রাজনৈতিক আন্দোলন করে যে দ্রুত দেশের স্বাধীনতা আদায় করা যাবে না, তা তদানীন্তন ভারতবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন। বিশেষ করে দেশের যুবক সম্প্রদায়। তারা যথেষ্টই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরীর আগে যেসব লড়াই চারিদিকে হচ্ছিল বিক্ষিপ্তভাবে, সেসব তো এক ছাতার তলায় এলো না। রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরী হয়েছে ১৮৮৫ সালে। কিন্তু কই, কোনো সুফল আসছে না। লড়াই কোথায়? এতে কি কাজের কাজ হচ্ছে কিছু, না শুধুই রাজনীতি হচ্ছে? একই মঞ্চের তলায় লাখো লাখো লোক এনে মিলিতভাবে লড়াই করে ব্রিটিশদের উৎখাত করা। সেটা হচ্ছে কোথায়?
অধিকাংশ যুবকের কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনের ওপর বিশ্বাস হারানো শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ রাষ্ট্র, পাঞ্জাব এবং মহারাষ্ট্রের অধিবাসীদের। অবশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামে এই তিনটে প্রদেশের মতো জোয়ার অন্য প্রদেশগুলোতে দেখা যায়নি। বাংলাতেই প্রথম সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য গুপ্ত সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়। এরপরে গোপন আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল বঙ্গপ্রদেশে। শত শত গুপ্ত সমিতি তৈরী হয়েছিল এবং ইংরেজদের রাতের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল সেইসব মহান বিপ্লবীরা।
দেশমাতৃকার জন্য নিজেদের জীবন নিমেষে বিসর্জন দিতেও তারা পিছুপা হননি। দেশমাতৃকাকে শৃঙ্খলামুক্ত করার একটাই মন্ত্র, মারো, মেরে তাড়াও। দুই বাংলাতেই তখন একের পর এক গুপ্ত সমিতি তৈরী হচ্ছে। হাজারে হাজারে যুবকেরা দেশমাতৃকার মুক্তির উদ্দ্যেশ্য নিয়ে যোগ দিচ্ছে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতিতে। এইরকম আবহে ঢাকা সংলগ্ন মানিকগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হলো সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার লীগ। যা পরবর্তীতে বাংলা ভাষায় "শ্রী সংঘ" নামে পরিচিত হয়। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিপ্লবী অনিল চন্দ্র রায়। সালের হিসেবে সেটা ১৯২১ সাল। পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন ধরে শ্রীসংঘের সর্বোচ্চ নেতার ভূমিকাতেও দেখা যায় তাঁকে।
এর কিছুদিন পরেই ঢাকায় তৈরী হলো "দীপালী সংঘ"। এশিয়ার প্রথম মহিলা সংগঠন। প্রতিষ্ঠাতা লীলাবতী নাগ ও তাঁর ১২ জন বন্ধু। সেটা ১৯২৩ সাল। তিনি সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম এ পাশ করেছেন। শুধু পাশ করেছেন বললে ভুল হবে। প্রথম শ্রেণীতে পাশ করেছেন এবং মহিলাদের মধ্যে প্রথম স্থান পেয়েছেন। যদিও কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হয়েছেন, কিন্তু বাবার বদলির চাকুরীর সুবাদে চলে আসতে হয়েছে ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনও কো-এডুকেশন চালু হয়নি। পর্দানশিন মুসলিম সমাজের মেয়েদের কাছে তখনও উচ্চশিক্ষার দ্বার খোলেনি। তিনি এই ব্যবস্থাকে ভাঙতে চান। লীলাবতী নাগের বাবা, গিরীশচন্দ্র নাগ (মাতা কুঞ্জলতা দেবী) ছিলেন সেই আমলের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনিও তাঁর পদমর্যাদার মধ্যে থেকেই গর্জে উঠতেন। মেয়ে নিশ্চয়ই তাঁর ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এক সাহেব এক নেটিভকে মেরে ফেলেছিলেন। এইরকম আচরণ তো সাহেবদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। অতি সাধারণ ঘটনা। কোর্ট কাছারি হলে সাহেবদের একটু বকাঝকা করে ছেড়ে দেওয়াটাই রীতি। কিন্তু গিরীশচন্দ্রের কোর্টে সেই কেস এলে তিনি গর্জে উঠলেন। সাহেবকে কঠিন শাস্তি দিলেন। এইরকমই ছিলেন লীলাবতীর পিতা। সেই গিরীশচন্দ্রই মেয়ের দাবী বা আবদার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করলেন আলাপ আলোচনা। চাপ তৈরী করলেন বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন দিক থেকে। শেষ অব্দি মেয়েদের জন্য উচ্চ শিক্ষার দরজা খুলে গেলো। লীলাবতী নাগ হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। যাঁর জন্ম ১৯০০ সালের ২রা অক্টোবর, গোয়ালপাড়া, আসাম।
এখানেই লীলাবতী নাগ সহপাঠী হিসেবে পেলেন অনিল চন্দ্র রায়কে। হেমচন্দ্র ঘোষের সুযোগ্য শিষ্য। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ১৯০১ সালের ২৬ শে মে মানিকগঞ্জ, ঢাকার বাইরা গ্রামে জন্ম। পিতা অরুণ চন্দ্র রায় আর মাতা শরৎ কুমারী দেবী। অরুণ চন্দ্র সরকারী শিক্ষা বিভাগের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯১৭ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর ১৯২১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম এ পাশ করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী ব্রহ্মানন্দের এবং স্বামী প্রেমানন্দের সংস্পর্শে আসেন। সম্ভবতঃ তিনিই বিপ্লবীদের মধ্যে প্রথম কল্পনা করেছিলেন যে আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে নারীদেরও স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে এবং যে কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক সংগঠনে পুরুষের প্রতিপক্ষ হিসাবে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা দরকার। তাঁর মাধ্যমে শ্রীসংঘে একগুচ্ছ মহিলা যোগদান করেছিলেন। শ্রীসংঘই প্রথম একটি সংগঠন ছিল যেখানে নারীরা পুরুষদের কাঁধে কাঁধ দিয়ে সামাজিক এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ এগিয়ে নিয়ে যেত।
পরবর্তীতে একদিকে যেমন দীপালী সংঘের বিভিন্ন কাজে শ্রীসংঘ সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে তেমনি অন্যদিকে লীলাবতী নাগ, অনিল চন্দ্র রায়ের বিপ্লব সাধনায় সহকর্মিনী হয়ে ওঠেন। ফলস্বরূপ দুই সংগঠনেরই শ্রী বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ১৯২১ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে শ্রীসংঘের ব্যাপ্তি ঢাকা শহরের সীমানা ছাড়িয়ে বাঁকুড়া, বর্ধমান, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, শ্রীহট্ট প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
এরমধ্যে ১৯২৬ সালে দীপালী সংঘের মহিলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা শহরে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সেটি ছিল এশিয়ার বৃহত্তম মহিলা সম্মেলন। লীলাবতী নাগ এবং অনিল চন্দ্র রায়, দুজনেরই অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল। বৈপ্লবিক কার্যকলাপের জন্য তাঁদের দুজনকেই বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। লীলাবতী নাগ মোট দশ বছর এবং অনিল চন্দ্র রায় মোট চৌদ্দ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন।
১৯৩৯ সালে এই দুই বৈপ্লবিক আত্মা একসূত্রে গাঁথা পড়েন। সেই সময়ে এই ধরনের বিবাহ সমাজে মানবতার বানীকেই প্রসারিত করেছিল। একে অসবর্ণ বিবাহ তারওপর স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বড়। আজকের দিনে এইসমস্ত বিষয় মূল্যহীন হয়ে গেলেও সেই যুগে সমাজকে উপেক্ষা করে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যথেষ্ট কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
তাঁদের বৈপ্লবিক কার্যকলাপের পাশাপাশি সামাজিক উত্তরণের যে প্রচেষ্টা এবং উদ্যম, তার প্রথম সংগঠিত বীজটি প্রোথিত হয়েছিল অনিল চন্দ্র রায়ের জন্মস্থান বাইরা গ্রামে। এতদিন দীপালী সংঘের প্রচেষ্টা ছিল মেয়েদের আত্মনির্ভর করা। তার সাথে যুক্ত হয়েছিলো মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলা। লীলাবতী নাগও নারী শিক্ষা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খোদ ঢাকা শহরে। অন্যদিকে এতদিন অনিল চন্দ্র রায়ের নিজস্ব প্রচেষ্টায় এবং উদ্যোগে গ্রামের অশিক্ষিত গোষ্ঠীকে শিক্ষা দেওয়ার কাজটি হয়ে আসছিল নৈশ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে। এবার নবদম্পতির মিলিত উদ্যোগে তা সংঘঠিত আকারে প্রকাশিত হলো। বাইরা গ্রামে উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো।
এরপরে এই দম্পতির একান্ত প্রচেষ্টায় সমগ্র বঙ্গপ্রদেশে একশটির বেশী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের সেইসব বিদ্যালয়ের বেশিরভাগেরই অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তিন চারটি বিদ্যালয় এখনও অধুনা বাংলাদেশে টিকে আছে মাত্র। সেখানেও সাম্প্রদায়িক কারণে বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে দু একটি বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হলেও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁদের নাম এখনও লেখা রয়েছে।
১৯৩১ সালের মে মাস, ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হলো "জয়শ্রী" পত্রিকা, বাংলার মেয়েদের মুখপত্রস্বরূপ। নামকরণ এবং আশীর্বাদ দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রচ্ছদ এঁকে দিলেন নন্দলাল বসু। সম্পাদনা লীলাবতী নাগ। উদ্দ্যেশ্য, মেয়েদের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও শঙ্কাহীন দেশসেবার ভাব জাগ্রত করা। জেলযাত্রার কারণে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকা প্রকাশে সাময়িক বিরতি ঘটেছে। তবুও চলেছে সেই পত্রিকার যাত্রা।
দুজনেই সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে কংগ্রেস থেকে বেড়িয়ে আসেন এবং ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন। আবার সুভাষ চন্দ্র বসুর মহানিস্ক্রমনের পর ফরোয়ার্ড ব্লক দ্বিখণ্ডিত হলে সুভাষবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন। নেতাজীর অবর্তমানে তাঁরই নির্দেশমতো দলের রাজনৈতিক পত্রিকা "Forward Blok" এর সম্পাদনার দ্বায়িত্ব পালন করেন লীলাদেবী। দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় লীলাদেবী ছুটে যান নোয়াখালী। এদেশে আগত হাজার হাজার শরণার্থীদের ত্রাণ, পুনর্বাসনের কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। একদিকে যেমন দুজনেই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন আন্দোলনে নিজেদের যুক্ত রেখেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তেমনি স্বাধীনত্তোর ভারতের অনেক আন্দোলনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।
চিদ্-বৃত্তিতে অনিল চন্দ্র ছিলেন আধাত্মবাদী আর হৃদ্-বৃত্তিতে মানব প্রেমিক। দুটি আপাতবিরোধী ভাবাদর্শের উত্তাল তরঙ্গ তাঁর সত্তাকে উদ্বেলিত করেছিল। একটি ব্রহ্মানন্দ-প্রেমানন্দ মহারাজের মাধ্যমে পাওয়া রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাবধারা আর অন্যটি রাজনৈতিক বিপ্লবের ভাবতরঙ্গ। একটি তাঁকে সংসারবিমুখ বিরাগী করে তোলে আর অন্যটি রূঢ় বাস্তবের মাটিতে এনে দাঁড় করায়। কিন্তু মানবদরদী অনিল চন্দ্র মানুষের দুঃখ বেদনাকে উপেক্ষা করে বৈরাগ্য সাধনে সমাজ ও সংসারকে ত্যাগ করতে পারেননি। উভয় আদর্শকে নিজের জীবনসাধনায় সমন্বিত করে নিয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে নেতাজীর ভাব ও কর্মসাধনায় সেই সমন্বয় দেখতে পেয়েছিলেন। শেষ অব্দি তাই নেতাজীর কর্মযোগে নিজেকে যুক্ত করে সুভাষবাদের মর্মোদঘাটন, প্রচার ও সংঘঠনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
অনিল চন্দ্র আর লীলাবতী ছিলেন একে অপরের "প্রাণ ইবাপৱঃ"। একে অন্যের পরিপূরক। লীলাবতী দেবী যেমন একদিকে ত্যাগের মধ্যেই জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। বাংলা এবং ইংরেজি সাহিত্যে ছিল প্রগাঢ় দখল। অন্যদিকে অনিল চন্দ্র সুবক্তা, দক্ষ সাংগঠনিক, গীতিকার, সুরকার, সাহিত্যিক এবং দার্শনিক।
অনিল চন্দ্রের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ধর্ম ও বিজ্ঞান, হেগেলীয় দর্শন, সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে মার্কসবাদ, নেতাজীর জীবনবাদ প্রভৃতি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ নবগীতিকা এবং নৃত্যনাট্য নেতাজীর ডাক অবশ্যই উল্লেখ্য। আবার জয়শ্রী পত্রিকায় লেখা এবং সম্পাদনা ছাড়াও কমিউনিস্টদের দেশবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রবন্ধ "We shall not stand it" লীলাবতী দেবীর উল্লেখযোগ্য লেখা। ১৯৪৫ সালে নেতাজীর পক্ষ থেকে প্রেরিত গোপন বার্তায় লীলাবতী দেবীকে এশিয়ার ঝাঁসি ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
অতি অল্প পরিসরের জীবনে অনিল চন্দ্র দেশের স্বাধীনতা এবং সামাজিক সংস্কারের ইতিহাসে যে অবদান রেখে গেছেন তা ভোলার নয়। মাত্র ৫০ বছর বয়সে ১৯৫২ সালের ৬ই জানুয়ারী ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন। মনের মধ্যে দুর্বল হয়ে গেলেও লীলাবতী দেবী তাঁর সামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যান। শরীর ভেঙে যেতে থাকে। নতুন উদ্যম ফিরে আসে ষাটের দশকের শুরুতে।
হঠাৎ করেই একটি কানাঘুষো কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। নেতাজীকে অমুক জায়গায় দেখা গেছে, তমুক জায়গায় দেখা গেছে। যদিও এটা পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই শুরু হয়েছিল তবুও ষাটের দশকের শুরুতে এসে কোলাহল যেন অনেকটাই বেড়ে যায়। শেষ অব্দি গোপন খবর থেকে নৈমিশারণ্য যাত্রা। সেটা ১৯৬৩ সাল। হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা এবং শেষ অব্দি সেই মহামানবের সাথে সাক্ষাৎ। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল অব্দি সেই মহামানবের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের দ্বায়িত্ব সামলেছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ এবং চাহিদামতো জিনিস সংগ্রহ করেছেন। কখনও নিজে গিয়েছেন সেই মহামানবের কাছে আবার কখনও পবিত্র মোহন রায়, সুনীল কৃষ্ণ গুপ্ত বা অন্য কাউকে পাঠিয়েছেন। পুরোনো শ্রীসংঘ বা বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স বা আজাদ হিন্দ ফৌজের বিশ্বস্ত বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ তৈরী করেছেন।
৭ই জানুয়ারী, ১৯৬৩ সালে লীলাবতী দেবী লিখলেন, "এক অত্যাশ্চর্য সত্য উদঘাটিত হলো। অভাবনীয় তার সম্ভাবনা। অচিন্তনীয় তার অনুষঙ্গিক সবকিছু। আমার অনুভূতিকে বিশ্লেষণ বা ভাষা দিতে চেষ্টা করবো না। কেবল বলবো "হে অঘটন ঘটন পটিয়সী দেবতা" আবার দেখলাম -
অকস্মাৎ কোথায় কি ঘটে
চির অসম্ভব আসে চির সম্ভবের বেশে।"
এই ১৯৬৩ সাল থেকেই ধীরে ধীরে তিনি রাজনৈতিক জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকেন। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত একটা বড় কারণ। যদিও সমাজসেবামূলক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৬৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী তীব্র সেরিব্রাল অ্যাটাকে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং কোমায় চলে যান। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৭০ সালের ১২ই জুন তিনিও ইহজগত ত্যাগ করেন।
তাঁর জয়শ্রী পত্রিকা তারপরেও বেঁচে ছিল। তাঁর সহকর্মীদের এবং শেষ অব্দি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের (বিজয় কুমার নাগ) হাতে। এই জয়শ্রী পত্রিকাতেই সত্তরের দশকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেই মহামানবের কথা "ওই মহামানব আসে"। দেশবাসী জেনেছে অনেক না জানা অধ্যায়ের কথা। যা আমাদের দেশের ইতিহাস বইতে কোনোদিন স্থান পাবে না। নেতাজীর ভগবানজীতে উত্তরণের ইতিহাস। গান্ধী বা নেহেরুর রাজনৈতিক জীবনের কালো অধ্যায়গুলো। বহির্বিশ্বের অনেক গোপন কথা।
স্বাধীনতা সংগ্রাম, সামাজিক আন্দোলন, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন এবং শিক্ষার জগতে অনিল চন্দ্র রায় এবং লীলাবতী নাগ ওরফে লীলাবতী রায় ওরফে লীলা রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। স্কুল, কলেজের পাঠ্যপুস্তকে অন্যান্য বিপ্লবীদের মতো ইনাদেরও নাম উহ্য থেকে গিয়েছে। সম্প্রতি সিধু কানহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ-র পাঠ্যপুস্তকে কিছুটা হলেও স্থান দেওয়া হয়েছে। তবুও ইতিহাসে নিতান্তই অনালোচিত ইনারা। একজনের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী পূর্ণ হয়েছে আর অন্যজনের পূর্ণ হবে আগামী বছর।
জয়শ্রী পত্রিকা এবং জয়শ্রী প্রকাশনীর উদ্যোগে গত ১৮ই অক্টোবর তারিখে উদযাপন করা হলো উনাদের সম্মিলিত ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী। স্থান গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী শিবানন্দ হল। উপস্থিত ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পক্ষ থেকে স্বামী বলভদ্রানন্দজী মহারাজ এবং স্বামী সুপর্ণানন্দজী মহারাজ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক তরুণ গোস্বামী, স্বনামধন্য নেতাজী গবেষক এবং চিত্র পরিচালক অম্লান কুসুম ঘোষ, লীলা রায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র বিজয় কুমার নাগ এবং প্রখ্যাত নেতাজী গবেষক ডাঃ শঙ্কর চ্যাটার্জি মহাশয়েরা। এক ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে দুই দেশপ্রেমী ও মানবদরদী মহান ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হলো।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।