8
হাতে রইল পেনসিল
হারাধনের ছিল দশটি ছেলে। নয়জন গেল কালের কবলে-- এক এক করে। শেষ ছেলেটি বোধহয় যমের অরুচি, তাই বেঁচেবর্তে রইল হারাধনের বংশের কুলপ্রদীপ হয়ে।
কিন্তু সে পিদিমেরও তেল ফুরিয়ে গেছে।
তাই যা হবার তা হল।
প্রথমে ভেউ ভেউ করে খানিক কেঁদে নিল।
তারপর ?--' মনের দুঃখে বনে গেল রইল না আর কেউ'।
সে না হয় হল।
কিন্তু আমরা ছিলাম আটজন, আট অশ্বারোহী। আমাকে বাদ দিয়ে ওরা সাতজন।
না, মনের দুঃখে বনে যাই নি। এখনও ব্যাট করছি।
কিন্তু সে তো টেল-এন্ডারের ব্যাটিং! একে নাইট -ওয়াচম্যান। তায় ফলো অন বাঁচানোর চাপ।
তাই অন্যদিকে কে কে টিঁকে আছে খোঁজ নিতে বেরিয়েছি।
কেন?
উত্তর নিজেরও জানা নেই।
শুধু ফলো অন নয়, একেবারে ইনিংস ডিফিটের ভয়। স্ট্র্যাটেজি যে ভুল ছিল সে তো বহু আগেই বুঝে গেছি।
আসলে ক্যাপ্টেন টস জেতায় আমরা ভেবেছিলাম যে খেলাটাই জিতে গেছি।
তো সাতজনের খোঁজ পেয়েছি। আসলে তিনজন। বিজনদা, শংকর আর বিমলে।
দুজন বীরগতি প্রাপ্ত হইয়াছেন-- সজল ও প্রিয়ব্রত। একজন রেনেগেড আখ্যা লাভ করিয়াছেন--সৌম্যদা।
রইলাম শুধু আমি।
আমি মুক্তপুরুষ।
বৌ ও দুই কন্যাসন্তান আমার সম্বন্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করিয়াছে। ফলে মন-বলে-আর-কেন-সংসারে-থাকি কেস!
কিন্তু এ কী হইল!
ব্যাংকে কর্ম করিয়াও আমি পাটিগণিতে কাঁচা!
যাদববাবু বা কে সি নাগ-- উভয়েরই স্নেহ হইতে বঞ্চিত।
দুই আর দুইয়ে কত হয় জানিতেও ক্যালকুলেটরের বোতাম টিপিতে হয়!
তাই খেয়াল করি নাই যে সাকুল্যে সাতজন হইয়াছে।
একজন এখনও বাকি। অলকেশ।
আমাদের সর্বকনিষ্ঠ ঘোড়সওয়ার।
সে আজ কোথায়?
শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে।
এতদিনে।
এবার তো নভেম্বরের বিকেলেও সোয়েটার চড়াতে হয় নি।
এখন ক্রিসমাস হাতছানি দিচ্ছে। একটা চোরাগোপ্তা উৎসব উৎসব ভাব।
সূর্যডোবার আগেই আমার দু'কামরার আস্তানার দরজায় তালা ঝোলাই।
হেঁটেই চলে যাবো মেট্রো স্টেশন গীতাঞ্জলি।
হাজরায় একবন্ধুর ঠেকে ডানহাতের ব্যাপার ও কিছু কাজের কথা সেরে ফিরতে হবে বিজনদার ঘরে।
একটা প্যাকেট নিয়ে আসতে হবে। কিসের প্যাকেট খোলসা করে বলে নি।
মরুক গে! কিছু একটা হবে।
তবে আমার মতলব আলাদা।
আমি খোঁজ চাই অলকেশের। বিজনবুড়োকে খোঁচালে কোন সুলুক সন্ধান নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
পকেটে চাবি, মোবাইল আর এটিএম কার্ড আছে তো! হাত ঢুকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যাই।
সিঁড়ি দিয়ে নামছি কি রামবিরিজের সঙ্গে দেখা। এই সাদামাটা ফ্ল্যাটবাড়ির একমাত্র সিকিউরিটি গার্ড ও ম্যানফ্রাইডে।
আমাকে দেখলেই ওর মুখে কেমন একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে।
ছোটবেলায় যুগান্তর পত্রিকায় কাফি খাঁর কার্টুনে এমনি এক মুখভঙ্গী দেখেছিলাম --নাপিতের চেহারায়।
তার সঙ্গে ছিল দু'লাইন ছড়া।
"ক্ষুর ঘষন্তি ক্ষুর ঘষন্তি চিড়িক চিড়িক পানি,
তোমার যা মনের কথা সে তো আমি জানি"।
হতভাগা! ও কী জানে?
