এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  মনে রবে

  • হে বৃক্ষনাথ

    বেবী সাউ
    পড়াবই | মনে রবে | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৯০৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)



  • — সবই মহাকাল, জানো? সবই! এই যে কুৎসা, কান্না, থুতু, ঘৃণা, ল্যাং, একে অপরকে কামড়ানো... এই সবের জন্যই তো পৃথিবী সুন্দর!
    —না দাদা... এসবের জন্য পৃথিবী ইন্টারেস্টিং...
    — হা হা... ঠিক বললে...

    তারপর শুরু হলো আমাদের প্রাণখোলা, মনখোলা আড্ডা। সেই আড্ডায় যেমন উঠে এলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তেমনি বারীন ঘোষাল। তেমনি তিনি শচীন দত্তকে এক ঝটকায় বলে ফেললেন 'খুনী'। আবার তিনি জানালেন বাংলা সাহিত্যের আসল রূপ আসলেই চেয়ার আর চেয়ার। স্বাভাবিকভাবেই আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। কারণ আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে চলেছি। কিন্তু তিনি তো একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছেন। তাছাড়া আমি জামশেদপুরে থাকা সাধারণ এক মানুষ। আমার কাছে বাংলা সাহিত্য, কবি সাহিত্যিকেরা ভগবানের চেয়েও অধিক প্রিয়। কলকাতা আমার কাছে এক স্বপ্ন নগরী। যেখানে পথে, ঘাটে, ক্যাবিনে, ময়দানে জমে আছে কোনো না কোনো লেখকের স্মৃতি। সেই কলকাতাকে গালি দিচ্ছিলেন তিনি। আমার অবাক হওয়ার চেয়েও ভয় কাজ করছিল বেশি। কীভাবে নেব সাক্ষাৎকার। কীভাবে লিখবো এসব! এতো পরমাণু বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর! আমি সম্পাদককে কথাগুলো জানালাম। তিনি বললেন, কথা বলতে বেশি দেবেন না। পয়েন্ট মনে করিয়ে দেবেন। রিপিট করতে হতে পারে!

    যতই সম্পাদক মহাশয় এসব বলুন না কেন, আমি কিছুতেই পারছি না। পয়েন্টে যেতে দিলে তো যাব! আশ্চর্য মানুষ রে বাবা! আমি আমার বিরূপতা চেপে রাখতে পারছিলাম না। নাকি পারছিলাম ফোন কেটে দিতে।
    — আমি জামশেদপুর থেকে বলছি। আপনি কি এখন বিজি?
    — হ্যাঁ, বলুন। আমাকে একটু বেরোতে হবে। তাও বলুন দু'মিনিট...

    সেই দু'মিনিটে আমি হয়তো দু'টো কথাই বলতে পেরেছিলাম। তিনি শুধু বলেই যাচ্ছিলেন। একের পর এক গল্প। ঘটনা। জামশেদপুরের ইতিহাস। অতীতের জামশেদপুর। সুবর্ণরেখার অতীত। আবার বারীন ঘোষাল, শচীন দত্ত থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার ইত্যাদি ইত্যাদি। যখন ফোন রাখি দেখি এক ঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট। দু'মিনিট কখন যে এক ঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট হয়ে তা সাহিত্যিক কমল চক্রবর্তীর সঙ্গে যারা কথা বলেছেন তাঁরা সহজেই অনুমান করতে পারছেন।

    প্রথম প্রথম তাঁকে আমার খুবই ঈর্ষান্বিত এবং রাগী স্বভাবের মানুষ মনে হত। মনে হত, ধুস! আমার দ্বারা এ ইন্টারভিউ নেওয়া সম্ভব না। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতেই দেয় না। শুধু কথা আর কথা। আর আমাকে চুপ করিয়ে রাখাটাই যেন তাঁর কাজ। আর আমি বুঝতে পারছিলাম আমাকে চুপ করিয়ে, তিনি মনে মনে বেশ মজাও পাচ্ছেন। অনেক সময় এমন হয়েছে তিনিও কথা বলছেন আমিও বলে যাচ্ছি। তিনি জামশেদপুর নিয়ে আরম্ভ করলেন তো আমি বান্দোয়ান। তিনি পুরুলিয়া তো আমি ঝাড়খণ্ড। পরে যখন অডিওগুলো শুনি, হাসি পায়। আবার মনে হয়, উফ! ইন্টারভিউ ছিল বটে!

    যাইহোক, তারপর ধীরে ধীরে মানুষটিকে চিনতে পারি। প্রথমে যুদ্ধ দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে একটা স্নেহভাব, প্রশ্রয়ভাব এসেছিল তাঁর মনে বুঝতে পারছিলাম। তাঁর মনের ভেতরটা দেখতে পেলাম। যে মানুষটাকে কতবার খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে, যে মানুষটাকে বলা হয়েছে এই ভালোপাহাড় ছেড়ে চলে যান নাহলে খবর আছে কিংবা দিনের পর দিন নিঃসঙ্গ এক প্রকৃতির কোলে বসবাস করতে চেয়েছেন বলে তাঁকে তাড়াতে চেয়েছে রাজনৈতিক পার্টি তিনি তো শরীরে লোহার বর্ম পরে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মনটা সেই দুয়ারসিনির নদীটির মতো। ঝিরিঝিরি। শান্ত। কুলুকুলু। ভালোবাসে বাচ্চাদের মতো হই হুল্লোড়। নাচ গান। একটা বাঁচার মতো বাঁচার জীবন। জীবনের জন্য জীবন। মৃতপ্রায় নয়। ইঁদুরদৌড়ে ছুটে বেড়ানো নয়। প্রাণের স্পন্দন নিয়ে ছুটে চলা।

    —প্রথম প্রথম এক দল লোক সন্দেহ করতো আমাকে। মুখে দাড়ি, জিন্স, গেঞ্জি, ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবিতে ভাবতো আমি খ্রীস্টান। প্রচার করতে এসেছি। আমি যে জায়গাটা নিয়েছি তার ৫ কিমি দূরে একটা নদী আছে, নাম সাতঘুরুং। সেই সাতঘুরুং নদীতে সোনা পাওয়া যেত। কেউ ভেবেছিল নদী থেকে গোপনে সোনা, তামা তুলে মাইলিং করবো। কারুর মাথায় এটা ছিল না যে এখানে জঙ্গল হতে পারে বা জঙ্গল করবো। তবে কিছু কিছু মানুষ এগিয়ে এসেছিল, সেটা খুব কম।

    কিছু মানুষের সন্দেহ করার কারণও ছিল। আমি ওখানে যাওয়ার ১০ বছর আগে লুথার থেকে এসেছিলেন প্রকৃতি পাণ্ডে। উনি খ্রিস্টান। কোটি কোটি টাকা নিয়ে এসেছিলেন। যাইহোক প্রকৃতি পাণ্ডে ‘ইশারা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। একটি ছোট্ট মাটির স্কুল, অসমাপ্ত কুয়ো, আধখোঁড়া পুকুর এসব করেছিলেন। যাই হোক উনিও কিন্তু আমায় বলে গিয়েছিলেন আমি পারবো না!
    সেইসময় রাজনৈতিক ক্ষমতায় যারা ছিলেন মানে তারা তো আমার নামে অ্যাক্টো সিটি অ্যাক্ট বের করেছিল। মানে আমি আদিবাসীদের জমি হরণ করে নিয়েছি। আমি জমি মাফিয়া। এমনই অর্ডার ছিল যে–আমাকে দেখতে পেলেই জেলে ভরে রেখে দেবে। দু'বছর তো আমি এখানে ওখানে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি। ওরা জানতো সবই। কিন্তু ভালোপাহাড় হোক এটা চাইতো না।

    একদিন আমার খুব জ্বর এসেছে। ভাইরাল। দু'দিন বিছানায়। তাঁর ফোন,
    — এই বয়েসে আবার জ্বর কী! আশ্চর্য! এই শরীর নিয়ে আপনারা লেখালেখি করতে আসেন! আমি এই আশি বছরে দু'হাতে দু'টো ভারী ব্যাগ নিয়ে এইমাত্র কলকাতা থেকে ফিরলাম। বান্দোয়ান থেকে ব্যাগ দু'টো বয়ে এনেছি...
    তারপর কথা আর কথা। কীভাবে কলকাতা গেলেন। এলেন। মাঝখানে বিরাট কাহিনি। বাংলা একাডেমি, কফি হাউস ইত্যাদি ইত্যাদি শুনে যখন ফোন রাখা হলো তখন আড়াই ঘন্টা কেটে গেছে। আমার জ্বরও গায়েব!
    —এত কথা জ্বরও হজম করতে পারে নি, দাদা... পালালো...
    তখন সে কি হা হা হাসি! আশি বছরের এক বাচ্চা যেন লেবেঞ্চুসের প্যাকেট পেয়ে হাসছে। কিংবা অঙ্কে পাশ করে গেলে যেরকম!
    — তুই তো কবিতা লিখিস! গদ্য লিখিস না কেন?
    — আসলে!
    — বড় আলস্য! বড় আলসে... কমল চক্রবর্তীকে দেখ! তরুণ বৃদ্ধ। আসলে বলে কিছু নেই। ভাঙ! ভেঙে ফেলতে হবে। তোড়ফোড়! কংক্রিটের শহরে থাকিস। কঠিন কর গলার স্বরকে। আদিম এবং অকৃত্রিম... তোড় দো! তোড় দো!
    স্বাভাবিকভাবেই তোড়ফোড়ের সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলেন সন্দীপন -শক্তি। চাইবাসা। শুরু হল জামশেদপুর। শুরু হলো কমল চক্রবর্তীর যৌবনের দিনগুলো। একই কথা যে কতবার শুনেছি। কতবার ভুলে গেছি। আবার শুনিয়েছেন। আবার! আবার!
    — কমলদা এগুলো তো বলেছিলেন। আবার...
    — আরে! শোন না!
    অগত্যা! আবার কখনো কখনো এত গাম্ভীর্য। এত উদাসীন! এত ঈর্ষান্বিত! এত কষ্ট! অভিমান! অভিযোগ! আসলে কমলদা কখনো নিজেকে আড়াল করেন নি। তাঁর লোভ ছিল, তাঁর ইচ্ছে আছে, তিনিও চান, তিনিও পেতে পারেন, তাঁরও যোগ্যতা আছে— সবকিছুই তিনি বলতেন। তাঁর কথায় বোঝা যেত তিনিও যোগ্য। তিনি আড়াল জানতেন না। আবার হয়তো কখনো কখনো বর্ম এঁটে সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতেন একের পর এক নগ্নরূপ। আমি যদিও কখনো চাইতাম না তাঁর চোখ দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে দেখতে, তিনিও হয়ত চাইতেন না, কিন্তু তাও তাঁর অনবদমিত মন সেইসব কষ্টের কথা বলে ফেলত। বলত, উপেক্ষা, অবজ্ঞার কথাও। বোঝাতে চাইতেন, বাংলা সাহিত্য ফুরিয়ে যাবে নাহয়। এসব জেনেও মেনে নেব আমরা! ইত্যাদি ইত্যাদি!
    তিনি বলতেন, বাংলার বাইরে থেকে লেখালেখি করার অসুবিধে। কষ্ট। উপেক্ষার কথাগুলো।

    — জানিস! সমরেশ মজুমদার আমাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন...অসমাপ্ত শেষ উপন্যাস নামে শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৪৩০) যেটা বেরিয়েছে... কিন্তু শেষ করতে পারলেন না... মৃত্যু বড় কঠিন। কঠোর। একটুও সময় দেয় না... সমরেশ মজুমদার মারা গেলেন। একজন এত বড় মাপের একজন সাহিত্যিক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। মৃত্যু ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাঁকে। মৃত্যু তো নির্ধারিত। কিন্তু আমরা শালা! শুয়োরের দল... সেই সাহিত্যিকের মৃত্যুতেও তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারলাম না। মাত্র কয়েকজন শ্মশান যাত্রী। আমি এই বুড়ো বয়েসে আড়াইশো কিলোমিটার পথ ডিঙিয়ে তাঁর কাছে পৌঁছে গেছি অথচ সারা কলকাতা চুপ। মাত্র তিরিশ চল্লিশজন মানুষ এসেছেন। ভাবা যায়! শালা! পৃথিবী! থুঃ...

    সত্যি তাই! কমলদাকেও মৃত্যু সময় দিল না। কয়েকদিন ধরে শুনছিলাম তিনি অসুস্থ। ফোন করবো করবো ভাবতে ভাবতেই মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাঁকে। আমিও তো হতে পারলাম না শ্মশানযাত্রী। শেষ পথের শরিক। শুধু আফসোস আর স্মৃতিচারণ! মৃত্যু ওই যে সময় দেয় না, কিন্তু আমরা কি দিই! মনে হয় মানুষ বড় একা। বড় নিঃসহায়।
    কমলদা এই স্বার্থপরতাকেই গালাগাল করত। থুতু ছেটাতে চাইত। তোড়ফোড় করে ভেঙে দিতে চাইত আমাদের ভালোমানুষির বর্ম!

