লেখক সলমান রুশদি নিজেই এক চলমান থ্রিলার; বিতর্ক, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ তাঁর সাহিত্যের সাথে হাত ধরাধরি করে চলে। ভারতীয় ইংরাজি সাহিত্যে তাঁর আত্মপ্রকাশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৮১তে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস বুকার তো পেয়েছিলই, এছাড়াও ১৯৯৩ এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে বুকার পুরস্কারের ২৫তম এবং ৪০তম বার্ষিকি উপলক্ষে দুবার ‘বুকার অফ বুকারস’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিল। জাদু বাস্তবতার ধারায় লেখায় এই বইয়ে বর্ণীত উপমহাদেশের ইতিহাস পাশ্চাত্যে প্রবল ভাবে জনপ্রিয় হলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে একটি ‘কটূক্তির’ কারণে ভারতে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল।
তাঁর পঞ্চম উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হওয়ার পর তো লঙ্কাকাণ্ড বেধে গেল। ১৯৮৯ এর ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খোমেনি ওই বইয়ে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করার কারণে লেখকের মৃত্যু কামনা করে ফতোয়া জারি করেন। লেখক আত্মগোপন করেন, ভারত সহ নানা দেশ বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ই অগস্ট, ২০২২, এক আততায়ীর আক্রমণ থেকে প্রায় অলৌকিক ভাবে রক্ষা পেয়ে ওই অভিজ্ঞতার ওপর লিখিত তাঁর সাম্প্রকিতম ‘নাইফঃ মেডিটেশন্স আফটার অ্যান অ্যাটেমটেড মার্ডার’ বইয়ে লেখক তাঁর ফতোয়ার দিনগুলিতে বারবার ফিরে গেছেন। ঘটনার প্রায় আট মাস বাদে লন্ডনে পোঁছে রুশদি চৌত্রিশ বছর আগের দিনগুলো স্মরণ করছেন যখন কিছু এয়ারলাইন্স তাঁকে বহন করতে ভীত ছিল, অজ্ঞাত কারণে তাঁর হোটেল বুকিং বাতিল হয়ে যেত, প্রকাশ্য জায়গায় যাওয়া বারণ ছিল, একান্ত পারিবারিক মিলনের সময়েও পুলিশের চর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলত, যখন তাঁকে সর্বত্র ‘অদৃশ্য’ থাকতে বলা হতো।
কিন্তু এই সাড়ে তিন দশকে বিশ্ব তো পালটে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ানের পতন ঘটেছে, ৯/১১ ঘটে গেছে, আল-কায়দা, আইসিসের উত্থান পতন হয়েছে, প্রযুক্তির অভাবনীয় উল্লম্ফন ঘটেছে, সর্বোপরি লেখকের আরও প্রায় পঁচিশটি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে; মানুষ রুশদিকে ‘দ্য মুরস লাস্ট সাই’ বা তাঁর আত্মজীবনী ‘জোসেফ অ্যান্টন’-এর লেখক হিসাবে চেনেন, ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ তাঁরা প্রায় ভুলে গেছেন। এখন লন্ডনে গেলে তিনি যে কোন জায়গায় যেতে পারেন, পুলিশ আড়ালে আবডালে নজর রাখেন; কোন বন্ধু, আত্মীয়র বাড়ি গেলে তাঁরা ঘরে ঢুকে পাশে বসেন না, বাইরে অপেক্ষা করেন। তাহলে এখন কেন? নিউইয়র্কের শতকোয়ার অ্যাম্ফিথিয়েটারে তিনি যখন দেখলেন এক যুবক তাঁর দিকে দৌড়ে আসছে তখন ওই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রথম তাঁর মনে হলঃ তাহলে এটাই তুমি, এসে গেছ! দ্বিতীয় চিন্তা যা তাঁর মস্তিষ্কে ঝিলিক মারলঃ এতদিন বাদে? কতো দিন হয়ে গেল, এখন কেন, এতো বছর বাদে কেন? পৃথিবী তো অনেক এগিয়ে গেছে? ওই অধ্যায়টা তো সমাপ্ত, চ্যাপ্টার ক্লোজড!
