7
একটা অদ্ভুতুড়ে গল্প!
দুদিন পরে শংকর এসে হাজির হল আমার অস্থায়ী ডেরায়।
আমার হাতের তৈরি কালো চা খেয়ে মুখ ভেটকে বলল -- সামান্য চা টাও ঠিক করে বানাতে পারিস না। তোকে নন্দিতাবৌদি আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছিল। পরে বুঝেছে যে এমন অপদার্থ লোককে মাথায় রাখলে বোঝা বাড়ে, তাই নামিয়ে দিয়েছে।
আমি মুচকি হাসি।
কিন্তু কোথায় যেন খচ্ করে লাগে। হয়ত আমার মুখের ভাবে সেটা কিছু ফুটে উঠেছে।
শংকর অপ্রস্তুত।
--সরি! অ্যাদ্দিন বাদে দেখা। এমন ইয়ার্কি করা ঠিক হয় নি। আগের দিন হলে তো--।
--ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি। ওর সঙ্গে সব চুকে বুকে গেছে, বললাম তো! কাটিয়ে দে।
ও চুপ মেরে যায়। এদিক ওদিক তাকায়। কোথায় যেন তাল কেটে গেছে।
তারপর আমি বাধা দেবার আগেই ফস করে একটা সিগ্রেট ধরায়।
-- এটা কি ঠিক করলি? ডাক্তারের বারণ আছে না?
--ছাড় তো! ডাক্তার? তিনকুড়ি পেরিয়ে গেছি, তুই আমি সব্বাই। এখন যা হবার তা হবে।
দীর্ঘজীবন লাভ? তাহাতে কাহার কয়গাছি কেশ উৎপাটিত হইবে?
--- তা বলে তুই ডাক্তারের কথা শুনবি না? বৌদির সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবি? বা তোর দুই মেয়ের সামনে?
-- ডাক্তারের সুপরামর্শ? নচিকেতা যমকে বলিলেন--ইহা কি অমৃত? যম নিরুত্তর।
তখন নচিকেতা ঘোষণা করিলেন- যেনাহংমৃতস্যাম্, তেনাহং কিমকুর্য্যাম্?
যাহা অমৃত নয়, তাহা লইয়া আমি কী করিব?
--- টীকা করুন নীলকন্ঠবাবু! আমি মহামহোপাধ্যায়ের কথার পাঠোদ্ধার করিতে অপারগ।
--- অর্থাৎ যে পথে গেলে বিপ্লব হইবে না তাহা শুনিয়া আমি কী করিব?
তেরে অঙ্গনে মেঁ মেরা ক্যা কাম হ্যায়?
--- তো কোন পথে গেলে বিপ্লব হইবে তাহা আপনি জানেন?
-- আমি? বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে জিগাইলেন কঃ পন্থা? যুধিষ্ঠির বলিলেন-মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা।
কিন্তু আজকে এই একুশ শতকে আমার মনে হয়-- কোন মহাজন পারে বলিতে?
কাউকে বিশ্বাস করি না। তোকেও না।
শালা সাতটা ঘোড়সওয়ার খুঁজে বেড়াচ্ছেন! যেন বিষ্ণু দে পড়ে ঘুম থেকে উঠেছেন।
--- যাক, তাহলে তোর এখনও বিপ্লব হওয়ায় বিশ্বাস আছে, বাঁচালি!
-- অ্যাই, অ্যাই বানচোত্! আমার মুখে কথা বসাবি না।
--- আমি বসাই নি। যদি বিশ্বাসই না থাকে তো খিস্তি করছিস কেন?
এত রাগ কিসের? মানে কোথাও একটা কিছু স্বপ্ন, একটা আশা--
--- আচ্ছা, তোর কেসটা কী বলত? তোর কোথায় খুজলি হচ্ছে?
--- মানে?
--- মানে খামোকা পুরনো ঘায়ের ওপর থেকে পাপড়ি টেনে তুলছিস কেন? ধান্দাটা কী?
---- ফের ভাট বকছিস! তার চেয়ে সজল আর প্রিয়ব্রত কী করে মারা গেল সেটা বল।
বিজনদা বলল না তোর থেকে শুনে নিতে?
---- শুনে কী হবে রে গুষ্ঠির পিন্ডি? আচ্ছা, তুই কী বাঙালী?
--- তবে না তো কি ছত্তিশগড়ি?
-- হতেও পারিস, শালা দো-আঁশলা কোথাকার।
-- এবার মার খাবি, তোর হয়েছেটা কী?
-- হবে আর কি? কোন শালা বাঙালীর চারদিকে যা ঘটছে তা নিয়ে কোন হেলদোল আছে?
সবার শালা একই ফান্ডা-- শাকভাত খাই, পকপক দেই!
আমি হেসে ফেলি।
--- তুই মাইরি একই রকম রয়ে গেলি! কোন পরিবত্তোন নেই।
গর্জে ওঠে বিজন-- না! পরিবত্তোন হয়েছে। সবার হয়েছে। তোর আমার সবার।
এই বঙ্গে সবার নুনু গুটিয়ে দুপায়ের ফাঁকে সেঁদিয়ে গেছে। নইলে আজ এ’দিন দেখতে হয়!
হ্যাঁ, বিজনদা বলেছে বটে, তাই এসেছি। কিন্তু নিজে শালা মুখ ফুটে বলতে পারল না।
ঘাটকাজের দায়টা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সটকে গেল। শালা বুড়ো ভাম!
শংকর বিড়বিড় করতে করতে দুহাতের বুড়ো আঙুলের নখ ঘষতে থাকে।
-- তুই কি বাবা রামদেবের চ্যালা হয়েছিস? এভাবে নখ ঘষলে টাকে দুগাছি চুল গজায় না কি যেন!
--শোন রমেন। আজ যে প্রিয়ব্রত বেঁচে নেই এর জন্যে দুজন প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। আমি আর বিজনদা।
-- কী আটভাট বকছিস?
-- না রে! আমরা দুজন প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।
--অংক কঠিন লাগছে।
ওর মুখ চোখের অবস্থা দেখে কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে দিই।
ঢকঢক করে খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে ও মুখ খোলে।
মনে পড়ে রমেন? ১৯৬৮র শেষের দিকে এক শীতের সন্ধ্যায় তুই আমাকে অনন্ত সিংয়ের ওই এমএমজি বা ম্যান-মানি-গান নামক দলের সদস্য বানালি।
আর ছ'মাস পরে আমি রিক্রুট করলাম প্রিয়ব্রতকে।
--খুব মনে আছে। ওটা একটা ডাকাতের দল ছিল, মানে সেই অনুশীলন-যুগান্তর দলের স্বদেশী ডাকাতদের মত।
আসলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের রোমান্টিক খোঁয়াড়ি অনন্ত সিংয়ের বুড়ো বয়্সেও কাটেনি।
কিন্তু দলটার ফর্ম্যাল নাম ছিল সি সি সি আর আই।সেন্ট্রাল কোঅর্ডিনেশন অফ কম্যুনিস্ট রেভোলুশনারিজ অফ ইন্ডিয়া না কি যেন!
আর অনন্ত সিংয়ের নিক ছিল ওজি বা ওল্ড গার্ড, তাই না? একটু একটু মনে পড়ছে।
--ধুস্! অনন্ত সিং একটি মানসিক রোগী ছিল। বড় বড় কথার আড়ালে শুধু অস্ত্র জোগাড় কর আর তার ট্রেনিং নাও।
কোন রাজনৈতিক লাইনের ধার দিয়ে যেত না। ওর চোস্ত ইংরেজিতে লেখা সার্কুলারগুলো মনে আছে? সেই যে রে ‘অবিনাশ’ নাম দিয়ে সাইন করে পাঠাত?
তাতে শুধু গোপন আড্ডা আর সিক্রেসির কথা, যেন বিপ্লবী নয়, স্পাইদের সংগঠন!
--ওসব থাক, প্রিয়ব্রতর কথা বল।
--বলছি, দাঁড়া না। তোকে, আমাকে আর, প্রিয়ব্রতকে আলাদা ইউনিটে দেওয়া হল। প্রিয়ব্রতর ইউনিটের লিডার বিজনদা।
অনন্ত সিং জানতে পারল যে প্রিয়ব্রত বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। মা ভালই পেনশন পেতেন আর ব্যাংকে ওর বাবার কিছু জমানো টাকা ছিল।
বিজনদাকে দিয়ে ওকে বলানো হল যে ব্যাংক থেকে দশহাজার টাকা তুলে আনতে। অস্ত্র কিনতে লাগবে।
ওর আর মায়ের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। মাকে ভুজুং-ভাজুং দিয়ে চেক সই করিয়ে টাকাটা তুলতে হবে, মা তো আর ব্যাংকে যাবে না।
উনিশ বছর বয়স। প্রিয়ব্রত ডিসিপ্লিন ভেঙে আমার সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইল কাজটা উচিত হবে কি?
