১
"শস্য নেই। যা আছে তা যৎসামান্য। শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি।" সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লালসালু উপন্যাসে লিখেছিলেন। অত বছর আগে লেখা এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য এই কথা গুলো। প্রতিটা শব্দ এখনকার জন্য প্রযোজ্য। আমরা এই সমাজেই বাস করছি।
জামাতের গণ জোয়ার এসেছে। মানুষ অতীত নিয়ে ভাবতে রাজি না। তারা একবার জামাতকে দেখতে চায়। সাধারণ মানুষের এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি এমনে এমনেই তৈরি হয়নি। সমস্ত শক্তি দিয়ে মানুষের মনে এই জিনিস স্থাপন করা হচ্ছে। যা এখন পর্যন্ত সফল বলা চলে।
এরপরের ধাপ হচ্ছে জামাতের নানা অপকর্মকে জায়েজ করার জন্য নানা জায়গা থেকে আওয়াজ তোলা। যে কোন একটা আকাম করবে, কেউ না কেউ তাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করবে। হিজাব নিয়ে কথা বলবে, দেখা যাবে আমাদের পরিচিত লোকজন, পছন্দের মানুষ ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করবে এইটা আসলে কত উপকারী জিনিস! ইতোমধ্যে একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে যে জামাত কোন অপরাধ করে না! চাঁদাবাজি করে না, খুন ছিনতাই রাহাজানি এইসবে জামাত নাই! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে জাহাঙ্গীরনগরেও যে শিবির জিতল তার বড় একটা কারণ এইটা। ছাত্ররা ছাত্রদলকে ভয় পাইছে, কারণ লীগ আর দল দুইটাই এর আগে এমন পরিস্থিতি ক্যাম্পাসে তৈরি করে রেখেছিল যে ছাত্ররা সাহস পায় নাই আবার দলের খপ্পরে পড়ার। এইটা ভাঙা কঠিন হবে। এই মনোভাব, জামাত দুধে ধোয়া তুলসী পাতা, এইটা থেকে বের হওয়া কঠিন হবে। জামাতর অপকর্মের ফিরিস্তি দেওয়া কঠিন। কারণ জামাত মাথামোটা রাজনীতি করে না। নিঃসন্দেহে এই এক বছরে বিএনপি যত আকাম করেছে তার সিকিভাগও জামাত করে নাই। কিন্তু করেই নাই তা বলারও সুযোগ নাই। আমার এলাকাতেই ভরপুর হয়েছে। সরকারি অফিসে কাজ গুলো ভাগাভাগি করে খেয়েছে সবাই।
জামাতের অপকর্ম না দেখার একটা বড় কারণ ধর্ম! এই মুল্লুকে ধর্মের লেবাস থাকলে সব জায়েজ হয়ে যায়। কাঁচা মিথ্যা কথা বলে ধরা খেলেও সমস্যা নাই। জাহাঙ্গীরনগরে শিবির জেতার পরে এক সাবেক শিবির ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে আলহামুল্লিলাহ, জাবির ক্যাম্পাসে আল্লাহ আকবর বলা যাবে। এতদিন বাথরুমে নামাজ পড়তে হয়েছে লীগের ভয়ে! এইটা বিশ্বাস হয়? একটা বাংলাদেশের মত জায়গায় মানুষ নামাজ পড়তে পারছে না, বাথরুমে নামাজ পড়ছে? এইটা একটা কাঁচা মিথ্যা কথা এইটা যে কেউ শোনা মাত্র বুঝবে। অথচ ধর্মের ঠুলি লাগানো কেউ বুঝতেছে না। বুঝলেও চুপ করে রয়েছে।
জামাত ধার্মিক! ইসলামের ঠেকা নিয়া রাখছে। আল্লার কাছ থেকে ফ্রাঞ্চাইজ নিয়া আসছে দেশে ইসলামের। এমন একটা ধারণা থেকেও অনেকে জামাত করে। অথচ এদের প্রতিষ্ঠাতা মউদুদিকে পাকিস্তানের মত ধর্ম ভিত্তিক একটা দেশ ফাঁসর রায় দিয়েছিল। ধর্মীয় একটা দলের নেতাকে ফাঁসি? কিছু তো গড়বড় আছে, এই প্রশ্নটা আসবে না মাথায়? মউদুদির লেখা বই গুলোতে সরাসরি ধর্ম বিরোধিতা আছে, আল্লাহকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে নানা লেখায়। অথচ তৌহিদই জনতার মাথায় প্রশ্ন আসে না কেন? আপনার আসবে, আমার আসে কিন্তু তাদের আসে না। তারা এগুলাকেও নানা যুক্তি দিয়া জায়েজ করে নেয়। গোলাম আজমের সরাসরি দেশদ্রোহিতার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে যারা নেতা মানে তাদের নিয়ে এত কথা লেখার কোন দরকার আছে? আগে ছিল না, এখন এইটাই বাস্তবতা যে মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে আর তাদেরকে ঘায়েল করা যাবে না, কারণ এইটাকে তারা ছুঁড়ে ফেলেই দিয়েছে। কিন্তু তা যদি বাদও দেই তবুও তো গোলাম আজম রেহাই পায় না। গোলাম আজম কোরানের আয়ত কোনটা কোথায় হবে এইটা নিয়ে মন্তব্য করেছে এক জায়গায়। একবার ভাবুন এইটা লীগ বা দলের কেউ বলছে! গা থেকে চামড়া খুলে নিতো না এই ছাগলেরা?
এমন নানা প্রমাণ আছে এদের মিথ্যাচারের। সাইদি বলে অজ্ঞান দেশের মানুষ। সাইদি প্রশ্নে লীগের অনেককেও দেখছি মৌন থাকতে! অথচ এই লোকটা নানা ওয়াজে কুদরতে খুদা, জাহানারা ইমামের নাম বিকৃত করে বলত। কুৎসিত মজা নিতো ভরা মজলিসে। অথচ নিজে যখন বিকৃত নামের শিকার হল তখন সে কোরানের আয়াত দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করল যে এইটা করা যাবে না, আল্লার নিষেধ আছে কারো নাম বিকৃত করার ব্যাপারে!
এক ওয়াজ ব্যবসায়ী ভরা মজলিশে বলছে ঢাবির মহসিন হলে আজান দিতে দিত না, শিবির জেতার পরে আজান দিয়ে নামাজ হচ্ছে ওই হলে। আরও বলছে সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছিল পড়ার। কিন্তু সে যখন জাহাঙ্গীরনগরে যায় গিয়া দেখে কোন এক ছাত্র সকালে মদ দিয়ে কুলি করছে! এগুলা যে সব মিথ্যা কথা তা সহজেই বুঝা যায়। মানুষের চাপে পরে হলের নাম বদল করেছে। বলছে এইটা সলিমুল্লাহ মুসলিম হল হবে, মহসিন হল হবে না। আমার বন্ধু থাকত সলিমুল্লাহ হলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দর হল হচ্ছে এসএম হল বা সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। আমার বন্ধুর বরাতে আমার এখানে বহুবার যাওয়া হয়েছে, থাকা হয়েছে, রাত জেগে আড্ডা হয়েছে। আর হ্যাঁ নামাজ পড়তেও দেখছি বহুবার। অথচ এই যে মিথ্যাচার এর কোন প্রতিকার নাই। কারণ জামাতের লোক বলেছে!
জামাতের প্রতি অগাদ বিশ্বাস থেকে ডাকসুর পরে জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী সব জায়গায় শিবিরের প্যানেল জিতে গেছে! জামাত বেহেশতের টিকেট বিক্রি করে, নানান বক্তব্যে দেখা গেছে তাদের নেতারা সরাসরি জান্নাতের টিকেট দিচ্ছে, দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিলেই জান্নাত! ছাত্রছাত্রীরা এমন একটা সুযোগ হারাবে কেন? তাই তারা দলে দলে জান্নাতের টিকেট কিনে নিছে, দোষ দেওয়া যাবে?
২
লেখার প্রতি আগ্রহ নাই হয়ে গেছে। হতাশ লাগে দেখে, বিষণ্ণতা জানি না কারণ কী। ধুর কী হবে লিখে এখন শুধু এমন মনে হয়। পরিবর্তন যে এত কুৎসিত হতে পারে তা কে জানত? ওঁত পেতে আছে নানা অপশক্তি, এইটা জানা এক জিনিস আর তার মধ্যে বাস করা আরেক জিনিস না? আমরা বাস করছি অশুভ শক্তি দ্বারা পরিচালিত এক সরকার ব্যবস্থায়।
মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আমার নিজের বড় দুলাভাই। বেচারা সাধাসিধা লোক। বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, স্বাভাবিক ভাবেই লীগের রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। লীগের লোকজনও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তাঁকে মূল্যায়ন করত। অবসর জীবন, তাই টুকটাক রাজনীতিও করতেন। আর তিনি এমনই লোক দল থেকে যে কম্বল আসত সাধারণ মানুষকে দেওয়ার জন্য তা অপ্রতুল ছিল দেখে নিজের টাকায় কম্বল কিনে মানুষকে দিত। আবার দলের কাছে চাওয়া হবে, কবে দিবে এদিকে মানুষের শীত তো এখনই লাগছে, কম্বল দরকার এখনই। তাই নিজেই কিনে বিলি করেছেন। বিএনপির লোকদের কত সাহায্য করেছেন। এখন বাড়ি থাকতে পারে না। দুইটা মামলা খাইছেন। পাতি নেতারা পর্যন্ত এসে ভয় দেখায়। অথচ ছোট ছেলেটা এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, পড়াশোনা শেষ করে বের হয়নি। এই ভাইগ্না আবার জুলাই যোদ্ধা! কেমন লাগে বলেন? এমন দৃশ্য ঘরে ঘরে এখন বাংলাদেশের।
এদিকে যাদের টাকা আছে তারা টাকার খেলা খেলছে। টাকা ঢালছে, আর কথিত জুলাই যোদ্ধা থেকে শুরু করে জামাত বিএনপি সবাই সুযোগ বুঝে, ঝোপের সাইজ বুঝে কোপ মারছে। আমাদের এলাকার লীগের জেলা কমিটির দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক পালিয়ে ভারত যাওয়ার সময় বেনাপোল বর্ডারে ধরা খায়। সেখান থেকে আনা হয় আমাদের জেলা কারাগারে। সেখান থেকেই মামলা লড়তে থাকেন। তিনি যেহেতু সাবেক, সরাসরি গোলাগুলি করেন নাই তাই বুঝা যাচ্ছিল জোর করে আটকে রাখলেও তিনি একটা সময় জামিন পাবেন। তাই হয়েছে। কিন্তু তা অবশ্যই সোজা পথে হয়নি। বিশাল অংকের টাকার বিনিময়ে হয়েছে। তিনি টাকা শুধু জামিনের জন্য দেন নাই। জেল থেকে বের হবেন, সীমান্ত দিয়ে ভারত ঢুকবেন, এইটা হচ্ছে প্যাকেজ। এই প্যাকেজেই তিনি বের হয়েছেন। বর্ডার অতিক্রম করে গোহাটি পৌঁছে গেছেন! শোনা যাচ্ছে দশ কোটি টাকায় এই কাণ্ড ফয়সালা হয়েছে। দারুণ না?
দুর্গা পূজা গেল এর মধ্যে। এবার জাঁকজমক করে পূজা হচ্ছে এইটা দেখানোর একটা জোর প্রচেষ্টা ছিল। ফলে প্রচুর আলোকসজ্জা আমরা দেখেছি। কিন্তু মানুষ ছিল নিষ্প্রভ। কেন? টাকা নাই! পূজায় কেনাকাটা নাই! ব্যবসায়ীরা একটু ধাক্কাই খেয়েছে এবার। সামগ্রিক অর্থনীতিই ভালো না, মানুষ উৎসব করবে কী দিয়া? সরকার যে বাজেট দেয় তা হাস্যকর। সারাদেশের পূজার জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল এবার। মণ্ডপ প্রতি দুই হাজার করে পড়ছে কি না সন্দেহ আছে আমার। অন্যদিকে আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গত ইদে যে ইদ শোভাযাত্রা আয়োজন করছিল তার বাজেটই মনে হয় ছিল পাঁচ কোটি! এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা।
৩
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কথা বলে শেষ হবে না। কোন একটা স্থায়ী কাজ করা কঠিন। সহজ কী? লোক দেখানো অনেক কাজ আছে যা দেখানো সহজ। সহজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত সবাই। এই একটা ভাস্কর্য বানায় ফেলছে (অবশ্যই হালাল ভাস্কর্য!) এই ডকুমেন্টারি বানায় ফেলছে! সেই ডকুমেন্টারি তারাই দেখে তারাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে। জুলাই ভাস্কর্য নামে একটা বস্তু সারাদেশে বানানো হয়েছে। এইটার বানাতে কত টাকা লাগছে জানি না। একটু খুঁজলে পাওয়া যাবে কিন্তু আমার আর রুচিতে ধরে না। অথচ ৫ আগস্ট যে শিল্পকর্ম গুলো চুরি গেছে তা নিয়ে এই মন্ত্রণালয়ের কোন মাথা ব্যথা নাই। প্রবল অরাজকতার মধ্যেও যারা এসএম সুলতানের শিল্প কর্ম হাতিয়ে নিয়েছে তারা তো সাধারণ কেউ না, তাই না? কোন শিল্পকর্মের দাম কত, কার কাজ এগুলা সাধারণ মানুষের জানার কথা না। দেশের শীর্ষ স্থানীয় শিল্পীদের কাজ চুরি হয়ে গেছে এই দিন। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর বাসা থেকে চুরি গেছে, লীগের প্রভাবশালী নেতাদের বাড়ি থেকে চুরি গেছে। এগুলা সব গুলোই অমূল্য সম্পদ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটা ডায়রি পর্যন্ত করেনি এগুলা উদ্ধারের জন্য।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আর শিল্পকলা একাডেমী ঘটা করে লালবাগ কেল্লায় আলাউদ্দিন খাঁর জন্মবার্ষিকী উৎযাপন করছে। খুব দারুণ সংবাদ। পরে জানলাম এইটা পুরোটাই তাদের নিজেদের আয়োজন ছিল, সাধারণ মানুষরা এর কাছেও যেতে পারে নাই! শুধুমাত্র দাওয়াত প্রাপ্তরাই যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, টিকেটও ছিল না। এই জন্য কেউ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে অন্য দিকে আরেক পক্ষ গেছিল এই আয়োজন ভণ্ডুল করতে। লালবাগ কেল্লায় কেন এই সব হবে? গান বাজনা কেন করতে হবে?
দেশে মনে হয় প্রতিটা জেলায় একটা করে মাজার ভাঙা হয়ে গেছে। এই তৌহিদি জনতার একটা পিউবিক হেয়ার এদিক থেকে সেদিক করতে পারে নাই মহান সরকার। এদিকে গায়েত্রী স্পিভাককে অতিথি করে লালন তিরোধান দিবস পালন করা হচ্ছে, বিশাল আয়োজন। লালন এমনেই কপাল ভালা বাউল। যার কারণে এমনেই তাঁর নাম সুনাম দেশ বিদেশ সকল জায়গায়। তাই বাকিদের অবস্থা জঘন্য হলেও লালনের মৃত্যুবার্ষিকী প্রবল ভাবে পালন করা হচ্ছে, সরকারের লোকজন, সরকার প্রধান ইংরেজিতে পোস্ট করে জানাচ্ছে এই খবর। ইংরেজি কেন? কারণ এইটা আমাদের বুঝ দেওয়ার চেয়ে সারা দুনিয়াকে বুঝ দেওয়া জরুরি যে এখানে বাউলদের মৃত্যুবার্ষিকী কত আয়োজন করে পালন করা হয়, দেখেন! এদিকে নিয়ম করে যে পাগলদের চুল কেটে দিচ্ছে তার বেলায় বিবৃতি দিয়েই খালাস! এদিকে এক পাগলের লাশ কবর থেকে তুলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিছে তৌহিদি জনতা! লালনের কপাল ভালা বেচারা সুপার স্টার তকমা পেয়েছে, নাহলে কপালে খারাপই ছিল। যদি সেই সম্ভবনা এখনও প্রবল ভাবে বিদ্ধমান। কারণ কাঠমোল্লাদের প্রধান শত্রুই লালন। বাউল ফকিরদের বিরুদ্ধে তাদের যত রাগ তার মূল হচ্ছে লালন। এখন হয়ত চুপ করেই রয়েছে, সামনেও এমনই থাকবে তেমন ভরসা পাই না।
৪
সেনা বাহিনীর সদস্যদের আটকের আদেশ দেওয়া হয়েছে। পরোয়ানা জারি না হলেও সেনাবাহিনী কাজ আগায় রাখার জন্য আগেই যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদেরকে আটক করেছে। একজন বাদে বাকি সবাই নিজে থেকেই আত্মসমর্পণ করেছেন। এরা কারা? বেশির ভাগই সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের প্রধান ছিলেন। মুশকিল হচ্ছে এইভাবে যদি সাবেক সেনা অফিসারদেরকে আটক করা শুরু হয় তাহলে এই খেলা শেষ হবে কোথায় গিয়ে তা বলা মুশকিল। এই জন্যই সেনা প্রধান এর বিরোধিতা করছে। এবং অদ্ভুত ভাবে আমরা দেখছি ওয়াকার সাহেব সাইড হয়ে গেছেন দৃশ্যপট থেকে। সামনে বিশাল বড় কোন উলটপালট হলে আশ্চর্য হব না।
এদিকে বিখ্যাত জুলাই সনদ সাক্ষরিত হয়েছে। সরকার ও সরকার প্রধান জুলাই সনদ নিয়ে যতখানি উচ্ছ্বাসিত জনগণ ততখানি উচ্ছ্বাসিত কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। যেহেতু এ এক আজব সময়ের আজব খেলা চলছে তাই এইটা নিয়া কথা বলাও বিড়ম্বনার। তাও দুইটা কথা এই সময়ে বলে না রাখলে পরবর্তীতে যখন এই সময়ের দিকে পিছন ফিরে তাকাব তখন নিজেকে অপরাধী মনে হবে যে আমি টু শব্দও করি নাই।
এই জিনিসের ভিত্তিতে আগামী সরকার ও সময় আবর্তিত হবে এমন কথাই বলা হচ্ছে। ডক্টর সাহেব আরও একটু বেশিই বলেছেন, তিনি বলছেন, - "আজ যে জুলাই সনদ সাক্ষরিত হল, তার মধ্যমে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবর্তন হবে। এর মাধ্যমে আমরা বর্বরতা থেকে সভ্যতায় আসলাম।আমরা এক বর্বর জগতে ছিলাম। আমরা এমন সভ্য হব যে মানুষ আমাদের দেখে ঈর্ষান্বিত হবে।" এই যে মানুষ সুযোগ পাইলেই আমাদের বর্বর ডাকে আর সভ্য করতে চায় এর কারণ কী? আর কেন একজন বিজ্ঞ মানুষের মনে হচ্ছে এই জিনিস সাক্ষরিত হওয়ার পরেই টুপ করে সবাই সভ্য হয়ে যাবে? সাক্ষর হওয়া মাত্র পুরো দেশ জুড়ে বিশেষ কী বৈদ্যুতিক প্রবাহ বয়ে যাবে যে এক ঝটকায় সবাই খুব সভ্য হয়ে যাবে? সাক্ষর তো হয়ে গেছে, এখন সবাই সভ্য আমরা, কেউ আর আমাদের অসভ্য বলতে পারবে না, তাই না? কালকে কেউ আর জোরজবরদস্তি করবে না, কেউ অন্যায় করবে না, ঘুষ খাবে না, দুর্নীতি করবে না, আমরা এখন সভ্য, দুনিয়া ঈর্ষা করবে আমাদের!
এই জিনিসে আমাদের ইতিহাসের কথা বলা নাই। টুপ করে দেশ স্বাধীন আর তারপরে ২০২৪! দারুণ না? এর আলোকে কেউ আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধকে ব্যাখ্যা করতে পারবে? প্রতিটা ধাপের যে ইতিহাস তা কেউ বলতে পারবে? জুলাই সনদের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে না? তখন? দেশের মাটিতে, ইতিহাসের প্রতিটা পাতায় যে ইতিহাস লেখা হয়ে আছে, তা অস্বীকার করে অদ্ভুত এক বস্তু তৈরি করা হল আর তা করা মহাসমারোহে।
সবচেয়ে হাস্যকর কাণ্ড সম্পর্কে তো এখনও বলিই নাই। তা হচ্ছে আমাদের জাতি সত্ত্বাকে অস্বীকার করা হল এখানে। হাস্যকর এই কারণে না যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশি করা হল, এই চেষ্টা তো আগেও হয়েছে। হাস্যকর হচ্ছে যিনি এর রূপকার তিনিই এক সময় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছেন, বই পর্যন্ত লিখেছেন। আলী রিয়াজের বই থেকে উদ্ধৃতি দেই? -
"পূর্ববর্তীকালে কখনো কখনো আমাদের জাতিসত্ত্বাকে ঘিরে এইসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে আমাদের নিরংকুশ অগ্রযাত্রার পথকে রুদ্ধ করবার জন্যে। কখনো কখনো এই প্রশ্ন তোলা হয়েছে যেন আমরা একটি মিমাংসীত বিষয় নিয়ে ব্যাপৃত থাকি। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে সংশয় তৈরী করে আমাদের চিন্তা চেতনার স্রোতকে রুদ্ধ করতে চাওয়া হয়েছে, চেষ্টা হয়েছে আমাদের কর্মোদ্যগকে সীমাবদ্ধ গন্ডীতে আবদ্ধ রাখতে। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’- এর যে কল্পিত ধারণা আজকে সরবে প্রচারিত হচ্ছে তার মূল লক্ষ্যও তাই।"(বাঙালি জাতীয়তাবাদ- আলী রিয়াজ, প্রকাশকাল ১৯৭৯, তিতাস প্রকাশনী)
এই একই প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণাকে প্রতিরোধ করতে বলেছেন, বলেছেন এটি একটু বিভ্রান্ত ধারণা! হাস্যকর কোথাও বুঝতে পারছেন? এই আলী রিয়াজ এখন সনদ বানাচ্ছে আর সেখানে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছেন। দারুণ না?
অবশ্য তিনি একাই না, এই সময়ের প্রায় সমস্ত বুদ্ধিজীবীই এমন কাজই করে চলেছেন। আগে কী নিজে কি বলেছেন তা বেমালুম ভুলে এখন নতুন করে সব হিসাব নিকাস করে নতুন গল্প শোনাচ্ছেন!
আমরা পাকিস্তানি এই একটা ধারণা চাপিয়ে দেওয়া থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। আমরা এক জাতি না, আমাদের জাতিসত্তা আলাদা। এই হিসাব থেকেই একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম যার নাম বাংলাদেশ। আপনে এত সহজে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন? পাকিস্তানিরা প্রথমে পাকিস্তানি বানাতে চেয়েছে পরে ধর্মের দোহাই দিয়ে চেষ্টা করেছে। আমরা মুসলমান না বাঙালি এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে আমাদের সামনে। আমরা এই প্রশ্নের মীমাংসা করেছি রক্তের বিনিময়ে। আমরা আমাদের জাতি পরিচয়কে জয়ী করেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নাই যে কেউ একজনের জাতি পরিচয় মুছে দিতে পারে। এইটা সম্ভবই না।
পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকান। ভারত অসংখ্য জাতি দিয়ে তৈরি একটা যুক্তরাষ্ট্র। যেদিন ভারত এই জাতিগুলোর জাতি পরিচয়ে হাত দিবে, যার চেষ্টা ইদানীং দেখা যাচ্ছে, সেদিন থেকেই এর বিপর্যয়ের শুরু হবে। যতদিন প্রতিটা জাতিকে সম্মান দিয়ে চলবে ততদিন কিছুই হবে না ভারতের। সবাকে ভারতীয় নাগরিক বানানো সম্ভব কিন্তু ভারতীয় জাতি বানাতে গেলেই লাগবে গণ্ডগোল!
জুলাই সনদে আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০(২) ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি বাতিল এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ৫ম, ৬ষ্ঠ এবং ৭ম তফসিল সংবিধানে না রাখার জন্য বলা হয়েছে। এতে একমত হয়েছে ২৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট। এদের মধ্যে বিএনপি এবং জামাত রয়েছে। নয়টি দল সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ বাতিলে একমত হয়নি। এদের বেশিরভাগই বামপন্থী দল। কী আছে এতে যা বাতিল চাচ্ছে এরা? সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদে আছে, — " ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখ হইতে ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে এই সংবিধান প্রবর্তন হইবার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ষষ্ঠ তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম এবং সপ্তম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হইল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষণ ও দলিল, যাহা উক্ত সময়কালের জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী বলিয়া গণ্য হইবে।" বুঝা গেল কিছু? এই হচ্ছে বাস্তবতা।
৫
অর্থনীতির লাল বাত্তি জ্বলছে দীর্ঘদিন ধরেই। একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। সরকার প্রধান ও সরকারের বাকি যন্ত্রগুলোর কারোই খুব একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না এইদিক নিয়ে। দুইদিন আগে প্যাসিফিক ডেনিম কারখানা বন্ধ হয়ে গেল, প্যাসিফিক জিন্স হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় ডেনিম কারখানা। ৩৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে এতে। এইটা বন্ধ হয়ে গেল ,এখন পর্যন্ত কার্যকরি কোন উদ্যোগ দেখা যায় নাই খোলার। নাসা বন্ধ হয়েছে, বেক্সিমকো তো আগেই গেছে! গত এক বছরে সাভার আর গাজীপুরেই বন্ধ হয়েছে ৩৫০টা গার্মেন্টস কারখানা। লক্ষ লক্ষ বেকার। দেশের আইন শৃঙ্খলা খারাপ না হলেই আশ্চর্য হওয়ার কথা না?
দুনিয়ার সকল দেশ আমাদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। যে শ্রীলংকাকে হাসিনা সরকার সাহায্য করল কয়েকদিন আগে সেই শ্রীলংকাও আর সহজে ভিসা দিচ্ছে না আমাদের! আমরা ধীরে ধীরে যাচ্ছিলাম এমন একদিকে যে ভারতের সাথে ভিসা ছাড়া যাওয়ার বা অন এরাইভাল ভিসা পাওয়া যাবে। অথচ এখন ভারতের চিকিৎসা ভিসা, ডাবল এন্ট্রি ভিসা হয়ে গেছে সোনার হরিণ। কত কত ছাত্রদের যে স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার কোন ইয়াত্তা নাই। এগুলার জবাব কে দিবে? চালকের আসনে বসার আগ পর্যন্ত নানা কথা বলা যায়। এমনে চালাও, ওইদিক দিয়া চালাও, তুমি ছাতার চালক, এই সহজ জিনিস বুঝ না? এগুলা বলা যায়। কিন্তু চালাইতে গেলে বুঝা যায় কতখানি চাপ নিয়ে কতদিক বিবেচনা করে সব করতে হয়। বাহির থেকে হায় আল্লা খালেদ বলে চিল্লাফাল্লা করলেও যখন ক্ষমতায় বসায় দেওয়া হয় তখন এক বছরে সবাই মিলে একটা অশ্বডিম্ব প্রসব করা ছাড়া আর কিছুই করা যায় না!
৬
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে এমন কথা এখন জোরেশোরেই বলা হচ্ছে। অন্যদের খবর না জানা গেলেও জামাত ইতোমধ্যে গণসংযোগ চালু করে দিয়েছে। লীগের কী হবে? আমি কোন আশা অন্তত এইবার দেখি না। লীগ জুলাই আন্দোলনের চেয়েও বড় ধরা খেয়েছে তাদের অসম্ভব রকমের দুর্নীতিবাজ নেতাদের কাছে। আমি ধরেন চাইলাম যে লীগ ক্ষমতায় আসুক কিন্তু আমি এইটা কোনদিনই চাই না আমাদের এলাকার মহান এমপিরা আবার এসে বসুক ক্ষমতায়! একজন নতুন এমপি পাইছিলাম, তিনি সাত মাসেই এমন সিনেমা দেখাইছে যে তারা আবার ফিরে আসছে এইটা চিন্তা করলেও আঁতকে উঠতে হয়। তো ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আমি আমার এলাকায় চাই না, যদিও জানি যারা আসতেছে তারা এর মধ্যেই যে খেলা দেখাইছে তাতে বাঁশ কনফার্ম হয়েই আছে। এমন সব জায়গায়ই না? আমি সিরাজগঞ্জের একজনের সাথে আমার এই ধারণাটা বললাম, তিনিও একই কথা বললেন, লীগ সরকারে আসুক কিন্তু আমার এলাকার এই নেতাদের চাই না! তো? আছে কোন রাস্তা?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।