অলংকরণ: রমিত
- স্যার, কখন বসবেন?
প্রশ্নকর্তা মৃগেলের মাথার পিছনে প্রচুর পাকা চুল। পেছন থেকে দেখলে বোঝা যায়। সেইসব সাদা দেখলেই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে অল্পবয়সে যকৃতের সমস্যা আছে কিনা। একদিন মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবে। মৃগেলের পাতি চায়না মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে সবুজ, গোলাপি লম্বা লম্বা ফাটল। অথচ তার কাছে চাইফোন প্রো ম্যাক্সও আছে। ওতে মৃগেল ফিতে ভিডো বানায়। অনেক ভিউ।
- পার্টি তো বলেছে বিকেলবেলা।
- কিসের শুট ?
- মুঘল আমলের ব্রাইডাল।
- ঠিক আছে বুঝে গেছি। লেহেঙ্গা, গোল ভারী গয়না এইসব নিয়ে যাব।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যে পার্টির আসার কথা ছিল আসেনি। তাদের ফোন করে কোনো লাভ নেই। গরজটা আমার নয়। বায়নার আদ্ধেক টাকা পেয়ে গেছি। মৃগেলেকে ফোন করে জানতে পারলাম সে রাস্তায় বেরোয়ইনি। খবরে নাকি বলেছে নিম্নচাপের বৃষ্টি আসবে।
স্টুডিও থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই বুঝতে পারি লোকটা আজকেও পিছন পিছন আসছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই খেয়াল করছি। রঙিন রিফ্লেক্টিভ রোদচশমা আঁটা অনুসরণকারী। খেলার মাঠে ক্রিকেটাররা যেরকম পরে। একদিন সোজা ঘুরে গিয়ে জিজ্ঞেস করব ভেবেছি - "আপনি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর? তনয়ার বাড়ির লোক লাগিয়েছে?" কিন্তু এখন ওর দিকে সময় নষ্ট করে কাজ নেই। আসছে আসুক। নন্দন কাননে ঢুকতে পারবে না।
ওখানে সবার ওপরের ফ্ল্যাটটা নাকি পেন্টহাউস। ছাদে হেলিপ্যাড আছে। পেন্টহাউসে যাবার জন্য এলিভেটরে ঢুকে একটা বিশেষ চাবি ঘোরাতে হয়। তবেই ওই তলার বোতাম টেপা যায় আর বোতামটা জ্বলে ওঠে। আমি কয়েকবার টেপার চেষ্টা করেছি, জ্বলেনি। স্বাভাবিক। চাবিটা লাগবে।
স্টেশনে গিয়ে লোকাল ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেনের জানলার তাকে আগে থেকেই লম্বা শুয়ে থাকা জল। স্টুডিওতে বসে বুঝতে পারিনি ইতিমধ্যেই অনেক বৃষ্টি হয়ে গেছে। সে ঘরের দেওয়ালের ভেতর দিকে মোটা রবারের স্তর। ভেতর থেকে বেশি আওয়াজ বাইরে যায় না এবং উল্টোটাও। দরজা লাগালে নিঃশব্দ। গানবাজনার জন্য ভাড়া দেওয়া হয় বলে এইরকম। মঞ্চে ওঠার আগেরদিন এ জায়গা ভাড়া নিয়ে চর্চা করে গানবাজনার দলবল। অন্যসময় ছবি তোলার জন্য ভাড়া নেওয়া যায়। মাঝে মাঝে গানের দলদের ক্যান্ডিড ফটোশুটও করেছি। একবার সে কি তুমুল ক্যাচাল। ছবি তোলার মাঝখানে পরের সময়ের স্লটের দল এসে হাজির। আগের দলের গায়িকা গান থামিয়ে তাকিয়ে দেখছে ঝগড়া।
- আমাদের কাল প্রোগ্রাম আছে। রিহার্স করতেই হবে। আপনারা ভাই আজ যান।
- প্রোগ্রাম না ছাই। মাচা আছে মাচা।
চিল্লামিল্লিতে স্টুডিওর মালিক ছেলেটা ওপর থেকে নেমে এল। ভকভক গাঁজার গন্ধ। চোখ লাল। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোচ্ছে। সর্দি হয়েছে মনে হয়। নিজের বাড়িতে স্টুডিও বানিয়েও শান্তিতে মৌতাতের উপায় নেই। শেষমেশ পুরোনো গানের দলের থেকে আরো দুঘন্টার টাকা নিয়ে নতুন গানের দলকে টাকা ফেরত দিতে হল। তারপর চলে গেল তারা। আমিও।