আমার মনের কথা ও কী জানে!!
--চললেন রমেনবাবু? এগারটার মধ্যে ফিরবেন তো?
-- মানে?
-- জাড়া বহোত হ্যায়। আমি এগারটার পরে গেটে তালা লাগিয়ে শুয়ে পড়ি।
বুড়ো হয়েছি। ঠান্ডা সয় না। তবিয়ত খারাপ হয়ে যায়।
-- চিন্তা কর না। তুমি তোমার হিসেবে শুয়ে পড়। আমি এগারটা বাজলে অন্য বাড়িতে থেকে যাবো।
-- রাগ করলেন বাবু? আসলে--।
আমি উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে যাই। এসব ওর ভড়ং।
সোসাইটির প্রেসিডেন্টের আশকারা পেয়ে মাথায় চড়েছে।
ও অন্যদের গাড়ি ধুয়ে দেয়। বাজার করে দেয়।বকশিশ পায়।
আমার ওসব বালাই নেই। ফলে ওর চোখে আমি মহাফালতু লোক।
আদ্দেক রাস্তা পেরিয়ে এসেছি সামনেই শ্রীগুরু আশ্রমের গেট।
আর একটু এগোতেই থমকে দাঁড়াই। ওই ছোট্টমত ক্লাবের সামনে এই ভিড় কিসের?
বর্তমান সরকারের বদান্যতায় ক্লাবে ক্লাবে ছয়লাপ। গলিতে গলিতে ক্লাব।
সবাই সগর্বে ঘোষণা করে যে ওরা সরকারের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দপ্তরের সৌজন্যে দু'লাখ টাকা করে পেয়েছে।
ভিড়টা অমনি এক ক্লাবের বিপরীতে বাঁধানো চাতালের সামনে।
কিছু চ্যাংড়া ছোঁড়া কাউকে ঘিরে হো-হো করে হাসছে। সঙ্গে স্ট্যান্ডের জনাচারেক রিকশাওয়ালা।
আমি পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করি।
তবু দাঁড়িয়ে পড়তে হল। কানে এসেছে এক মহিলার কন্ঠস্বর।
উনি কাউকে অনুনয়- বিনয় করছেন। কিন্তু ওই গলার স্বর যে আমার চেনা!
ভিড়ের মাঝে উঁকি মারি।
হ্যাঁ, অনুনয়মাখা গলার স্বরের মালকিনকে আমি চিনি।
আমার ফ্লোরে একটা ফ্ল্যাট বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দরজাটি।
দরজায় কার্সিভ হস্তাক্ষরে লেখাঃ
কৃষ্ণা মাইতি, এম এ ;
সুধীর মাইতি, পি এইচ ডি।
উঠতে নামতে চোখাচোখি হয়েছে, আলাপ হয় নি।
কোন স্কুলে পড়াতে যান।
একবার আমার দরজায় বেল টিপে আমার ইস্ত্রি করা কাপড় দিয়ে গেছিলেন,
আর একবার ডাকে আসা কিছু কাগজপত্র।
সেদিন এসেছিলেন জানতে যে ফ্রিজ সারাইয়ের কোন দোকানের ফোন নম্বর জানা আছে কি না।
রামবিরিজের সূত্রে খবর পেয়েছি যে সুধীরবাবু হটাৎ একদিনের জ্বর ও মাথাব্যথায় গত হয়েছেন। বছর দুই হল।
উনি এখন একাই থাকেন। ছেলে মুম্বাইয়ে।
তবে ওঁর গলার স্বর! নারীকন্ঠের হিসেবে একটু মোটা ,তবে জোয়ারিটা বড্ড মিঠে।
তাই ভিড়ের মধ্যে ওঁর অনুনয়ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
কিন্তু উনি বারবার রিকোয়েস্ট করছেন কাকে? ওই ছোকরাগুলোকে?
কেন? ওরা কি ওঁকে ভরা বিকেলে খোলা রাস্তায় বিরক্ত করছে?
কালে কালে হল কী!
প্রতিবেশিনীর প্রতি কর্তব্যবোধে সচেতন হয়ে এগিয়ে গেলাম।
কী হয়েছে, ভাই?
যা হয়েছে তার মাথামুন্ডু বুঝতে বেশ সময় লাগল।
শানবাঁধানো রকে বসে এক থুড়থুড়ে বুড়ি। ধপধপে সাদা চুল ছোট করে ছাঁটা।
পরনে সাদা থান, গায়ে একটা হাল্কা উলের ব্লাউজ। পাশে একটা থলি মত, আর আধখালি জলের বোতল।
এঁকে চলতে ফিরতে কয়েকবার দেখেছি।
সকাল বেলা হাঁটি হাঁটি পা পা করে রোয়াকে এসে বসেন,
আর সূর্য ডুবলে পরে উঠে কোথায় যেন চলে যান। কারো সঙ্গে কথা না বলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন।
উনি চারপাশের লোকজন দোকানপাটের বিষয়ে যেন উদাসীন ।
কখনও হাসতে দেখিনি। এতদিন পাগল ভেবে এড়িয়ে গেছি।
তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছেন আমার প্রতিবেশিনী।
সামনে নামিয়ে রেখেছেন এক বোতল দুধ, কিছু ফল আর প্লাস্টিকের টিফিন কৌটোয় কিছু রুটিতরকারি।
কিন্তু বৃদ্ধা নির্বিকার পাথরপ্রতিমা।
--মাসিমা, কিছু মনে করবেন না। রোজ দেখি শীতের মধ্যে একা একা এমনি খোলা জায়গায় বসে থাকেন।
এই উলের ব্লাউজটা নিন, বেশ গরম। আর এই প্যাকেটে দুটো শাড়ি।
বৃদ্ধা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
--- মাসিমা, আমি আপনার মেয়ের মত। প্লীজ, এগুলো নিন।
আর এই এক প্যাকেট বিস্কুট, সামান্য ফল, আর এই টাকাটা রাখুন।
টাকার কথা কানে যেতেই বৃদ্ধা চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
আধবোজা উনুনে যেন আবার আঁচ বেড়ে উঠছে।
জোড়া হাত কপালে উঠলো।
--ধন্যবাদ! আপনি কে জানি না। কিন্তু এসব কিছুই আমি নিতে পারবো না।
দয়া কইরা ফেরত নিয়া যান।
--কী বলছেন মাসিমা?
-- ঠিকই শুনেছেন। আপনার দয়া দেখানোর কুনো দরকার নেই।
আমি খুব ভালো আছি। আপনে যান।
আমার প্রতিবেশিনী কৃষ্ণা ম্যাডাম এই রূঢ় প্রত্যাখানে অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক দেখছেন।
আমাকে যেন দেখেও দেখলেন না।
শেষে তামাশা দেখা ছেলের দলকে ধরলেন।
-- ভাই, আপনারা একটু বোঝান না! উনি কেন অমন করছেন?
--- কাকিমা, কোন লাভ নেই। অমন আড়বুঝ বুড়ি এ তল্লাটে দুটো নেই।
নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। উনি বোঝেন না।
-- উনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি কি অন্যায্য কিছু বলেছি?
আজ আমার স্বামীর বার্ষিকী। এই সময় প্রতি বছর এসব করে থাকি।
এমন অভিজ্ঞতা কখনও হয় নি।
--- আরে উনি ওইরকমই।
এবার আমি একটু নাক গলাই।
-- শুনুন মাসিমা। আপনি থাকেন কোথায়? বাড়িতে কে কে আছে?
রোজ ঠান্ডায় এমনি করে খোলা জায়গায় বসে থাকলে নিমোনিয়া হতে পারে।
চলুন,আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
-- ধন্যবাদ! আমার কারো সাহায্যের দরকার নেই। এসব হইল জুতা মাইরা গরু দান।
এবার আমার হতভম্ব হওয়ার পালা।
--মানে?
-- আপনেরা কিছুই জানেন না। এই ছোকরাগুলান জানে।
ওই যে রাস্তার অইপারে যেখানে অগো নতুন ক্লাব ঘর উঠতাছে--সেইটা ছিল আমার জমি।
সোয়ামি নাই, ছেলে এখানে থাকে না।
কিন্তু অরা আমার ঘর ভাইঙ্গা দিছে, জমিন কাইড়া নিসে। আমারে নিঃস্ব করছে।
এখন আপনেরা আইছেন দয়া দেখাইতে? কুনো দরকার নেই।
আমি মরলে ওই ফলমূল ট্যাহা দিয়া আমার ছেরাদ্দ কইরেন, এখন যান।
আমি শ্বাস টানি। একনজর ছেলেগুলোকে দেখি। ওরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে জরিপ করছে।
আমি মাপা পায়ে ওঁর কাছে গিয়ে কৃষ্ণাকে সরিয়ে উবু হয়ে বসি।
--মাসিমা, আপনার কাছে ওই জমির কোন কাগজ বা দলিল আছে?
ধরেন কর্পোরেশনে ট্যাক্সের রসিদ?
যা দেইখ্যা সবার বিশ্বাস হইব যে জমিনটা আপনের ছিল।
বলামাত্র ক্লাবের ছেলেগুলো হা-হা করে হেসে উঠল।
-- আপনে কি উকিল নাকি মেসোমশায়? ওসব আগেই অনেকে চেষ্টা করেছে।
ওঁর গল্পটা সত্যি নয়। এসব বুড়ো বয়সের ভীমরতি।
আমি মুচকি হাসি। ওদের দলটাকে স্ক্যান করে চশমা পরা ছেলেটিকে বলি-- না, উকিল-টুকিল নই।
জানতে চাইছি ব্যাপারটা কী? তোমাদের সঙ্গে এনার কিসের ঝগড়া?
ওদের চোখের সম্মিলিত চাউনি নরম হয়।
চশমা পরা ছেলেটি বলে --এবার লাইনে এসেছেন কাকু। আমাদের দিকটা শুনে নিন।
আমরা অত খারাপ লোক নই।
-- না কাকু! এই দিদার জমি বা এক ইঁটের খুপরি ঘরটি ছিল সরকারি জমির উপর জবরদখল করে।
তাই ওঁর কাছে কোন কাগজ বা পাট্টা নেই। থাকতে পারে না।
সে দিক দিয়ে দেখলে ওই জমির উপর ওঁর কোন আইনি হক নেই।
-- আপনিই বলুন কাকু, যখন করপোরেশন রাস্তার উপর জবরদখলি দোকান ভেঙে দেয় তখন কিসের জোরে ভাঙে।
বে-আইনী বলেই তো!
আমি গলা খাঁকরি দেই।
-- এটা কি সত্যি যে তোমাদের নতুন ক্লাবঘর ওই মহিলার ভিটের ওপর তৈরি হচ্ছে?
যদি তাই হয় সেটাও তো একরকম সরকারি জমিতে দখল, বেআইনি ভাবে।
তাই তো?
-- না কাকু! আমাদের পাট্টা আছে।
ওই জমির টুকরোটি আমাদের ক্লাব সরকারের থেকে লীজ নিয়েছে, রেজিস্ট্রি করে।
পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে।
হ্যাঁ, এই সরকারের থেকে যে দু'লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছি তার থেকেই, বাকিটা ক্লাবঘর তৈরিতে লাগছে।
-- কিন্তু জবরদখল জমিবাড়ি ভেঙে দিলেও আইনি ক্ষতিপূরণ দেবার বা বা পুনর্বাসনের ব্যব্স্থা আছে না? আর এই দিদার বয়েসটা দেখ!
-- বলেছি না আমরা অমানুষ নই।
আসুন, ওই দেখুন, পেছনের জমিতে অ্যাসবেস্টসের ছাদ আর এক ইঁটের দেওয়াল দিয়ে দিদার জন্যে আমরা একটা থাকার জায়গা করে দিয়েছি।
ক্লাব থেকে তার টেনে একটা বাল্ব ও লাগিয়ে দিয়েছি।
দেখবেন আসুন।
ওরা খুব একটা বাড়িয়ে বলেনি।
ঘরের মধ্যে একটি নেয়ারের খাটিয়ায় বিছানা করে কম্বল পেতে মশারি টাঙিয়ে দেওয়া আছে, কোণে একটি জলের কুঁজো ও গেলাস।
কিন্তু দিদা যে ওই ঘরে যেতে চায় না!
ফিরে যাই ওই বৃদ্ধার কাছে।
-- মাসিমা, ছেলেগুলো আপনার নাতির মত। আপনাকে ভালবেসে ভাল ব্যবস্থা করেছে।
কেন অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে আছেন। আমার হাত ধরুন।
সন্ধ্যে হয়ে এল। ঠান্ডা বাড়ছে, চলুন-- আপনার ঘরে নিয়ে যাই।
উনি আমার দিকে এক অদ্ভূত চোখে তাকিয়ে রয়েছেন, পলক পড়ছে না; এক মিনিট ।
শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-- তোমারে বুঝাইতে পারি না।
আমার ভিতরটা জ্বইল্যা যায়। ওরা ভাল ঘর ভাল বিছানা দিছে।
কিন্তু সেই ঘরে আমার সোয়ামির গায়ের গন্ধ কই? আমার ছেলের ছোটবেলার মুতের কাঁথার ঝাঁঝ কই?
কইলাম তো, কারো দয়া চাই না।
এই বুড়া হাড় কয়খান জুড়াইতে আর বেশি দিন নাই।
পারলে আমারে আগের জায়গাতেই মরতে দাও।
আর না পারলে দূর হইয়া যাও, মাগনা কুয়ারা কইরো না!
নীল সাদা শাড়ি, নীল রঙা ডায়েরি
সেদিনের সন্ধ্যেতে এক অচেনা বুড়ির বেয়াড়া জিদের কাছে হার মেনে ঘরে ফিরে এসেছিলাম।
রাত্তিরে খেতে ইচ্ছে করছিল না। মুখের ভেতরে লংকাবাটার স্বাদ।
কেন যে মানুষকে সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়!
বুড়ি বৈতরণী পেরোবে বলে এক পা বাড়িয়েই রয়েছে , তবু জমি নিয়ে জিদ গেল না।
খামোকা কষ্ট পাচ্ছে। শুধু বেয়াড়া জিদের জন্যে। ফালতু ইমোশনাল অত্যাচার।
একটুকরো জমি মানে একটুকরো জমিই, তার বেশি কিছু নয়।
তবু তার মধ্যে ও সোয়ামির গায়ের গন্ধ, খোকার ছোটবেলার পেচ্ছাপের ভিজে কাঁথার ঝাঁঝালো গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
যত্তসব পাতি সেন্টু।
ঠিক যেন নন্দীগ্রাম সিঙ্গুরের চাষী। ওদেরও সেই পাতি সেন্টিমেন্ট।
আরে বাবা, তখন যদি টাটাকে ওরা হাসিমুখে জমি দিয়ে দিত তো আজকে সিঙ্গুর আর অজ পাড়াগাঁ না থেকে একটি চিত্তরঞ্জন বা দূর্গাপুর, নিদেনপক্ষে একটা বেলঘরিয়া -টিটাগড় হয়ে যেত।
পাতি সেন্টিতে সুড়সুড়ি দিয়ে বিরোধীরা ওদের হাতে তামাক খেয়ে গেছে, দোষ দেবে কাকে!
