দুটো জীবন পাশাপাশি চলছে। বয়সের তফাৎ মাত্র ছয় বছর। সমান্তরাল জীবনের সূচনা সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকা থেকে, সেখানে তিনি লিখতেন ধারাবাহিক উপন্যাস ‘পাহাড়ের মত মানুষ’। সেদিন থেকে তাঁকে চিনি। যেমনভাবে লেখককে পাঠক চেনে তার বেশি নয়। ধারাবাহিক পড়তে তখন ভালো লগত না কিন্তু নামটা আমাকে টেনেছিল। তারপর যেদিন প্রথম দেখি, তাও আবার রাস্তায়। কফি হাউসের উল্টোদিকের রাস্তায় তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন কলেজ স্কোয়ারের বইয়ের দোকানগুলোর সামনে রাস্তার দিকে লোহার রেলিং ছিল। তিনি রেলিংএর ওপারে, অর্থাৎ ফুটপাথে, আমি রাস্তায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়, শচিন দাশ আরও অনেকে তাঁদের ঠিক মনে করতে পারছি না। সেই প্রথম দেখা পাহাড়ের মত মানুষকে। এই গৌড়চন্দ্রিকা করার একটাই কারণ তিনি আত্মজীবনী লিখেছেন। নাম দিয়েছেন, ‘পেন্সিলে লেখা জীবন’। অতিমারীকালে লেখা, এই আত্মউন্মোচন। আমি ‘আত্মউন্মোচন’ শব্দটা কেন ব্যবহার করলাম, এ প্রশ্ন আসতেই পারে। তিনি বলেছেন ‘আত্মজীবনী’। আমি কেন ‘আত্মউন্মোচন’ বলছি, সেটা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, দ্বিতীয়ত আমিও তো সেই সময়ের একজন পথিক। আমরা পাশাপাশি হাঁটছি, আড্ডা মারছি, পাশাপাশি বসছি, এক টেবিলে কফি পান করছি। তবু তিনি তফাতে চলেন। তাঁর এই তফাতে চলা এবং দেখা আমার কাছে বিস্ময়। বিস্ময় বুঝতে বুঝতে পাশাপাশি চলা। তাই সমান্তরাল জীবন।
তিনি লিখছেন, “আমি সামান্য মানুষ, জীবনভর কলমে লিখেছি, তার উপর জল পড়ে লেখা ধুয়ে গেছে কতবার। আমি আমার কথা পেন্সিলে লিখতে শুরু করলাম”। পেন্সিলে লিখলে শুধুমাত্র রাবার ছাড়া কিছু দিয়ে মোছা যায় না। এমনকি পুড়ে গেলেও কাগজের লেখাগুলো পড়া যায়। জীবনেও কোনও কিছু মোছা যায় না। পুড়ে যাক, বন্যায় ভেসে যাক, কিংবা ভূমিকম্পে বসে যাক। জীবন কিছু হারায় না। সব থাকে এবং সজীব থাকে। সেই সজীবতা নিয়েই ‘পেন্সিলে লেখা জীবন’ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। লেখাটা প্রথম ধারাবাহিক পড়ি গুরুচণ্ডা৯ ওয়েবম্যাগে। তারপর প্রকাশিত হয় ‘সৃষ্টি’র একুশ শতক পত্রিকায়। ‘পেন্সিলে লেখা জীবন’ নামটার আরেকটা অর্থ আমার কাছে এসেছে। জীবন গড়ে তোলা যায়। ভুল হলে মুছে ফেলে নতুন করে গড়ে তুলতে কোনও অসুবিধা নেই। এ এক আত্মপ্রত্যয়ের উচ্চারণ। পাঠকের জীবনও নতুন করে গড়ে তোলার সম্ভাবনার ইঙ্গিত। আসুন আমরা প্রবেশ করি ‘পেন্সিলে লেখা জীবন’ গ্রন্থে। বহুস্তরে নির্মিত এই আত্মখনন।
প্রথম স্তর – সময়
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ১৯৫১ থেকে ২০২০ অর্থাৎ উনসত্তর বছরের কথা তিনি আমাদের বলেছেন। এটা ক্যালেন্ডারের হিসাব। সেই সময় ধরলে একটা কালখণ্ড আমাদের সামনে আসে। কিন্তু একজন শিল্পী তো শুধু বেঁচে থাকেন না, তিনি অন্বেষণ করেন। জীবন খোঁড়েন। তাঁর এই খনন শিল্পের জন্ম দেয়। তাই তাঁর কালখণ্ড পাঠকের কাছে অন্য সময় নিয়ে আসে। ক্যালেন্ডার তখন আর দেওয়ালে থাকে না। সময়ের হাওয়ায় উড়ে যায়।
#
অমর মিত্র জন্মেছেন দেশভাগের চারবছর পরে। তিনি দেশভাগের শরিক বা দর্শক না হলেও দেশভাগের কষ্ট, যন্ত্রণা ও জ্বালা শৈশব থেকেই তাঁকে আক্রমণ করেছে। এই না পাওয়ার বা বঞ্চিত হওয়ার দিনগুলোয় তিনি আক্রান্ত হননি, কারণ তাঁর মা-ঠাকুমার বড় কোলে এবং আঁচলের তলায় তাঁরা ভাই-বোনেরা ছাড়াও আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত, অপরিচিত, গ্রামতুতো সবাই আশ্রয় পেয়েছে। অল্প জায়গা মানুষ বেশী, পড়ার জায়গা নেই, নিজস্ব কোনও স্থান নেই। শুধুমাত্র নিরাশ্রয় মানুষগুলোকে ভালো রাখার জন্য সন্তানদের প্রায় সময় ঘরের বাইরে থাকতে হয়। ক্যালেন্ডারের বাইরের এই যে সময়, তখন মানুষ ভালবাসতে জানত। অর্থের অভাব ছিল কিন্তু ভালবাসার কৃপণতা ছিল না। অপরকে ভালবাসার বীজ সবার অলক্ষ্যে বপন করেছিলেন সন্তানদের মধ্যে। এই শিক্ষা তাঁর মধ্যে প্রোথিত হয়েছে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর অনুজ এবং সমবয়সী বন্ধুরা সবাই এটা অনুভব করে।
#
বেলগেছিয়া থেকে হাসনাবাদ পর্যন্ত মার্টিন রেল চলত। তিনি দেখেছেন দক্ষিণের বারান্দায় বসে। কিন্তু ৭৯সি বাসে চড়ে মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলেন ছোটবেলায় দণ্ডীরহাট। বাগুইআটি জোড়ামন্দির থেকে যে রাস্তাটা রাজারহাটের দিকে গেছে, সেটা আমাদের ছোটবেলায় পরিচিত ছিল রেলের রাস্তা বলে। দণ্ডিরহাট বালককে একটা দৃশ্য মনে গেঁথে দিয়েছে “ও খোকা, মিত্তির বাড়ির ছেলে না? হ্যাঁ, বলতে তাঁর একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে আসত আমার দিকে। ভাত খেয়েচ? কী দিয়ে ভাত খেলে? মাছ খেইলে। কী মাছ? মাছের কালিয়ায় কি ফুলকপি ছিল? টমটমের চাটনি ছিল কি? ক্ষীর খেয়েচ কাঁটাল দিয়ে? মাংস কবে খেয়চ খোকা?” ঐ সময়ে প্রাইভেট বাস শহরে ঢুকতে পারত না। মারঠ্ঠা ডিচের পারে দাঁড়িয়ে থাকত। মানে, আর জি কর মেডিকেল কলেজের সামনে যে খাল, তার দুপাশে ছিল বাস স্ট্যান্ড। পাঞ্জাবী ড্রাইভার আর কন্ডাকটররা এইসব বাস চালাত। এখন বাস কন্ডাক্টরদের মুখে যেসব কথা শুনি, সব পাঞ্জাবীদের ‘লেডিজ রোখকে’ বা ‘বাচ্চা আছে’। লেখক একটা কথা জুড়েছেন, ‘ডিগা ডিগা’ কথাটা কাকাদের মুখে শুনতাম, অনেকদিন পরে পড়লাম। তখন ট্রামে বিহারি কন্ডাক্টর বেশি ছিল। বাঙালিদের দেখা যেত না। তাঁরা ধুতির উপর খাকি হাফ্ শার্ট পরতেন, অনেকের মাথায় লম্বা টিকি ছিল। তাঁরা আধা হিন্দি আধা বাঙলায় কথা বলতেন। বেলগেছিয়ায় একটা ট্রাম ডিপো ছিল। ভোর চারটেয় ট্রাম ছাড়ত। ট্রামের ঘন্টা ধ্বনিতে খাস কলকাতার লোকেরা জানতে পারত সকাল হয়েছে। এই লেখায় দুবার সকালের ট্রামের কথা এসেছে। একটা সময় ছিল বলা হত, ট্রাম যতদূর যায় ততটুকু কলকাতা।
#
একটা সময়ের কথা আছে যা আমাদের সমাজের দ্রুত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ষাট-সত্তরের দশক পর্যন্ত বড়লোক-গরীবলোক, পণ্ডিত-মূর্খ সবার সন্তানেরা একই স্কুলে পড়ত। মাধ্যম ছিল মাতৃভাষা বাংলা। তারা একসঙ্গে খেলত। স্বপ্ন বিনিময় করত। পিতাদের ধনী-দরিদ্র, পণ্ডিত-মূর্খ ব্যবধান সন্তানদের মধ্যে ছিল না। ধীরে ধীরে আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্নরা সন্তানদের সরিয়ে নিলেন এইসব স্কুল থেকে। সমাজ ভাগ হল।