    যে মানুষগুলো আমাদের চারপাশে থাকেন, তারা শুধু থাকেন। সেভাবে তাদের কথা ভাবা কিংবা তাদের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকানো কোনটাই হয় না সেভাবে। কিন্তু হঠাৎ যখন কোনো একটা অঘটন ঘটে যায়, সেই সময়টাকেই পুরোপুরি নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আর সেই নাড়ানো থেকে আমরা আবার সেই অস্তিত্বহীন অস্তিত্বের দিকে ফিরে তাকাই।
    জানতাম কমলদা অসুস্থ। এই খবরটাই যেন একটা অবিশ্বাস্য। কেননা, কমল চক্রবর্তী মানে এক তরতাজা যুবক। হো হো উচ্চস্বরে হাসি কিংবা প্রচুর গালাগাল দিয়ে বাংলা সাহিত্য সমাজকে জাহান্নামে পাঠানো। কমলদা মানে শান্ত, নির্জন এক তটভূমি। বুনো বৃক্ষের মতো তাঁর অবস্থান। কিংবা হাঁটুর ওপর ধূতি পরে একটা রুখা শুখা পাহাড়ের বুকে জীবন প্রতিষ্ঠা।
    — আরে বাপ রে! পাঠক! পাঠক দেখলেই আমার ভয় করে। আমি দৌড়ে পালাই...
    ফোনে কথা প্রসঙ্গে এই কথাগুলো বলছিলেন আর তারপরেই হো হো করে হাসি। সেই হাসির ভেতর কী ছিল? অভিমান? তাচ্ছিল্য? নাকি সময়ের হাতে নিজেকে সমর্পণ? কিংবা হয়তো কিছুই ছিল না উপেক্ষাটুকু ছাড়া।

    কিন্তু তার মধ্যেও তিনি প্রশ্ন করে বসেন একের পর এক। সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা আমার। কিন্তু এখানে যেন তিনি প্রশ্নকর্তা। আমাকে দিতে হচ্ছে তাঁর প্রশ্নের উত্তর। আর সেই প্রশ্নের ভেতর থেকে উঠে আসছে পুরনো জামশেদপুর এবং এখনকার জামশেদপুরের তুলনা। আমি তাঁর চোখ দিয়ে পুরনো জামশেদপুরকে দেখি। সেই ভোর ছুটে আসা এক সকালের কথা আমার মনে পড়ে। মনে পড়ে, লম্বা টিনের ছাউনির নীচে দাঁড়ালে বৃষ্টির শব্দ কেমন হয়! এবং আমার মনে যায় বৃক্ষনাথের সেই সব প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য রচিত শব্দগুলি। যদিও তিনি তাঁর লেখার কথা এখানে কিছুই বলছিলেন না সেরকম, কিন্তু তারপরেও আমার মনে হচ্ছিল, একের পর এক পৃষ্ঠা যেন খুলে যাচ্ছে আর আমি তার সামনে বসে আছি। আর আমি সুবর্ণরেখার তট পেরিয়ে ছুটে যাচ্ছি কমল চক্রবর্তীর সঙ্গে। বৃক্ষনাথের পাশে পাশে হাঁটছি। কথায় কথায়, শব্দে শব্দে তিনি যে রচনা করছিলেন এক আশ্চর্য পুরনো ইতিহাস। খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া, প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সেই ছোট্ট বালক কমল চক্রবর্তীকে আমি সেদিন খুব কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম এবং বুঝতে পেরেছিলাম আজকের এই ভালোপাহাড় গড়ে ওঠার পেছনের রহস্য। যদিও তিনি বলতেন,
    — নাগরিক জীবনে সব থাকে। আমার মনে হয়েছিল ‘জীবন’ থাকে না। আমি ভাবতুম কবিতা লেখার, মদ গাঁজা খাওয়ার একটা ঠেক তৈরি করবো। প্রথমেই যে ভালোপাহাড়েই করবো এরকম কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।
    আমি প্রায় ঝাড়গ্রামে যেতুম। টাটা স্টেশন থেকে তো এক দেড় ঘন্টা। আমার এক বন্ধু ছিল পার্থ সারথী চৌধুরী, তার বাড়িতে থাকতুম আর বহুদূর পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতুম। ওখানে অশোক মহান্তী , ও একটা হোটেল চালাত। কবিতাও লিখত। আরো কয়েকজন ছেলে আসতো। আমরা কবিতা চর্চা করতুম। শালের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতুম। মনে হতো ঠেক তৈরির জন্য ঝাড়গ্রাম ই আদর্শ জায়গা।
    —শুনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও এরকম কিছু একটা করেছিলেন।
    — হ্যাঁ, পথের পাঁচালী। বনগাঁর এক প্রান্তে। পথের পাঁচালী ছিল একটা হস্টেল। দু-চার বিঘা জমির উপরে। কিছুটা গাছপালা ছিল। আমি ওখানে গিয়েছিলাম। বারীন ঘোষালকেও নিয়ে যাই। দু দিন থেকেওছিলাম ওখানে। সুনীলদাকে বলতাম–ভালোপাহাড়টা যা হয়েছে না সুনীলদা! ভালোপাহাড় ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছে করে না। সুনীলদা বলতেন–‘ ভালোপাহাড় ছাড়া তোমার অন্য কোনো কথা বলো না, তখন থেকে দেখছি আধঘন্টা ধরে ভালোপাহাড় ভালোপাহাড় করে যাচ্ছো। দেখো তোমার মতো আমিও করেছিলাম ‘পথের পাঁচালী’ । আমি শেষ পর্যন্ত পেরেছি কী? তুমি কী করবে? তোমার টাকা কোথায়?’ এসব বলবার পর চেক দিলেন আমার হাতে। সুনীলদা এরকম সাহায্য করতেন আমাকে।
    আসলে কী বলো তো... হ্যাঁ বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধা বলে একটি চরিত্র ছিল। সে সারাদিন কৃষ্ণ কৃষ্ণ করতো। তার কারণ হচ্ছে তুমি যদি ভালোবাসো, তুমি যদি নিবেদিত হও, ভালোবাসার জিনিসকেই প্রতি মুহূর্তে সবাইকে বলতে ইচ্ছে করবে। কেউ শুনুক আর না শুনুক। সারা পৃথিবীতে সে বলে বেড়াতে চায় –আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই অবধি না গেলে ভালোবাসা হয় না।

