"সময়কে কখনও খুব ছোটো মনে হয় - একটা বিন্দু। জাস্ট। চোখের সামনে সেই আবার বেজায় প্যাঁচানো আর লম্বা হয়ে যেতে থাকে। এই ছিল একটা মার্বেল, তারপরেই ময়াল সাপ। মাথার ভেতর কেমন টলটল করে, গুলিয়ে যায় সব যখন লম্বা সময়, ছোট সময়টাকে গিলে নেয় আর আমি জালার মত একটা পেটের ভেতর কাঁচের গুলির নড়াচড়া দেখতে পাই -নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে একটা দুটো তিনটে অনেক রং ঘুরে ঘুরে বেড়ায় -আমার অস্থির লাগে, মাথার চুল টানতে থাকি, কান্না পায়। গড়িয়াহাটের ডাক্তারবাবু আমাকে এই সব ডায়রির পাতায় লিখে রাখতে বলেন- তারিখ, সময়সমেত। কোনো কোনো দিন লিখতে বসলে আমার দিনক্ষণ সব পিছু হঠতে থাকে, পিছিয়ে পিছিয়ে ডায়রির পুরোনো সব এন্ট্রির মধ্যে ঢুকে পড়ে লাইনগুলো ; একটা লেখার ওপর অন্য লেখা চেপে বসে -নীল কালির ওপর কালো কালি তার ওপর সবুজ, লাল কালির অক্ষর, শব্দ -জট পাকিয়ে যায় সব। ডায়রির পাতা ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে খেতে থাকি যেন সময়কে চিবুচ্ছি আর চিবুচ্ছি।"
ষোলটি গল্পের সংকলন, ইন্দ্রাণীর তৃতীয় গল্পের বই 'হরিণের কাছাকাছি'র গল্পগুলির মূল প্রতিপাদ্যই এই - 'সময়'।
'রজতজয়ন্তী' গল্পে যেমন, দম্পতি ট্রেনে করে এক হাটের খোঁজে যায়। সেই হাটের এক একদিন এক একরকম থিম থাকে। সেদিন থিমের হাটের বিষয় সময়। তলায় নীল রঙে দুমুখো তীরচিহ্ন। প্রৌঢ়া সে হাটের দোকানে খেলনা, শিকারগড়ের নেকড়ে, অথৈ জলের গুপ্তধন আর সাদা ভূতের আড্ডা এসব বই দেখতে পান, আর প্রৌঢ় দেখতে পান শ্মশান।
"কপিকল ঘুরিয়ে জল তুলে আনছিল এক বুড়ো মানুষ। কুয়োর জলে চোখ নিবদ্ধ ছিল বুড়োমানুষের। স্বাতীও জল দেখছিল। প্রশ্ন করতে দ্বিধা করল সে -বুড়োমানুষও যদি জল-ঝরা বরফের হাঁসের গল্প করে। শীতের বিকেলে অবিশ্রান্ত পাতা ঝরছিল। মাথার ওপর ঝকঝকে আকাশ আর রোদ, দিন শেষ হতে যেন অনেক বাকি -হাতে যেন অগাধ সময়; এই সব সময়ে ঝরা পাতার সম্পূর্ণ গতিপথ নিরীক্ষণ করার কৌতূহল জাগে। বিকেলের রোদে, গাছের ডালে পাখি এসে বসে, উড়ে যায়, ফিরে আসে। ওরা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সেই সব পাতা ঝরা দেখছিল।"
গল্পগুলিতে অনেকবার ফিরে আসে লাল মেঝেতে ফাটা দাগ, "সেই সব দাগ জুড়ে জুড়ে ছবি আঁকা যায় -মৃত আত্মজন, পশু, পাখি, মেঘ"। বহুসময়েই এই সমস্ত অতীতের স্মৃতি আটকে থাকে সেসব আবহমান ছবিতে -
"আমাদের মফস্বলের ক্ষয়াটে বেগুনি আকাশের তলায় সার্কাসের তাঁবু আলোর মালায় সেজে ছিল - প্রতিবছর শীতে যেমন হয়।" ['সার্কাসের আলো']
"প্রতিটি মানুষের একটি নির্দিষ্ট ভরকেন্দ্র থাকিবার কথা -যাহার চতুর্দিকে সে ঘুরিয়া ফিরিবে সমস্তজীবন। বিবাহের বৎসর না ঘুরিতেই বকুলবৃক্ষটি যে বীথিকার একান্ত ভরকেন্দ্র হইয়া ওঠে, ইহার নিজস্ব আখ্যান ছিল।" ['বকুলকথা']
"মৃত প্রিয়জনের চশমা, ঘড়ি, কলম চিরকালই দেরাজে সংরক্ষণ করে মানুষ ; কিংবা গোটা দুই রুমাল, একটি পাঞ্জাবি, শাড়ি ন্যাপথালিন দিয়ে আলমারিতে রাখে ; সেই মতো প্রমীলা সংরক্ষণ করছিল এই পুল, এই বাড়ি, এই বাগান একা হাতে।" ['সোয়ান লেক']