এখানে নদীর পাশ দিয়ে ট্রেনলাইন। যেতে যেতে জানলায় নদীতে ভাসা নৌকাদের দেখা যায়। মেঘের আড়ালে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। অথচ পাঁকের কড়া গন্ধ। আর অ্যামোনিয়ার। গাছতলায়, নদীঘাটে নিব্বা নিব্বিরা অন্তহীন ফিতে ভিডিও বানায়। কখনো হাতে হাত ধরে তুড়ি মারলে তাদের পোশাক আর চারপাশ বদলে যায়। কখনো তাদের মধ্যে কেউ একজন এগিয়ে এসে লেন্সের ওপর হাত রাখে, হাত তুলে নিলে দেখা যায় নতুন দুনিয়া। এই নদীতীরেই বহু রোম্যান্টিক ফটোশুট করেছি নাকে রুমাল বেঁধে। ছবিতে কোনো গন্ধ আসে না। সবকিছু স্বর্গীয় মনে হয়। প্রি ওয়েডিং ফটোশুটের সেসব সৌন্দর্য ফ্রেমবন্দি করার পালা চলে। কখনো সাদা মার্বেলের স্মৃতিসৌধের সামনের সবুজ ঘাসমাঠে আবার কখনো সমুদ্রের ধারের বালিতে। বিয়ের সিজন আসছে। দু তিনমাস দম ফেলার জো থাকবে না, কালবোসের মত দুজন সহকারী আর ছাতা লাগানো ভারী আলো নিয়ে দৌড়ে বেড়ানো। তেপায়া নিধিরাম সর্দারের ওপর ক্যামেরাদের ফিট করে ফটাফট ক্যান্ডিড। বিয়ে থেকে অ্যালবাম পুরো প্যাকেজ। বিয়ের রাতে রাত এগারোটার পর প্রতি ঘন্টা ছবি তোলার জন্য অতিরিক্ত চার্জ। কেউ কেউ প্রি ওয়েডিং হনিমুনেও ছবি তোলানোর বায়না দেয়। যাওয়া আসা থাকার টিকিট কেটে দেয়।
- ধুরর , একটাও ভালো ছবি উঠছে না।
- জড়িয়ে ধরুন , এবার ফুলটা ওর হাতে দিন। পারফেক্ট। এইবার হাঁটু মুড়ে …
- আর কতক্ষণ , হাঁটু ছড়ে যাচ্ছে তো
- ফ্রেমটা ঠিক করে বানাতে হবে। প্রি ওয়েডিং বলে কথা। সবুজ শাড়ি আর নীল পাঞ্জাবি সুন্দর মানাচ্ছে ছবিতে।
- সবুজ নয়, এটাকে ব্র্যাট নিয়ন বলে। ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ এখন।
নন্দন কাননে তিরিশতলার ওপরে কালবোসের ফ্ল্যাটে সারাঘর উড়ে বেড়াচ্ছিল তাস আর খিল্লি, উঁচু হাসির আওয়াজ। কেউ সবুজ রঙের আম আঁটির ভেঁপু বাজাচ্ছিল। আমি গালে, কপালে চন্দন লেপা অবস্থায় বাবু হয়ে বসা। চোখ বন্ধ রাখলে চন্দনের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আরাম, গন্ধ। বাকিরা ঘরময় রঙিন জল ভরা বেলুন ছোঁড়াছুঁড়ি করছিল, মাথায়, দেওয়ালে বেলুন ফেটে বেরিয়ে আসছিল রং।
এসব রংবেররঙের বেলুন ফাটানোতে একসময় ওস্তাদ ছিলাম। স্কুলে পড়ার সময় রাজ্য লেভেলে বন্দুকবাজ। ঠিকঠাক নিশানায় লাগালেই রূপোর, নিদেন ব্রোঞ্জের পদক। আর এখন কালেভদ্রে বাড়ি গেলে দেখি ধুলো জমছে পদকদের ওপর। কারণ স্পোর্টস কোটায় চাকরি বলে কিছু হয়না এখন। এখন ভারী ক্যামেরা নিয়ে ছবিশিকারী। সেলফি স্টিকে আমার পৃথিবী আটকে থাকে। ফকেট থ্রি, মোপ্রো এগুলো আমার শরীরের অংশ হয়ে গেছে কবে। সঙ্গের ব্যাগে সবসময় মাছের চোখের মত দুতিনখানা লেন্স, ছোট তেপায়া নিধিরাম আর সম্পাতি। বড় বায়না ছাড়া সম্পাতিকে বাড়ি থেকে বের করি না। আমার পোষা ড্রোনের নাম। ঘন্টায় ভাড়া দশ হাজার। কালবোসের নন্দন কাননের ফ্ল্যাটে সোফার নিচে সে আরামে ঘুমিয়ে ছিল। ওর চারটে ডানায় আমি হাত বুলিয়ে দিই।
কালবোস মিডিয়া কোম্পানি চালায়। এ মিডিয়া নিউ মিডিয়া। সঙ্গে ব্র্যান্ডিং এজেন্সি। তার ফিন্সটাগ্রাম প্রোফাইলে নীল সাদা কালো বৃত্ত দিয়ে তৈরী শয়তানের চোখের ইমোজি, যাতে নজর না লাগে। কালবোস বলল - তুই যেমন সম্পাতিকে এনেছিস আমিও আমার সুদর্শন চক্রটা বার করি। সুদর্শন চাকাটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার রোবট চাকতি। মেঝেতে ছেড়ে দিলেই গড়িয়ে চলতে শুরু করে, যেখানে যেখানে ধুলো পায় শুষে নেয়।
অনেকক্ষণ ঠায় চন্দন মেখে বসে আছি। হঠাৎ মনে হল বাড়ি ফেরা দরকার। অথচ উঠে দাঁড়াতেই কড়াৎ করে বাইরে একটা বাজ পড়ল।
- যাহ, শান্ত বাড়ি যাবে কি করে? বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
- দোলের দিনে বৃষ্টি। এসব কি অলুক্ষুণে ব্যাপার।
ছোটবেলায় যে পাড়ায় থাকতাম, লোকেরা বলত সে পাড়ার গলিতে রথের মেলা বসলে তবেই বছরের প্রথম বৃষ্টি আসে। গলির লোকেরা অপেক্ষা করত মেলা আর বৃষ্টি হাত ধরাধরি করে আসার জন্য। আর এখন পৃথিবীর ঋতুচক্র নাকি চটকে গেছে। এই কথা আমি অনেকদিন থেকে চারপাশে শুনতে পাচ্ছি। ঝড় জল বাজ পড়ার এখন কোনো মাথামুন্ডু নেই।
- আমরা কি এখন কিছু খেলব ? তাস আছে যখন আন্ডারকভার বা মাফিয়া খেলা যায়।
- উনো বলিসনি এটাই ভাল।
- মডারেটর কে হবে ?
জমায়েতে এক মেয়েকে আগে কখনো দেখিনি। সবাই তার নাম বলছিল ময়ূরী। সে বলল - আমি মডারেটর হব। সারাঘর থেকে আবার তাস কুড়োনো হল। কিছু পাত্তি অবধারিত নিরুদ্দেশ। সবাই ভাগ হয়ে গেল ডিটেকটিভ, ডাক্তার, মাফিয়া এবং শহরের লোকে। ময়ূরী তাস বাঁটল। সবাই চোখ বন্ধ করো। এবার মাফিয়ারা জেগে ওঠো। মাফিয়া আমাকেই করা হয়েছে। তারপর ময়ূরীকে দেখালাম কাকে মারতে হবে। ময়ূরীর হাতে ছোট পিস্তলটির ট্রিগার টিপলে নল থেকে রঙিন জল বেরিয়ে আসে। সেইমত তাক করতেই কালবোস ভস্ম হয়ে গেল। সেখানে পড়ে থাকল একমুঠো নীল আবীর।
দ্রুত সারাঘরে নানারকম রঙের আবিরের টিলা। লাল নীল গেরুয়া সবুজ। খেলা শেষের পর ময়ূরী জিজ্ঞেস করল - "তাহলে তনয়ার সঙ্গে তোর কেসটা কী?"
শুরুতে আমাকে তনয়া সবজায়গায় ফেক ক্যান্ডিড ছবি তোলার জন্য নিয়ে যেত। ফিন্সটাগ্রামে দেওয়া তনয়ার সেসব ছবির নীচে গোলাপী রঙের কাটা জিভের ইমোজি দিত বুভুক্ষু জনতা। অবশ্য সেসব ছবির বেশিরভাগটাই নকল এডিটের কারিকুরি। আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। এমনিতে কাজ করত ডিজিটাল ঘটকের। বলত ছেলেমেয়েরা এখন ভয়োরুম যাবার জন্য বিয়ের গাঁটছড়া বাঁধার সাইটে আসে, বিয়ে করতে নয়। তারা নাকি এক সকালবেলা কথা বলে, সন্ধেবেলা দেখা করে, রাত্তিরে ভয়োরুমে যায়, পরেরদিন সকালবেলা আলাদা হয়ে গিয়ে আর ফোন তোলে না। ভুতু হয়ে যায়। যারা দু তিনবারের বেশি দেখা করেনি, তনয়ার ছিল সেইসব নাম্বারে ফোন করার কাজ।
- বিয়ে কেন করছেন না? প্রোফাইল কেন দেখছেন না? কিরকম হলে সুবিধা হবে?
