বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম সোহাগপুর। সোহাগপুর গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই খুব স্বাভাবিক জীবন শুরু হয়। মানুষ ক্ষেতে খামারে কাজ করতে যায়। শ্রাবণ মাস চলছে। হাল চাষ পুরদমে চালু। সোহাগপুর খুব প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় এখানে গ্রামীণ জীবন যেন আরও বেশি গ্রামীণ। যুদ্ধের কোন আঁচ আসেনি এখানে। কিন্তু যুদ্ধ চলছে, পাকিস্তান আর্মি কাছেই, তেল্লাখালিতে ক্যাম্প করেছে এগুলা তাদের জানা। ঠিক এমন একটা অবস্থায় খবর আসল গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢুকেছে। সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কেউ দৌড় দিয়ে বাড়ি ফিরে যায়, কেউ অপেক্ষা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য। তাদের ধারণা ছিল তাঁরা কেন দৌড়াদৌড়ি করবে? তাঁরা কি চোর ডাকাত? তাঁরা তো যুদ্ধেও যায় নাই, তাহলে তাঁরা কেন ভয় পাবে? তাঁরা সাধারণ মানুষ, ক্ষেতে কাজ করছে, ভয়টা পাবে কেন? পাকিস্তান আর্মি গ্রামে ঢুকে এক মাথা দিয়ে, শুরু করে হত্যাযজ্ঞ! যারা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল তাঁদেরকে মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে দেয়। যারা দৌড়ে বাড়িতে ফিরেছিল তাঁদেরকে খুঁজে বের করে মারা হয়। পুরো গ্রাম অল্প কয়েক ঘণ্টায় পুরুষ শূন্য হয়ে যায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ১৮৭ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। রক্তের নহর বয়ে যায় পুরো গ্রাম জুড়ে। লাশ কে কাফন পরাবে আর কে কবর দিবে? এদিকে ওদিকে পড়ে থাকে লাশ। শেয়াল কুকুরে খায়, কাক শকুনে খায়! শান্ত একটা গ্রাম মুহূর্তের মধ্যে আরও শান্ত হয়ে যায়, একেবারে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এই গ্রাম পরে পরিচিতি পায় বিধবাপল্লী হিসেবে!
আমাকে এখন প্রায়ই যা শুনতে হয় তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে আসলে অত বর্বরতার কিছু না, অনেক মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে! বলা হয় অতীত নিয়ে বসে থাকলে চলবে? আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে না? তাই সরকারি ঘোষণায় বিজয় দিবস পালনে পাকিস্তান নামটাই নাই, নাই কোন বীরত্বের গল্প। আছে জুলাইয়ের আবু সাইদের নামা! আমাকে বলা হয় কথা কইস না এখন, চুপ করে থাক! কিন্তু এই বিজয়ের মাসে চুপ করে আর থাকতে ইচ্ছা করে না। তাই বর্বরতার যা আছে, যত ভয়ংকর নির্মমতা আছে তা লিখে যেতেই থাকব। যদি কোথাও কারো মনে দাগ কাটে!
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিউজউইকে একটা প্রতিবেদন ছাপা হয় ( ২ আগস্ট, ১৯৭১)। প্রতিবেদনের শুরুতেই পাকিস্তান বাহিনীর নিষ্ঠুরতার এক করুন বিবরণ দেওয়া হয়। হালুয়াঘাটে আহত জওয়ানদের রক্ত দরকার। পাক মেজর গ্রামে গিয়ে কিছু যুবককে আশ্বস্ত করে ক্যাম্পে নিয়ে আসেন রক্ত দেওয়ার জন্য। রক্ত নেওয়ার সময় শরীর থেকে সমস্ত রক্ত নিয়ে মেরে ফেলা হয় সবকটি যুবককে। পাশবিকতার নমুনা আছে কোথাও এমন? হিটলারের গ্যাস চেম্বারের সাথে মিল পাওয়া যায়?
এই একই প্রতিবেদনে আরেকটা নিষ্ঠুর ঘটনা বর্ণনা করা হয়। নানা জায়গা থেকে চাপ আসায় ইয়াহিয়া সাধারণ ক্ষমা ঘোষান করে যুদ্ধের সময়। সীমান্তে শরণার্থী ক্যাম্পও খুলে। বলাই বাহুল্য এতে কেউই তেমন সাড়া দেয়নি। ক্যাম্প গুলো খালিই থাকে। কিন্তু বাংলার অতি সাধারণ মানুষকে তো আমরা চিনিই। তাদের অনেকের মনে হয়েছে যাক, এবার বাড়ি ফিরে যাওয়া যাক। তেমন একজন হচ্ছেন গোবিন্দচন্দ্র মণ্ডল। তিনি এই খবর শুনে নিজ গ্রামের পথে রউনা দেন, সাথে দুই কিশোরী কন্যা। বাড়ির আগেই পাক সেনাবাহিনী তাদের আটক করে। গোবিন্দচন্দ্র হতভম্ব হয়ে দেখেন নিজের দুই কিশোর কন্যার ধর্ষণ, ধর্ষণ করতেই আছে, করতেই আছে! - "Govinda Chandra trudged through monsoon- drenched swamplands and past burned-out villages. When he neared his scrap of land, soldiers stopped him. As he watched in helpless anguish, his daughters were raped- again and again and again" ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীতিই ছিল আদমি নেহি মাংতা, হম্ মিট্টি মাংতা নীতি। মানুষ যত ইচ্ছা মরুক, কোন সমস্যা নাই। এখন মৃতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবার। কেন এই প্রশ্নের উত্তরও নাই তাদের কাছে। একটু কম দেখায়া তাদের কী লাভ তা তারাও জানে না। কিন্তু ইতিহাসের পাতা থেকে কিছুই হারায় যায় না। পদচিহ্ন রেখে যায় সব জায়গায়। এই আধুনিক যুগে তো আরও সত্য এই কথা। ১৯৭১ সাল প্রস্তর যুগ না। তখনকার পেপার পত্রিকায় ফুটে আছে বর্বরতার ছাপ বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকা ১৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালেই প্রকাশ করে মৃতের সংখ্যা অন্তত ৩-৫ লাখ! এমন করে খুঁজলে প্রতি ধাপে ধাপেই যে শহীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তা সহজেই দেখা যায়। কিন্তু চোখ থাকিতে অন্ধ যে জন সে কেমনে দেখবে?
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গণহত্যাকে অস্বীকার করার কথা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভেবেছে। যুদ্ধের সময় কিন্তু এমন না। তারা যখনই সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছে তখনই কোন লুকালুকি করে নাই। তারা কী চায়, কেন চায় তা খুলেই বলেছে। ১৪ এপ্রিল গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে খুলনা জুটমিল এলাকার এক অফিসারের কথা বলা হয়েছে, তিনি সোজাসুজিই বলেছেন, যারাই আমাদের সামনে পড়ছে তাদেরই আমরা খুন করেছি। লাশ গুণে দেখার ঝামেলা আমরা করিনি।! আর আজকে এদের শাবকেরা নানান রঙের গল্প শোনায় আমাদের।
২ আগস্ট ১৯৭১ সালে টাইম ম্যাগাজিন প্রথম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কাভার স্টোরি হয়, নাম দেওয়া হয় পাকিস্তানের যন্ত্রণা ( Paskistan’s Agony), মূল প্রতিবেদনের নাম দেওয়া হয় সোনার বাংলা ধ্বংসের অভিযান (Revanging of Golden Bengal), আমি নেটে ঘেটেঘুটেও কোথাও এই প্রতিবেদকের নাম খুঁজে পাই নাই। যিনি লিখেছেন তিনি কাব্যিক ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন যুদ্ধকালীন অবস্থা। বাঙালিকে তিনি বুঝতে পেরেছেন চমৎকার ভাবে। বাঙালির বর্ণনা দিয়েছেন এই ভাবে - ""A warm and friendly but volatile people whose twin passions are politic and poetry, they have nurtured a gentle and distinctive culture of their own. conversation- 'adda' is the favorite pastime... Typically, Bangladesh chos as its national anthem not a revolutionary song but a poem by the poe Rabindranath Tagore, 'Golden Bengal'." কবিতা আর রাজনীতি আমাদের দুইটা যুগল নেশা, আড্ডা যে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় অবসরের সঙ্গী এইটা বুঝা কিন্তু সহজ কথা না!
কাব্যিক ভঙ্গি ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যের কথা বলার সময়। আমি ধান ক্ষেত আর পাট ক্ষেতকে পান্নার সাথে তুলনা করতে দেখি নাই আগে অন্য কোথাও! এখানে তিনি লিখেছেন - "It is indeed a land of unexpectedly lush and verdant beauty, whose emerald rice and jute fields stretching over the Ganges Delta as far as the eye can see belie the savage misfortunes that have befallen its people. মুগ্ধ প্রতিবেদক তার মুগ্ধতা লুকানো চেষ্টা করে নাই একটুও। কিন্তু সেই সাথে বাংলার মানুষের দুর্ভাগ্যের কথাও বলেছেন।
এই প্রতিবেদনেই হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপরে যে বিশেষ করে আক্রোশ দেখানো হয়েছে তা বলা হয়েছে। লুঙ্গি খুলে মুসলমানিত্ব পরীক্ষা করার কথা আমরা নানা জায়গায় পড়েছি। এখানে তা নিশ্চিত করেছে লেখক। প্রতিবেদন থেকে - "The Hindus, who account for three- fourths of the refugees and a majority of the dead, have borne the brunt of the Moslem military's hatred. Even now, Moslem soldiers in East Pakistan will snatch away a man's lungi (sarong) to see if he is circumcised, obligatory for Moslems; if he is not, it usually means death. Others are simply rounded up and shot. Commented one high U.S. of- ficial last week: "It is the most incred- ible, calculated thing since the days of the Nazis in Poland." শুধু এই প্রতিবেদন না, আরও বেশ কিছু জায়গায় আমি দেখিছি তুলনাটা করা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে। বলা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এমন নির্মমতা বিশ্ব আর দেখেনি।
পাকিস্তানের নীতির সমালোচনা করা হয়েছে এখানে। যখন এই ভূখণ্ডে সাহায্য বেশি দরকার তখন পাকিস্তানিরা সর্বনিম্ন বরাদ্দ দিয়েছে আমাদেরকে। এগুলা আমরা বলতাম, বলা হয়েছে বহুবার। কিন্তু টাইম ম্যাগাজিন তখনই বলেছিল এই কথা। প্রতিবেদক ভরসা রেখেছেন বাঙালির ওপরে, লিখেছেন, "The proud Bengalis are unlikely to give in" এত সহজে হাল ছাড়ার লোক এরা না! মার্কিন নীতির তীব্র সমালচনা করা হইছে এতে। এবং শেষ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের উক্তি - Tagore once wrote: Man's body is so small, His strength of suffering so immense. মানুষের এত ছোট শরীর তবু তার কষ্ট সহ্য করার কী অপরিসীম শক্তি!
প্রতিবেদন গুলো সাধারণত আবেগ শূন্য হয়। কিন্তু এখানে প্রতিবেদক যথেষ্ট আবেগ নিয়েই লিখেছেন তা বুঝা যায়। কিন্তু হায়, সেই আবেগ আমাদের কেন জানি নাই হয়ে গেছে। কোন আত্ম সচেতন জাতির ইতিহাস ভুলে যাওয়ার কথা না। একটা জাতি কীভাবে জাতীয় ইতিহাস ভুলে যায় আমার তা জানা নাই। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ইতিহাস আছে কি না তাও আমার জানা নাই। এ এক বিরলতম জাতি যারা প্রাণপণে নিজের গর্ব ভুলে যেতে চায়। প্রাণপণে প্রমাণ করার চেষ্টা করে এইটা অর্জন না এইটা ব্যর্থতা! এই বিজয় বিজয় না, এইটা উল্লাসের না, এইটা আনন্দের না, সবই লজ্জার, পরাজয়ের! এমন অদ্ভুত প্রাণী বিরল না? কেন বিজয়ের মাসে আমাকে এগুলা লিখতে হবে? আমি গর্বের গল্প বলব এই সময়, আমি আনন্দ প্রচার করব এই সময়। কেন এখনও মুক্তিযুদ্ধকে ডিফেন্ড করতে হবে? উত্তর আপনেও জানেন আমিও জানি। আমি এটাও জানি এই এক অস্ত্র যার কাছে অপশক্তির পরাজয় নিশ্চিত। আজ হোক কাল হোক জাতি ঠিকই তার শেকড় খুঁজে নিবে। এইটাই একমাত্র ভরসা।
প্রথমে সোহাগপুর গ্রামের কথা লিখেছি। যা পরে বিধবাপল্লী হিসেবে পরিচিতি পায়। এই গ্রামটা লোকচক্ষুর আড়ালেই চলে গেছিল। অনেক পরে এক সাংবাদিক ( সম্ভবত জনকণ্ঠ পত্রিকায়) প্রথম এই গ্রাম নিয়ে প্রতিবেদন করে। সবাই শিউরে উঠে এর গল্প শুনে। এরপরে সরকারি অনুদান আসে। বিগত লীগ সরকার এদের জন্য যথেষ্ট করে। পাকা বাড়ি করে দেয়, মাসিক অনুদান দেয়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ঈদ চান্দে নানা উপহার দেওয়া হয়। সরকারি সাহায্য লেগেই থাকে। যে নির্মমতার শিকার তাঁরা যুদ্ধের সময় হয়েছিল তার কিছুটা হলেও লাঘবের চেষ্টা করা হয়। এবার আমার মনে হল এই গ্রামটা ঘুরে আসা যাক। আমি গতকাল চলে গেলাম সেখানে। এত ভিতরে হবে তা আমি ভাবিনি। খুঁজে বের করে যখন হাফিজা বেওয়ার বাড়িতে উপস্থিত হলাম তখন তিনি থতমত খেয়ে গেলেন। কথা বলতেই চাইলেন না। কিন্তু বলা শুরু করলেন। মাত্র বিয়ে হয়েছিল উনার। তার কথায় - জষ্টি মাসে বিয়া করে আনছে শাওন মাসেই বিধবা! উনার স্বামীর নিজের একটু জমি ছিল, তা চাষ করতেন আবার অন্য মানুষের জমিও চাষ করতেন। সেদিন ক্ষেতে কাজ করার সময় যখন খবর আসল যে আর্মি আসছে তখন তিনি দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িকে মানুষ নিরাপদ মনে করে। কিন্তু সেদিন বাড়ি আর নিরাপদ ছিল না, পাক সেনারা বাড়িতে এসেই গুলি করে মারে তাঁকে। কথা বলতে বলতেই তিনি কই জানি হারিয়ে জান! খেই হারিয়ে ফেলেন মাঝে মধ্যে। মনে নাই কিছু বলেন আবার নিজেই শুরু করেন নিজের দুঃখের কথা। না খেয়ে থেকেছেন দিনের পর দিন, কচু ঘেচু সিদ্ধ করে খেয়েছেন। কেউ ছিল না দেখার। লবণের দাম বেড়ে গেছিল, কচুটা যে লবণ দিয়ে খাবেন সেই উপায়ও ছিল না! সেখান থেকে এখন পাকা বাড়ি, মাসে বিশ হাজার টাকা অনুদান। বাড়তি নানা কিছু তো আছেই। জিজ্ঞাস করলাম এখন? এখনের কথা বলতে তিনি নারাজ! সব বন্ধ, শুধু মাসিক ভাতাটাই চালু আছে।
সেখান থেকে গেলাম অন্য আরেকটা বাড়িতে। সঙ্গত কারণেই নাম বলছি না। ক্যামন আছেন জিজ্ঞাস করতেই তিনি কোন রাখঢাক না করেই বললেন শেখ হাসিনা নাই ভালো ক্যামনে থাকব! আমি এই উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না! বললাম আরে কী কন, আমরা আছি না? তিনি হাসেন। উনার বয়স আশি ছাড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই সন্তানের জননী তিনি। তবে বাল্য বিবাহ হয়েছিল তাই খুব যে বয়স ছিল তাও না। তার মেয়ে আমার সাথে কথা বলল। তার বয়স ছিল ৮/১০ বছরের মত। তিনিই মূলত কথা বললেনে। তার মা পাশে বসে শুনলেন মাঝেমধ্যে নিজেও প্রসঙ্গ মত কথা বললেন। ক্যামন ছিল ২৫ জুলাইয়ের সেই দিন? তিনি বললেন এই বেলার মধ্যে সব শেষ হয়ে গেছিল! তখন বাজে দুপুর ১২টার মত। মানে ১২টার মধ্যে ১৮৭ মানুষকে মেরে শেষ করে ফেলেছিল করিতকর্মা পাকিস্তান আর্মি। যার মধ্যে ৬২ জন বিধবা হওন। ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় অনেক নারীকে। আমি যার সাথে কথা বলতেছিলাম তাঁকেও ঘর থেকে টেনে বের করেছিল। সেখান থেকে তিনি রক্ষা পান। নানা প্রসঙ্গে কথা বলতেছিলেন তিনি। কষ্টের জীবনের কথা বললেন তিনিও। তাঁরা এখানকার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলেন চট্টগ্রামের দিকে। এরপরে যখন খবর পেয়েছে যে সরকার তাঁদের খোঁজ করতেছে তখন তাঁরা আবার ফিরে আসে এবং এখানে থাকা শুরু করে। তাঁর মেয়ের সাথে কথা বলার মাঝেই তাঁর আরেক বিস্ফোরক প্রশ্ন, শেখ হাসিনা ফিরবে না? আমাদের জন্য ম্যালা করছে, বুঝছেন? না খায়া থাকতাম, ম্যালা করছে, এই ঘর দিছে, টাকা দিছে, সম্মান দিছে!
অবধারিত ভাবেই প্রশ্ন আসে এখন কী বুঝতেছে তাঁরা? মুক্তিযুদ্ধকে যে খেয়ে ফেলছে তাঁদের ক্যামন লাগে? জানি রুঢ় হয়ে যায় কিন্তু তবুও জিজ্ঞাস করলাম। তাঁর মেয়ে বলল দেখেন ওই যে একটা স্মৃতিস্তম্ভ, সরকার এইখানের এই ঘটনার স্মরণে বানায় দিছিল। আমারে কন তো এইটা কার কী ক্ষতি করছিল? এইটা কেন ভাঙল? এইটা কী দোষ করছে? এইটা চোখের সামনে ভাঙল, আমাদের খারাপ লাগে না? তিনি বললেন কয়েকদিন আগে কে জানি ওই স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দিয়ে জোরে জোরে বলতেছিল এগুলা সব চোর ডাকাত ছিল তাই মারছে সবগুলাকে! তিনি শেষ করলেন এই বলে যে এত বছর বুকটা এই বড় বলে দুই হাত প্রসারিত করে দেখালেন, এই বড় ছিল, বড় করে ঘুরছি, এখন হাতটা ছোট করে বললেন এখন এই ছোট হয়ে গেছে, সাহস পাই না, ডর করে! এবং আমিও উনার কথার সাথেই একমত! এইটাই প্রকৃত চেহারা বাংলাদেশের। মুক্তিযোদ্ধারা মাথা নিচু করেই টিকে আছেন এই দেশে। এই লজ্জা রাখার জায়গা আছে? কত বড় আহাম্মক হলে এইটা সম্ভব? ফিরতি পথে অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে ফিরলাম। উনার বাড়ি যাওয়ার আগে আমিও সেই ভাঙা স্মৃতিসৌধ দেখে গেছি। এইটা যখন উদ্বোধন হয় তখন পত্রিকায় পড়েছিলাম। এর নাম দিছিল ‘সৌরজায়া স্মৃতিসৌধ’। কার এত রাগ এই সৌরজায়া স্মৃতিসৌধের উপরে? কেন?
আমাদের দেশে ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ অতি মাত্রায়। কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে তাদের মত হতে পেরেছি? ইহুদিদের বর্তমান অবস্থা দেখলে তাদের অতীত বুঝা যাবে না। বহু বছর তাদেরকে চরমভাবে নিগৃহীত করে রাখা হয়েছে। শোষণ করা হয়েছে। নির্যাতন করা হয়েছে। তারা তা ভুলে যায় নাই। বছরের পর বছর গেছে। ভূমিহীন হয়েছে। কিন্তু কোনদিন তারা ভুলে নাই কিছু। তারা ধরে রেখেছে তাদের উপরে নির্যাতনের কথা। সেই চেতনা কোনদিন ভুলন্ঠিত করেনি। আর বাঙালি, আমরা পঞ্চাশ বছর যেতেই পাকিস্তান প্রেমে অন্ধ! এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বললে অন্তত দশ পনেরো জায়গা থেকে গেল গেল রব উঠবে! আমাদের এমনই কপাল বিজয়ের মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক বলে মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে ভারতের ন্যারেটিভ প্রচার করা হবে তাই তা তিনি করবেন না। আমাদের এমনই কপাল যে এই জিনিসকে ছাত্ররাই ভোট দিয়ে পাশ করিয়েছে! এদেরকে দোষ দিয়াই লাভ কী? মহান শান্তির দূত বিজয়ের মাস উপলক্ষে দেওয়া পোস্টেই মুক্তিযুদ্ধের বদলে জুলাই যোদ্ধাদের নাম নিয়েছেন!