ওরা তো আর পোঁছেও না।
এখন মরগে যা!
'ভালো রে ভালো করে গেলাম কেলোর মার কাছে,
কেলোর মা বললে আমার ছেলের সঙ্গে আছে’।
যখন তোরা এত বছরের পুরনো দল ছেড়ে মা-মাটি-মানুষের নামে নেচে উঠেছিলি তখনই বলেছিলাম
--‘আজ বুঝবি নে, বুঝবি কাল,
পোঁদ চাপড়াবি পাড়বি গাল'।
এসবই হল কালীদার কথা।
আমাদের বাঙালপাড়ায় একজন খাস ঘটি। মোহনবাগানের সাপোর্টার।
ও নাকি এ পাড়ার আদি বাসিন্দা কোন খানদানি জোতদার পরিবারের ছেলে।
মাথাটা গেছে। কিন্তু আমরা ভালবাসি, কালীদা বলি।
কেউ ওকে পাগল বলে খোঁচালে তাকে মারতে বাকি রাখি।
কষে গাল দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিই।
সে যুগে কাকদ্বীপ না কোথাকার সম্পন্ন বাড়িতে ওর বিয়ে ঠিক হয়।
তখন ওর বয়েস বাইশ, বিয়ের আসরে ও চেঁচিয়ে ওঠে-- এ বিয়ে করবুনি, লিচ্চয় করবুনি।
এরা ঠকিয়েছে। আমাকে অন্য মেয়ের ফটু দেখিয়েছিল।
মেয়ের বাবা দিব্যি গেলে বললেন-- আমার একটিই মেয়ে। ওর ফটুই দেখেছিলে বাবা।
হ্যাঁ, সে ফটু কোলকেতার পার্ক স্ট্রিটের সায়েবি দোকানে তোলা, সেটা মানছি।
সবার পেড়াপিড়িতে কালীদা বিয়ে করে ফিরে এল বটে, কিন্তু গুম মেরে রইল।
কিছুদিন পরে মাথায় ছিট দেখা দিল। বৌ বলল এসব আমাকে লুকনো হয়েছে।
আমিই ঠকেছি। তারপর গয়নাগাটি কাপড়জামা নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল।
বরাবরের মত।
এবার মাথার ছিট বিঘৎখানেক থেকে গজখানিক হল।
পাবলিক মেনে নিল যে কালী হল মহাপাগল।
কারণ ও ছিল ছোটদের খিস্তিমাস্টার। পয়সা নিয়ে খিস্তি করতে শেখাত।
আমি ছিলাম এক মনোযোগী ছাত্র।
আমতলার ঠেকে আসত কালীদা।
এসেই হাত পাতত-- দে না চার আনা। এক প্লেট ঘুগনি খাব, অধীরের দোকানের। বড় ভালো বানায়।
কেউ প্রথমে গা করল না দেখে বলল,
--রমেন কোথায়? ও তোদের মত না, ঠিক পয়সা দেবে।
সবাই হেসে উঠত।
-এই যে কালীদা তোমার রমেন। তোমাকে দেখে মুখ লুকোচ্ছে।
অগত্যা আমাকে এসে কালীদার হাতে চার আনা বা পঁচিশ নয়া পয়সা গুঁজে দিতে হত।
একগাল হাসি নিয়ে কালীদা শুরু করল।
--এই ধাঁধাটা বল দেখিঃ
হেসে হেসে গেল মেয়ে পরপুরুষের পাশে,
দেয়ার সময় উহু-উহু, দেয়া হলে হাসে।
আমাদের বাকরুদ্ধ অবস্থা দেখে মিটিমিটি চোখে বলল--যা ভাবছিস তা নয়, এ হল শাঁখারির শাঁখা পরানো।
মেয়েরা হাসি মুখে শাঁখা পরিয়ে দিতে বলে। কিন্তু হাত মুচড়ে একটু একটু করে চাপ দিয়ে পরানোর সময় লাগে বই কি,
হয়ে গেলে খুশ।
--রাখো তো কালীদা! ওসব মা-ঠাকুমার যুগের গপ্পো।
আজকাল কোন মেয়ে শাঁখা পরতে শাঁখারির কাছে যায়?
কালীদা দমে না।
--বেশ, এটা বল।
দেখেছি মায়ের, দেখেছি বোনের, শালীরও হয়েছে দেখা,
কিন্তু বৌয়ের দেখতে যে পাব কপালে নেইকো লেখা!
--কী আজেবাজে ঘটি জোক্!
-- পারলি না তো! শোন।
উত্তরটা হল -বিধবার নিরাভরণ হাত।
আমরা মায়ের বোনের বা শালীর বৈধব্যও দেখতে পারি। কিন্তু বৌয়ের বৈধব্য?
দেখতে হলে তো আগে আমাকেই পটল তুলতে হবে।
কী যে ভাবছি! কোন মাথামুন্ডু নেই। রোদ্দূর উঠেছে, ঘুলঘুলি দিয়ে উঁকি মারছে।
খিদে টের পাচ্ছি। কাল রাত থেকে খাইনি যে!
এবেলা মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিলেই হয়।
রাত্তিরে মোড়ের থেকে রুটি আলুরদম আনিয়ে নেব’খন।
দরজায় মৃদু খটখট। সাতসকালে কে এল রে বাবা!
লুঙি ঠিক করে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে পড়েছি।
প্রতিবেশিনী কৃষ্ণা মাইতি পি এইচ ডির বাঁ হাতে টি পট, ডান হাতে একটি ব্রাউন প্যাকেট।
আচ্ছা, ফরসা মেয়েদের নাম কেন কৃষ্ণা হয়, আর কালোদের গৌরী?
মাথায় ঘুরপাক খেয়ে বেজে উঠল ছেলেবেলার রেডিওতে শোনা অনুরোধের আসরের গান—
“নীল শাড়ি তার অঙ্গে যেন আকাশ গঙ্গা ঝরা!
কালো কেশের ঘনঘটায় মেঘের স্বয়ম্বরা”।
উনি বেশ সপ্রতিভ ভাবে প্রায় আমাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
-- আচ্ছা লোক তো মশাই। দরজায় কলিং বেল লাগান নি।
সকালে একটি ছেলে, সম্ভবতঃ ক্যুরিয়র, ঠক ঠক করে হার মেনে এই প্যাকেটটা আমার ফ্ল্যাটে ছেড়ে গেছে।
আর দুটো কাপ নিয়ে আসুন তো।
এই শীতের সকালে একসঙ্গে একটু চা খাই।
আমার আবার একা একা চা খেতে ভালো লাগে না।
সবার সঙ্গে সহজে মিশতে পারি না, বুঝতেই পারছেন।
কিন্তু কাল থেকে তো আমরা বন্ধু হয়ে গেছি তাই না?
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করি।
কে আবার বাজায় বাঁশি, এ ভাঙা কুঞ্জবনে!
কিন্তু প্যাকেটের মোড়ক খুলে চমকে উঠি।
একটি নীল রেক্সিনে বাঁধানো ডায়েরি, সঙ্গে বিজনদার হাতে লেখা চিরকুট।
রমেন,
তোর শেষ অশ্বারোহীর ডায়েরি। এতদিন আমার কাছে রাখা ছিল। তোকে দিয়ে হালকা হলাম।
বিজনদা।
ডায়েরির প্রথম পাতাতেই একটা আড়াআড়ি করে লেখা নোটঃ
"এই ডায়েরি যেন আমার মৃত্যুর পরে কমরেডরা পড়ে। "
অলকেশ রায়চৌধুরি,
১৭/১২/১৯৮৫
----- প্রথম ভাগ সমাপ্ত---
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।