি আমার গায়ে মাথায় শরীরের নানা জায়গায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর-- আর ব্যথাবেদনা কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে।

    শ্রীমা? মাদার!
    হ্যাঁ, উনিই তো!
     

    --- মা, আমি আপনার ছেলে! বোকা ছেলে! অবাধ্য ছেলে। আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। আমায় বাঁচিয়ে দাও।
    --- ছিঃ! মায়ের কাছে সব ছেলেই সমান।
    --- আমি সেরে উঠে পন্ডিচেরি যাব, মা! পারব?
    --- পারবে। আর কিছু চাও?
    ---- আমি সেরে গেলে বাকি জীবন তোমার আশ্রমে গিয়ে সারাদিন কুয়োর পাড়ে গাছতলায় বসে কাঠবেড়ালির খেলা দেখব।
    আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

    সেরে উঠছি। কথা বলতে পারছি। কিন্তু দুর্বল লাগছে। যদিও মুরগির স্টু ও অন্যান্য হাইপ্রোটিন খাবার সেই রাইল টিউবের মধ্যে দিয়েই পেটে যাচ্ছে। 
    চিবিয়ে খাবার ক্ষমতা নেই।
    এই আংশিক সেরে ওঠা, একটু ভালো লাগা, ব্যথা কমে যাওয়া অন্য কিছুর লক্ষণ নয় তো?
    কিসের লক্ষণ অলক?

    প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে, জান তো!
    ছ্যাবলামি ছাড়; শ্রীমার উপর ভরসা রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে।

    দাদা বৌদি মিলে আর একটা কাজ করেছে। আমাকে লিখতে বারণ করেছে। এনে দিয়েছে একটা মোবাইলের মত দেখতে টেপ রেকর্ডার। 
    আমার যখন ইচ্ছে হয় ওটা অন করে কথা বলি; মানে নিজের স্মৃতিতে যা আছে তা উল্টে পাল্টে দেখি।
    বৌদি কথা দিয়েছে যে শেষে ওগুলো নিজে একটা খাতায় লিখে যত্ন করে রেখে দেবে। পরে কোন একজন কমরেড এসে নিয়ে যাবে।

    আমি নিজের জীবনকে দেখছি যেন ডিরেক্টর বা এডিটর রাশ প্রিন্ট মনিটরে দেখছে,-- ব্যাক করে , ফরওয়ার্ড করে, আর ক্খনও  পজ বাটন টিপে। 
    ওদের মতই কড়া চোখে নিজেকে দেখি। ভুল -ঠিক নয়, কোন অনুশোচনা নয়, শুধু নেড়েচেড়ে দেখা জীবনটা অন্যরকম হতে পারত কী না !
     


    সেই যে স্কুল লাইব্রেরির বই পোড়াতে গেছলাম। প্রণবস্যার অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন। --
    তুমি, তুমি অলক? তুমি রবীন্দ্ররচনাবলী মাটিতে ছুঁড়ে ফেললে!
    -- হ্যাঁ, তাতে কি হয়েছে? উনি আপনাদের ঠাকুরঘরের পুতুল, কিন্তু আমার চোখে উনি শিলাইদহের জমিদারনন্দন। কড়া হাতে পাবনার কৃষক বিদ্রোহ দমন করেছিলেন।
    --আর 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটা?
    --ওটা সেই অপরাধবোধ থেকে লেখা। দুর্ভিক্ষের সময় চাষীদের খাজনা মাপ করেছিলেন কি?
    ততক্ষণে হরি আর শ্যাম গোটা দুই খন্ড ছিঁড়ে তাতে দেশলাই ধরাচ্ছে। রবীনবাবু স্যার ফ্যাকাশে মুখে স্টাফ রুম থেকে চলে গেলেন।

    ভোলা আর ন্যাপলার রুস্তমী হাঁক! পুরো ওপরের তলা ফাঁকা।
    কিন্তু প্রণবস্যার হাল ছাড়েন নি।

