এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অপর বাংলা

  • লড়াই আসলে মৌলবাদী আর মুক্তমনার

    প্রবুদ্ধ বাগচী লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ঢাকার বিশ্বখ্যাত নাগরিক অশোক মিত্র মশাই (খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও পশ্চিমবঙ্গের একদা অর্থমন্ত্রী) লিখেছিলেন – দেশভাগের পরে বাংলার আকর সত্তা ও সংস্কৃতির বেশিটাই পড়েছে পুবভাগে। শস্যশ্যামল নদীঘেরা যে বাংলার ছায়া আমাদের সাহিত্যে ধরা দেয়, তার বেশিটাই পুবের। তার একটা বড় কারণ, বাংলার লিখিত সাহিত্যে উত্তর বাংলা বা রাঢ় বাংলা কিংবা জনজাতি ঘেরা জঙ্গলমহলের প্রতিনিধিত্ব প্রায় শূন্য। ফলে রবীন্দ্রনাথ যে ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ দেখেন বা জীবনানন্দ দেখেন রূপসী বাংলা কিংবা জসীমুদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ আসলে আজকের হিসাবে ওপার বাংলারই মানচিত্র। ইতিহাস বলে, এই তথাকথিত পুববাংলার মানুষ মূলত কৃষিজীবী, শান্তিপ্রিয় এবং মোটের উপর সাম্প্রদায়িকতার কলুষমুক্ত, যতদিন না তাঁদের বাইরে থেকে উস্কানি দিয়ে হিংসার চাষবাস শেখানো হয়। ব্রিটিশ আমলে বাংলার পশ্চিম অংশে সাম্প্রদায়িক হানাহানির খবর পাওয়া যায়, পূর্বে নয়। বরং বাংলার যে বারো ভুঁইয়া বছরের পর বছর মোগল হানা আটকে দিয়েছিলেন, তাঁদের দশজনই ধর্মে মুসলমান। সুদূর চট্টগ্রামের আরাকান রাজসভার দৌলত কাজী বা সৈয়দ আলাওলরা বাংলায় কাব্য রচনা করেছেন। আলি রেজা, শেখ কবির লিখেছেন বৈষ্ণব পদাবলী, মুসলমান কবিরা অনুবাদ করেছেন রামায়ণ, মহাভারত। কিছুতে কিছু আটকায়নি, সাহিত্যের তুলসীতলা অশুদ্ধ হয়নি।
    আর রাজধানী কলকাতা হওয়ার সুবাদে পুববাংলায় জন্মানো বাঙালিরাই এদিকে এসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের নাম উজ্জ্বল করেছেন গত ২০০ বছরে। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন থেকে পরিচালক মৃণাল সেন; জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ; অমর্ত্য সেন থেকে জ্যোতি বসু; শচীন কত্তা থেকে জর্জ বিশ্বাস। এরকম এক অভিন্ন সাংস্কৃতিক বোধ ও মায়া জড়াজড়ি করে আছে দুই বাংলায়। সম্ভবত এই কারণেই দেশভাগের অব্যবহিত পরে পূর্ব পাকিস্তানে যখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর ইসলামী মৌলবাদের দাপাদাপি শুরু হয়, এপার ওপারের কোনও বাঙালিই স্বস্তিতে থাকতে পারেননি। একথাও হয়ত অনেকে জানেন যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে পুববাংলার বিতাড়িত মুক্তমনা বিদ্বজ্জনদের আশ্রয় দিয়ে ভারত সরকারের কানে ব্যাপারটা তুলে দেওয়ার কাজও প্রথম করেছিলেন পশ্চিমবাংলারই কিছু সমব্যথী মানুষ। তাই আজও বাংলাদেশের সামান্যতম তেতো ঘটনায় বাংলাভাষী আমাদের সত্তা আহত হয় সবথেকে বেশি। কারণ এক হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে ‘বাংলাদেশ’ গঠন ছিল এমন এক দৃষ্টান্ত, যার তুলনা গোটা দুনিয়ায় প্রায় নেই। তাই আজ প্রায় দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ আবার যখন ক্রমশ ইসলামি মৌলবাদীদের মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠছে, তাতে আমাদের মন খারাপ। সম্প্রতি যে কদর্য ঘটনার কলঙ্কে কেঁপে উঠল বাংলাদেশ, তার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাভাষী হিসাবে আমাদের মন সংক্ষুব্ধ ও বিষাদে মলিন।
    আসলে এর সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়েছে আগেই। দেশের সরকারের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিক্ষোভ থেকে যে উত্তেজনার আগুন জ্বলেছিল দেড় বছর আগে, সেই আগুন নিজেদের ল্যাজে নিয়ে ছারখার করতে চাইছিলেন মৌলবাদের নাতিপুতিরা। এই অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম লক্ষ্য হল, যেখানে যত অসাম্প্রদায়িক উদ্যোগ আছে সেগুলোকে আক্রমণ করা এবং তাঁদের পেছনে প্রতিবেশী দেশের ইন্ধন কল্পনায় করে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ খুঁচিয়ে তোলা, বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন চালানো। ঠিক যেমন এদেশে হিন্দুত্বের স্বঘোষিত অভিভাবকদের সহজ কৌশল – প্রতিবেশী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জনমানসে অকারণ উত্তেজনা ছড়ানো এবং পারলে দেশের সব সংখ্যালঘু মানুষকে পিটিয়ে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া। এটা স্বীকার করে নেওয়া ভাল, যে উদ্দীপ্ত আবেগ বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশকে এগিয়ে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দিকে, আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেও তার স্পন্দন রাজনৈতিকভাবে স্তিমিত হয়ে আসে খুব দ্রুতই। গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির মধ্যে বিভাজন এবং তলায় তলায় বয়ে চলা মৌলবাদের স্রোত কখনো বাংলাদেশকে এনে ফেলেছে সামরিক শাসনে, কখনো সম্মিলিত মৌলবাদী আগ্রাসনে। কিন্তু এই রাষ্ট্রনৈতিক জোয়ার-ভাঁটা এড়িয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির একটা বিপুল উদ্ভাসিত মঞ্চ তৈরি হয়েছে এবং জাগরূক থেকেছে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মন ও মননে। বাংলা ভাষাকে বৃহত্তর দুনিয়ার মানচিত্রে হাজির করার গৌরব শুধুমাত্র তাঁদের, এপারের বাঙালির নয়। আমরা সেই আলোর দীপ্তিতে খুঁজে নিয়েছি ভাষাগত ভ্রাতৃত্ব। তাই আজ বাংলাদেশের বুকে যে নিষ্ঠুর ও ঘৃণ্য হানাহানির বিষ ছড়িয়েছে, তাতে আমাদেরও আশঙ্কিত ও উত্তেজিত হওয়ার সঙ্গত কারণ আছে। বাংলা ভাষা কারও বাবার সম্পত্তি নয়। বাংলার সংস্কৃতির কোনো সীমান্ত নেই। উগ্র মৌলবাদীদের আসলে কোনো দেশ হয় না।
    এখন কথাটা হল, বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর এই উন্মত্ততার কারণ কী? সোজা কথা – আসন্ন নির্বাচনকে বানচাল করা অত্যন্ত জরুরি। গত ১৮ মাসে দেশের তদারকি প্রশাসন যতই তাঁদের মাথায় করে রাখুক, সত্যি সত্যি নির্বাচন হলে জামাতিদের কপালে ক্ষমতার শিকে ছেঁড়া খুব কঠিন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনায় অতি উত্তেজিত এপার বাংলার যেসব মানুষ গোটা বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষকে সাম্প্রদায়িক অভিধায় দেগে দিতে চান ও উদ্বাহু হয়ে ফেসবুকে ঘৃণা বুকনি ঝাড়েন, তাঁদের হয়ত জানা নেই (অথবা জেনেশুনেও বলেন না) যে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ভোটে নানা চেহারায় জামাতিরা অংশ নিলেও আজ অবধি ৫-৬ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। কারণ স্বভাব ও চেতনাগতভাবে ওদেশের মানুষ জামাতিদের সঙ্গী নন। তাই নির্বাচনে সুবিধা হবে না – এমন বিপদের গন্ধ পেয়েই তারা মরিয়া, একটা এসপার ওসপার করতে চায়।
    জামাতিরা যে ভাষা ও গোঁড়া সংস্কৃতির পক্ষে সওয়াল করে, যেভাবে তারা রবীন্দ্রনাথসহ বাংলাভাষী স্রষ্টাদের অসম্মান করে, তাঁদের সাহিত্য ও গানকে অস্বীকার করে, ভারতীয় মনীষীদের মূর্তি ভাঙে, ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন – তা সাধারণ বাংলাদেশির উচ্চারণ নয়। কেননা তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় জানেন, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মহতী স্রোতে তাঁরা সামিল হতে পেরেছেন এক বুক রক্ত দিয়ে। বরং জামাতিদের সঙ্গে খুব বেশি মিল ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের, যারা মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা গাওয়া যাবে না বলে ফতোয়া জারি করেছে এবং প্রকাশ্যে গাওয়ার জন্যে দেশদ্রোহের অভিযোগ এনেছে আসামের এক কংগ্রেস নেতার বিরুদ্ধে। এদেরই কেউ কেউ কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে শিরোনামে এসেছিল, কেউ আবার সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রকে পাড়াতুতো দাদার স্তরে নামিয়ে এনে বাংলা ভাষা বিষয়ে নিরেট অজ্ঞতা প্রকাশ করে ফেলেছেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ বোঝেন, উর্দু-আশ্রিত ভাষা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ লড়াই তাঁদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ ও পাথেয়। এখান থেকে মুষ্টিমেয় জামাতি তাঁদের ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিতে পারবে না। তাঁরা ভুলে যাননি, মুক্তিযুদ্ধে যে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিলেন, আর তাঁদের যারা মেরেছিল, উভয়েই ধর্মে মুসলমান। দুই লাখ বাঙালি মুসলমান নারীর সম্ভ্রম যারা কেড়ে নিয়েছিল, তারাও ‘আল্লার অনুগত সেবক’। তাহলে? ভাষা না ধর্ম? ধর্ম না ক্ষমতার সখ্য? কোনটা বিবেচ্য?
    এই গ্রস্ত সময়ে বাংলাদেশে আক্রমণের মূল লক্ষ্য তাই বাংলাভাষী উদারপন্থীরাই। এর সঙ্গে জুড়ে নিতে হবে সহজিয়া সুফি, মাজারপন্থী এবং বাউল-ফকিরদের, যাঁরা শরিয়তে আস্থাশীল নন। কিন্তু তাঁরা বৃহত্তর বাংলা সংস্কৃতির অংশ। আছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও। এর আগে তাঁরা বারবার আক্রান্ত হয়েছেন, আজ তাঁদেরই একজন, দীপু দাস, নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। ধর্মের সেবকরা কী সহজে ঘাতক হতে পারে! মনে পড়ে যায় সিকি শতক আগের এক শীতকালের কথা, যেবার ওড়িশার খ্রিস্টান যাজক গ্রাহাম স্টেইনসকে সপরিবারে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিল ভারতের কিছু গর্বিত হিন্দু। তারপরেও গোমাংস ফ্রিজে রাখার অনুমানে আখলাক আহমেদকে অনায়াসে বাড়িতে ঢুকে খুন করা হয়েছে, সংখ্যালঘু প্রবাসী শ্রমিককে পুড়িয়ে মেরে তার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সোশাল মিডিয়ায়। ঘাতকে ঘাতকে কী আশ্চর্য মিল! একটা ঘৃণ্যতাকে অন্য ঘৃণা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় না ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের মৌলবাদী নৈরাজ্যের ফাঁকতালে এপার বাংলাতেও দিব্যি মুসলমানবিদ্বেষ ও কুটিল সাম্প্রদায়িক চেতনার বাড়বাড়ন্ত হয়েছে।
    আসলে বিপদটা দুই বাংলার অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনা মানুষগুলোর, লড়াইটা মৌলবাদের সঙ্গে সাধারণ শুভবুদ্ধি ও নির্মলতার। এখন কথা হল, জামাতিরা বেছে বেছে দুটো সংবাদপত্র আর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উপর আঘাত করল কেন? এর পিছনে একটা স্পষ্ট নীল নকশার হদিশ পেয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞ মহল। পাকিস্তানের আগ্রাসী ইসলামি ভাষা ও মৌলবাদের দাপট থেকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার যে ধারাবাহিক প্রয়াস, তার প্রথম সারিতে ছিল ওই দুই সংবাদপত্র এবং ছায়ানট বা উদীচীর মত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাস। গত প্রায় একমাস ধরে প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছিল। ছায়ানট ও উদীচীও তাদের ফেসবুক পেজে রাখছিল নানা উদ্দীপনার গান ও আলোচনা। খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশের মৌলবাদীরা আসলে পাকিস্তানের মৌলবীদের বোড়ে, যারা বাংলাদেশে পাকিস্তানবিরোধী চিন্তাস্রোত রুদ্ধ করতে চায়। তাই এদের স্বাভাবিক লক্ষ্য ওই উদার অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনিতেই ডামাডোলের সুযোগে বাংলাদেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকদের বিনা বিচারে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে, নানা সংবাদ প্রকাশ্যে আসছে না। গত কয়েকদিনের তাণ্ডবে হত্যা করা হয়েছে এক সাংবাদিককেও। এপারের হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের সঙ্গে ওপারের জামাতিদের নাকি প্রচণ্ড লড়াই। কিন্তু খেয়াল করতেই হবে – এপারেও গৌরী লঙ্কেশ, গোবিন্দ পানসারে বা এম এম কালবুর্গির মত মুক্তমনাদের নিকেশ করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। অরুন্ধতী রায়কে অনেক জায়গায় ঢুকতে দেয়নি এবং যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি বা জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে অবাধে কুৎসা করেছে। ক্যাম্পাসে হিংসাও চালিয়েছে। পারলে হয়ত পুড়িয়েই দিত।
    কার্যত বাংলাদেশের জামাতি উপদ্রব এখন ওদেশের কুশাসনের উপর চেপে বসতে চাইছে। যে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ লড়াই করে স্বাধীনতা পেয়েছেন, সেই স্বাধীনতার লড়াইয়ে যাঁরা ছিলেন না তাঁরাই এখন গদি দখলে মরিয়া, হিংসার আগুন জ্বালাতে অগ্রণী। এই নৈরাজ্যের আসল শিকার সাধারণ মানুষ। বেশ কিছু পোশাক তৈরির কারখানা বন্ধ, কর্মীরা বেকার। স্কুলে স্কুলে গানের শিক্ষক নিয়োগে বাধা দিচ্ছে জামাতিরা। এমনকি দেশের তিনটে প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যেও তারা কিছুটা প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের অন্ধ মতবাদ প্রচারে নেমেছে।
    এপারে যারা বাংলাদেশের এই ঘটনাবলী দেখিয়ে দেশটা হিন্দুবিরোধী – এই বয়ান নির্মাণে বেপরোয়া, তারা ইচ্ছা করেই খেয়াল করছে না যে ওপারের যাবতীয় হিংসার লক্ষ্য আসলে আক্রান্ত সাধারণ শান্তিপ্রিয় খোলা মনের মানুষ, ধর্মের নিরিখে তাঁদের বেশিরভাগই মুসলমান। প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার কাগজের পরিচালক-সাংবাদিক-সাধারণ কর্মী, ছায়ানট কিংবা উদীচী শিক্ষার্থী – আঁচে প্রথমে পুড়ছেন তাঁরাই। আবার ওঁরাই বুক বেঁধে বিপদের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রকাশ করছেন কাগজ, হাতে হাত ধরে পার হতে চাইছেন বিষের বিষাদসিন্ধু। ছায়ানটকে পুড়ে যেতে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠছে যে শিক্ষার্থী, যে বিএনপি নেতার শিশুকন্যাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে – তারা সবাই ধর্মে মুসলমান, মাতৃভাষা বাংলা। সেই ভাষাতেই সে আর্ত চিৎকারে ফেটে পড়েছে।
    ছায়ানটের প্রবাদমানবী সনজিদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের গানের কণ্ঠরোধের পর্বে বুক চিতিয়ে রমনার মাঠে গান গেয়েছিলেন। তাঁর দুঃসাহস বাংলাদেশের স্পর্ধা। সাদি মহম্মদ মারের সাগর পাড়ি দিয়ে গান গেয়ে চলেন, এই তাঁর সাধনা। আসলে জামাতিদের ভয় আর সংশয় এই প্রতিবাদীদের আগুনকেই। ধর্মাশ্রিত মৌলবাদ আসলে তার নিজের ধর্মের মানুষকেও বাঁচাতে পারে না। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য মুক্ত চেতনার খোলা হাওয়া। হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি – সব মৌলবাদীরই এক নিয়ম। একদিকে মৌলবী ব্রিগেডের অন্ধতা, অন্যদিকে ঝড়ের মুখে পাল ওড়ানো অকুতোভয় জনস্রোত – দেশে দেশে কালে কালে এরাই দুই যুযুধান পক্ষ। কালের যাত্রার ধ্বনি আসলে যুগসঞ্চিত বেদনাকেই ভাষা দিতে চায়। হিংসার অশ্বমেধ আটকে যায় শুভবুদ্ধির বেড়ায়। আশা করি বাংলাদেশ পারবে সেই উগ্রতার মুখে নুড়ো জ্বেলে অগ্নিশুদ্ধ প্রভাতের দিকে এগিয়ে যেতে। আমরা শুনতে পাচ্ছি তাঁদের সেই চলার স্ফূর্তি, তাঁদের ডানার আওয়াজ। দেখতে পাচ্ছি তাঁদের শপথের আলো।

    নাগরিক ডট নেট পোর্টালে প্রকাশিত
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অপর বাংলা | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন