প্রশ্নঃ “আমাদের সীমান্তবর্তী কোন কোন দেশ এক সময় আমাদের দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল?”
উত্তরঃ “পূর্বে ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার) এবং বাংলাদেশ, পশ্চিমে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান, উত্তরে তিব্বত, নেপাল এবং ভুটান, এবং দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা”।
এই প্রশ্নোত্তর বোধমালা-৪ এর পৃষ্ঠা ৫-এ পাওয়া যায় যেটি ক্লাস ফোরের ছাত্রদের সাংস্কৃতিক চেতনার ওপর একটি পাঠ্যপুস্তক। বইয়ে আরব সাগরকে ‘সিন্ধু সাগর’, ভারত মহাসাগরকে ‘হিন্দু মহাসাগর’ এবং তিব্বতকে একটি পৃথক দেশ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
এই একই সিরিজের শিক্ষকদের একটা গাইডবুকে এই বিস্ময়কর দাবী করা হয়েছেঃ
“অতীতে সারা জম্বুদ্বীপ জুড়ে হিন্দু সংস্কৃতি বিরাজ করতো….. আজ যেটা আমরা এশিয়া বলি সেটা প্রাচীন কালে জম্বুদ্বীপ ছিল। পুরো মিশর, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কাজাখিস্তান, ইজরায়েল, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, চিন, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জাভা, সুমাত্রা, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান এর অংশ ছিল”।
বইটির একই বিভাগে বলা হচ্ছেঃ “কৌরব ও পাণ্ডবদের যুদ্ধের পরবর্তী কালে অঞ্চলটা সংকুচিত হয়ে আর্যাবর্ত হয়ে যায় যাতে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু মধ্যবর্তী সময়ে বহিরাগত আক্রমণ, ধর্মান্তরকরণ এবং যুদ্ধবিগ্রহর ফলে এখন আমাদের শুধুমাত্র হিন্দুস্তান রয়ে গেছে…. বৈজ্ঞানিক তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় যে হিমালয় এবং তার পারিপার্শ্বিক, যার কেন্দ্রে আছে কৈলাস, পৃথিবীতে স্থলভূমির প্রাচীনতম নমুনা। ত্রিবিষ্টপ (তিব্বত) পৃথিবীর উচ্চতম ভূভাগ। মনে করা হয় সর্বনাশা প্লাবনের পরে এখানেই মনুষ্য জাতির উদ্ভব হয়েছিল”।
হরিয়ানাতে অবস্থিত ‘বিদ্যা ভারতী সংস্কৃতি শিক্ষা সংস্থান’ থেকে প্রকাশিত বোধমালা সিরিজ, যাতে আছে শিক্ষকদের তিনটি গাইডবুক এবং ক্লাস ফোর থেকে টুয়েলভের পাঠ্যপুস্তক, তাতে এই ধরণের বহু ‘ফ্যাক্ট’ উপস্থাপিত হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে আরএসএসের শাখা ‘বিদ্যা ভারতী অখিল ভারতীয় শিক্ষা সংস্থান’ দ্বারা পরিচালিত স্কুলগুলিতে এই বইগুলিই পড়ানো হয়ে থাকে। আরএসএস ভারতের শাসক দল বিজেপির মতাদর্শগত অভিভাবক এবং এদের নীতি নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী সারা ভারতে বিদ্যা ভারতীর ১২৮২৮ স্কুলে ৩৪.৬০ লক্ষ ছাত্রছাত্রী এবং ১.৫ লক্ষ শিক্ষক আছেন। বেশির ভাগ স্কুল সেন্ট্রাল বোর্ড অফ স্কুল এডুকেশন, বিভিন্ন স্কুল বোর্ড এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ওপেন লার্নিং দ্বারা অনুমদিত।
বিদ্যা ভারতী নিজেদের “বিশ্বের সর্ব বৃহৎ শিক্ষা সংগঠন” হিসাবে দাবী করে থাকে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে “একটা জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতি নির্মাণ করা যেটা নারী পুরুষের একটা তরুণ প্রজন্ম গড়ে তুলবে যারা হিন্দুত্বর প্রতি দায়বদ্ধ, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং যারা প্রাণবন্ত ও শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক ভাবে পরিপূর্ণ উন্নত………”
