এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অপর বাংলা

  • তোমাদের যা বলার ছিল, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?

    বিপ্লব রহমান লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৫ বার পঠিত

  • "প্রজন্ম ‘৭১" নামক শহীদ পরিবারের সন্তানদের সংগঠনের সাইদুর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ১৯৯২ – ৯৩ সালের দিকে। তখনও ঢাকার রায়ের বাজারে বধ্যভূমিতে বর্তমান শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধটি গড়ে ওঠেনি। তবে সে সময় প্রজন্ম ‘৭১ নিজ উদ্যোগে একটি ছোট্ট স্মৃতিসৌধ গড়ে সেখানেই প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আসছিল। তখন সরকারগুলোর কাছে এ নিয়ে তারা অনেক ধর্ণা দিয়েও তারা কিছু করতে পারেনি।

    সে সময় ‘সাপ্তাহিক খবরের কাগজ’ এ অরক্ষিত রায়ের বাজার বধ্যভূমির ওপর একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করার জন্য আমি শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারগুলোর সঙ্গে একে একে দেখা করে সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করি।



     সে সময় সাইদুর রহমানের সঙ্গে আমার কথা হয় তার তখনকার কর্মস্থল মতিঝিলের একটি ব্যাংকের সদর দপ্তরে। তিনি বলছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা।

    তখন তিনি পাঁচ-ছয় বছরের শিশু। বৃহত্তর রংপুরের সৈয়দপুরে যৌথ পরিবারের আদরে আনন্দময় শৈশব জীবন কাটছে তার। ‘৭১ এর উত্থাল দিনগুলোতে বিহারি (১৯৪৭ এ দেশবিভাগের সময় ভারতের বিহার থেকে এপারে স্থানান্তরিত উর্দুভাষী পাকিস্তানিরা কথ্য ভাষায় 'বিহারি' নামে পরিচিত) রাজাকাররা 
    মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত তাদের বাড়ি আক্রমণ করে বসে।

    বাড়ির বড়রা শিশু সাইদুরকে একটি বড় ঘরে খাটের নীচে হাঁড়িকুড়ির পেছনে লুকিয়ে রাখেন।

    তারপরেই ঘটে যায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি!

    রাজাকাররা ওই ঘরে সাইদুরের মা-বাবা, অন্যান্য ভাই-বোন, আত্নীয় – স্বজন সবাইকে ধরে এনে কসাইয়ের মতো জান্তব উল্লাসে রাম দা দিয়ে একে একে কুপিয়ে হত্যা করে!

    আর এ সবই ঘটে যায় শিশুটির চোখের সামনে। জীবনের ভয়ে ছোট্ট সাইদুর টুঁ শব্দটি করার সাহসও পায়নি।



    এর পর বহুবছর ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফেরে। বেশ কিছুদিন শিশুটি মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগেছে। এখনো স্বজনের আর্তনাদ তাকে আর ১০টা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দেয় না।…

    ব্যাংকার সাইদুর রহমান যখন তার এই দুঃসহ স্মৃতিকথা আমাকে বলছিলেন, তখন বার বার গভীর বেদনায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল তার মুখ, ভেঙেচুরে যাচ্ছিল তার কন্ঠস্বর!

    কথা বলতে বলতে তিনি বলপয়েন্ট দিয়ে নিউজপ্রিন্টের একটি প্যাডের পাতায় কাটাকুটি করে কি যেনো একটি কথা বারবার লিখছিলেন।

    সাক্ষাৎকার শেষে তার অনুমতি নিয়ে আমি নিউজপ্রিন্টের ওই কাগজটি চেয়ে নেই। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, অনেক কাটাকুটির ভেতর ঝকঝকে হরফে তিনি একটি কথাই বারবার লিখেছেন:

    'তোমাদের যা বলার ছিল, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?
    তোমাদের যা বলার ছিল, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?
    তোমাদের যা বলার ছিল, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?'

    শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজের ওই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের ভেতর স্ক্যান করে সাইদুর রহমানের হাতে লেখা নিউজপ্রিন্টের টুকরো অংশটিও তুলে দেওয়া হয়। লেখাটির শিরোনামও দেই:

    'তোমাদের যা বলার ছিল, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?'

    প্রতিবেদনটিতে সরকারি উদ্যোগে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধ গড়ার জন্য শহীদ পরিবারগুলোর আকুতি তুলে ধরা হয়। পরে প্রজন্ম ‘৭১ এই লেখার শিরোনাম নিয়ে একটি পোস্টারও প্রকাশ করে।



    এরপর বিএনপি সরকার বদ্ধভূমিতে স্মৃতিসৌধ স্থাপনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করলেও এর নথি আর উর্ধ্ব দিকে ধাবিত হয় না। সাইদুর রহমানসহ প্রজন্ম ‘৭১ এর সদস্যরা সরকারি উচ্চ মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। তবু কিছুতেই কিছু হয় না। একটি একটি করে বছর গড়ায়।

    প্রজন্ম ‘৭১ এর নিজেদের গড়া ছোট্ট স্মৃতি সৌধটি প্রতি বছর ভেঙে পড়ে। প্রতি বছর পিলার আকৃতির ওই সৌধটি ১৪ ডিসেম্বরের আগে আবার গড়া হয়। আবারও দিন যায়।

    শেষে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে স্মৃতি সৌধের সরকারি প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখে। তৈরি হয় বর্তমান নান্দনিক স্মৃতি সৌধ কমপ্লেক্স।



    'সাপ্তাহিক খবরের কাগজের' ওই প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লেখার পর বহু বছর সাইদুর রহমানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই।…

    ২০০০ সালের দিকে একুশে টেলিভিশনের (ইটিভি) কারওয়ান বাজারের ভবনে কি একটা কাজে বিখ্যাত সাংবাদিক সায়মন ড্রিং এর কাছে গিয়েছি। লিফটের ভেতর এক অচেনা ব্যক্তি আমার নাম ধরে ডাকেন। লোকটিকে আমার খুব চেনা চেনা মনে হলেও আমি তাকে পুরোপুরি চিনে উঠতে পারি না। তখন তিনি নিজের নাম বলতেই হঠাৎ এক নিমিষে আমার মনে পড়ে যায় সব।

    সাইদ ভাই তখন ইটিভিতে সংবাদ পাঠক হিসেবে খণ্ডকালীন কাজে যোগ দিয়েছেন। ইটিভি বন্ধ হওয়ার পর তিনি চ্যানেল আই এ সংবাদ পাঠ করতে থাকেন।

    এর পর বহুদিন প্রায় রাতে চ্যানেল আই সংবাদ দেখতে বসলে আমি তাকে খবর পড়তে দেখি। মাঝে চ্যানেল আই টক-শোতে কয়েকবার অংশ নিয়েছি। প্রতিবার কাজ শেষে সাইদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছি।

    নতুন করে শুরু হওয়া ইটিভির একটি অনুষ্ঠানে বছর ১৫ আগে আবারো দেখি তাকে। সেদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে একটি টক-শোতে সরাসরি প্লাজমা টিভিতে স্টুডিওতে হাজির সাইদুর রহমান।

    তিনি খুব স্পষ্ট গলায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে বললেন:

    যতদিন এই বিচার না হবে, ততদিন অন্তত আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতেই থাকব। … এমন কি মৃত্যূর সময় শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে যদি একটি মাত্র মুহূর্ত পাই, তখনও এ দেশের মানুষের কাছে বলব, আমি এর বিচার চাই!…



    এরপর ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ গণজাগরণ, গোলাম আজম, কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিজামী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের কারাদণ্ড ও ফাঁসি কার্যকর, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্রমেই ক্ষমতার লোভে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার হয়ে ওঠা, ২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা জামানার পতন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ, জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ  থেকে খালাস, ইউনূস জামানায়  জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য তাণ্ডব, এর সহযোগি ছাত্র শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস, মুক্তিযুদ্ধের স্মারকগুলোকে মব জাস্টিসের নামে ধ্বংস করা ইত্যাদি চলছেই। 

    এরপরেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শুভ শক্তি সোচ্চার রয়েছে। কারণ মোটা দাগে ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধই বাংলাদেশের ইতিহাস; মুক্তিযুদ্ধ কোনভাবেই আওয়ামী লীগের এজমালি সম্পদ নয়।
     
    কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলতে মরিয়া রাজাকার বাহিনী জানে না, ইতিহাসকে বিকৃত করা যায়, কিন্তু  কখনোই মুছে ফেলা যায় না-- এটিই ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম। 
    আর মুক্তিযুদ্ধের শেষ নাই। 

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অপর বাংলা | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৫ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    পত্তাদকাল - %%
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন