১
জরুরি কাজে ঢাকা যেতে হয়েছিল। আর ঢাকা এমন এক শহর যেখানে প্রতি নিয়তই কিছু না কিছু ঘটছে। এমন এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে যেতে আমাকে আমার এক বন্ধু রাশান কালচারার সেন্টারে নিয়ে গিয়েছিল। আমি বরাবরই এই সব থেকে দূরে থাকা লোক। কিন্তু এখানে গেলাম। এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে নতুন এক দিক উম্মচিত হল আমার সামনে। সেখানে কিসের যেন সেমিনার চলছিল, সেখানে কোন রাখঢাক না করেই সবাই তীব্র সমালোচনা করতেছিল বর্তমান সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ, ৭২ সালের সংবিধান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা নিয়ে। আমি এইটা প্রত্যাশা করে নাই। পরে যা বুঝলাম রাশিয়া বেশ আয়োজন করেই এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। শুধু তাই না, রাশিয়া আগে অল্প কিছু ছাত্র নিতো স্কলারশিপ দিয়ে রাশিয়ায় পড়ার জন্য। ওরা এটাকে আরও বাড়িয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য যেটা লাগছে তা হচ্ছে রাশিয়ায় পড়াশোনা করতে যেতে কোন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স লাগছে না, লাগছে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কাগজপত্র সত্যায়িত করার ঝামেলা। এইটা দারুণ না?
ঢাকায় থাকলে নানা মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়। বড় শহরের এইটা একটা সুবিধা। আর ঢাকার মত শহর, যেখানে তৈরি হচ্ছে সব নীতি নির্ধারণই সিদ্ধান্ত। সেখানে তো এইটা আরও বেশি প্রযোজ্য। আমাদের এলাকার পলাতক এক লীগের নেতার সাথে দেখা হল। মনে হল আপন ভাইয়ের দেখা পেয়েছে। ভাই, কেমন আছ বলে জড়িয়ে ধরল আমাকে। এই লোকটাকে আমি আগেও খেয়াল করেছি। তিনি মূলত রাজনীতির লোক না। লীগের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু এই সব নিয়ে তার কোন আবেগ আছে বলে আমার মনে হয় নাই। বরাবরই মনে হয়েছে তিনি ভাইয়ের রাজনীতি করেন। কালকে যদি ভাই মানে আমাদের এলাকার এমপি যদি জামাতে যোগ দেয় তাহলে তিনি বিনা প্রশ্নে জামাতে যোগ দিবেন! তো তার সেই মহান ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাস করলাম। ভাই কলকাতায় আছে! টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নিয়মিত মিটিং হয়। তিনি ভাইয়ের সুবাধে লীগের রথী মহারথীদের সাথে মিটিঙে বসে থাকেন। চুপ করেই থাকেন কিন্তু থাকেন। তারা নানা আলোচনা করে তিনি শুনেন।
তার কাছেই শুনলাম সবাই মানে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় সবাই মিলে শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে গেছিল। আমাদের এলাকার এমপি সাবেক এমপি সবাই গেছিল। সেখানে শেখ হাসিনা নাকি সবাইকে গালিগালাজ করেছেন। তার কথা হচ্ছে আমাকে তো বন্দুকের মুখে এখানে পাঠিয়েছে। আমি মরে গেলেও আসতে চাই নাই। ওরা জোর করে পাঠিয়েছে। তোমারা দেশ ছাড়ছ কেন? খুব যৌক্তিক প্রশ্ন!
মুশকিল হচ্ছে কেন তারা দেশ ছাড়ছে এইটা শেখ হাসিনার না জানাটা উনার আরেকটা বড় ব্যর্থতা। এই লোক গুলোর যদি সৎ সাহস থাকত তাহলে দেশেই থাকত। আইভি রহমান থেকেছে। আনিসুল হকেরা থেকেছে। এমন না তারা পালিয়ে যেতে পারতেন না, পারতেন। কিন্তু থেকেছেন। ব্যারিস্টার সুমন নিজে থেকে পুলিশের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। আর যে হাজার হাজার নেতা ভারতে পালিয়ে গেল কেন গেল? তাদের সেই সাহস ছিল না। এখানেই লীগের রাজনীতির করুন দশা পরিষ্কার বুঝা যায়। এরা দেশে থাকেল মানুষ টেনে হাড় মাংস আলাদা করে ফেলত! এতই চমৎকার নেতা তারা!
প্রচণ্ড খারাপ অবস্থার মধ্যে মানুষ এখন লীগের আমলকেই ভালো বলে। সরকারের নানা প্রচারণায়ও কাজ হচ্ছে না। মানুষ এখন মুখে বলা শুরু করছে। ঢাকায় প্রথম দিকে ঝটিকা মিছিল বের হলে সাধারণ মানুষই বাধা দিত। কিন্তু এখন আর দেয় না। মানুষ সাহায্য করে উল্টো। এই প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে তবুও কেন লীগ ফিরে আসার নাম নিতে পারছে না? গত জুলাইয়ের মানুষ মারার জন্য? না। পারছে না তার বড় কারণ হচ্ছে আমরা চাই লীগ ফিরে আসুক কিন্তু আমার এলাকার পুরাতন সেই নেতারা যেন না আসে! এই বক্তব্য সবাই দিচ্ছে, তাহলে ফিরবে কোন পথে? আর এই কারণেই সহসাই লীগের আর ফেরা হচ্ছে না। এই আবর্জনা গুলোকে ঝেড়ে ফেলে যদি চেষ্টা করে তাহলে হয়ত সামনে আবার সুযোগ আসবে। কিন্তু যদি এরাই ঘুরেফিরে হাজির হয় তাহলে বিপদ আছে। বিএনপি যেমন দীর্ঘ ১৭ বছর অপেক্ষা করেছে তাদের নেতাদের খাসলতের জন্য। এবং তারপরেও সেই একই চেহারা দেখাচ্ছে জনগণকে। তাই এত কষ্ট সংগ্রামের পরেও বুকে সাহস পাচ্ছে না যে তারা ক্ষমতায় আসবে! কারণ আমার এলাকায় আমি দুই একজন বাদে বাকি সেই পুরাতন লুটেরাদেরই দেখছি। তাই অমাবস্যা আর কাটে না আমাদের কপালে!
সেই বড় ভাইয়ের কাছে শুনলাম শেখ হাসিনা চাচ্ছে যে কোন মূল্যে নির্বাচনে যেতে। এর জন্য যা করার সব করার চেষ্টা করছে লীগ। হুট করেই যে সরব হয়েছে শেখ হাসিনা তার কারণও এই। পর পর বেশ কয়েকটা বড় পত্রিকায় সাক্ষাতকার দেওয়া এইটারই কারণ। কিন্তু আমি মাঠ পর্যায়ে সেই চেহারা দেখি না। মানে এমন না লীগের জনপ্রিয়তা নাই বা অন্য কিছু। আমি বলতেছি সরকারের কথা, সরকার তো লীগের নাম শুনলেই পাগলের মত আচারন শুরু করে। এরা কোনমতেই লীগকে এখনই রাজনীতিতে আসতে দিবে না এইটা পরিষ্কার।
শেখ হাসিনার রায় দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। তার প্রতিবাদে লীগ ১৩ তারিখ ঢাকা শাটডাউনের ডাক দিয়েছে। জিজ্ঞাস করলাম কয়েকজন কর্মীকে। যে পরিস্থিতি তাতে কেমনে কী? জবাবে যা বলল তা হচ্ছে ভাই এইটা জনগণের অবস্থা বুঝার একটা চেষ্টা। মানুষ কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় তা দেখাটাই আসল উদ্দেশ। এইটা আমার কাছে অবান্তর মনে হয়নি। মিছিল যখন শুরু করে, ঝটিকা মিছিল তখনও এমন একটা লক্ষ ছিল। এবং এইটার ফল পেয়েছে লীগ। প্রথম প্রথম মানুষ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাত। কিন্তু এখন এমনও খবর পাওয়া যায় যে মানুষ সাহায্য করে। মিছিল করলেই পুলিশ ধরে, একদম সাধারণ মানুষ পুলিশ যেন না ধরতে পারে এই ব্যাপারে সাহায্য করে। এইটা অনেক বড় অগ্রগতি না?
২
বিএনপি নির্বাচনের জন্য সারাদেশে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। আমাদের এলাকায় যাকে দেওয়া হল সে আসলে ডামি, তার বাবা হচ্ছে সাধারণ সম্পাদক জেলা কমিটির। তিনি সরাসরি নিজে না করে মেয়েকে দিয়ে নির্বাচন করাচ্ছেন। কে এই ভদ্রলোক? তিনি হচ্ছেন এই জেলার এখন পর্যন্ত যত চাঁদাবাজি হয়েছে তার আসল কারিগর। একজন বলল মেয়ে কিন্তু ভালো, বাবার মত না! আমি বললাম কেমন ভালো? বললেন, ধর ১০ লাখ টাকা চাইল বাবা, মেয়ের কাছে গেলে ও ওইটাকে কিস্তি করে দেয়! মানে হচ্ছে বলে আচ্ছা, আপনে একবারে না দিয়ে অল্প অল্প করে দিয়েন! এই হল অবস্থা। তারেক রহমান চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হবে বলে চাঁদাবাজদেরই মনোনয়ন দিলেন। এবং অনেকেই বলছে যে এইটা হচ্ছে ওর চাঁদাবাজি। ওরা এতদিন চাঁদাবাজি করে যা কামাইছে, তিনি মনোনয়ন দিয়েই সব নিয়ে নিয়েছেন। আরেক পক্ষের কথা হচ্ছে তিনি সব নিয়ে নিবেন বলেই এরা এতদিন চাঁদাবাজি করে টাকা তৈরি করেছে যেন মনোনয়নের সময় দেওয়া যায়! কী একটা অবস্থা! কোনটাকেই অসত্য মনে হচ্ছে না।
কয়েক লক্ষ শ্রমিক বেকার হয়েছে, সাড়ে তিনশ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়েছে। এই বন্ধ গুলো কিন্তু বিজিএমিএ লিস্টেড। কিন্তু আমি এই লাইনের লোক হওয়ায় আমি জানি সবাই বিজিএমিএর সদস্য হতে পারে না। যে পরিমাণ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করলে বিজিএমিএ সদস্য করে তা সবার পক্ষে করা সম্ভব হয় না। কেউ ছোট করে দুই লাইন তিন লাইনের একটা ফ্যাক্টরি খুলে বসে আছে। সেখানে বড় কোম্পানির বাড়তি কাজ করে দেয়। লোকাল কাজ করে। এই ধরণের ফ্যাক্টরি হয়ত কয়েক হাজার বন্ধ হয়েছে! এগুলার কোন প্রভাব নাই? কিন্তু কে খোঁজ রাখে? খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
জামাতের নেতারা ৫৪ বছরের প্রতিশোধ নিতে চায়, কারো কোন মাথাব্যথা নাই এই নিয়ে। যেন এগুলা খুব স্বাভাবিক কথা। এইটাও স্বাভাবিক যে এত বছর রাজাকারদের সঙ্গে গভীর প্রেম করে এখন মির্জা ফকরুল একাত্তরের ঘাতকেদের সাথে কোন সমঝতা হতে পারে না বলে বক্তব্য দেয়। কেউ কেউ বলে তার পিতা নিজেও রাজাকার ছিলেন! বুঝ এবার…
নির্বাচন নিয়ে নতুন যে তামাশা শুরু হয়েছে তা এক কথায় অনবদ্য! জামাত জোর গলায় গণভোট চাচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের আগে। বিষয় হচ্ছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য। সংবিধান পরিবর্তন করে জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এই নিয়ে হ্যাঁ না ভোট। আমি প্রথমে এইটা নিয়ে খুব একটা ভাবি নাই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এইটা একটা মস্ত সুযোগ লীগের জন্য। এরা যে বিপুল আগ্রহ নিয়ে গণভোট চাচ্ছে তার কারণ হচ্ছে তারা ধরেই নিয়েছে হ্যাঁ জিতবে। আচ্ছা, যদি না জিতে? এই ভোটে তো কোন প্রার্থী নাই। তাই মানুষের ভোট দিতে সমস্যা কই? লীগের যা জনপ্রিয়তা আছে, সেই সাথে বর্তমান সরকারের যে সুপার ব্যর্থতা, তাতে না জিতে তো খুব স্বাভাবিক। তখন কী হবে? এর উত্তর একটা হচ্ছে তারা হ্যাঁ না ভোটকে সুষ্ঠু ভাবে হতে দিবে না। ওইটাকে কারুকাজ করে হ্যাঁ পাস করাবে। দুই নাম্বার হচ্ছে তারা এইটা নিয়ে ভাবেই নাই। এতে যে লীগের জনপ্রিয়তা প্রমানের একটা পথ তৈরি হবে তা সম্ভবত বুঝতে উঠতে পারেনি। আচ্ছা, লীগ কি বুঝতে পারছে এইটা একটা সুযোগ তাদের জন্য? তাদের তো দেখি না গণভোটের পক্ষে কথা বলতে। আমার মনে হয় বলয়া উচিত।
এক বছর আগে ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর নানা গল্প শোনা গেছে। আমরা আচ্ছা, দেখি কতদূর হয় বলে অপেক্ষা করেছি। আর আমরা দেখলাম কী? একজন শাসক নিজের যা যা গুছানোর সব গুছিয়ে নিলেন। কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি পাকা করলেন, ট্যাক্স মৌকুফ করলেন, যে জিনিস তিনি হয়ত আদালতে লড়ে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারতেন তা তিনি ক্ষমতা বলে বন্ধ করে নিষ্পত্তি করলেন। খুব ঢাক ঢোল পিটিয়ে রাজধানীতে বিনিয়োগ সম্মেলন হল। এখন পর্যন্ত নতুন বিনিয়োগের খবর নাই! তারা মানুষকে বোকা বানানোর জন্য নানা সময় নানান কথা বলে, বলতে বলতে সম্ভবত নিজের মিথ্যায় নিজেই বিশ্বাস করা শুরু করে। তাই যখন যে কোন সাধারণ বুদ্ধিমত্তার লোক বুঝবে এমন পরিস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগ কম আসাটাই স্বাভাবিক সেখানে তারা জোর করেই প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে যে না প্রচুর বিনিয়োগ আসতেছে। এখন যখন দেখা যাচ্ছে লবডঙ্কা, তখন কোথায় কোথায় গণ অভ্যুত্থান হয়েছে সেখানে কেমন বিনিয়োগ আসছে তার তুলনা দেখাচ্ছে! এবং সেখানেও ফাঁকিবাজি! নিজের পছন্দ মত ডাটা বসিয়ে একটা পাগলা বুঝ দেওয়ার ধান্দা!
আমাদের আর কাল প্রহর কাটে না। রাত যত গভীর হয় প্রভাত তত কাছে এসে, এই তত্ত্ব আমাদের জন্য আর খাটে না। আমরা দেখি অন্ধকার রাত আরও অন্ধকার হচ্ছে, সূর্যের দেখা নাই। নুন্যতম শিক্ষিত একটা ছেলেও দেশে থাকতে চাচ্ছে না, অথচ সমস্ত দুনিয়া ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে আমাদের জন্য। মানুষ আলোর খোঁজে দেশ ছাড়তে চায়। মানুষ বুঝে গেছে সহসা এই অন্ধকার কাটবে না। এই রাত দীর্ঘ হবে, আরও দীর্ঘ…
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।