    --শোন, অলক! তুমিতো প্রশ্ন কবিতাটা চমৎকার আবৃত্তি করতে। আর শ্রীবিদ্যাসাগর নাটকটা? সব ভুলে গেলে?
    -- আপনারা আমাদের সব সত্যি কথা শেখান নি স্যার। স্কুলের বইগুলো মিথ্যে কথায় ভর্তি। 
    ওই বিদ্যেসাগর যে ব্যারাকপুরের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ওঁর মেট্রোপলিটান স্কুল বিল্ডিংয়ে গোরা পল্টনদের থাকতে দিয়েছিলেন সেটা কোনও ইতিহাস বইয়ে লেখা হয়েছে?
    ---- অলক, আজ তুমি বড় উত্তেজিত হয়ে আছ। মনের এই অবস্থায় মতাদর্শগত বিতর্ক চলে না। বলি কি--আজ বরং তুমি বাড়ি যাও। 
    ভাল করে ভেবে কাল আমার সঙ্গে কথা বল।

         আমার বেশ অসুবিধে হচ্ছে। সঙ্গের চ্যাংড়া ছেলেগুলো হাঁ করে স্যারের কথা গিলছে। আর বেশিক্ষণ এরকম চললে মুশকিল হবে। 
    আমাকে কিছু একটা করতে হবে।
     

    দেশব্রতীর তাত্ত্বিক শশাংক বলেছেন-- এই সময়ে সমস্ত স্কুলে ছাত্র যুবদের এই প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ধামাধরা মতাদর্শের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম চালাতে হবে।
     এই আইকনগুলোকে ভাঙতে হবে। মার্ক্স কি ম্যানিফেস্টোর ভূমিকাতেই বলেন নি যে কোন কিছুই আর অনঢ় অটল পবিত্র বলে থাকবে না। সব ধ্বংস হয়ে যাবে।
    সমস্ত ট্র্যাডিশন আর সেকেলে ধ্যান -ধারণা এক ফুঁয়ে উড়ে যাবে?
    আর চারুদা কথা দিয়েছেন -- এই বছর গরমের ছুটিতে ছাত্র ও যুবশক্তি তাদের কাজটি সম্পূর্ণ করলে বাংলার বিস্তীর্ণ সমতল দিয়ে গণমুক্তি ফৌজ মার্চ করে যাবে!
    ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়।
     

    আর তো মাত্র একটা দুটো বছর। তারপর সেই গণমুক্তি ফৌজে আমিও নিশ্চয়ই একটা কম্যান্ডার হব।
     আমার ইচ্ছে পলিটিক্যাল কমিশার হওয়ার। কিন্তু সে ভারী কঠিন । অনেক পড়াশুনো করতে হবে।
     অ্যান্টি-ড্যুরিং আর ডায়লেক্টিস অফ নেচার গুলে খেতে হবে। বড় কঠিন ইংরেজি। 
    স্তালিনের "দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ" পড়েছি। খুব একটা বুঝি নি, আর ওঁর "লেনিনবাদের ভিত্তি" ও "লেনিনবাদের সমস্যা" কিরকম আঁতলেমি লেগেছিল। 
    বেড়ে লেগেছে মাওয়ের ' অন ক্ন্ট্রাডিকশন" আর " অন প্র্যাকটিস"।
     

    সে যাক গে, আমি প্ল্যাটুন কমান্ডার তো হতেই পারি, অন্ততঃ একটা মিলিশিয়া কম্যান্ডার। পরে না হয় গণমুক্তি ফৌজে যোগ দেওয়া যাবে।
    মিলিশিয়া হলে নাকতলা-টালিগঞ্জ এলাকাতেই থাকা যাবে।
     গণমুক্তি ফৌজে গেলে তো কেন্দ্রীয় কম্যান্ডের অধীন, অন্য রাজ্যে যেতে হতে পারে।
    ততদিনে জিবি কে কনভিন্স করে সঙ্গে নিয়ে যাব। জি বি মানে গৌরী বোস, শ্যামলা রঙের মিষ্টি দেখতে। 
    আচ্ছা, কালো মেয়েদের নাম কেন গৌরী হয়? আর ফরসা হলে কৃষ্ণা?
     
     

    সেসব প্রশ্নের মীমাংসা পরে হবে। আপাততঃ আমি নাকতলা ইউনিটের ছাত্রদের কম্যান্ডার। 
    আমার নয়া শোধনবাদী সিপিএম মাস্টারমশাই প্র্রণবস্যারের কথায় আমি যদি অ্যাকশন বন্ধ করে ফিরে যাই তাহলেই হয়েছে!
    উনি আমায় ভালবাসেন? স্নেহ করেন? ফালতু কথা। আজ উনি বিপ্লবের পথে বাধা, শ্রেণীশত্রু।
    শ্রেণীশত্রুর আবার কিসের ভালবাসা?

    চেষ্টা করে চোয়াল শক্ত করলাম।
    --স্যার, আপনিই বরং চলে যান। আমাদের কাজটা পুরো করতে দিন, আপনার সম্মান রক্ষার দায় আমার নয়।

    দেশলাই জ্বালালাম।
    সাদাদাড়ি রবীন্দ্রনাথ, ফ্রকপরা আন্না তড়খড়ে ( নলিনী) ও মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক বঙ্কিম একসঙ্গে পুড়তে লাগলেন। 
    তাতে যোগ হল সীতার বনবাস ও প্রভাবতী সম্ভাষণ।
     

    -- রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যেসাগর আর বঙ্কিম পোড়াতে কষ্ট হয় নি? মন থেকে করেছিলে ?
    -- সত্যি কথা বলতে কি, মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছল। রাত্তিরে ঘুম হয় নি। আজও তার জন্যে একটা কাঁটা বিঁধে আছে।
    --- তাহলে কেন করলে? আদেশ পালন? পার্টির প্রতি আনুগত্য?
    --- ধর, খানিকটা তাই।
    --- খানিকটা মানে? বাবার সব কথা মেনেছিলে? তাহলে তো সময়মত পড়াশুনো করে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করতে! 
    যার নিজের বাবার প্রতি আনুগত্য নেই , সে পার্টির অচেনা এক বুড়োর নামে আনুগত্য মারাচ্ছে!
     

    --- আরে তখন ভাবতাম দেশে একটা যুদ্ধাবস্থা চলছে। আমরা রণক্ষেত্রে আছি। সেখানে বেশি প্রশ্ন করলে মুশকিল।
     ধর, প্রত্যেক সৈনিক যদি লড়াইয়ের সময় গুলি চালানোর আদেশ বা ম্যানুভারিং এর ইস্যু নিয়ে বিতর্ক শুরু করে তাহলে তো দুশমন মেরে উড়িয়ে দেবে শুধু নয়, ওয়াক ওভার পাবে।
     তবে যতগুলো কাজ নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে করেছি তার জন্যে কাঁটা খচ খচ করে আজও।

    -- আর পরীক্ষা বয়কট? এদিকে ৭১ না ৭২ এ স্টেটসম্যান পত্রিকায় বড় করে বেরিয়েছিল যে শিলিগুড়িতে চারু মজুমদারের মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে আর ওনার স্ত্রী লীলা মজুমদার নিজে অন্য গার্জেনদের সঙ্গে বাইরে দাঁড়িয়ে। তাহলেই দেখ--তোমার মত ফুট সোলজাররা অনেকেই বার খেয়ে ক্ষুদিরাম।
    -- ওঃ শালা, আবার এসেছিস? এইসব ফালতু কোশ্চেন করার জন্যে?
    চারুদা চারুদা, ওনার মেয়ে ওনার মেয়ে। দুটো আলাদা সত্ত্বা। 
    মেয়ে -বৌ বিপ্লবীদের পথেই চলবে এমন কোন কথা আছে? বা সব সন্তানই বাবার ক্লোন হবে?
     তাহলে ঢাকার বারুদী গ্রামের জ্যোতি বসু লোকনাথ বাবার শিষ্য হতেন বা চন্দন বসু শিল্পপতি না হয়ে শ্রমিক নেতা।

    -- ওসব বাতেলা ছাড়! পরীক্ষা নিয়ে তোমার মনে কোন কাঁটা নেই?
    --- এতদিন পরে এসব কথা তুলে কী লাভ?
     

    হ্যাঁ; আছে বই কি। সেই ১৯৭০ এর মার্চ। টালিগঞ্জ ইউনিটে নতুন এসেছেন সুকুমারদা। উনি প্রথম যৌবনে আরসিপিআই করতেন। 
    পান্নালাল দাশগুপ্তের সেই দমদম--বসিরহাট আর্মড ইনসারেকশন প্রোগ্রামে উনিও সক্রিয় ছিলেন। একস্প্লোসিভ এক্সপার্ট।জেল খেটেছেন। 
    পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।
    এতদিন পরে উনি সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন-- আমাদের এম-এল পার্টিতে, সোজা টেকনিক্যাল কোরের দায়িত্বে। 
     
    আমি ওঁর চ্যালা হয়ে গেলাম। ওর সঙ্গে খাল পেরিয়ে ব্রহ্মপুরের কাছে রেনিয়া বুড়িয়া এইসব গ্রামে গেলাম। 
    মাটির দেওয়াল আর খোড়ো ঘরের মধ্যে পুরো আর্সেনাল! বিরাট কর্মকান্ড।
     ওঁর ট্রেনিংয়ে কিছু ছেলে আর গাঁয়ের লোক মিলে তৈরি করছে মর্টার আর গোলাবারুদ। 
    এক অমাবস্যার রাত্তিরে এমনি একটা দেহাতি ছোট কামানে ভরে একটি গোলা টেস্ট ফায়ার করা হল।
    অন্ধকার চিরে শাঁ শাঁ করে দূর আকাশে ছুটে যাচ্ছে একটি অগ্নিগোলক। আমি মুগ্ধ, আমি রোমাঞ্চিত।
     বললাম হাতে কলমে আপনার কাছে কাজ শিখব।
     

    উনি আমার দ্রোণাচার্য। ভালই চলছিল।
    এদিকে স্কুলে বোর্ড পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড এসে গেছে। আমি নিতে গেলাম না। কী হবে পরীক্ষায় বসে?
    পনের দিন পর । সুকুমারদার শরীর খারাপ। বাড়িতে যেতে খবর পাঠিয়েছেন। কোন গোপন খবর আছে।
    ভাড়া বাড়ি , দোতলায় দুটো ঘর। ভেতরের ঘরে রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে।
     

    কড়া নাড়তে যে দরজা খুলে দিল তাকে দেখে আমি অবাক! সৌম্যেন! আমার সঙ্গে ক্লাস ইলেভেনে বি’ তে পড়ে! আমি সায়েন্স, ও আর্টস; কিন্তু এখানে কী করছে? 
    সুকুমারদা ঘর চালাতে টিউশন করেন নাকি?

    ও আমাকে দেখে ততটাই অবাক,
    -- তুই!!
    -- সুকুমারদা আছেন? ওঁর সঙ্গে একটু দরকার ছিল।
    -- বাবা তো বাথরুমে, এক্ষুণি বেরোবে। তুই ভেতরে আয়। এই চেয়ারটায় ভাল করে বোস।
    ইতিমধ্যে সুকুমারদা বেরিয়ে এসেছেন।
     
     

    -- আরে অলক , এসে গেছ। ভাল হয়েছে। কিছু ডকুমেন্ট তোমাকে একজায়গায় পৌঁছে দিতে হবে।
    তারপর ওঁর চোখ গেল সৌম্যেনর দিকে।
    -- তুমি এখানে কী করছ? যাও, ভেতরের ঘরে গিয়ে পড়তে বস। বোর্ড পরীক্ষার আর দু'সপ্তাহ বাকি।
    -- না বাবা, আসলে অলক আমার সঙ্গে একই ক্লাসে নাকতলা স্কুলে পড়ে, তাই--!
    -- ঠিক আছে, অলক আমার কমরেড। তুমি গিয়ে পড়ায় মন দাও।

    উনি অনেক কথা বলছিলেন।কিছুই আমার মাথায় ঢুকছিল না। 
    শেষে ওঁর দেওয়া কিছু কাগজ জামার তলায় লুকিয়ে চলে এলাম।

    রেনিয়া বুড়িয়া গ্রামের কর্মশালায় আর যাইনি।
                                                                                                                                                                                      (চলবে)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ২৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Aditi Dasgupta | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৫:৩১734049
  • এই পর্বের শিরোনামটা ---!!! দারুন লাগলো!!! 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন