ছবি: রমিত
কেনিয়ার প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিওংগা গত ২৮শে মে সাতাশি বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের তিন মহীরুহঃ গুগি থিওংগা ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। অন্য দুজন ছিলেন নাইজেরিয়ার চিনুয়া আচেবে এবং নাট্যকার, কবি ওলে সোয়িংকা। প্রথমজনকে আফ্রিকান উপন্যাসের পথিকৃৎ গণ্য করা হয়; ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘থিংস ফল এপার্ট’ উপনিবেশকারী শক্তি কী ভাবে অধীনস্থ দেশের ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে বিপন্ন করে তোলে তার একটি মাইলফলক। দ্বিতীয় জন সাহিত্যে আফ্রিকার প্রথম নোবেল প্রাপক।
গত এক দেড় দশক ধরে নগুগি থিওংগার নাম বারবার সম্ভাব্য নোবেল প্রাপক হিসাবে আলোচিত হয়েছে। প্রতিবার বিশ্বজুড়ে তাঁর অনুগামীরা হতাশ হয়েছেন। একবার কয়েক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষারত সাংবাদিকরা এতটাই হতাশ হয়ে পরেন যে, লেখকের পরিবারকে তাঁদের জন্য চা জলখাবারের ব্যবস্থা করে সান্ত্বনা দিতে হয়েছে। অনেকেই মনে করেন তাঁর নোবেল না পাওয়ার প্রধান কারণ তিনি আফ্রিকান সাহিত্যিকদের ইংরাজি, ফরাসির মত উপনিবেশিক ভাষা পরিত্যাগ করে স্থানীয় ভাষায় লেখার জন্য আহ্বান করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘উইপ নট চাইল্ড’, ‘পেট্যালস অফ ব্লাড’, ‘উইজার্ড অফ দ্য ক্রো’। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর আলোড়নকারী নন-ফিকশন ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড: দ্য পলিটিক্স অফ ল্যাঙ্গুয়েজ ইন আফ্রিকান লিটারেচার’। এই বইয়ে তিনি লেখেন উপনিবেশিক শাসনের সময় পরাধীন মানুষদের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয় এবং পরিবর্তে বিদেশি ভাষা ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় কেনিয় ইংরাজি, নাইজেরিয় ইংরাজি কি স্থানীয় ভাষা নয়, তখন তিনি বলেন এটা অনেকটা এক দাসের তার দাসত্বের স্থানীয়তার জন্য গর্ব! অধীনস্ত মানুষ যখন উপনিবেশিক শাসকের ভাষা নিজের বলে দাবি করার চেষ্টা করে, তখন সেটা হয়ে দাঁড়ায় দাসত্বের সাফল্য! এই সময় থেকেই তিনি ইংরাজির পরিবর্তে গিকুয়ু ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন। তাঁর অল্পবয়সের দুটি স্মৃতিকথাঃ ‘ড্রিমস ইন আ টাইম অফ ওয়ার’ এবং ‘ইন দ্য হাউস অফ দ্য ইন্টারপ্রেটার’। প্রথমটির সময়কাল তাঁর জন্ম থেকে ১৯৫৫ অবধি, দ্বিতীয়টি তার পরের চার বছর যখন তিনি আল্যায়েন্স স্কুল থেকে পাস করে উগান্ডায় কলেজে পড়াশোনা করতে চলে যান। এই লেখায় আমরা মুলত তাঁর ‘ড্রিমস ইন আ.....’ গ্রন্থটির ভিত্তিতে তাঁর ছেলেবেলা এবং তৎকালীন কেনিয়া সম্পর্কে জানা বোঝার চেষ্টা করব।
লেখকের পিতার চার স্ত্রী, তাঁদের চব্বিশ সন্তান। থিওংগা ঠিক কত নম্বরে সেটা সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারনা ছিল না, কিন্তু তাঁর নিজের মায়ের, (মাইতু) তিনি ছিলেন চতুর্থ সন্তান। পিতার প্রথম স্ত্রী ছিলেন বড় মা, মাইতু মুকুরু, অন্য দুজন ছিলেন ছোট মা, মাইতু মুনাইইনি । স্ত্রীরা কেউ পরস্পরকে তাঁদের নাম ধরে ডাকতেন না, তাঁদের পিতার কন্যা হিসাবে সম্বোধন করতেন। বাড়িটা ছিল একটা ছড়ানো প্রাঙ্গন যাতে পাঁচটি ঘর। প্রধান ঘরটি ছিল তাঁর বাবার যেখানে রাতে ছাগল ঘুমাত। অন্য চারটি ঘর স্বামীর ঘরের সমদূরত্বে অবস্থিত ছিল। স্ত্রীরা পালা করে তাঁর বাবার ঘরে খাবার নিয়ে যেতেন। এই চার মহিলার মধ্যেকার ঐক্য ছিল লৌহদৃঢ়, বাইরের কোনও ঘটনা, এমনকি তাঁদের স্বামী ও সন্তান পর্যন্ত সেই ঐক্যে চিড় ধরাতে পারত না। মায়েদের সবার সন্তানকে শাসন করার অধিকার ছিল; যদি কেউ তাঁর জন্মদাত্রী মায়ের কাছে অভিযোগ করতো, তাঁর অধিক শাস্তি বরাদ্দ ছিল। তাঁদের নিজেদের মধ্যেকার মনোমালিন্য তাঁরা নিজেরাই মিটিয়ে ফেলতেন, এক্ষেত্রে বড় মা মুখ্য ভূমিকা নিতেন। জ্ঞান হওয়ার পরে লেখক উপলব্ধি করেন, ‘আমাদের জমি ঠিক আমাদের জমি নয়’। সেটা ছিল এক আফ্রিকান জমিদারের সম্পত্তি, তাঁর পরিবার ছিলেন ভাড়াটে, আহই । আবার মনে হতো আমাদের পরম্পরাগত জমি কি ইউরোপিয়ানদের কাছে হারিয়ে ফেলেছি? বিষয়টা থিওংগার কাছে ধোঁয়াটে ছিল!
লেখকের জন্মের তিপান্ন বছর আগে বার্লিন কনফারেন্সে ইউরোপীয় শক্তিগুলি মহাদেশটিকে তাদের নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে ফেলেন। এর ফলে ১৯১৪ সালে যখন প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হল তখন টাঙ্গানিকা (অধুনা তানজানিয়া) এবং কেনিয়া তাদের প্রভু, যথাক্রমে জার্মানি এবং ব্রিটেনের হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। যুদ্ধের শেষে ‘সভ্য’ দেশের সৈন্যরা আফ্রিকার জমি উপহার হিসাবে পেলেন এবং আফ্রিকার সেনারা তাঁদের জমি হারালেন এবং জবরদখলকারী হয়ে গেলেন। এটাই আদপে কেনিয়ার গল্প – উচ্ছেদ, নির্বাসন, ধারাবাহিক বিনাশ। ১৯০২ সাল থেকে ইউরোপিয়ানরা বারবার স্থানীয়দের নানা অছিলায় উৎখাত করে জমি দখল করেছে। প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে যে আফ্রিকান সৈন্যরা ফিরে আসেন তাঁদের জমি থেকে বিতাড়িত করে রিফট ভ্যালি নামক জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৪১এ সৈন্যরা যখন যুদ্ধে তখন তাঁদের আবার উচ্ছেদ করে ওলে নগুরুয়েনি নামক স্থানে নির্বাসিত করা হয়। তিন বছর বাদে তাঁরা যখন ফিরে আসেন তাঁদের তৃতীয় বার উৎখাত করার তোড়জোড় শুরু হয়। তাঁরা রুখে দাঁড়ান। উপনিবেশিক সরকার তাঁদের বলপূর্বক ট্রাকে তুলে ইয়াট্টা নামক স্থানে পাঠিয়ে দেয় যেখানকার মাটি কালো পাথরের মতো। বিপর্যস্ত এই মানুষেরা তাঁদের এই পরিস্থিতি নিয়ে গান বাঁধেন, যেটা লেখক ১৯৪৮ সালে প্রথম শোনেন এবং কয়েক বছর বাদে স্কুলে সেই গান করেন।
মহতি প্রেম আমি দেখেছিলাম সেখানে
নারী ও শিশুদের মাঝে
যখন একটি দানা মাটি থেকে তুলে
ভাগ করে নিয়েছিল সকলে।
১৯৪৭ এর এক সন্ধ্যায় লেখকের মা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি স্কুলে যেতে চাও?’ পরিবারে তাঁর দাদা ওয়ালেশ মোয়াঙ্গি এবং কয়েকজন তুতো ভাই অতীতে স্কুলে গেছে, কিন্তু পয়সার অভাবে দু এক বছর বাদেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। মেয়েদের অবস্থা তো আরও করুণ, তাঁরা কেউই এক বছরও ক্লাস করে উঠতে পারত না। বাড়িতে অক্ষরজ্ঞান অর্জন করতো যাতে অন্তত বাইবেলটা পড়তে পারে। তাই মা যখন তাঁকে প্রশ্ন করেন তিনি বিহ্বল বোধ করেন। যখন তিনি কোনও মতে সম্মতি প্রকাশ করেন, মা তাঁকে জানিয়ে দেন যে তাঁরা গরীব, এবং তাঁর দুপুরের খাবার নাও জুটতে পারে। ‘কথা দাও ক্ষুধা বা কষ্টের কারণে তুমি কখনো পড়াশোনা ছাড়বে না। এবং তুমি সব সময় তোমার সেরাটা দেবে।‘ স্কুল এবং ইউনিফর্মের খরচ তাঁর মা খেতের ফসল বাজারে বিক্রি করে যোগাড় করলেন। একটি দোকানে পোশাক কিনতে গিয়ে নয় বছর বয়সি বালক দেখল দেয়ালে চশমা পরা এক ভারতীয়ের ছবি টাঙান রয়েছে। কয়েক বছর বাদে জানলেন তিনি এম কে গান্ধী যাঁর সাথে ১৯২১ সালে গঠিত ‘ইস্ট আফ্রিকান এ্যাসোসিয়েশন’-এর নেতা হ্যারি থুকু সংযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং সেই সূত্রে স্থানীয় ভারতীয় ও তাঁদের নেতা মণিলাল এ দেশাই-এর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে ছিলেন।
মাত্র দেড় বছর পরে প্রথম স্কুল ছেড়ে মাঙ্গুও নামে এক জায়গার স্কুলে ভর্তি হলেন। এই দুটি ছিল দুই ধরনের বিদ্যালয়। প্রথমটি ছিল কিররে স্কুল, যাদের উপনিবেশিক শাসকের নানা শর্ত মেনে চলতে হতো, যেমনঃ গিকুয়ু ছেলেমেয়েদের মধ্যে সুন্নত বা খতনা একটি ধর্মীয় প্রথা হিসাবে মানা হতো। শাসক নিদান দেয় এটি অখ্রিস্টিয় প্রথা হওয়ার কারণে সমস্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিজেদের পরিবারে, বিশেষ করে মেয়েদের genital mutilation, নিষিদ্ধ করতে হবে; কখনই ‘কিকুয়ু সেন্ট্রাল এ্যাসোসিয়েশন’, সেই সময়ে কেনিয়ার প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন-এর সদস্য হওয়া যাবে না; প্রধান রাজনৈতিক নেতা জোমো কেনিয়াট্টা, যিনি কয়েক দশক পরে, স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন, তাঁর অনুগামী হওয়া যাবে না; এবং সরকার এবং মিশনারিদের দ্বারা সংগঠন ছাড়া অন্য কোনও সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়া যাবে না। যাঁরা এইসব শর্তে রাজি হলেন না তাঁরা আফ্রিকান স্বাধীন স্কুল আন্দোলন গড়ে তুললেন। ‘কিকুয়ু ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কুলস এ্যাসোসিয়েশন’ কারিং’আ স্কুল গড়ে তুলল, যেখানে আফ্রিকান শ্রমিক নয় আফ্রিকান মানুষ গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হল। থিওংগার নতুন স্কুল, কারিং’আ স্কুল। সেখানে সে পড়াশোনায় দারুণ কিছু করল এমনটা নয়, কিন্তু গ্রামের মাতব্বরদের সভার খুঁটিনাটি সম্বলিত একটা বিবরণ লিখে শিক্ষককে চমকে দিল।
ইতিমধ্যে দেশে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার হয়ে উঠেছে। ‘কেনিয়া ল্যান্ড এন্ড ফ্রিডম আর্মি’, মৌ মৌ নামে খ্যাত বিদ্রোহ তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। থিওংগার বৃহত্তর পরিবারের এর ঢেউ এসে পড়ছে। লেখকের দাদা ওয়ালেশ বিদ্রোহে যোগ দেন, গেরিলা বাহিনির সদস্য হয়ে আত্মগোপন করেন। একই সাথে তাঁর তুতো ভাই শাসকের পক্ষ নিয়ে ময়দানে শামিল হন। গিকুয়ুদের মধ্যে একটা প্রবাদ আছে একই মায়ের গর্ভ থেকে খুনি এবং বিদ্রোহি উভয়েরই জন্ম হতে পারে। এই সময়ই কেনিয়াট্টা গ্রেপ্তার হন। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করা সত্ত্বেও তাঁকে মৌ মৌ বিদ্রোহের মূল নেতা হিসাবে অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৫৯ অবধি কারাবাসের পর তাঁকে নির্বাসিত করা হয়।
১৯৫৩ সালে লেখকের মা তাঁকে বলেন, আমি তোমার বাবার কাছে খবর পাঠাচ্ছি যে তুমি এখন পুরুষ হওয়ার উপযুক্ত। থিওংগার বাল্যকালে তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর এই প্রথম তাঁর মা স্বামীর সাথে পুনরায় যোগাযোগ করলেন। এই প্রথা বাস্তবায়িত করার জন্য পিতামাতা উভয়ের সম্মতি প্রয়োজন। স্কুলের ছুটির সময় কিশোরের সুন্নতের দিন ঠিক হল। পুরো অনুষ্ঠানটির তিনটি পর্ব আছে – প্রস্তুতি, সুন্নত এবং নিরাময়। উপনিবেশিক সময়ের আগে বরিষ্ঠদের একটি কাউন্সিল পুরো দেশের জন্য প্রথা-পালনের দিন ধার্য করতেন। সারা দেশজুড়ে ছেলেমেয়েরা নির্দিষ্ট দিন এবং সময়ে ওই তিনটি পর্ব পালন করতেন। তখন নিজের পরিবার তো বটেই, পুরো সম্প্রদায়, সমাজ এই অনুষ্ঠানে একত্রে অংশগ্রহণ করতো। সময়ের সাথে সাথে সমষ্টিগত অংশগ্রহণ কমে এসেছে। এখন অনেকে কোনও ঝুঁকি না নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে শল্যচিকিৎসকের মাধ্যমে কাজটা করিয়ে নেয়।
থিওংগা কিন্তু সাবেকি প্রথাতেই বিশ্বাসী, কারণ তিনি মনে করেন এই প্রথা তাঁর ব্যক্তি ও জাতি পরিচিতি-কে জোরদার করে। তিনি প্রস্তুতি পর্বটা খুব উপভোগ করেন। এই সময় পড়শিদের বাড়িতে যেতে হয়, খাওয়াদাওয়া হয়, তাঁরা নানা উপহার দেন। দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন বাড়িতে আসে, নাচ গান হয়। গানের ভাষা প্রায়শই অশ্লীল এবং যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ হয়। যৌনতা নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা হয়, যদিও শারীরিক ঘনিষ্ঠতার কোনও অনুমতি নেই। ‘আসল’ কাজের দিন সকালে মাথা ন্যাড়া করতে হয় এবং শরীরের সমস্ত চুল ছেঁটে ফেলতে হয়। থিওংগা জানেন এই সময় কোনও ভাবে ভয় পেলে সারা জীবন তাকে কাপুরুষ বলে গণ্য করা হবে। কর্তনের সময় সে কোনও ব্যথাই অনুভব করে না কারণ বরফশীতল জলে স্নান করার দরুণ তার ত্বক অসাড় হয়ে থাকে। এরপর অন্তত তিন সপ্তাহ তাকে একটি ঘরে রেখে নিরাময় পর্ব চলে। এই পর্বের শেষে তাকে একটি মেয়ের সাথে শারীরিক সঙ্গম করে নিজের সতীত্ব বর্জন করে পুরুষত্ব প্রমাণ করতে হয়। থিওংগাকে বলা হয় তিনি এখন একজন সম্পূর্ণ পুরুষ। যে সব বন্ধুদের সুন্নত হয়নি তাঁদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছেদ করতে হয়, নতুন বন্ধু পাতাতে হয়। এখন তিনি বড়দের সাথে মেলামেশা করতে পারেন, স্ফূর্তি করতে পারেন। পুরো অনুষ্ঠানের পরে লেখকের মনে হয় এই সামান্য অঙ্গছেদ নয় নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষমতায়নের আসল উৎস শিক্ষা ও জ্ঞান।
কেনিয়া আফ্রিকান প্রাথমিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের কাছে একটা আতঙ্ক ছিল। মোটামুটি পাঁচ শতাংশ পাস করে ‘হাই স্কুল’ বা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে যেতে পারত। তখন চারিদিকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি হওয়ায় পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া খুব সমস্যা ছিল। যখন তখন সেনারা গ্রামে ঢুকে পড়তো, ধরপাকড় করতো, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত। ইংরাজি ছাড়া কোনও পাঠ্যপুস্তক ছিল না, খালি শিক্ষকদের নোটস। থিওংগা সেগুলোই বারবার পড়তেন আর পড়তেন তাঁর প্রিয় TREASURE ISLAND এবং GREAT EXPECTATIONS। পরীক্ষার কয়েক দিন আগে ওয়ালেশ দলবল নিয়ে এসে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলেন। দাদা তাঁর পড়াশোনা নিয়ে রীতিমত গর্ব বোধ করতেন। লেখক তাঁকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলেন, পাহাড়ে তাঁরা কী ভাবে আত্মগোপন করে থাকেন, সরকারি বাহিনির সাথে তাঁদের সংঘর্ষের অভিজ্ঞতা, তাঁদের নেতা মার্শাল দেদান কিমাথির কথা, যাঁকে নিয়ে ১৯৭৬ সালে তিনি নাটক লিখবেন, ‘দ্য ট্রায়াল অফ দেদান কিমাথি’। কিন্তু পরীক্ষার চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে তিনি কিছুই জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারলেন না।
এক দিন গির্জা থেকে ফেরার সময় লেখক এবং তাঁর সাথীদের সেনাদের একটা দল ঘিরে ধরল। এক ইংরেজ অফিসার তাঁকে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করল। একবার লেখক তাঁর উত্তরে সম্মানসূচক এফেন্ডি, (মহাশয়) ব্যবহার না করায় তাঁকে পেল্লাই এক ঘুষি মারল। প্রবল ব্যথা সত্ত্বেও লেখকের অহং বোধ তাঁর কান্না রোধ করলো, এতে অফিসার আরও ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে পরপর আঘাত করে মাটিতে ফেলে দিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, লেখকের কোনও ভাই বাড়ির বাইরে থাকে কি না, সে বাড়িতে এসেছিল কি না ইত্যাদি জানা। যখন তারা বুঝল যে দাদার গতিবিধি সম্পর্কে লেখকের কোনও ধারণা নেই, তখন তারা তাঁকে ছেড়ে দিল।
পথেঘাটে এরকম হেনস্থা এবং অপমানিত হওয়া উপনিবেশিক জীবনে আকছার ঘটে। মোটামুটি সবাই এই অপমান নীরবে হজম করে নেয়। লাঞ্ছিত হওয়ার কিছু দিন পরেই লেখক জানতে পারলেন তিনি আরও বড় স্কুলের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। পরিবার, পড়শি সবাই আনন্দে মেতে উঠলেন, কিন্তু তারপরেই সবার সম্বিত ফিরলঃ পড়ার জন্য এত টাকা, স্কুলের ইউনিফর্ম, জুতো তাঁর মা যোগাড় করবেন কোথা থেকে? গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো একই সাথে গুজব ছড়াল যে সরকারের অনুগত ধনী ব্যক্তিরা এক মৌ মৌ বিদ্রোহীর ভাইকে অ্যালায়েন্সের মতো একটা সম্মাননীয় স্কুলে সুযোগ না দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করবে। এত অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও গোষ্ঠী সংহতি, ভ্রাতৃত্বর সুবাদে টাকাপয়সা সমেত সবই যোগাড় হয়ে গেল।
স্কুলে যাওয়ার জন্য থিওংগা জীবনে প্রথম ট্রেনে চড়বেন। প্রায় সব কামরা ‘শুধুমাত্র ইউরোপিয়ানদের জন্য’ অথবা ‘শুধুমাত্র এশিয়ানদের জন্য’, আফ্রিকানদের জন্য তৃতীয় শ্রেণীর কামরাই শুধু বরাদ্দ। স্কুলে এই যাত্রা পথেও তিনি বারবার নানা বাধার সম্মুখিন হলেন। অবশেষে যখন তিনি স্কুলে প্রবেশ করেন তখন তাঁর মনে পড়ে মায়ের সাথে তাঁর চুক্তি হয়েছিল যুদ্ধের সময়েও তাঁর স্বপ্ন দেখা জারি থাকবে।
তিন মাসে বাদে থিওংগা ছুটিতে বাড়ি ফেরেন। রেল স্টেশন পেরিয়ে তিনি হেঁটে গ্রামের দিকে যান, তিনি বুঝতে পারেন তিনি পৌঁছে গেছেন, কিন্তু তাঁর বাড়ি কোথায়? দেখেন তাঁর বাড়ি শুকনো মাটি, টুকরো কাঠ, ঘাসের একটা স্তুপ; খুঁটির ওপর খাড়া করা তাঁর মা এবং ভাইয়ের ঘর মাটিতে মিশে গেছে। চোখ তুলে দেখে পুরো গ্রামটাই হাপিশ হয়ে গেছে। কোথায় গেলেন তাঁর পরিবার? কিন্তু সেটা তো আরেক গল্প যা জানতে হলে পাঠককে তাঁর পরের স্মৃতিকথা, ‘ইন দ্য হাউস অফ দ্য ইন্টারপ্রেটার’ পড়তে হবে।