ততদিনে সদর স্ট্রীট পোস্ট অফিস ডাকাতি আর রাসেল স্ট্রিট স্টেট ব্যাংক ডাকাতি সফল । ।
বুড়োর হাতে লাখদশেক টাকা এসেছে। তবে আবার এই টাকার খাঁই কেন?
আমি গিয়ে বিজনদার সঙ্গে দেখা করলাম। সিক্রেসি ভঙ্গ করায় বিজনদা রেগে গিয়ে প্রিয়ব্রতকে খুব বকল।
বলল অবিনাশের নির্দেশ সংগঠনে কেউ কোশ্চেন করে না। উনি অগ্নিযুগের পোড়খাওয়া বিপ্লবী।
এ টাকাটা চাওয়া হচ্ছে প্রিয়ব্রতর বিপ্লবী কর্মকান্ডের প্রতি ডেডিকেশন কতটা বোঝার জন্যে।
কোন চাপ নেই। প্রিয়ব্রত ফিরে যেতে পারে।
প্রিয় আমার মত জানতে চাওয়ায় তখন বলেছিলাম যে সংগঠনের আদেশের বাইরে আমার আলাদা করে কিছু বলার নেই।
বিপ্লব থেকে বাদ পড়ে যাবে, দুধভাত হয়ে যাবে?
উনিশ বছরের ছেলেটা নিজের সতীত্বের পরীক্ষা দিতে পরের দিন সন্ধেবেলা দশহাজার টাকা এনে বিজনদার হাতে তুলে দিল।
অনন্ত সিং খুশি। সংগঠনে বিজনদার ধক বেড়ে গেল।
কিন্তু এর ঠিক চার’মাস পরে--- তখন তুই টিবি হয়ে বাড়ি ফিরে গেছিস--আমি বিজনদা সব্বাই ওই ডাকাতের দল ছেড়ে এম-এল পার্টিতে যোগ দিলাম।
সেখানেও প্রিয় বিজনদার সঙ্গে সেঁটে রইল।
ইতিমধ্যে চারু মজুমদারের "গেরিলা অ্যাকশন সম্পর্কে কয়েকটি কথা" দলিল বের হয়ে চারদিকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে।
বিজনদা আর প্রিয় ওই লেখাটা পড়ে বার খেয়ে চলে গেল সুন্দরবনের গোসাবা এলাকার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে।
সেখানে একটা বাঘা জোতদারকে টার্গেট করল।
কৃষ্ণপক্ষের রাত। ওরা ছ'জন। বিজনদা, প্রিয় আর চারজন ভূমিহীন ক্ষেতমজুর। পরে জেনেছিলাম যে আসলে ওরা হল তাড়িখেকো লুম্পেন প্রলেতারিয়েত।
বিজনদা ও আর একটা ক্ষেতমজুর জোতদারের বাড়িতে দুদিন ধরে বাগানের ঘাস আর আগাছা সাফ করার অছিলায় ভাল করে রেকি করল।
তারপর রাত্তিরে দুটো গুপ্তি আর ছুরি ও কাটারি নিয়ে হামলা করে বুড়ো জোতদারকে মাটিতে শুইয়ে দিল।
কিন্তু বিজনদার তদন্তে ভুল ছিল।
ওরা জানতে পারে নি যে জোতদারের ঘরে বন্দুক আছে। দোতলার বারান্দা থেকে বুড়োর মাঝবয়েসি ছেলে গাদা বন্দুক থেকে ফায়ার করতেই একজন তাড়িখোর লুটিয়ে পড়ল।
বাকিরা পালাল। কিন্তু শহুরে ছেলে প্রিয়ব্রত পারল না। অন্ধকারে আলপথে দৌড়তে গিয়ে খেজুর কাঁটা বিঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
এদিকে ওদের বাড়ি থেকে 'ডাকাত পড়েছে ডাকাত পড়েছে' শোর উঠেছে।
একটু একটু করে জ্বলে উঠছে কুপি আর লন্ঠন। জ্বলে উঠছে মশাল।
ঘর ঘর থেকে লাঠি সোঁটা কুড়ুল নিয়ে লোক বেরিয়ে আসছে দলে দলে। প্রিয়ব্রতরা তিনজন ধরা পড়ে গেল।