লেখকের ওপর আক্রমণটা এরজন্যই এতো বিস্ময়কর। তাঁকে এতটাই বিপদমুক্ত মনে করা হতো যে শতকোয়ায় কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থাই ছিল না। পরে তিনি যখন লন্ডনে যান সিকিউরিটি অফিসার তাঁকে বলেন, ইংল্যান্ডে অন্তত আপনার কোন বিপদ আছে বলে আমাদের জানা নেই, কিন্তু কোথায় কোন উন্মাদ অপেক্ষা করে আছে কে জানে! হাদি মাতার সেই নিঃসঙ্গ নেকড়ে, লোন উলফ, যিনি লেখককে ভণ্ড মনে করতেন, যে ওই উপন্যাসের মাত্র দুটি পাতা পড়েছেন, ইউটিউবে ধর্মগুরুদের বাণী শুনে উদ্দীপ্ত হয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে তিনি লেখকের প্রতি রাগ পুষে রেখেছেন, নিজেকে তৈরি করেছেন কিন্তু হায়, তবুও তিনি পেশাদার খুনি হতে পারেননি। অন্তত পনেরো বার তিনি তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছেন, চোখে, মুখে, বুকে, পেটে, হাতে, ঘাড়ে, তাঁর এক চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন, তবুও তিনি তাঁকে হত্যা করতে পারেননি। পুত্র মিলন লেখককে জানান কতো ঘটনা আছে যেখানে ছুরির একটি মাত্র আঘাতে মৃত্যু ঘটে, আর তোমার ক্ষেত্রে... এই লেখায় ওপরে অলৌকিক শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু লেখক তো অলৌকিক, নিয়তি এসবে বিশ্বাস করেন না, তিনি নিখাদ নাস্তিক। ডাক্তার তাঁকে বলেন, জানেন আপনি কতো ভাগ্যবান? আপনার কপাল ভালো ওই ছেলেটা একটা মানুষকে কীভাবে ছুরি দিয়ে খুন করতে হয় জানে না। কিন্তু রুশদি তো ভাগ্যে-টাগ্যে বিশ্বাস করেন না, গুলি মারো ভাগ্য! তিনি আততায়ীকে করুণা করেন, যে এতটাই অপদার্থ যে পঁচাত্তর বছর বয়সের এক বৃদ্ধকে বারবার আঘাত করেও হত্যা করতে ব্যর্থ হয়।
ছুরি যেমন হিংসার প্রতীক, ভাষাকে ছুরির মতো ব্যবহার করে সেই হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তাকে প্রতিরোধ করা যায়। এই বিষয়ে লেখক মিশরের দিকপাল সাহিত্যিক নাগিব মাহফুজকে স্মরণ করেন। তিরিশ বছর আগে নোবেলজয়ী লেখক যখন হেঁটে কফির দোকানে যাচ্ছিলেন একটি গাড়ি তাঁর পাশে গড়িয়ে আসে। লেখক ভেবেছিলেন বোধহয় তাঁর কোন গুণগ্রাহী, কিন্তু এক ব্যক্তি লাফিয়ে নেমে তাঁর ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করেন। কিছু দিন পূর্বে তাঁর একটি বই নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল এবং তাঁর নাম ‘হিট লিস্টে’ উঠে গিয়েছিল। তিনি দেহরক্ষী রাখতে অস্বীকার করেছিলেন, বলেছিলেন, কী আসে যায় ওরা যদি আমাকে পেয়ে যায়? আমি আমার জীবন অতিবাহিত করেছি এবং আমার যা মনে হয়েছে তা করেছি। রুশদির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারির পর একশো জন মুসলিম লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তিনি তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি যা বলেছিলেন তা চিরস্মরণীয়, একটা চিন্তাকে শুধুমাত্র অন্য চিন্তা দিয়ে বিরোধিতা করা যায়। যদি কাউকে শাস্তি দেওয়াও হয়, চিন্তাটা থেকেই যাবে, বইটাও থেকে যাবে।
২০২১ এর মে মাসে রুশদি আমেরিকান সাহিত্যিক এলিজা গ্রিফিথকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর জীবন স্বস্তি, শান্তি, ভালবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। উক্ত ঘটনার মাত্র তিন মাস আগে তিনি পেন, আমেরিকার একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছিলেন, যেখানে বিষয় ছিল বর্তমান বিশ্বের সংকট। তিনি বলেনঃ রাশিয়ায় এক স্বৈরাচারীর উত্থানের কারণে ইউক্রেন আজ নির্মম অত্যাচারের সম্মুখীন। আমেরিকা মধ্য যুগে ফিরে যাচ্ছে যেখানে শ্বেতাঙ্গরা শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর খবরদারি করছে না, নারীর শরীরের ওপরেও প্রভুত্ব করার চেষ্টা করছে। ভারতে ধর্মীয় সংকীর্ণতাবাদ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়েছে এবং হিংসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, গণতন্ত্রের বিনাশ ঘটছে। ইতিহাসের মিথ্যাচার হচ্ছে যা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সুবিধা প্রদান করে, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন করছে; এবং এটা জানা দরকার এই যে মিথ্যা আখ্যানের ঢক্কানিনাদ শোনা যাচ্ছে তা জনপ্রিয়, মানুষ বিশ্বাস করছে, ঠিক যে ভাবে রাশিয়ার স্বৈরাচারীর মিথ্যাও সবাই বিশ্বাস করছে। এটাই আজকের বিশ্বের কুৎসিত বাস্তবতা।
লেখকের ওপর আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা পরেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন, ফ্রান্সের মাকোঁ এমনকি ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, যিনি মনে করেন রুশদি যথেষ্ট উচ্চমানের লেখক নন, তাঁরা ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দেন। কিন্তু তাঁর চৈতন্যে তাঁর বহু লেখার কেন্দ্রে যে দেশ ভারত তা এখনো সদা জাগ্রত। সেই দেশের প্রতিক্রিয়া তাঁকে মর্মাহত করে। তিনি লিখছেন, ভারত আমার জন্মস্থান, আমার প্রেরণা ওই দিন কোন কথা খুঁজে পায়নি। (২৫শে অগস্ট, ঘটনার প্রায় দু সপ্তাহ বাদে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ওই ঘটনার নিন্দা করেন।) রুশদি লিখছেন উলটে অনেকে উল্লাস প্রকাশ করেন; মানুষ তো ঘৃণা করবেই যদি চৌত্রিশ বছর ধরে তাঁকে ঘৃণার প্রতিমূর্তি করে গড়ে তোলা হয়।
ঘৃণা, হিংসার এই বাতাবরণে একজন লেখক কী করবেন? রুশদি মিথিক্যাল গ্রিক পয়গম্বর, সংগীতকার অরফিউয়াসকে স্মরণ করছেন। তাঁর মাথা ছিন্ন করে যখন তাঁকে হেব্রাস নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখনও অরফিউয়াস গান থামাননি, তাঁর সংগীত দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ভয়াবহতার আবহে আমাদেরও আজ গান গেয়ে যেতে হবে, জোয়ারের দিক পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।