চরিত্রগুলি অতীতে বসবাস করে এবং মাঝে মাঝে ঘুরতে আসে বর্তমানে। পাশাপাশি কিছু গল্পে বোঝা যায় অতীত সতত সুখের নয়, অপরাধী অতীত সেই চরিত্রগুলির বর্তমানকে সংকটের মুখে ফেলে দেয় -
"কোনো সাপই তার ছেড়ে আসা খোলসে আবার ঢোকে না। ঢুকতে পারে না। সেই সব খোলস, শরীরের মাপের সঙ্গে আর মেলে না, কখনও গভীর ক্ষতচিহ্নও তাতে লেগে থাকে। স্নান সেরে পাঞ্জাবি গলাতে গিয়ে মনে হল।" ['সলস্টিস']
"ছাল চামড়াহীন গোলাপি মাংসপিন্ড -যেন একটা ক্ষত বিক্ষত প্রাণী আমার অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এসেছিল -মানুষ বলে চেনা যায়না তাকে; জবুথবু সে বসে রইল পায়ের কাছে -বেড়ালের মত -আদর করা যায়, আবার লাথিও মারা যায় তাকে।" ['পদ্মসম্ভব']
এক ছোট সাবসেট নিলে আমরা লেখক চরিত্রদেরও দেখতে পাই। ঘুরতে গিয়েও যাদের "নেটওয়ার্কের আওতায় আসা খুব জরুরী, কিন্তু আমি গল্পের কাছেই পৌঁছতে চাইছিলাম। সকাল থেকেই। " 'কোলক্লিফ ২০২৩'র জল, পাথর, পুরোনো রেললাইন, বন্ধ খনিতে যেমন তারা গল্প খুঁজেও পেয়ে যায় -"গল্পহীন কোনো জায়গা হয় নাকি? কথা হল, সে গল্প আবার তোমার পছন্দ হবে কি না -"
কিছু কিছু গল্পে অতীতের চরিত্রের বা ঘটনার ছায়া লম্বা হয়ে বর্তমানের চরিত্রের ওপর পড়ে। গল্পের অতিথি চরিত্র হিসেবে দেখা দেন অতীতচারীরা। 'ট্রফি' গল্পের রেভারেন্ড হরপ্রসাদ বা 'পদ্মসম্ভব'র তেনজিন। অথবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, সুনীল গাঙ্গুলি।
"বহুদিন পরে আমাদের ঘরদোরে আজ পাহাড়ের গন্ধ- তেনজিন এসেছে। কতদিন পরে ব্যাকপ্যাক বারান্দায় রেখে স্নান করতে গিয়েছে কেউ। বাথরুমে জলপড়ার আওয়াজ, ডেটল সাবানের, শ্যাম্পুর গন্ধ ছাপিয়ে রৌদ্রস্নাত বারান্দা থেকে পাহাড়ের ঘ্রাণ ঘরে ঢুকছে। তেনজিনের ছেড়ে রাখা জুতোয় পাহাড়ের ধুলো, মাটি, দুটো একটা মৃত পতঙ্গ, শুকনো ঘাস।" ['পদ্মসম্ভব']
'হেমন্তে যেমন ঘটেছিল' গল্পের কথক যেমন নেপোলিয়ানের ছবির মত মনে করে -"সেন্ট হেলেনা দ্বীপ শুরু হয়েছে গড়িয়াহাট থেকে আর আমাদের এই বাড়িটা লংউড হাউজ।" 'ক্রিসমাস ইভ' গল্পে মিশে যান রানা প্রতাপ, চেতক, হিঙ্গুলিয়া কুকুর আর বুলেটবাবার থান যেখানে ফুল, আগরবাতির সঙ্গে মদের বোতল পুজো দিতে হয়।
"পুরোনো কম্পাসে দিক চিনে" নিতে চাওয়ার মত "এই ভাবনাগুলো বস্তুত ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরোর মত লীলাময়ীর কাছে এসেছিল -যেন খাটের তলা পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা করে পুঁতি বেরোচ্ছে- সমস্ত পুঁতির দানা টুকিয়ে তুলে, মালা গেঁথে ফেলা সম্ভব হয়নি লীলাময়ীর।"
কিন্তু ইন্দ্রাণী গাঁথতে পেরেছেন। সেজন্যই 'দ্য স্পাই হু লাভস মি' গল্পের কথক চরিত্রকে স্পাইয়ের দেওয়া সেই ঘন লালচে বাদামি কাঠের পালিশ করা বেহালার বাজনায় বিস্তৃত গল্পগুলি হয়ে দাঁড়ায় সময়ের কুহক চরকায় কাটা শব্দতন্তুজাল, যেখানে "স্ক্রিনসেভার বদলে যায় রোজ। আজ দুটো পাহাড়ের মধ্যে হ্রদ - আকাশের রিফ্লেকশনে নীলে নীল -সেখান থেকে ভুস করে উঠে এলো পাসওয়ার্ড লেখার খোপ- যেন প্রাণভোমরার কৌটো।" বইয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রচ্ছদ ও নামাঙ্কণ যথাযথ, ইশারাময়।