#
বালকটি ভুলতে পারেন নি, উনসত্তর বছর বয়েসেও স্পষ্ট মনে আছে, লেখাপড়া জানা নিকট আত্মীয় ভারতবর্ষে এসে চাকরি না পেয়ে ইলেকট্রিক মিস্ত্রির মই বইছেন পেটের দায়ে এবং আত্মজন ডাকলেও লজ্জায় সাড়া দিচ্ছেন না।
তাঁর স্কুলের প্রথমদিকে খাদ্য আন্দোলন দেখেছেন। বলতে গেলে শেষ দিকটা নকশাল আন্দোলনের সময়। স্কুলের একটা ঘটনা এই লেখায় আছে। স্কুল শেষ করে কলেজ তারপর বেকার জীবন কয়েক বছর। চাকরি পেয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে, চাকরি জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করেছেন। থাকা, খাওয়া এবং বিদ্যুৎহীন পরিবেশে একজন শহরবাসী যুবক দাঁত কামড়ে পড়ে থেকেছেন। গ্রাম চিনবেন বলে। ভূমিরাজস্ব দপ্তরের আধিকারিক হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়েছে। মানুষের হিতার্থে ঝুঁকি নিতে হয়েছে। যারা ‘জলচল’ নয় বলে সহকর্মীরা তাঁদের ছোঁয়া কিছু খান না, তাঁদের বাড়িতে অন্নগ্রহণ করছেন বলে সহকর্মীরা বিরক্ত হচ্ছেন, বাজে কথা বলছেন। যুবকটি গ্রামের সাদা-কালো দুরকম ছবি দেখতে দেখতে এক অদৃ্শ্য রঙ দিয়ে তার টুকরো টুকরো ছবি তিনি তুলে ধরেছেন এবং একথা সত্যি তিনি এমন কিছু সময়ের ছবি মনে রেখেছেন, এতদিন পরেও যা মনকে চঞ্চল করে। পাঠক হিসেবে থমকে দাঁড়াতে হয়। কুর্নিশ না করে থাকা যায় না সেই যুবককে।
দ্বিতীয় স্তর: আত্মীয়-পরিজন
লেখাটা সন তারিখ ধরে হয়নি। কখনও সামনের দিকে এগিয়েছে আবার কখনো পিছিয়েছে। কথক এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অবলীলায় চলে গেছেন, আবার পাঠককে ফিরিয়ে এনেছেন। পিতামহ ও পিতামহী থেকে শুরু হয়েছে। বাবা-মা, দুই কাকা, মামা-মামী, দুই দাদা, ছোট বোন, বউদি, তাঁর মা উপস্থিত হয়েছেন। এছাড়া নিজের অজস্র বন্ধু-বান্ধব, বিভিন্ন বয়সের বন্ধুদের নাম মনে রেখেছেন। বিশেষ স্থান দিয়েছেন সাহিত্যিক বন্ধুদের। এইসব বন্ধুদের অনেকের বাড়িঘর এবং তারা কেমন আছেন, সেসবও জানেন। দাদার বন্ধুদের, বাবার বন্ধুদের, মায়ের বন্ধুদের কথা পাঠককে বলতে ভোলেন নি। যিনি বস্তিবাসী, তিনি প্রইভেট টুইশান করেন, তার ভাই বাজারে আলু বেচে, দণ্ডিরহাটের পোস্টঅফিস কর্মী কাজের শেষে গ্রন্থাগারিক, ছুটির দিনে ছোটদের নিয়ে নাটক করা মানুষ, কে নেই? বাবার জীবনের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের একটা কথার খুব মিল আছে, “সেই বাঁচে,যে অপরের জন্য বাঁচে”। তিনিতো সারাজীবন অপরের জন্যই বেঁচে ছিলেন। আর মা সর্বংসহা, কয়লার উনোনের সামনে বসে সবার সেবা করে গেছেন। সব সময়েই হাসিমুখ এবং কোনও অপ্রাপ্তি নেই। একজন মানুষের এইরকম বাবা-মা পাওয়া একটা বড় প্রাপ্তি। এর সঙ্গে একজন মানুষের কথা না বললে মনে হয় অসম্পূর্ণ থাকবে। তিনি মধুবাবু,আস্ত একটা উপন্যাস।
এত অসংখ্য চরিত্র ছড়িয়ে আছে মানুষটির হয়ে ওঠার পিছনে, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ভালবেসেছেন, তাঁদের কথা বিস্তারিত বলেছেন। কিন্তু যাঁরা আহত করেছেন, তাঁদের নাম উল্লেখ করেন নি। তিনি মনে করেন ভালো এবং মন্দ দুটোই হয়ে ওঠার পিছনে জরুরী। তাঁর মতে এরা সবাই অনবদ্য মানুষ।
তৃতীয় স্তর: সাহিত্য
তিনি হাঁটছেন। পাশাপাশি আমরা হাঁটছি। সম্পাদক হাঁটছেন, প্রকাশক হাঁটছেন। পাঠকও হাঁটছেন। এক পথে পাশাপশি একই সময়ে। তিনি দেখছেন, আমরা দেখছি তাঁর চোখ দিয়ে। বইটি হাতে নিয়ে আমার অন্বেষণ ছিল, তিনি লেখার রসদ কোন পদ্ধতিতে আহরণ করেন, সেইটা খোঁজার। গত এপ্রিল মাসে বইটি হাতে পেয়েছি। প্রায় ন’মাস লেগে গেল ছোট একটা লেখা লিখতে। তার কারণ, সব গল্প উপন্যাস তো আমার পড়া নেই, তিনি যখন কোনও পরিস্থিতিতে উল্লেখ করেছেন। আমার মন মিলিয়ে নিতে চেয়েছে। কারণ সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে এটা মনে হয় জরুরী ছিল।
আমার পড়া অমর মিত্রের প্রথম উপন্যাস “পাহাড়ের মত মানুষ”। অমৃত পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হোত। কলকাতার যুবক উপন্যাসটা পড়তে পড়তে একটা অজানা জায়গা আবিষ্কার করতাম। এই উপন্যাস প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “প্রহরাজ রাজবাড়ি, সেই নদী, আমার সেই নদী পার হওয়ার অভিজ্ঞতা এসেছিল ‘পাহাড়ের মত মানুষ’ উপন্যাসে। কিন্তু লজ্জিত হয়েছিলাম পিঠে পার হওয়ার কথা লিখতে। ...শ্যমলবাবু লিখতে বললে, আমি বলেছিলাম পারব না, ধারাবাহিক উপন্যাস লেখা কঠিন। আমার দুই বন্ধু সমীর আর তুষার খুব ধমকেছিল আমাকে। সম্পাদক বলছেন, “ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিস। যা তোর রাজবাড়ি আর রাজকন্যা নিয়ে লেখ। সেই যে রাজার ছেলে গরু নিয়ে বেরয় তা নিয়ে লেখ। সেই যে রাজকন্যা একা একা ঘুরে বেড়ায় রুখু চুল আর ময়লা শাড়ি পরে, তার কথা লেখ। লেখ দুই রানির কথা।লেখ। তোকে যে পার করাল, তার কথা লেখ। পারবি লিখতে?” সুতরাং লিখেছিলাম। রাজবাড়ি আর বেলিয়াবেড়ার কত কথা, সব মনে আছে”।(পৃ:১১৭)
উপন্যাসের নাম ‘মালতী মাধব’: “দণ্ডীরহাট গ্রামের জমিদারদের রেখে যাওয়া বাড়িতে ছিল বড় এক পাঠাগার। সেই পাঠাগার ছিল তরুণদার দায়িত্বে। এ ব্যতীত তিনি ছিলেন পোস্ট অফিসের ডাকপিয়ন। চিঠি বিলি করতেন। সাব পোস্ট অফিসের অনেক কাজই করতেন। চিঠিতে সিল মারা, ডাকের থলেতে ভর্তি করা, হরকরার চিঠি রিসিভ করা-সব। বেলা আড়াইটা অবধি হতো তাঁর কাজ, তারপর লাইব্রেরি। ........... তরুণদাকে নিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখেছিলাম,’মালতী মাধব’। ডাকপিয়ন তরুণদা ছিলেন সেখানে অলৌকিক হয়ে। বেনামে চিঠি লিখে ডাকপিয়ন ডাকঘরের সিল মেরে সেই চিঠি যাকে গোপনে ভালবাসতেন, তাঁর কাছে পৌঁছে দিতেন”। (পৃ:২৮)
উপন্যাস: ও আমার পছন্দপুর (প্রথমে নাম ছিল-এক বসন্তের জন্ম): “মানুষের মুখই কথা বলে। মানুষের মুখ দেখে গল্প লিখেছি অনেক। একটি লোককে আমি দেখতাম আলিপুর কালক্টরেট থেকে অফিস করে বাড়ি ফেরার সময়। এই বছর পনের আগের কথা বলছি। লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায় কোনো এক কারখানার শ্রমিক – দুঃস্থ। বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টরকে শধু উত্যক্ত করত বাস জোরে চালাবার জন্য। সে বেহালার থেকে বেলগেছিয়া ফিরত। বাসে ভাড়া দিতনা খুব সহজে। আগে বাসটা চালাও, তারপর ভাড়া। এই শুয়ারের বাচ্চা বাস চালা, নইলে ভাড়া পাবিনে। তার যাবতীয় ক্ষোভ বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টরের উপর বমি করে দিত। সেই লোকটা আমাকে সহ্য করতে পারত না। কারণ আমি একদিন বলেছিলাম, “ড্রাইভারকে এভাবে উত্যক্ত করবেন না। গালাগালি দিচ্ছেন কেন?”