    আসলে মানুষ এসব টুকরো টুকরো স্বপ্ন নিয়ে, টুকরো টুকরো জীবন নিয়েই তো হেঁটে যায়। অন্তহীন সেই হাঁটা। একটার পর একটা। তারপরে আরেকটা পথ। পথের ওপর পথ। পাশে, সামনে। আড়ালে। একদিন হয়ত দেখা গেল, সেই ঠেক কবেই যেন একটা ভালোপাহাড় তৈরি হয়ে গেছে। যেখানে কয়েকশো শিশুর কলকাকলি। শ্বেতশুভ্র রাজহংস কিংবা বুনো পাখিদের আস্তানা। সঙ্গে জুটে যাচ্ছে নাগরিক জীবনকে পেছনে ফেলে আসা বন্ধু বান্ধবের দল। সঙ্গে কমল চক্রবর্তী। হেঁটে যাচ্ছেন এক অদৃশ্য দুনিয়ায়।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৯০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:fd55:db18:bcd8:***:*** | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৫:০৫537130
  • ভাল লাগল। মনে হচ্ছিল, কমল চক্রবর্তী কে নিয়ে একটা লেখা আসুক 
  • পাপাঙ্গুল | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২৩:০২537205
  • ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ ছাড়াও কমল চক্রবর্তীর লেখা নিয়ে কিছু লিখলে ভাল লাগত। আমার পাপ , রুটির ওপিঠ , স্যার যদুনাথের আদি ভারতবর্ষের ইতিহাস এই ট্রিলজি ছাড়া ওনার গদ্য আর বিশেষ পড়া হয়নি। এক অনুচ্ছেদের সঙ্গে পরের অনুচ্ছেদের ভাবনার মিল নেই , এক পাতার সঙ্গে পরের পাতার বিষয়ের মিল নেই। খুবই 'মুক্ত' গদ্য।
  • আশুতোষ বিশ্বাস | 2401:4900:1c3f:5424:e53a:15ca:3dbe:***:*** | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:৫০537262
  • খুব সুন্দর লেখা। 
  • মানস | 2409:40e0:19:4e8e:18b6:e2ff:fe91:***:*** | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:১৯537264
  • ভিষন ভালো
  • অমলেন্দু চক্রবর্তী | 2401:4900:314a:b794:0:6c:f08f:***:*** | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৯:১২537292
  • লেখাটি খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বেবী সাউ মহাশয়া। সম্পাদক মহাশয় ও বেবী সাউ কে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানায়।
  • Argha Bagchi | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:১৭537474
  •  
    ভালোমানুষীর পাঁকে / কমল হয়েই / ফুটলে ঝরলে গড়লে মরলে / ভালোপাহাড়ের বাঁকে /
    সেসব এখন থাক / লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ বলছে / প্রণাম বৃক্ষনাথ
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন