বছর পাঁচেক আগে শান্তিনিকেতন রেলওয়ের ক্যান্টিনে নিরামিষ খেয়ে প্রশংসা করে বলা হয়েছিল, 'ভাই, দারুণ "মজা" হইছে!'
ক্যান্টিন বয় অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। পরে বললো, 'নিরামিষ আবার "মজা" হয় কি করে?'
তাকে বুঝিয়ে বলতে হলো, এখনে 'মজা' সুস্বাদু অর্থে। মোটেই 'পুকুরটি "মজে" গেছে', বা 'কলাটি "মজে'' গেছে' এরকম সাধারণভাবে-- নষ্ট হয়ে গেছে-- অর্থে নয়।
আবার লোকগানে, 'আমার মন "মজাইয়ারে" দিল "মজাইয়া", মুর্শিদ নিজের দেশে যাও', বা 'ঘুম ভেঙে খুব "মজা" হয়েছে/এঁড়ে গরু বেড়া ভেঙে খেজুর গাছে চড়েছে'...
'মজা' কথাটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। প্রথমটিতে 'বশ' এবং দ্বিতীয়টিতে 'আনন্দ' অর্থ বোঝাচ্ছে।
অথচ "মজা" কথাটি ওপারে স্বল্প পরিসরে ব্যবহৃত, তার ব্যবহারিক সীমানা খুব বেশি নয়।
এই হচ্ছে বাংলা ভাষার যাদু বাস্তবতা।
৩
এপারে 'বাসা' বলতে অস্থায়ী নিবাস, শহরের ভাড়া বাসা ইত্যাদি বোঝানো হয়। আর গ্রামের পৈতৃক ভিটা, স্থায়ী ঠিকানাকে বলা হয় 'বাড়ি'।
জালালউদ্দিন খাঁর লোকগানে আব্দুল আলিমের কণ্ঠে যেমন বলা হয়েছে, 'সেই পারে তোর "বসত-বাড়ি", এ পারে তোর "বাসা"...।
অথচ কলকাতাসহ ওপারে সর্বত্র শোনা হয়েছে শুধু 'বাড়ি' কথাটি, সেখানে 'বাসা'র তেমন কদর নেই। অবশ্য এপারে দেওয়ালে দেওয়ালে 'টু-লেট' বিজ্ঞাপনে 'বাড়ি ভাড়া'ই লেখা হয় কেন, কে জানে?
আরও যাদু ও বাস্তবতা আছে।
আবার 'উদয়ের পথে" নামক ১৯৪৪ সালের পুরনো বাংলা ছবিতে দেখেছি 'বাটী ভাড়া'!
এপারে ২০কে অহরহ 'বিশ' বলা হয়, যেমন, বিশ টাকা-- ইত্যা দি। কলকাতার বাংলায় 'বিশ' যেন 'বিষবৎ', ওপার বাংলায় ২০ মানে 'কুড়ি', এর বাইরে কেউ কখন দুই দশের বাইরে ভাবতে পেরেছেন কি?
৪
মহামারী যুগের আগে ২০১৭ সালে এপারে প্রথম ওটিটি 'বায়স্কোপে' বিস্তর ডেটা খরচ করে দেখা হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের 'শেয়াল দেবতা রহস্য' গল্প অবলম্বনে ঢাকায় ফেলুদার অভিযান।
বিবিসির আধুনিক শার্লক হোমসের মতো এই খানে ফেলুদা চরিত্রে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ডিজিটাল, আর তোপসে চরিত্র ঋদ্ধি সেন যেন ডাবল ডিজিটাল।
এরপরেও ফেলুদা ঢাকার আদি জ্ঞানে ফেল মেরে তোপসেকে বলেন, ঢাকায় নাকি সিঙ্গারাকে 'সামুচা' বলে!
আর পুরো সিনেমা ঢাকাইয়া ফ্লেভার দিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদি ঢাকাইয়া ভাষার প্রক্সি সংলাপের বিষয় না হয় উহ্যই থাক।
এবার একে ভাষার যাদু বললে কম বলা হয়, বলতে হবে, বাংলা ভাষার ভেল্কি!
এবার সাম্প্রতিক ছবির প্রসঙ্গ।
'একেন বাবু ও ঢাকা রহস্য' সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে একটি দৃশ্যে ঢাকা মহানগরী ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অনিবার্ন চক্রবর্তীকে অনেকটা এরকম বলতে শোনা যায়, 'এখানে (ঢাকায়) "প্যারা" কোনো মিষ্টি নয়, নানা ঝুট-ঝামেলাকে এখানে "প্যারা" বলা হয়'...।
মানে, অঞ্চল ভেদে শব্দের অর্থটাই বদলে গেছে।
৫
কিছুদিন আগেই কোরবানি ঈদের সময় পশুর হাটের নানান ব্যানারে ছেয়ে গেল মেগাসিটি ঢাকা। আর ডিজিটাল পোস্টারে ফেসবুক।
বিস্ময়ের সাথে দেখা গেল, আশৈশব দেখা 'বিরাট গরু-ছাগলের হাট' কথাটিকে যান্ত্রিকভাবে 'শুদ্ধ' করে এখন লেখা হচ্ছে, 'গরু-ছাগলের বিরাট হাট!' অথচ প্রচলিত প্রথম কথাটি মোটেই ভুল নয়।
এ যেন, রাখলাম রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল!
প্রায় চার দশক পেরিয়ে মনে পড়ছে ঢাকা সিটি কলেজের বাংলার ক্লাস। খ্যাতিমান অধ্যাপক নরেন বিশ্বাসকে দেওয়া হয়েছিল 'বিরাট গরু-ছাগলের হাট'-এর সমাধান।
নারকেল মাথার ছাত্রদের সেদিন তিনি সহজ কথায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এটি প্রচলিত বলে একে 'শুদ্ধ' করার দরকার নেই। এখানে 'বিরাট' কথাটির সাথে 'হাট' কথাটি অদৃশ্য ব্রিজে সংযুক্ত।
ঠিক যেমন, 'উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়' কথাটিতে মোটেই 'বালিকা উচ্চ' নয়। এখানে 'উচ্চ' কথাটির সাথে 'বিদ্যালয়' কথাটি ব্রিজ তৈরি করে সংযুক্ত।
আবার যেমন, 'খাঁটি গরুর দুধ' ইত্যাদি। এসবই শুদ্ধ বাংলা।
এরকম আরও অজস্র আছে, বলে বোধহয় শেষ হবে না!
এসবই হচ্ছে বাংলা ভাষার যাদু বাস্তবতা, একই সঙ্গে মাধুর্য।