বিজনদা ও বাকি দুজন পালিয়ে গেল।
ওদের ধরে এনে জোতদারের আঙিনায় থামের সঙ্গে বেঁধে শুরু হল গণধোলাই, একেবারে হাটুরে মার।
এর মধ্যেই প্রিয়ব্রত চেঁচিয়ে বলতে লাগল-- ভাইসব, ভুল করছ। আমরা ডাকাত নই। আমরা তোমাদের বন্ধু। তাই জোতদারের শত্রু।
এই পরিবারটি বছরের পর বছর তোমাদের ঠকিয়েছে। মিথ্যে কাগজ বানিয়ে জমি জিরেত দখল করেছে।
তোমাদের ভিটেমাটি ছাড়া করেছে, তোমদের মা-বোনেদের দিকে কুনজর দিয়েছে। তাই ওকে শাস্তি দিতে এসেছিলাম।
মার কমতে কমতে বন্ধ হল। দুজন ওদের বাঁধন খুলে দিতে গেল।
কিন্তু এর মধ্যে বুড়ো জোতদারটা মুখে রক্ত তুলতে তুলতে নিথর হয়ে গেল আর ওর ছেলেটা প্রিয়র গায়ে গাদা বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ঘোড়া টিপল।
ওর বডি যখন পুলিশের গাড়িতে করে ওদের বাড়িতে পৌঁচে গেল তখন সেখানে বিজনদা বা আমি কেউ ছিলাম না।
পরে মাসিমা আমকে বারবার খবর পাঠিয়েছেন। হিম্মত হয় নি ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, ওঁর চোখের দিকে তাকাতে।
ভাবতে ভাল লাগে যে এতদিনে উনিও বোধহয় ওর ছেলের কাছে চলে গিয়েছেন।
‘ক্ষমার কথা ওঠেই নাকো, কে কারে করে ক্ষমা’
আমি আবার চা বানাই। শংকর পর পর চারটে সিগ্রেট খেয়ে প্যাকেট শেষ করে ফেলে।
আমি চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিই যে এই শেষ, আজ আর নতুন প্যাকেট খোলা হবে না।
ওর গলার স্বর ভাঙা ভাঙা।
--- আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি রে। বিজনদা নিজেকে দোষ দেয়, কিন্তু ও তো সব সময় আমার মত জানতে চাইতো।
আমি কখনই চারু মজুমদারের ওই দলিলের লাইনটা মানতে পারিনি। সমানে তর্ক করেছি।
তুই ভাব তো-- যে শ্রেণীশত্রুর রক্তে হাত রাঙায় নি, সে কম্যুনিস্ট নয় -- এটা কোন কথা হল?
তাহলে তো মার্ক্স থেকে হো চি-মিন সবার হাত ধুয়ে ধুয়ে ল্যাব টেস্ট করে দেখতে হবে কার হাতে কতটা কিসের রক্ত লেগে আছে! এটা সায়েন্টিফিক লাইন?
এ তো সেই কালীপূজো করা বাঙালীর কথা! বিপ্লবের নামে তন্ত্রসাধনা!
----চারু মজুমদারের পাগলামির প্রায়শ্চিত্ত ভদ্রলোক নিজের জীবন দিয়ে করে গেছেন। তার দায় তুই নিজের ঘাড়ে নিয়ে ফালতু অপরাধবোধে ভুগছিস কেন?
বাকি লোকজন কী ছিঁড়ছিল? কানু-খোকন- কেশব --কদম? আর জংগল সাঁওতাল?
পুলিশের কোডে ফোর কে অ্যান্ড ওয়ান জে! চীন ঘুরে আসা সৌ্রেন বসু?
কাং শেং আর চৌ এন-লাইয়ের কাছ থেকে ঝাড় খেয়েও দেশে ফিরে সেসব সাধারণ কমরেডদের থেকে গোপন করে সিএম এর বন্দনায় নোট্স্ লিখলেন?
---- সে কথা বললে অনেকটা দায় তো চীনা পার্টির ওপরেও বর্তায়। রেডিও পিকিং আর পিপলস্ ডেইলি তো সমানে ভারতের আকাশে 'বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ' বলে চেঁচিয়ে আমাদের মাথা খারাপ করে দিল।
কিন্তু আজ আমি করে খাচ্ছি। বৌ-মেয়েদের নিয়ে সংসার করছি। অথচ প্রিয়ব্রত নেই।
বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আর আমার সাহস নেই ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াবার। নে, এই তো হাল তোর এক ঘোড়সওয়ারের।
ভাল করে দেখে নে-- ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে।
শংকর হাসল না মুখ ভ্যাংচাল-- বোঝা গেল না।
-- এবার সজলের কথা বলবি? আমাদের নিজে নিজে হাঁপানির ইঞ্জেকশন নেওয়া গুয়েভারার কথা?
--- কিছু বলার নেই। ওর গল্পে "মোটরসাইকেল ডায়েরি"র মত কোন রোম্যান্টিক স্বাদ নেই, নাটকীয়তা নেই।
বর্ধমানের গলসি না কাঁকসা কোথা থেকে যেন ধরা পড়ে। জেলে মার খায়, ভূখ হরতাল করে। হাঁপানির রোগী। রাত্তিরে টান ওঠে।
ভোরবেলায় জেলের হাসপাতালে পাঠানো হয়। ততক্ষণে অক্সিজেন কম হয়ে যাওয়ায় টেঁসে গেছল।
-- ওর বাবা-মা আগেই বাংলাদেশে মারা গেছলেন। এখানে জ্যাঠার বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করত। আর জ্যাঠার ছিল সুদের আর বন্ধকীর কারবার।
সেই নিয়ে একবার চোপা করায় উনি সজলকে বাড়ি থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করেছিলেন।
--- হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে ওই বোধহয় সবচেয়ে আগে ঘরের মায়া ছেড়ে পথে নেমেছিল।
তোর ফেরারি ফৌজের তিনজন অশ্বারোহীকে তো দেখলি।
লিস্টির দুজন মৃত। এবার কাকে কাকে দেখতে যাবি?
--- সৌম্যদাকে।
--যাস না, গিয়ে লাভ নেই।
--কেন?
--ভুল দরজায় কড়া নাড়া হবে।
-- মানে?
--- ও রেনেগেড; বেইমান দলত্যাগী।
-- এই তো তোদের দোষ। মতে না মিললেই রেনেগেড! ছাড় তো এসব! বড় হ!
সৌম্যদা কি মিদনাপুর জেলে দুবছর কাটিয়ে আসে নি? ও কি তোদের মত ঘর ছেড়ে গাঁয়ে যায় নি?
কৃষকের ঘরে একবেলা পান্তা খেয়ে অন্য বেলা জল খেয়ে পেট ভরায় নি? তবে?
শংকর আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
-- ওসব ঠিকই বলছিস। কিন্তু ওটাই সবটা নয়। বলছি, শোন তা'লে।
সৌম্য বানচোত হচ্ছে একটা ইঁদুর! ধেড়ে নয়, নেংটি ইঁদুর।
-- কী যা তা বলছিস?
-- ঠিকই বলছি রে! দেখ, জাহাজ ডোবার সংকেত সবার আগে কারা টের পায়?--ইঁদুরেরা। সৌম্য হল সেই জাত।
ও আগেই টের পেয়েছিল যে আমাদের জাহাজ ডুবছে। আমরা কিছুই বুঝিনি।
তখন চাকুলিয়া আর মাগুরজানে মিলিটারি পুলিশ ক্যাম্পে সফল অ্যাকশনের আনন্দে রায়বেঁশে নাচছি।
ও বাড়িতে খবর পাঠাল। বাবা-কাকারা পুরনো কংগ্রেসি। সেখান থেকে পলিটিক্যাল প্রেশার এল। নিজে জেলারের সঙ্গে লাইন করল।
একদিন দেখলাম ও আমাদের সেল থেকে সরে গেছে। তখনও বুঝতে পারিনি। ওর কী হবে ভেবে ভয় পেয়েছিলাম।
পরে দেখলাম ও জেলের রাইটার না কি যেন হয়ে গেছে, গ্র্যাজুয়েট ছিল তো! হাতখরচা পেল, ভাল খাওয়াদাওয়া।
-- সে কি রে! সৌম্যদা রাইটার?
-- আশ্চর্য্যের কি আছে? আসলে বয়সে বড় বলে দাদা বলতাম, সম্মান দিতাম। কিন্তু ও ছিল হামবড়া কথার ফুলঝুরি।
চটকদার ও হাসির কথা বলে আমাদের মত কমবয়েসিদের ইয়ার হয়ে যেত, কিন্তু মানুষটা ছিল ভেতরে ভেতরে ছ্যাবলা।
আমি হেসে ফেলি।
-- ঠিক বলেছিস , ও ছিল মহা বাতেলাবাজ।। সেটা মনে আছে?
সেই যে ওদের পোড়ো বাগানে আর ক্ষেতে কাজ করতে কিছু সাঁওতাল লেবার এসেছিল আর ও ইউনিটের আড্ডায় বলল-- সাঁওতালদের বলেছি দিনের বেলায় ঠেসে ঘুমোতে আর রাত্তিরে আমাদের মোমবাতির আলোয় তির চালানো শেখাতে। মজুরি পুরো পাবে।
এবার দুটো মাস অপেক্ষা করুন কমরেড্স্। মাত্র দুটো মাস। তারপর একদিন সকালবেলায় কোলকাতার ভদ্রজনেরা চায়ে চুমুক দেওয়ার আগে খবরের কাগজ খুলে চমকে উঠবেন।
লুঙ্গিতে গরম চা ছলকে পড়বে। সমস্ত কাগজের প্রথম পাতায় ব্যানার হেডলাইন--" নকশালবাড়ির তির নাকতলায়"।
ও আমাকে টিউশন পাইয়ে দিয়েছিল বাতেলা মেরে। আমাকে গুরুমন্ত্র দিল-- বেশি পড়াবে না। ঘন ঘন টেস্ট নেবে।
সেই সময়টা ছাত্রের মার সঙ্গে গল্প করে কাটাবে। ব্যস্, কেল্লা ফতে। টেস্টের ভয়ে ছাত্র নিজেই কষে পড়বে আর নাম হবে তোমার।
এদিকে বাচ্চার মা খুশি হলে পাবে মুখরোচক সব জলখাবার।
আর ওটা মনে পড়ছে, সেই যে--প্রেসি ও যদুপুরের কমরেডরা রিসার্চ করে এমন বোম বানিয়েছে যে তুমি আমি পোঁদ চেপে বসলেও কিছু হবে না।
কিন্তু সিপিএম এর দীপু বসল কি---।
সেবার বেলেঘাটায় খুব মার খেল না সিপিএম এর হাতে! সেই যে রে ---
সিপিএম এর জাঁদরেল নেতা কে জি বসুর শালা খোকন নকশাল হয়ে নিজের জামাইবাবুকেই সব জায়গায় বেয়াড়া সব কোশ্চেন করে কাঠি করতে লাগল---
তখন বেলেঘাটার সিপিএম ক্যাডারা দুজনকেই পেঁদিয়ে বিন্দাবন দেখিয়েছিল। সৌম্যদারও দুটো দাঁত পড়ে গেছল চ্যালাকাঠের বাড়ি খেয়ে।
--- আর বামপন্থী নাটক করার সময়েও নিজেই পরিচালক আবার নিজেই হিরো।
--- ও হো! তোর সেই খার অ্যাদ্দিনেও যায় নি? সেই চালের ব্ল্যাক ধরা নিয়ে পথনাটিকা!
বাসভাড়া ও প্রত্যেক দিন পাঁচটাকার কড়ারে পেশাদার নায়িকা এলেন। রিহার্সাল চলছিল।
মেয়েটার ইচ্ছে ছিল বিপ্লবী হিরোর রোল তুই করবি, কিন্তু শেষ সময়ে--।
--ছাড় ওসব কথা। মোদ্দা ব্যাপার হল সৌম্য আদৌ অশ্বারোহী নয়। ও হল খচ্চরবাহন।
ছোটবেলার প্রেমিকাকে বিয়ে করে 'সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন' গোছের সংসার করছে।
আমার পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার কোন ইচ্ছে নেই।
--- তা বেশ। কিন্তু একটা ব্যাপারে ধন্দ মিটছে না।
--কোন ব্যাপারে?