এই সংগঠনের বই হিন্দি ছাড়াও বাংলা, তামিল, ওড়িয়া সহ বারোটি ভাষায় প্রকাশিত হয় এবং সরকার-স্বীকৃত পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি শেখানো হয়। কিন্তু ছাত্র ও শিক্ষকদের এগুলি শেখা আবশ্যক এবং এই বইগুলির ভিত্তিতে বাৎসরিক পরীক্ষাও হয়। এই পরীক্ষার নাম ‘অল ইন্ডিয়া কালচারাল এওয়ারনেস এক্সামিনেশন’ যা ১৯৮০ থেকে হয়ে আসছে। বিদ্যা ভারতী ওয়েবসাইট অনুযায়ী ২০১৮-২০১৯ এ ২২৩২১৩৪ জন ছাত্র, ৫৬৩৭৩ শিক্ষক এবং পিতামাতা এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল।
বিদ্যা ভারতী স্কুলে কী ইতিহাস শেখায় এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের একটি সাম্প্রতিক বিবৃতি থেকে জানা যাচ্ছে যে NCERTর ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করার কেন্দ্রীয় সরকারের যে পরিকল্পনা তা বিদ্যা ভারতীর ভূতপূর্ব প্রধান দীননাথ বাটরার সম্পাদিত একটি বইয়ের মাধ্যমে লাগাতার প্রচেষ্টার সাথে সম্পর্কিত। বইটির নাম, ‘দ্য এনেমিজ অফ ইন্ডিয়ানাইজেশনঃ দ্য চিল্ড্রেন অফ মার্ক্স, ম্যাকলে এবং মাদ্রাসা’। ২০০১ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো যখন অটল বিহারি বাজপেয়ীর সরকার দেশের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করার পরিকল্পনা করছিল।
ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের নব্বইতম জন্মদিন উপলক্ষে সাম্প্রতিক একটি অনলাইন আলোচনায় জেএনইউর অবসরপ্রাপ্ত আধুনিক ইতিহাসের অধ্যাপক আদিত্য মুখ্যার্জী হিন্দুত্ববাদীরা ১৯৫২ সালে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবেশ করে কী ভাবে অল্পবয়সীদের মগজ ধোলাই করার ওপর জোর দেওয়া শুরু করে তা ব্যাখ্যা করেন। ঐ বছরই বিদ্যা ভারতী উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুরে প্রথম সরস্বতী শিশু মন্দির স্থাপন করে। মুখ্যার্জী বলেন সেই সময় থেকে তাদের সাম্প্রদায়িক অ্যাজেন্ডা চরিতার্থ করার জন্য তারা বারবার ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করেছে।
‘সাংস্কৃতিক চেতনা’র বিকিরণ
বিদ্যা ভারতী শিক্ষকদের জন্য তিনটি বই প্রকাশিত করেঃ প্রবেশিকা, মধ্যম এবং উত্তম।
উত্তম বইটিতে আরএসএসের যে ‘অখণ্ড ভারত’ কনসেপ্ট, বা অবিভক্ত ভারত, যেটা বলা হয় ‘বৃহত্তর ভারত’ কিংবা গ্রেটার ইন্ডিয়া, সেটার প্রায় সম্পূর্ণ রূপটা পাওয়া যায়। ১৪ই আগস্ট আরএসএস ‘অখণ্ড ভারত সংকল্প দিবস’ হিসাবে উদযাপন করে যে দিন অংশগ্রহণকারীরা অখণ্ড ভারতের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার শপথ নেয়।
উত্তম বইয়ের ৩৩ পৃষ্ঠার একটা অনুচ্ছেদে লেখা আছেঃ “মুলার, ওয়েবার, লুডবিগ, হাউস্ম্যান, শ্রোডারের মতো বিদেশী ঐতিহাসিকরা বেদ, রাম, কৃষ্ণ সম্পর্কে ভুল ধারণা ছড়িয়েছে এবং এটা করে ইন্ডিয়ার নতুন প্রজন্মকে প্রাচীন ভারত এবং তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর গরিমা থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিভিন্ন ভারতীয় ঐতিহাসিকরাও এঁদের অনুসরণ করা শুরু করেন এবং আমাদের বিশাল দেশের বাস্তব অস্তিত্বকে নিছক কল্পনা হিসাবে ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু আধুনিক ইতিহাস প্রমাণ করে যে আজকের স্বাধীন দেশগুলি, যেমন ত্রিবিষ্টপ (তিব্বত), উপগণস্থান (আফগানিস্তান), ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার), সিংহল (শ্রীলঙ্কা) এবং কিংপুরুষ (নেপাল) এক সময় অবিভক্ত ভারতের অংশ ছিল”।
ম্যাক্স মুলার, ম্যাক্স ওয়েবার, আলফ্রেড লুডবিগ, লরেন্স হাউস্ম্যান এবং লিওপোল্ড ভন শ্রোডারের মতো ঐতিহাসিকরা প্রত্যেকেই প্রাচীন ভারত সম্পর্কে পাণ্ডিত্যের জন্য পরিচিত।
ক্লাস ফাইভের ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক বোধমালা ৫, প্রথম অনুচ্ছেদেই পুনরুল্লেখ করছে যে অখণ্ড ভারত ‘শত্রুদের’ দ্বারা বিভক্ত ছিল। “শত্রুদের দ্বারা অখণ্ড ভারতের এই বিভাজন আমাদের চিন্তাতেও প্রতিফলিত হয়। আমাদের শপথ নিতে হবে যে আমরা যার উপাসনা করি সেই অখণ্ড ভারতকে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে”।
বাংলা মাধ্যমের ছাত্রদের স্কুল ডায়েরিতে একটা গান আছে যেটার গড়পড়তা ইংরাজি অনুবাদ হচ্ছেঃ পশ্চিমের গান্ধার ভারতের অংশ, পূর্বের ব্রহ্মদেশও তাই, অখণ্ড ভারতে আমাদের জয় নিশ্চিত তাই”।
বোধমালা ৪ বইয়ে আমরা ব্যাখ্যা পাই যে প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের পরিশ্রমের কারণে আমাদের সংস্কৃতি বহু দেশে পৌঁছে গেছিল। এই দেশগুলি হচ্ছেঃ ময় (মেক্সিকো), আর্য/পার্শু-দেশ (ইরান), উপগণস্থান (আফগানিস্তান), লাভা দ্বীপ (লাওস), বরুণ দ্বীপ (বোর্নিও), শ্যাম দেশ (থাইল্যান্ড), চম্পা দেশ (ভিয়েতনাম), ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার), মালয় দ্বীপ (মালয়েশিয়া)।
ইরানকে ‘পার্শু-দেশ’ হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে কারণ হিন্দু পুরাণ শাস্ত্র অনুযায়ী পরশুরামের জন্ম পারস্যে হয়েছিলো, যা হচ্ছে আজকের ইরান।
অস্ট্রেলিয়ায় হিন্দুদের প্রভাব সম্পর্কে বোধমালা ৭ বলছে যে বুমেরাং কৃষ্ণর সুদর্শন চক্রের অনুকরণে করা হয়েছে। এই বইয়ে এটাও বলা হচ্ছে যে চিন একটা সংস্কৃত শব্দ এবং চিনের সংস্কৃতি আর্য সংস্কৃতি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার কর্নেল জেমস টড চিন জাতির উৎস ভারতীয় পুরাণে পুরুরাবার পুত্রের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন।
উত্তম বইটিতে এই দাবী আরও জোরদার করা হচ্ছে; সেখানে বলা হচ্ছে যে প্রাচীন চিন হরিবর্ষ নামে পরিচিত ছিল।
ক্লাস এইটের ছাত্রদের বই বোধমালা ৮ এর পৃষ্ঠা ৭য়ে দাবী করা হচ্ছে যে নিম্নলিখিত জায়গাগুলি এক সময় ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিলঃ মানস সরোবর (তিব্বত), কৈলাস পর্বত ((তিব্বত), পশুপতিনাথ এবং মাউন্ট এভারেস্ট (নেপাল), নানকানা সাহিব এবং সাধু বেলো (পাকিস্তান)।
বিদ্যা ভারতীর বিভিন্ন বইয়ে ভারতকে “বিশ্বের প্রাচীনতম দেশ” বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। যেমন বোধমালা ৮, পৃষ্ঠা ৮য়ে বলা হচ্ছে, “মনুষ্যমাত্র কি জননী আদিভূমি ভারত”। সমস্ত মানুষের উৎস ভারতবর্ষে।
সত্য না কল্পনা
যাঁরা নবাগত তাঁদের জেনে রাখা ভালো যে আরএসএস বা সমমনোভাবাপন্ন সংগঠন সম্পর্কিত প্রকাশনা ছাড়া সিন্ধু সাগর বা হিন্দু মহাসাগরের মতো কথা কোনও ভৌগলিক বা ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ব্যবহার করেন না।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেখায় যে মনুষ্য জাতির উৎস ভারত নয়, সেটা আফ্রিকা।
হিমালয় এবং সেটার পারিপার্শ্বিক পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন স্থলভূমি নয়; সেই কৃতিত্ব বরং ৩.৬ বিলিয়ন বছর পুরানো বারবার্টন গ্রিনস্টোন বেল্টের, যা আফ্রিকায় অবস্থিত মাখানজ্বা পর্বত নামেও পরিচিত। উল্টে ‘জিওলোজিকাল সোশ্যাইটি অফ লন্ডন’ এর মতামত হচ্ছে, “হিমালয় পর্বতমালা এবং তিব্বত উপত্যকা ৫ কোটি বছর আগে ইন্ডিয়ান এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘাতের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিলো, যে সংঘাত এখনো জারি আছে”।
জম্বুদ্বীপ কি পুরো এশিয়া জুড়ে ছিল যেখানে হিন্দু ধর্ম বিরাজ করত? অক্সফোর্ডের রেফারেন্স অনুযায়ী জম্বুদ্বীপ হচ্ছে, “বৌদ্ধ পুরাণে বর্ণিত তখনকার বিশ্বের চারটি মহাদেশের মধ্যে দক্ষিণতম যা মনে হয় আজকের ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে সাদৃশ্য যুক্ত”।
বিশ্বাসযোগ্য গবেষণায় এমন কোনও ঐতিহাসিক উল্লেখ নেই যে হিন্দু ধর্ম সারা এশিয়ায় বিরাজ করত।
এই বইগুলিতে ভারতের প্রতিবেশীদের সম্পর্কে যা তথ্য দেওয়া আছে তার উৎস সম্ভবত আরএসএসের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক বা প্রধান মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার, যিনি সংগঠনকে চার দশকের বেশি সময় ধরে গড়ে তুলেছেন, তাঁর রচনাতে পাওয়া যায়।
তাঁর ‘বাঞ্চ অফ থটস’ বইয়ে তিনি লিখছেনঃ “আফগানিস্তান ছিল আমাদের প্রাচীন উপগণস্থান। মহাভারতের শল্য এখানকারই ছিলেন। আজকের কাবুল এবং কান্দাহার ছিল গান্ধার, কৌরবদের মাতা গান্ধারী যেখানকার মানুষ ছিলেন। এমনকি ইরান আদিতে ছিল আর্য। সেখানকার পুরানো রাজা রেজা শাহ পেহলভি ইসলামের পরিবর্তে আর্য মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হতেন। পার্সিদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ জেন্ড আভেস্তা প্রায় অথর্ব বেদ। পূর্বে বার্মা হচ্ছে আমাদের প্রাচীন ব্রহ্মদেশ। মহাভারতে ইরাবতের উল্লেখ আছে, আধুনিক ইরাবতী উপত্যকা যা ঐ মহাযুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত। দক্ষিণে লঙ্কার সাথে যোগাযোগ সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল যা মুল ভূখণ্ড থেকে কোনও ভাবেই আলাদা মনে করা হতো না”।
বাস্তবে নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, তিব্বত এবং শ্রীলঙ্কা প্রাচীন সময়েও ভারতের অংশ ছিল না। ব্রিটিশ রাজের আগে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ কোনদিনও একই শাসকের অধীনে ছিল না।
নেপাল ও ভারতের সীমানা এক হলেও, নেপাল কোনদিনও ভারতীয় শাসকের অধীনে ছিল না। নেপালিরা বিশ্বাস করেন যে প্রথম কিরাত রাজা যলম্বর এবং মহাভারতের বার্বারিকা একই চরিত্র। মহাভারতে নেপালের কিরাতদের সম্পর্কে অনেক উল্লেখ আছে কিন্তু দুটো জাতির মধ্যে যোগাযোগ থাকার অর্থ এই নয় যে তারা একই জাতি ছিল। কিরাত বংশের শাসন থেকে শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় শতক অবধি ভারত ও চিনের মধ্যে স্থলবন্দী এই দেশে বিভিন্ন নেপালি পরিবার শাসন করেছে----লিচ্চাভি এবং ঠাকুরি বংশ (খ্রিস্টাব্দ ৩০০-১২০০), মল্ল যুগ (খ্রিস্টাব্দ ১২০০-১৭৬৯)। অবশেষে পৃথ্বী নারায়ণ শাহ, শাহ বংশ স্থাপন করেন যা ২০০৮ অবধি দেশ শাসন করে।
ভুটান যার সাথে ভারতের একই সীমানা সেটাও কোনও দিন ভারতীয় রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়নি। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের ভুটান সংক্রান্ত নোটে এমন কোনও ইঙ্গিত নেই যা থেকে বলা যেতে পারে যে এই দেশটা কোনও দিন ভারতের অংশ ছিল।
ভারতীয় পুরাণে ত্রিবিষ্টপর উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু সেটার অর্থ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত আছে। কারো মতে এটা ইন্দ্রর ভুবন, কেউ বলেন এটা স্বর্গরাজ্য। কোনও বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক প্রকাশনা নেই যার দ্বারা নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে যে ত্রিবিষ্টপ তিব্বত কিংবা সেটা কোনও কালে ভারতের অংশ ছিল।
৫৪৩ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ রাজা বিজয় সিংহ শ্রীলঙ্কায় রাজ্য স্থাপন করেছিলেন, তার আগে শ্রীলঙ্কার কোনও রাজনৈতিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। অনুমান করা হয় বিজয় সিংহ বঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন এবং ঐ দ্বীপ রাজ্যে বসবাস করা শুরু করেছিলেন কিন্তু সেই দেশ কখনই কোনও ভারতীয় বংশ দ্বারা শাসিত হয়নি।
ব্রিটিশদের দ্বারা অধিকৃত হওয়ার পরই মায়ানমার ভারতীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং একই শাসকের অধীনে আসে।
বিশ্ব মানচিত্র অনুযায়ী ২৫০ খ্রিস্টপূর্বে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় ইন্ডিয়া একটি রাজনৈতিক একক হিসাবে সর্বাধিক ৫০০০০০০ কিমি বিস্তার লাভ করেছিল। খ্রিস্টাব্দ ১৬৯০এ মোঘল সাম্রাজ্যের সময় বিস্তার ছিল ৪০০০০০০ কিমি। বাকি সব সাম্রাজ্য এর থেকে ছোট ছিল। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ যুগেও তা ছিল ৪৬৬৮৮৬০ কিমি।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের মধ্যে আধুনিক আফগানিস্তানের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল, পূর্বে যা বাংলা এবং আসাম অবধি বিস্তৃত ছিল। দক্ষিণের বহু অঞ্চল যেমন আজকের তামিলনাড়ু, কেরালা এবং কর্ণাটক ও অন্ধ্র প্রদেশের অংশবিশেষ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সিকিম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুর, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
ঐতিহাসিকদের মতে মূল গান্ধার অতীতের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স ছিল, যা আজকের পাকিস্তানের পেশোয়ার উপত্যকা। বৃহত্তর গান্ধারর মধ্যে পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকা, তক্ষশীলা এবং পূর্ব আফগানিস্তান অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ঋক বেদ এবং মহাভারতে গান্ধারর উল্লেখ ছিল। মৌর্যদের আগে এবং পরে এই অঞ্চল গ্রিকদের অধীনে ছিল এবং তারপর খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টাব্দ তৃতীয় শতাব্দী অবধি বৌদ্ধ কুশান বংশের অধীনে আসে। এরপর অঞ্চলটির দখল নেয় কিদারাইত ও হূণরা এবং নয় থেকে এগারো খ্রিস্টাব্দ অবধি শাহি বংশ এখানে রাজত্ব করে। কিন্তু কুশানদের অধীনে শুধুমাত্র আজকের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারত ছিল এবং পূর্বে এর সীমানা গাঙ্গেয় অববাহিকার মধ্যবর্তী অঞ্চল অবধি বিস্তৃত ছিল। হিন্দু শাহি রাজ্যের বিস্তার এর থেকে কম ছিল।
এছাড়া কোনও বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা নেই যার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে আফগানিস্তানের নাম এক সময় উপগণস্থান ছিল। মৌর্য যুগের পর সেই ব্রিটিশ আমলে আফগানিস্তান আবার বাকি ভারতের মতো একই শাসকের অধীনে আসে। গোলওয়ালকারের দাবী যে কাবুল ও কান্দাহার গান্ধার ছিল সেটা বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী চিন্তাবিদ পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কান্দাহারের নাম গান্ধার থেকে এসেছে কি না সেটা নিয়ে সংশয় আছে, এটা আরও এই কারণে যে ঐতিহাসিক রেকর্ড মতে গান্ধার যেখানে অবস্থিত ছিল কান্দাহার সেখান থেকে বহু দূর।
কিন্তু যখন কিছু বই দাবী করছে যে পুরো এশিয়া হিন্দু ধর্মের প্রভাবে ছিল, সেখানে গান্ধারর মতো ছোট একটা অংশের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে কি নেই সেটা একেবারেই ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।
যেটা উপলব্ধি করা প্রয়োজন সেটা হল ‘হিন্দু’ কথাটার অর্থ কি? স্বামী বিবেকানন্দের মতামত ছিল যে হিন্দুদের বরং বলা যেতে পারে, “বৈদিক, অর্থাৎ যারা বেদ অনুসরণ করেন, কিংবা আরও ভালো বেদান্তবাদী যারা বেদান্ত অনুসরণ করেন”। তাঁর মতে হিন্দু কথাটা এসেছে একটা জায়গার বিকৃত ফার্সি উচ্চারণ থেকে, যেটা হচ্ছে সিন্ধু নদীর ওপার যেখানকার সমগ্র জনগণ বর্তমানে আর বেদ অনুসরণ করেন না।
তাই যদি আমরা মনে করি যে হিন্দুরা হচ্ছে বৈদিক মানুষ, তাহলে কিন্তু মনে রাখতে হবে যে বিশ্বের বহু পণ্ডিত এবং ঐতিহাসিক হরাপ্পা মহেঞ্জোদারোকে বৈদিক-পূর্ব যুগের সভ্যতা বলে মনে করেন। এর অর্থ বেদ রচনা হবার আগেও সভ্যতা ছিল এবং ধর্মও ছিল যা মানুষ পালন করত।
রাজনৈতিক নৃতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক পার্থ চ্যাটার্জী, যিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, তিনি তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘দ্য ট্রুথস এন্ড লাইজ অফ ন্যাশানালিজমঃ এজ নেরেটেড বাই চার্বাক’এ লিখছেন যে আধুনিক পণ্ডিতদের মতে আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর ভারতে আসে এবং স্থানীয় জনসাধারণের সাথে মিশে যায়। “বৈদিক আর্যরা অভিবাসী ছিল, এই ধারণাটিই ভারতের এক সুপ্রাচীন ইতিহাস দাবী করার যে প্রগাঢ় জাতীয়তাবাদী বাসনা, তার ভিত টলিয়ে দেয়।”।