এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • প্রেম - অপ্রেম : আমার দুপুর 

    Manali Moulik লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১০৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • নিস্তব্ধ দুপুরে জানলার গ্রিলের যে নকশা দেয়ালে ফুটে ওঠে রোদের কারুকার্যে, তার সঙ্গে খেলাঘর সাজানোর ঐতিহ‍্য আমার সেই ছোটোবেলা থেকে। 'ছোটোবেলা' লিখি সবসময়ে, ছেলেবেলা আর মেয়েবেলার দ্বন্দ্ব নাহয় থাক। এসবের মধ‍্যে ছোটোরা কোথায় যেন হারিয়ে যেতে পারে দিক ভুলে। দুপুর নিয়ে এক আশ্চর্য অনুভব চিরদিনই আমাকে আচ্ছন্ন করে এসেছে। টগরগাছে কোণে মাথা নীচু করা ঘুঘুপাখির একমনে কুবকুব ডাকের সঙ্গে হেঁটে বেড়ানো আর জানালার গরাদে বসে পায়রার চিরপরিচিত ডাক। ডালভাতের গন্ধ ছাপিয়ে সেসব আশ্চর্য দুপুর আমার একান্ত নিজস্ব ঐশ্বর্য। কেবল দুপুর কেন?  নিজস্ব বিকেল, সন্ধ‍্যে, অপরাহ্ন, ত্রিযামা যামিনী সবই আছে আমার। সেসব মহানগরীতে বসে অন‍্য কেউ দেখতে পায় না। আমাকে ভিতর থেকে খুঁড়লে তার অতল সামুদ্রিক হ্রেষা হয়তো আমি নিজেই শুনতে পাই। এসব আমাকেই টানে। যেমন পুরাতন স্লোগান লেখা দেয়াল, ধুলোজমা সংবাদপত্র আর আবছা আঁধার বারান্দা আমার আশৈশব প্রেমিক। হ‍্যাঁ, বলছিলাম টগর গাছের কথা। তার পাতার ছাপোষা কারুকার্য দুপুরের রোদে আলপনা এঁকে দিতো মামাবাড়ির একফালি উঠোনে। পাশের ভাঙা দালানে সমান্তরিক আকৃতির রোদ ঠিক সাড়ে তিনটে পর্যন্ত থাকবে, তারপর সূয‍্যিমামার বাড়ি ফেরার ব‍্যাগ গোছানোর সময় হলে সেও ফিরবে নিজেকে গুছিয়ে। জানালার কোণায় দীপাবলির দিনের আধভাঙা প্রদীপ। সামনেটায় একটুখানি কালি এখনো লেগে আছে। ঝুমকো জবা আর সিম গাছের চারার গায়ে দ্বিপ্রাহরিক সোনার অলংকার। এরপর অপরাহ্নের ধূপছায়া শাড়ি পড়ে সাজবে ওরা। বৈকালিক প্রসাধন সেরে নেবে বেগুনি-নীল-কমলা আলোর ফুলে। ওই প্রদীপের দিকে তাকালেই দুপুর, আবার ঝিলমিলে রোদ....আমার নিজস্ব দুপুর ভাবায় উজ্জয়িনীর দ্বিপ্রহরের কথা। হয়তো খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতেও নামতো এমনই সোনাগলানো দুপুর। শ্বেতপ্রস্তরের কোনো বাঁধানো পুষ্করিণীর পাশে পাশে অলক্তরঞ্জিত পায়ের ছাপ ফেলে হেঁটে যেতো  কোনো নগরবধূ। প্রান্তরের গ্রাম‍্যবালিকারা তখন দয়িতসমীপে যাওয়ার আগে একটি ধানের মঞ্জরী বা যত্নে গাঁথা যুথিকা ফুলের মালা খোঁপায় জড়িয়ে নিতে ব‍্যস্ত। সোনালী রোদের সময় ফুরিয়ে সেই নীলাভ আঁধার আকাশকে ঢাকতে শুরু করবে তখনই ওই শ্বেতপ্রস্তরের ঘাটে সারি সারি এমন প্রদীপ জ্বলে উঠবে। জল তখন হবে হীরকদ‍্যুতিতে মাখামাখি। ভাঙা ভিটের গায়ে আছড়ে পড়বে নগরবধূর কলহাস‍্যের ঝংকার। সত‍্যিই কি এমন দুপুর উজ্জয়িনী, শ্রাবস্তী বা শূরসেন-মৎস‍্যে নেমে আসতো?  আকাশের রঙ তখন হয়তো ছিলো আরো নীল, পৃথিবীর বয়স আরো কম। এই দুপুরকে আমি দেখতে পাই, ছুঁতে পারি হাওড়ার কোয়াটার্সের ঘরে বসে। যখন আমার দেয়ালে রোদের আঁকিবুঁকি, কম্পার্টমেন্টের ফুলগাছের নীচে পায়রার একটানা ডাক। আমাদের এই প্রেম তো আজ থেকে নয়। আরো ছোটোবেলায় খেলাঘর বাঁধতে লেগেছিলাম নিজের গরজেই। বোকা থাকে মানুষ ছোটোবেলায়, যা আত্মা যায় তাকে একদম হাতের মধ‍্যে পাওয়া চাই। রঙ করা প‍্যাকিং বাক্সের রাজপ্রাসাদ আর ছোটো ফুলের চারা বসিয়ে সাজানো নগর, চকের গুঁড়ো আর শোলায় তৈরী জলাশয়, গোটাকয়েক পুতুল রাজকন‍্যা। পড়তে বসা তো সেই সন্ধ‍্যায়, আমার নিজস্ব দুপুর কাটতো ওই প‍্যাকিং বাক্সের প্রাসাদ আর ধূপের প‍্যাকেটের রোল করা পিচবোর্ডের স্তম্ভ নিয়ে। যার গায়ে পেনসিল দিয়ে ছোটো ছোটো আয়তাকার ইঁট এঁকে দেওয়া যায় আর হলুদ মার্বেল পেপারের পর্দা ঝোলানো যায়। যে রঙের রোদ এসে পড়তো এই খেলাঘরে, সেই কি জানতো তাকে আবার আহ্বান করা হচ্ছে নেহাৎ ফেলে আসার কল্পনায়?  তখন ম্লান হয়ে যায় এই ধূলিধূসরিত বয়স্ক পৃথিবী, ঈর্ষা - দ্বেষ আর সংঘর্ষের অভিজ্ঞান। সেই দুপুর ষষ্ঠ শতাব্দীর না ২০১৬ র? তা আমার জানা নেই। তবে এগুলি আমার নিজস্ব দুপুর। এ তো গেলো অঙ্গসজ্জার কথা, এখন মঞ্চে চরিত্র কারা? সেইসব রাজকন‍্যা পুতুলদের সাজগোজও একটা আবিষ্কার বলা চলে যা ভেবে এখন নিজেরই হাসি পায়।  গোলাপী, লাল,নীল কাপড়ের টুকরো দিয়ে শাড়ি পরানো হলো, চুল বেঁধে দিয়ে নাহয় খোঁপার মতো করা হলো, কিন্তু এই কবরীতে পাথরের ফুল বা হীরের তারার কী হবে? একটা আলপিনের মধ‍্যে দিয়ে রঙিন পুঁতি ভরে দিলে তা নিজে থেকেই বড়োদের মাথার কাঁটার মতো হয়ে যায়। তারপর পিনের সূঁচালো দিকটা খোঁপায় গুঁজে দিলেই মিটে গেলো। হলুদ রঙের গার্টার পুতুলদের হাতে পাকে পাকে জড়িয়ে দিয়ে সুবর্ণকঙ্কন। কোনো গার্টার ছিঁড়ে কয়েকটি গিঁট বাঁধার পর দুয়েকটা কাঁচের পুঁতি গেঁথে দিয়ে আগের মতো করলেই দিব‍্যি হার হয়ে যেতো। নতুন ধরণে শাড়ি পরানোর (মেখলা, নাচের পোশাক, নীচোল ধরণের শাড়ি) জন‍্য আলপিন গেঁথে গেঁথে নতুন সব প্রচেষ্টা। এদের নিয়ে সেসব খেলা শুরু করার আগে নাম দেওয়ার সমস‍্যা কী কম?  এখন এসব ভেবে নিজেরই হাসি পায়।  কাঞ্চনমালা, মুক্তামালা, নীলকুন্তলা, বিম্ববতী, শঙ্খমালা আরো অজস্র কল্পনার পাখা বিস্তার একবার শুরু হলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা আমার হাতে নেই।
    মহানগরীর পেট্রোল-ডিজেলের ধো ঁয়ায় ঢাকা আকাশ আর নিঃশ্বাসের ফুরসৎ না পাওয়া তপ্ত দ্বিপ্রহরে মনে একঝলক শীতল বাতাসের মতো সেসব ফিরে আসে। আর প্রেমের সংজ্ঞা লিখতে বসলে নতুন নতুন করে যার কাছে ফিরে যেতেই হয়। সেই আমার প্রথম প্রেম, একান্ত নিজস্ব দুপুর।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শ্রীমল্লার বলছি | ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:৩৭736483
  • এই তো সেইলেখা! কত আদরযত্ন দিয়ে লেখা, আবারও পড়ব এইলেখা। নতুনভাবে পড়ব! 
    আর সত্যি বলতে যে-কোনও লেখাই তো আসলে আয়না। লেখকের সব লেখায় হয়তো পাঠক নিজের মুখ দেখে উঠতে পারে না, কিন্তু এমন অনেক লেখা আছে— যেখানে পাঠক নিজের মুখ দেখতে পাই। এ লেখা তেমনই... heart
  • প্রিয়তমাসু | ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:০৬736487
  •  খুব যত্ন নিয়ে সুন্দর লেখা । পড়তে বসে নিজের ছোটবেলার অনেক আবছা স্মৃতি মনে পড়ে গেল,  পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে কিছুটা একাকী একাত্মবোধ |  
  • Manali Moulik | ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:০৪736492
  • ধন‍্যবাদ সকলকে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন