ইসকন নিয়া হুট করেই দেশ গরম। আর আমি আজ পর্যন্ত বিরোধের কারণই বুঝলাম না। শুধু দেখি দুই একদিন পরে পরে মানুষ গরম হয়ে যায়। এবারও আগামাথা কিছুই জানি না আমি। মোবাইল নষ্ট, ঠিক করানোর জন্য এক পরিচিত মোবাইলের দোকানে বসে আছি। দোকানদার পরিচিত। নানা বিষয়ে নানা আলাপ হচ্ছে। ব্যবসাপাতি যে চাঙে উঠে বসে আছে, কিছুতেই নামছে না এইটা নিয়া ম্যালা প্যাচাল চলল। হুট করেই তিনি দোকানে যে ছেলেটা আমার মোবাইল ঠিক করার কাজ করছে তাকে জিজ্ঞাস করলেন, ইসকন নিয়া আবার কী হইছে? কী করছে ওরা? ছেলেটা জবাব দিল ওরা তো খুব উগ্র! সমানে মুসলিম মেয়েদেরকে বিয়ে করে হিন্দু বানায় ফেলতেছে, প্রেমের ফাঁদে ফেলে এই কাজ করছে! আমি সাধারণত এই সব আলাপে মন্তব্য করি না। এবারও কিছু বলি নাই শুধু ফিক করে হেসে দিছি। ছেলেটা কী বুঝল কে জানে, আমার হাসি দেখে যোগ করল এমন করা বলে আর কী, আমরা কী সত্য মিথ্যা জানি!
পরে খোঁজ করলাম কাহিনী কী তা জানার জন্য টঙ্গির কোন মসজিদের ইমামকে ইসকনের লোকজন অপহরণ করে পঞ্চগড় নিয়ে গেছিল। সেখানে পায়ে শেকল পরিয়ে ফুটপাথে রেখে দিছিল। কী ভয়ংকর কথা না? তারা আবার অপহরণ করে চিঠিও লিখে গেছে। সেখানে বলছে ইমাম যেন কোনদিন আর ইসকনের বিরুদ্ধে কথা না বলে। থানায় মামলা হয়েছে। দেশ উত্তাল। আমাদের ছোট্ট জেলা সদরেও এই ঢেউ এসে হাজির। ইসকন মন্দিরের দরজা শক্ত করে লাগায় রেখে বসে আছে মন্দিরের লোকজন। আর্মির গাড়ি গেটের সামনে দুইটা দাঁড়িয়ে থাকে রাত করে। এর মধ্যে পুলিশ সিসি টিভি ফুটেজ দেখে জানাল যে এমন কিছু হয় নাই। তিনি যেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে গেছে বলেছেন সেখানকার এক পেট্রল পাম্পের সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে তিনি একা একাই হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন। পুরাই ফরহাদ মজহার কেস! ইমাম যিনি আবার একজন মুফতিও, তিনি এরপরে স্বীকারোক্তি দিলেন যে হ্যাঁ, তিনি নিজেই করেছে তবে তা যে করেছেন এইটা নিজের জ্ঞানে করেন নাই। তার মনে হচ্ছিল কেউ তাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। তার এক পুত্র এর পিছনে জাদুটোনা আছে কি না তা জাদুটোনা বিশেষজ্ঞদের খতিয়ে দেখার জন্য আহবান জানিয়েছেন! জাদু করছে, শয়তানে করাইছে, জীন এসে করাইছে সব বুঝলাম, খালি বুঝলাম না এতে টেনে কেন ইসকনকে আনা হল!
যে কোন সাধারণ বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এরপরে কী করবে? প্রতিবাদ মিছিল টিছিল যে আয়োজন করা হয়েছিল তা বাতিল করবে, তাই না? না। এইটা বাংলাদেশ। এখানে এমন কিছু হয় যা দুনিয়ার আর কোথাও হয় না। এমন একটা মিথ্যাচারের পরেও বিক্ষোভ মিছিল হল। প্রতিবাদ সমাবেশ হল। যুক্তি কী? যুক্তি হচ্ছে এগুলা পুলিশ জোর করে বলিয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ? এগুলা এখন বানানো ওয়ান টুর ব্যাপার! একটা পোস্ট দেখলাম আরও একটু এগিয়ে বলছে যে এই কাফিরদের দ্বারা সব সম্ভব। এরা এমন নানা তথ্য উপাত্ত দেখিয়ে এর আগে মাওলানা নিজামি, মুজাহিদদের ফাঁসি দেয় নাই? এরাও একই সব! হইল না কাণ্ড একটা?
দাবী একটাই দেশে ইসকন নিষিদ্ধ করতে হবে। আমি এই সরকারের কোমরের জোরের কথা বুঝানোর জন্য সব সময় বলি কাঠ মোল্লাদের ভয়ে যে সরকার একজন নিরীহ মানুষ চিন্ময় দাসকে মুক্তি দিতে পারে সে আর কী করতে পারবে? মাথা ভর্তি গু নিয়ে চিংড়ি মাছের সরকার!
কলেজে যখন পড়ি তখন পড়ছিলাম সুনীল গাঙ্গুলির বিখ্যাত উপন্যাস পূর্ব পশ্চিম। সেখানেই পড়ি প্রথম ইসকনের নাম। প্রভুপাদর কষ্টকর জীবন, কষ্ট করে কোন মার্কিন মুল্লুকে ইসকনের মত একটা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, এগুলা পড়েছিলাম। তখন আমি আমার আশেপাশে ইসকনের লোকজন কাওকে দেখি নাই। আমি ভাবছি দেখি নাই কিন্তু আসলে দেখছি। এইটা বহু পরে জানতে পারছি। এরপরে বহু পরে সিলেট গিয়েছি ঘুরতে। আমরা তিন বন্ধু মিলে। সেখানে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে পরে আমাদের একজনের খালাত ভাই আবার আমাদের সবারই বন্ধু। ওর সাথে দেখা হলে ও বলল যে ওরা ছাত্ররা প্রায়ই সুযোগ পেলে ইসকনের মন্দিরে খাইতে যায়! কেন? সস্তায় ভালো খাবার দেয়, আর কী কারণ লাগে? বলল সমস্যা একটা হচ্ছে প্রভু বলে ডাকতে হয়। আরে সস্তায় ভালো খাবার দিলে প্রভু ডাকতে সমস্যা কই? কোন সমস্যা নাই!
এরপরে আবার কবে জানি না। আমার মেজোবোনের বাড়ির কাছে প্রাচীন একটা মন্দির আছে, সেটা ইসকনের তত্ত্বাবধায়নে চলে গেল। খুব প্রাচীন এই মন্দিরটা। আখড়াবাড়ি মন্দির বলতাম আমরা। ইসকনের অনেক টাকা, এইটা আমরা জানতাম। এবার চাক্ষুষ হতে থাকল। মন্দিরের চেহারা বদলে যেতে থাকল। দারুণ বিশাল একটা শক্তিশালী গেট বানানো হল। যা এখন খুব কাজে লাগছে! পরে আমরাও প্রভু বলে সিঙ্গারা খাওয়া শুরু করলাম। তারাও প্রভু ডাকে। আমরা সময় সুযোগ পেলেই সন্ধ্যায় লুচি আলুর দম খেতে যাই।
এই যে এতদিনের জানাশোনা, ধরে ধরে হিন্দু বানিয়ে ফেলছে এই খবর কোনদিন শুনলাম না কেন? যারা মাথায় টুপি দিয়ে চিল্লাফাল্লা করছে তাদেরকে হিন্দু বানানোর চেষ্টা করল আর আমরা যারা সুযোগ পাইলেই মন্দিরে গিয়ে বসে থাকি তাদেরকে আজ পর্যন্ত একটু চেষ্টাও করল না? তারা তো বিলক্ষণ জানত আমরা হিন্দু না। তবে? কিছুদিন শুক্রবার করে গুড়ের জিলাপি ভাজত, জুম্মা পড়ে তো টুপি পরেই জিলাপি কিনতে চলে গেছি, তো? ভেজালটা কই? এই জন্যই মোবাইলের দোকানে ফিক করে হেসে দিয়েছিলাম।
ইসকন আমার কাছে মুসলিমদের তাবলীগ, খ্রিস্টানদের মিশন চালানোর মতই মনে হয়। সবাই যার যার ধর্ম প্রচার করার চেষ্টা করছে। এতে দোষ আছে? থাকলে সবারই আছে। আর না হলে কারোরই নাই। অনেকেই এইভাবে ধর্ম প্রচারকে খারাপ চোখে দেখে। মিশনারিদের দেখতেই পারে না অনেকে। আমি তেমন মনে করি না। আরে ধর্ম ধুয়ে পানি খাবে? কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে কেউ পা ফেলে না সেখানে যদি কেউ চিকিৎসা শিক্ষা নিয়ে হাজির হয় আর তাতে প্রভাবিত হয়ে যদি কেউ ধর্ম ত্যাগ করে তাহলে বেশ করে। মিশনারিরা খুব ভালো করছে। ইসকনেরও তেমনই চেষ্টা আছে, হয়ত ওই পর্যায়ে যেতে পারে নাই। অন্যদিকে এই মুল্লুকে আমাদের সংখ্যাধিক্য এই জোর ছাড়া আর কিছুই নাই তাও সবাইকে এই লাইনেই থাকতে হবে বলে গলা ফাটালে কাজ হবে? কাজের জবাব কাজ দিয়া দেও না। খালি এখানে আমি সংখ্যায় বেশি বলে যদি জোর করি তাহলে এই পর্যন্তই, সবাই যদি সংখ্যা গোনা শুরু করে তাহলে কই যাবেন? এই খেলা শেষ হবে কই গিয়ে? ভালো কাজের প্রতিযোগিতা হোক, মানুষ তখন এমনেই বাপ দাদার ধর্মে পড়ে থাকবে। কিন্তু ভয় যদি একমাত্র অস্ত্র হয় তাহলে মানুষের জন্য শুধু বিপদই।
দশম শতকের দিকে ইরানে সুফিবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। শিয়া সুন্নি বিতর্কের মধ্যে এরা আরেক নতুন মতবাদ হাজির করল। তারা প্রচলিত পথে না হেঁটে দাবি করল শুধু ভালোবাসা দিয়েও ঈশ্বরের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এইটা যথারীতি গোঁড়া মুসলিমদের পছন্দ হল না। সুফিরা প্রচলিত ধর্মীয় রীতিনীতিকে প্রত্যাখ্যান করল। আর তাঁদেরকে প্রত্যাখ্যান করল প্রচলিত ধার্মিকেরা। এই বিতর্ক আজও বিদ্যমান। শরিয়ত আর মারেফতের দ্বন্দ্ব চলমান এখন পর্যন্ত।
তুর্কিরা ভারতবর্ষে আসার পরে সুফিবাদ ভারতে আসে। আর ভারত হচ্ছে আগে থেকেই ধ্যান, ভক্তির তীর্থভূমি। এখানে এসে সুফিবাদ পেল নতুন দিশা। এখানে আগে থেকেই নির্জনে কেউ না কেউ ধ্যান করে, কেউ না কেউ বনে বাস করে এবং কেউ কিছুই মনে করে না। এই বিশাল জনগোষ্ঠী সাদরে গ্রহণ করল সুফিবাদকে। তিনি একজন ধ্যানী মানুষ, এই পরিচয়ই যথেষ্ট হয়ে গেল। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সবাই তাঁকে মানতে লাগল। যা এখন পর্যন্ত সুফিবাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
নানা মানুষ আকৃষ্ট হল। নানা নতুন চিন্তার জন্ম নিলো। কবির নামের একজন দুই লাইনের দোহা লিখত। দুই লাইনেই গভীর চিন্তা প্রকাশ পেত। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। এই কবির সরাসরি সুফিবাদের স্পর্শে এসেছিলেন। ঈশ্বর নিয়ে চিন্তা ভাবনা তাঁকে আধ্যাত্মিক মর্যাদা এনে দেয়। পরবর্তীতে কবিরপন্থিরা হিন্দু ধর্মের সাথে মিলে গেলেও এখন পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে কবির নামটা জনপ্রিয়।
এমনই আরেকজন নানক। তিনি সংসার ছেড়ে সুফিদের সাথে যোগ দেন। বলা হয় তিনি মক্কা থেকেও ঘুরে আসেন। এরপরেই জন্ম নেয় নতুন এক মতবাদ। শিখ ধর্মের আবির্ভাব। যা ভক্তিবাদের সাথে যুক্ত। সরাসরি সুফিবাদের প্রতি ঋণী।
মধ্যযুগে যতগুলো ভক্তিবাদ এসেছে তারা সবাই সুফিবাদের প্রতি ঋণী। এখন হচ্ছে যে কারণে এই লেখার প্রচেষ্টা সেই গল্প। শ্রীচৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করে গেছেন। কৃষ্ণপ্রেম প্রচার করে গেছেন। শ্রীচৈতন্য যখন তাঁর ভক্তিবাদ প্রচার করছেন তখন বাংলায় জোরেশোরে সুফিবাদ এসে গেছে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেবও সুফিবাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। বৈষ্ণবদের মধ্যে যে আধ্যাত্মিকতা দেখা যায় তার সাথে সুফিবাদের আধ্যাত্মিকতার মিল রয়েছে।
এবার আসি আরও একটু ভিতরে। যার জন্য রচনা লেখা! আগেই লিখেছি আমি যখন কলেজে পড়ি তখন পূর্ব পশ্চিম পড়েছিলাম। সেখানে পড়েছিলাম এক অদ্ভুত লোকের কথা। নাম স্বামী প্রভুপাদ। তিনি সুদূর মার্কিন মুল্লুকে কৃষ্ণপ্রেম ছড়িয়ে দিয়ে চান। চেষ্টা কষ্টকর ছিল। সেই কষ্টকর চেষ্টাই অবিশ্বাস্য কাণ্ড করল। ধীরেধীরে জন্ম নিলো আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইংরেজিতে International Society for Krishna Consciousness, ইসকন। ইসকনের মূল্যেও সেই বৈষ্ণবদের আধ্যাত্মিকতাই। সেই ভক্তি, প্রেম যা দিয়ে ঈশ্বরের খোঁজ পাওয়া যায়। যার সাথে পারস্য দেশে জন্ম নেওয়া সুফিবাদের সাথে দারুণ মিল!
যা বলার চেষ্টা করছি তা হচ্ছে আপনাদের সমস্যাটা কই? ইসকনকে তার মত করে চলতে দিলে সমস্যাটা কই? তারা ধরে ধরে জোর করে মানুষকে হিন্দু বানায় দিচ্ছে এমন আজগুবি আলাপ কইরেন না। এই আলাপ ওই পাশে কিছু ছাগল করে, তারা দাবি করে মুসলিমরা ধরে ধরে প্রেমের ফাঁদে ফেলে সব হিন্দুকে মুসলিম বানায় ফেলতেছে। আর এখানে আবার সেই গল্প, চরিত্র উল্টে গেছে শুধু! হিন্দু ধর্ম যদি তাঁরা প্রচার করতে চায় আপনে বাধা দিবেন? বহু বছর ধরে খ্রিস্টান মিশনারিরা এই কাজ করে চলছে। বাধা দিবেন কী দিয়ে? সংখ্যাধিক্য আছে আপনার এই হুমকি দিয়ে? মিথ্যা অপবাদ দিয়ে? ভক্তির মোকাবেলা করতে হবে ভক্তি দিয়ে। আপনে সারাদিন দাঁত খিঁচবেন আর কেউ ধর্ম ত্যাগ করলে কল্লা নিবেন? এইভাবে ইসলাম এই পর্যন্ত আসছে? আমাদেরও একটা সংগঠন আছে না ধর্ম প্রচারের জন্য? এইটার বয়সও অনেক। এখন দুই পক্ষ মারামারি করে মানুষ মেরে ফেলছে, রক্তারক্তি কাণ্ড! এই দায় কার? প্রেম কই? ভক্তি কই?
আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর সূত্র একটাই। শান্তিতে থাকা। শর্ত একটাই আপনার শান্তি যেন অন্যের অশান্তি না হয়ে যায়। ব্যাস, এখন আপনি যা ইচ্ছা করেন আর শান্তিতে থাকেন। একটাই জীবন, যতভাবে শান্তিতে থাকা যায় সেই চেষ্টাই হওয়া উচিত প্রধান চেষ্টা। শুধু শর্তটা মনে রাখলেই চলবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।