-- আমার ইংরেজির মাস্টারমশায় দীনেন স্যার! তুই বলছিস, বিজনদাও বললো, মানে ঘটনাটা সত্যি।
কিন্তু কেন ঘটলো তার একটা ব্যাখ্যা থাকবে তো?
অমন সাদামাটা নিরীহ গোছের ভ্দ্রলোক কেন দলত্যাগী বলে চারটে ছেলেকে মৃত্যুদন্ড দিলেন?
কেন নিজের প্রাক্তন ছাত্রের নামে মিথ্যে ডায়েরি করলেন? এটার কোন ব্যাখ্যা তোদের কাছে আছে?
ওই বেড়ালের পোঁদে ফুঁ দিয়ে বাঘ বানানো ঠিক যুক্তি হল না।
--- আছে, ব্যাখ্যা আছে। কাকোল্ড কথাটার মানে জানিস তো?
-- জানি, যার স্ত্রী অন্যের প্রেমিকা। ওই খানিকটা কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়া গোছের সিনড্রোম।
-- উনি ছিলেন কাকোল্ড।
-- সে একটা কোলকাতা ছাড়ার আগে শুনেছিলাম বটে! ওঁর অল্পবয়েসী স্ত্রীকে নিয়ে অনেকে রসালো মন্তব্য করত, ছেলেরাও।
আমার রুচিতে বাঁধত। হয় প্রতিবাদ করেছি, নয় স্থানত্যাগ করেছি।
কিন্তু একজন ক্রিশ্চান স্যার ছিলেন, গ্রামার পড়াতেন। জ্যাকব সার।
উনি বৌদিকে নিয়ে কবিতা লিখতেন শুনেছি। ও'রম একটু আধটু ফ্লার্ট!
-- ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়েছিল। রোজ ঘরে এসে সময়ে অসময়ে সহকর্মী বৌকে লাইন দিচ্ছে, সবার সামনে। আর স্ত্রীও প্রশ্রয় দিচ্ছেন --কাঁহাতক সহ্য করা যায়।
কিন্তু বৌদি বেশ টেঁটিয়া। একদিন স্বামী-স্ত্রীর তিক্ত তর্কাতর্কির পর উনি টিক-২০ খেলেন। এমন মেপে খেয়েছিলেন যে মরবেন না, কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হবেন।
খবর শুনে গিয়ে দেখি স্যার ময়লা গেঞ্জি আর ধুতি পরে তালপাতার পাখা নেড়ে উনুন ধরাচ্ছেন আর ছোট ছোট দুটো বাচ্চা খিদেয় কাঁদছে।
খুব খারাপ লাগল। গিয়ে আমার গার্লফ্রেন্ডকে পাঠালাম।
ও গিয়ে স্যারকে সরিয়ে ভাতে ভাত, ডাল আর দুটো তরকারি রান্না করে দিল।
এই ঘটনার পর স্যার গুম মেরে গেলেন। বৌদি হাসপাতাল থেকে ফিরে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলেন।
জ্যাকব স্যারের সঙ্গে এখানে ওখানে গিয়ে আলাদা করে দেখা করতে লাগলেন।
আর দীনেনস্যারের ঘর-গেরস্তি সবার কাছে হাসির বস্তু হয়ে দাঁড়াল।
এই হিউমিলিয়েশন দুর্বল ব্যক্তিত্বহীন পুরুষের অপবাদ বা ইঙ্গিত ওঁর ভেতরে বারুদ পুরে দিল।
ফলে রাজনৈতিক হিংস্রতার দিনে যখন ওঁর কাছে ডিসিশন চাওয়া হল উনি একেবারে নির্মম এক অবতারের রূপ ধরলেন।
নৃসিংহ অবতার।
না, উনি নিজের কাজের জন্যে এতটুকু অনুতপ্ত ছিলেন না। কিন্তু ভায়োলেন্স এক দুধারি তলোয়ার--সেটা বুঝতে পারেন নি।
তাই সিদ্ধার্থ রায়ের যুব কংগ্রেসের হামলার দিনে চুপচাপ সপরিবারে পাড়া ছেড়ে যাওয়ার সময় ওঁর চোখের মধ্যে ঠিক আতংক নয়, কেমন হতাশার ছাপ ছিল।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।