- দেখছি তো অনেক, পছন্দ হচ্ছে না।
- সামনে বছর পুজোয় বৌকে নিয়ে ঘুরতে বেরোতে হবে তো, ছবি তুলবেন কত। হাসিহাসি ছবিতে হ্যাশট্যাগ লাগাবেন - #নবমীসর্টেড।
বহু সময় পাত্র পাত্রীর মায়েদের সঙ্গে তনয়াকে আমি দেখেছি ঘন্টার পর ঘন্টা এরকম নির্বিকার বাক্যালাপ চালিয়ে যেতে। যার শেষে তারা হাল ছেড়ে দিয়ে কাউকে শর্টলিস্ট করে, পাকা কথা, বিয়ে অবধি গড়িয়ে যায় জল। বিয়ে কনফার্ম হলেই তনয়ার কমিশন। মাসে দশটা বিয়ে করাতে পারলে আরো নগদ বোনাস।
এরও আগে তনয়া এক স্টাফিং ফার্মে এইচ আর ছিল। সেখানে ভুতুড়ে চাকরীর জন্য ইন্টারভিউ নিতে হত খুব। ভুতুড়ে চাকরি মানে শুধু লোক দেখানোর জন্য যেসবের বিজ্ঞাপন দিতে হয় কিন্তু আসলে কোনও খালি জায়গা নেই।
বাইরে গুম গুম করে মেঘ ফাটার আওয়াজ। এত ওপরে ফ্ল্যাটটা যেন হাওয়ায় পালকের মত কাঁপছিল। সুদর্শন চাকাটি আমার পায়ের কাছে ঠোকরাচ্ছিল, কিন্তু এখানে কোনো ধুলো নেই। দুহাতে তাকে তুলে সরিয়ে পাশে ছেড়ে দিলে আবার ধুলোর খোঁজে অন্যদিকে চলে গেল।
ময়ূরী বসে বসে মোবাইলে খেলছে। স্ক্রিনে নানা রকম ফল ভেসে ওঠে আর আঙ্গুল দিয়ে তাদের কাটতে হয়। কলা আনারস তরমুজ স্ট্রবেরী। কখনো একটা রাগী পাখিকে দোলনায় বসিয়ে ছুঁড়ে দিতে হয়। নীল আলোর তলায় বসে আমি এতদিন সেইসব খেলে এসেছি। এখন লাঠির মত আমার গিম্বালের মাথায় বসানো থাকে শয়তানের সেই নীল চোখ। গুপ্তিতে লুকোনো তলোয়ারের মত লাঠিটাকে দেখে কেউ বুঝবে না অকুস্থলে ক্যামেরা বসানো। কোনদিন বেরিয়ে যাব স্টিং অপারেশন করতে।
- বাড়ি ফিরলি না?
- বৃষ্টি হচ্ছে নাকি?
- বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে বৃষ্টি তো হয়। কয়েকবছর ধরে দেখছি।
ঘুড়ি ওড়ানোর চীনা মাঞ্জায় সম্পাতির অসুবিধা হয় খুব। একবার উড়তে গিয়ে আটকে পড়েছিল। ডানায় কাটা দাগে চেপে বসেছিল মাঞ্জার কাঁচ।
আজ আর ঘুড়ি ওড়ানোর সম্ভাবনা নেই। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি খাল বিল নদীর জল উপচে এসে শহরের উঠোন ভেসে যাচ্ছে। জলটুঙ্গীর মত জেগে আছে আকাশছোঁয়া বহুতলের সারি। দামী এসইউভিরা কাগজের নৌকার মত ভাসছে। এই নন্দন কাননের খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকা নীল জলের সাঁতার পুল এ রকম বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কথা। সাজানো বাগান জলের তলায়।
এরকম বৃষ্টি হলেই এই শহর বিপজ্জনক হয়ে যায়। সমস্ত জমা জলের নিচে খোলা তারের মুখ জেগে ওঠে। রাস্তায় খসে পড়তে পারে বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং। ধ্বসে যেতে পারে পায়ের তলার সেতু বা মাথার ওপরের উড়ালপুল। এরকম আকছার ঘটে। বৃষ্টির মধ্যে ফিতে ভিডিও করতে গিয়ে পাঁচতলার ছাদ থেকে পড়ে বা ভিডিও কল করতে গিয়ে বাজ পড়ে মারা যায় কেউ কেউ।
তনয়া একদিন এসে বলেছিল - তোকে একটা জিনিস দেখাই। প্রম্পট লিখলেই ভিন্টেজ ছবি। মেকাপ লাগবে না। ভারী ক্যামেরা লেন্স ফটোশুট সব আজ থেকে বাতিল। এই টুলটার নাম ছোটকলা। তনয়া খুটখুট টাইপ করছিল - “Create a retro, vintage-inspired image - grainy yet bright based on the reference picture. The girl should be draped in a perfect red aesthetic retro saree. The vibe must capture the essence of a 90s movie brown -haired baddie, with wavy curls and a small flower tucked visibly into her hair, enhanced by a windy, romantic atmosphere. She stands against a solid wall with deep shadows. add mystery and artistry to the scene.” এন্টার মারতেই ম্যাজিক। লেখার সঙ্গে হু হা তনয়ার ছবি পাল্টাচ্ছে। কখনো সমুদ্রের ধারে চুলে রজনীগন্ধা গোঁজা। কখনো দুর্গা ঠাকুরের সামনে পদ্মফুল হাতে। অজান্তেই আমার চোখ গোলগোল হয়ে গেছে। এই এক নতুন মজা। যদিও সবাইকে একই রকম দেখতে লাগবে তাও বিয়ের ছবি তোলা ছাড়া আপাতত আমার আর কোনো কাজ রইল না।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজে মুখ তুলে দেখি সেই রঙিন রোদচশমা পরা লোক। বাকিরা ঘুমে আচ্ছন্ন। ডাকলেও উঠবে না।
- চলুন যাবেন তো ?
- কোথায় ?
- এখান থেকে এমনিতেও বেরোতে পারবেন না। আপাতত সব ডুবে গেছে। এলিভেটরের চাবি আমার কাছে। পেন্টহাউসে যেতে চাইলে বলবেন। নিয়ে যাব।
- ওপরে ?
- হ্যাঁ। খুব ভালো ভিউ পাবেন। আলিশান জায়গা। যাবার ইচ্ছে আছে আমি জানি। তারপর ছাদে হেলিকপ্টার দাঁড় করানো আছে। ময়ূরী চালাবে। ভাবুন কী করবেন। আমাদের কোনো তাড়া নেই।
লোকটা পা ছড়িয়ে বসল সোফার পায়ের কাছে। তারপর খুব অলস ভঙ্গিতে একটা সাদা সিগারেট ধরাল। সিগারেট টানছে। নাক দিয়ে ধোঁয়াও ছাড়ছে। কিন্তু সিগারেটের আকৃতি বদলাচ্ছে না। কোন ছাই নেই। অন্যহাতে মোবাইল বার করে খেলতে শুরু করল। লজেন্স ভাঙার খেলা। স্ক্রিনে মনোহরা লজেন্সগুলোকে ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ নিচের দিকে নামছিল।
এতদিন বায়নার গাদা গাদা বিয়েতে বুদ্বুদ ওড়ানোর যন্ত্র, নকল আগুনের ফুলঝুরি , কাগজের কনফেটি, হলুদ গোলাপী নকল ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে সবুজ আলো জ্বালিয়ে সম্পাতিকে উড়িয়ে দিয়েছি। বোতাম টিপে আর একবার জাগালাম। আজ নন্দন কাননের তিরিশ তলার খোলা বারান্দা থেকে উড়িয়ে দিলাম।
পৃথিবীর সমস্ত আদিগল্পে ভয়ের কাহিনী তো একটাই। পৃথিবী জলে ডুবে যাবার। অনেকদিন আগে স্কুলে পড়ার সময় শুনেছিলাম। পেটে লাগানো ভারী লেন্সের চোখ দিয়ে সেই পৃথিবীর ছবি তুলতে তুলতে সম্পাতি উড়ে যাচ্ছিল একটুকরো শুকনো ডাঙার খোঁজে।
এবং তখনি ট্র্যাফিক সিগনালের ক্যাপচা এসে লোকটির লজেন্সভাঙা দিগন্ত ঢেকে দিয়েছিল। নিজেকে যন্ত্র না মানুষ প্রমাণ করার জন্য মোজাইকের অজস্র টালির মধ্যে থেকে তাকে বেছে বেছে বিরক্তিকর ক্লিক করতে হচ্ছিল বাসের বা জলের কলের টুকরো ছবিতে।