“আপনার কী মশায়,আপনার কী? হাতে বহুত সময়। গরমেন্ট সারবিস মনে হয়। কত ঘুষ। আমার শালা বেতনই নেই”।
আমাকে ঘুষখোর বলে দিল। বাসের লোক আমার দিকে তাকাতে লাগল। কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর তার সঙ্গে বাসে দেখা না হোক, বাজারে দেখা হত। ক্রুদ্ধ চাহনি”। তাকে নিয়ে এই উপন্যাস।
লেখার মধ্যে ভি. আই. পি. রোড, অশ্বচরিত, ধ্রুবপুত্র এবং অন্যান্য উপন্যাসের কথাও আছে। ওনার একটা উপন্যাস আমার খুব প্রিয়, ছোট উপন্যাস, “হে নবীন সন্যাসী”। এই উপন্যাসটিরও একবার উল্লেখ আছে।
চতুর্থ স্তর: সাধনা
একজন তেইশ বছরের যুবক উত্তর কলকাতায় মায়ের আদরে আনন্দে ছিলেন। তিনি চাকরি পেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে চলে গেলেন। যেখানে বিদ্যুৎ নেই, পরিশ্রুত জল নেই, পাকা বাড়ি নেই, এমনকি শৌচালয়ও ভালো নেই। রোজ মোটা চালের ভাত, ডাল আর কুদরির তরকারি। একটাই সঙ্কল্প লেখক হতে হবে। প্রমোশন নেন নি, উৎকোচ নেন নি। ভূমি রাজস্ব দপ্তরে চাকরি করায় বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতে হয়েছে। স্থানীয় ভূস্বামীরা আদর করে তাদের বাড়িতে থাকতে বললেও, নিজের সামর্থ্য মত ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা। এই বিষয়টা ফল্গু নদির মত সমগ্র আত্মকথনের তলা দিয়ে বয়ে চলেছে। কোথাও উচ্চকন্ঠে বলা হয়নি। কিন্তু অনুভবে মিশে গেছে। দুশো তিরিশ পাতার এই আত্মকথায় কখনই তলানিতে কিছু নেই। স্বচ্ছ। কাকচক্ষু স্বচ্ছ।
পঞ্চম স্তর: সমান্তরাল পথ
আধুনিক জীবনে ভালো থাকতে গেলে, কিছু শিখতে হয়। এসব শেখান কিছু গুরুরা। তাঁদের বইগুলোর নাম বাংলায় করলে এরকম হয়, ‘আমিও পারি’, ‘এসো জয় করি’ বা ‘হারব না’ ইত্যাদি। তারা নতুন কিছু বলেন না। আমাদের প্রাচীন ঋষিরা যা উচ্চারণ করেছেন, তাই নতুনভাবে উচ্চারণ করেন। এই আত্মজীবনী সেই কথাই বলেছে। নিচুস্বরে, সাধারণ মানুষের বেশে পাঠকের কাছে নিয়ে এসেছেন সেই প্রাচীন বার্তা পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সততা এবং একাগ্রতা পৌছে দেবে প্রার্থিত স্থানে। এই কথাগুলো তিনি তাঁর জীবনচর্চার মধ্যে দ্রবীভূত করেছেন। তাই উচ্চারণ করেছেন সাবলীল ভঙ্গিমায়। নিজের কথা বলতে বলতে আমাদের চিনিয়েছেন সমান্তরাল পথ।