এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  স্মৃতিচারণ  স্মৃতিকথা

  • অঙ্কে যত শূন্য পেলে

    প্রবুদ্ধ বাগচী লেখকের গ্রাহক হোন
    স্মৃতিচারণ | স্মৃতিকথা | ১২ মার্চ ২০২৪ | ৬৯১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • অঙ্কে যত শূন্য পেলে
     
    প্রবুদ্ধ বাগচী 
     
    পর্ব ১০

    গণিতের সঙ্গে আমার শেষ দু’ বছরের সহবাস ছিল আলোয় অন্ধকারে ভরপুর। তবে শুরু করতে হলে অন্ধকার দিয়েই শুরু করা ভাল। চতুর্থ  বছরে আমার সামনে ফেলে দেওয়া হল যে উচ্চতম গণিতের ফর্দ, তা দেখে প্রাথমিকভাবে আমার শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এর আগেই বারে বারে টের পেয়েছি কোন গভীর অধঃপাত থেকে গড়িয়ে এসেছি এই গণিতের দরবারে, অনেক কিছুই বুঝি না, কোনোক্রমে পরীক্ষায় নম্বর পেয়ে উতরে যাই, এই পর্যন্ত। তবু এ যেন গ্রিক পুরাণের  রাজা অয়দিপাউসের মতোই এক নিষ্ঠুর নিয়তি যা কেটে বেরিয়ে আসা প্রায় অসাধ্য। সোফোক্লিসের  ‘রাজা  অয়দিপাউস’-এর শম্ভু মিত্র-কৃত বঙ্গীকরণে আছে সেই অমোঘ নির্দেশ ‘সব কিছু জানতে চেয়ো না’ —- কারণ সব সত্য সহ্য করা যায় না। গণিতের সঙ্গে আমার জীবনযাপনের আড়ালে ছিল সেই গভীর সত্য। সেই সত্য ইঙ্গিত দিচ্ছিল, গণিতের পথে আর এগোনো কার্যত আমার পক্ষে অসম্ভব। বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ই তার বুনিয়াদি ভিত্তির সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে নিউটনের সূত্র আমরা মাধ্যমিক স্তরে পড়ে থাকি, তাই কিন্তু আরও বিস্তারিতভাবে পড়ানো হয় উঁচুস্তরে —--- তার আধুনিক গাণিতিক ব্যাখ্যা, ক্যালকুলাসের মাধ্যমে কীভাবে পৌঁছানো যায় তার অন্দরে সব সমেত। তাই স্থুলে ভুল হলে এক্ষেত্রে সমূহ সর্বনাশ।

           কিন্তু ঘটনাটা হল এখনো এদেশে স্নাতক পেরিয়ে অন্য-কোনো বিষয়ে উত্তর- স্নাতক পড়াশোনা করা যায় না। তাছাড়া স্নাতকস্তর অবধি বিদ্যে না-থাকলে কি আর তার পরের তলার দরজায় কড়া নাড়া যায় ! যদিও ইউরোপের কোনো কোনো দেশে ( যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, জার্মানি ) এবং মার্কিন দেশে এমন কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যাদের বলা হয় বিকল্প বিশ্ববিদ্যালয় (alternative university)  সেখানে প্রথাগত শিক্ষা-পদ্ধতির বাইরে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। এই বিষয়ে লন্ডনের ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্কুল (LIS)-এর নাম উল্লেখযোগ্য —--- ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাকেন্দ্র এখন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দু-ধরনের ডিগ্রিই দেয়। এদের গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি হল বি এ এস সি (Bachelor of Arts and Science) —- কলা ও বিজ্ঞান নিয়ে একইসঙ্গে যে শিক্ষাগ্রহণ করা সম্ভব এদেশে তা ভেবে ওঠাই মুশকিল। অবশ্য আমাদের দেশে ষাটের দশকে মুম্বাইয়ে এলফিনস্টোন কলেজের কিছু অধ্যাপক ও সিনিয়র ছাত্র/ছাত্রীদের উদ্যোগে এরকম একটা ‘বিকল্প বিশ্ববিদ্যালয়’-এর ধারনা নিয়ে কিছু চেষ্টা করা হয়েছিল। যেসব বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছিল না সেগুলো নিয়ে আলাদা করে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছিল আগ্রহী পড়ুয়াদের —- অবশ্য খুব বেশিদিন এই উদ্যোগ স্থায়ী হয়নি (সূত্রঃ ফ্র্যাকচার্ড ফ্রিডম– কোভাড ঘান্দি)।  বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুও অবশ্য মূলত পদার্থবিদ্যার ছাত্র হয়েও জীববিদ্যায় গবেষণা করে খ্যাত হয়েছেন।  বিখ্যাত ঐতিহাসিক ভি ভি কোশাম্বী মূলত গণিতের ছাত্র ছিলেন। সম্প্রতি বাঁকুড়ার এক মাস্টারমশাইয়ের কথা পড়লাম যিনি গণিতের শিক্ষক হয়েও নিজে নিবিড় ইতিহাসের চর্চা করতেন ও তাঁর ছাত্র ছাত্রীদের ইতিহাস পাঠে ও চর্চায় উৎসাহ দিতেন। বিশ্বভারতীর গোড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথও এমন একটা ভাবনা ভেবেছিলেন ও তার কিছু কিছু প্রয়োগও করেছিলেন। আমাদের মনে পড়ে যাবে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক ও গায়ক শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কথা। শৈলজারঞ্জন ছিলেন রসায়নের স্নাতকোত্তর আর বিশ্বভারতীতে তিনি রসায়ন পড়ানোর আমন্ত্রণ নিয়েই গিয়েছিলেন। পরে দিনেন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ করে দেন। বিস্মিত শৈলজারঞ্জন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, গুরুদেব, আমার বিষয়টা তাহলে কী হবে ? কবি কৌতুক করে জবাব দিয়েছিলেন, ধরে নাও মিউজিকাল কেমিস্ট্রি বা কেমিক্যাল মিউজিক ! 
                                                                                                                
           
      আমাদের মতো ঔপনিবেশিক শিক্ষা-ব্যবস্থার কাঠামোয় ডিগ্রি অর্জন ও শিক্ষার মধ্যে একটা ফারাক থেকে যায় এটা সবাই জানেন। কিন্তু উত্তর-স্নাতক স্তরে যদি কেউ কোনো বিষয়কে অধিগম্য না করে তুলতে পারে তাহলে তার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কারণ এর পরের মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে এই ঘাটতি মেটানো মুস্কিল, অন্তত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। বলতে গেলে, আমার ক্ষেত্রেও ঘটল ঠিক একই ব্যাপার। এই বিশেষ কালপর্বে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুন নতুন সহপাঠী/ সহপাঠিনীরা ভরিয়ে তুলছিল আমাদের ক্লাস-ঘর। তাদের ঘিরে বাড়তি কৌতুহলের প্রসঙ্গ ছেড়েই দিলাম, কিন্তু তাদের প্রায় সকলেই যে ক্লাসের পড়া-বুঝে নিতে পারছে এবং বিষয়গুলো আত্মস্থ করতে পারছে —এটা অনুভব ও চাক্ষুষ করার পর আমি যেন আরও হতোদ্যম হয়ে গেলাম। কারণ, ওই উচ্চতর গণিতের প্রায় তিন পোয়াই আমি হজম করতে পারছি না, মেরেকেটে এক পোয়া নিতে পারছি নিজের ভেতর। জানি, সুন্দরীরা এইভাবেই মধুর প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু মাঠে নেমে গোল রক্ষা করতে না পারলে কোথায় পাব আমার দাঁড়াবার জায়গা ? 

          সত্যি বলতে কি নিজের কবরের জন্য সাড়ে তিন হাত জমি পাওয়াও ক্রমশ অসাধ্য হয়ে উঠল আমার কাছে। বিপদ কখনো একা আসে না। তাই এই পর্বেই আমার পারিবারিক দুর্যোগ এমন এক বিপজ্জনক কিনারায় চলে গেল যে সুদীর্ঘকাল ছিটকে গেলাম নৈমিত্তিক ক্লাস থেকে। প্রায় একরকম সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছিলাম পরীক্ষা দিয়ে লোক-হাসানোর কোনও মানে হয় না। ক্লাস করি না, নোট হাতে পাই না আর বিষয়গুলিতে ধাতস্থ হওয়া তো আরও পরের ব্যাপার —- কীভাবে বসব পরীক্ষায় ? কিন্তু নির্বোধদের এই একটা সুবিধে যে দেবদূতরা যেখানে যেতে ভয় পায় তারা সেখানে ঢুকে পড়ে অকুতোভয়। কার্যত হলও তাই। গড়পরতা জ্ঞান-গম্যি ভরসা করে ঢুকেই পড়লাম পরীক্ষার হলে। কিছুটা মুখস্ত, কিছুটা হল ম্যানেজ করে খুব সাফল্যের সঙ্গে কূলে তরী ভেড়ানো যায় না — আমিও পারলাম না। সবাই যাকে ‘ভাল ফল’ বলে তা হওয়া আমার সম্ভব ছিল না। গণিত-সুন্দরী জানত আসলে গোড়া থেকেই আমার প্রেমের ভিতর ছিল নষ্টামি, ফাঁকি আর না-বোঝার হাহাকার —- আস্তে আস্তে তার বাঁধন শিথিল করে দিচ্ছিল সে, জানান দিচ্ছিল আর বেশিদিন আমার প্রশ্রয় পাওয়ার উপায় নেই। তবু আজ এতদিন পরেও, তার কাছে নতজানু আমি, বলতে চাই , সেই উচ্চ-মাধ্যমিকের দিনগুলো থেকেই কিন্তু আমার দুর্বলতার প্রান্তগুলো আমি একটু একটু করে মেরামত করে নিতে চেয়েছি, পারিনি। তাই সব গরলচিহ্ন নিজের শরীরে বহন করেও এটুকু সহানুভবের শরিক কি তুমি হতে পারো না, আজও ? 

           হয়তো সব সম্পর্ক চুকে যাওয়ার আগে আমরা সবাই একবার আলপথে শরীর বিছিয়ে মরিয়া চেষ্টা করি এই বিচ্ছেদকে ঠেকিয়ে দেওয়ার। আরুণি উদ্দালকের মতো ।  আর সেই একটি চাওয়ার ভিতর থেকে  ভোর আলোয় বেজে ওঠে  এক নির্ভার ঘণ্টা-ধ্বনি। শেষ এক আরতির শিখা। নিভে যাওয়ার আগে একবার জ্বলে ওঠা, একবার মাত্র বাগেশ্রীর আলাপ বিস্তারের মধ্যে চাবুকের শপাং শপাং —-- যেমন আমাদের দেখিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক তাঁর ছবিতে। কার্যত, গণিতের সঙ্গে আমার শেষ বছরের দিনলিপি এমনই চড়াই আর উতরাইয়ে বর্ণিল। এই বছরটাতেই সুযোগ আসে নিজের মতো কিছু বিষয় বেছে নেওয়ার, যার পোশাকী নাম স্পেশ্যাল পেপার। এই উদার নির্বাচনের সুযোগে আমি খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম আমার কিছু একান্ত দিগন্ত, কিছু শিরা-উপশিরার লোহিত-স্রোত। অ্যাস্ট্রোনমির সঙ্গে কিছু বোঝাপড়া হয়েছিল আগেই, তাই সুযোগ পেয়েই এর সঙ্গে জড়িয়ে নিলাম কসমোলজি বা ব্রহ্মান্ডবিদ্যা। এর হাত ধরে এল বিশেষ আপেক্ষিকতা, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও সাধারণ আপেক্ষিকতার নতুন এক বিশ্ববীক্ষা। জানতাম না, ঠিক কতটা আর কতটুকু পেরে উঠব। তবু একবার চেষ্টা করে দেখি —--- Let us try to make another world/ Where we live with only love in our hearts (রবার্ট লং) ।  সত্যিই এ এক বিচিত্র পৃথিবী।

          পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা হল একটি বিভাজিকা, যার একদিকে সাবেকি নিউটনীয় ধারণা অন্যদিকে স্পেস-টাইম একাকার করে ফোর্থ ডাইমেনশন বা বস্তুর চতুর্থ মাত্রা নিয়ে বিস্ময়কর সব আবিষ্কার। ভাল লাগতে শুরু করল এর ধারণাগুলো, বুঝতে পারছিলাম এইসব থিওরি জ্ঞানের জগতে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। তার কতটুকুই বা আমি আঁজলা ভরে নিতে পারব ! তবু যখন স্পেশ্যাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির ক্লাস শুরু হল, বুঝলাম এ এক আশ্চর্য জগৎ। সময় নামক মাত্রা কিভাবে দুনিয়ার দেখার চোখই পাল্টে দেয় তা ধরে ফেলেছেন আইনস্টাইন, স্পেস-টাইমের যূথবদ্ধতায় সেই দেখা কেমন হবে ক্যানভাসে তার ছবি এঁকে চলেছেন ওই সঙ্গীতভাবুক মানুষটি।  এরও পরে তিনি ঢুকে পড়বেন সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে, সেটা আরো বড় পরিসর, আরো জটিল তার হিসেব-নিকেশ।  অবশ্য কোয়ান্টাম থিওরিকে না বুঝলে এর কোনোটাই গম্য হয় না —-- আর কোয়ান্টামের জগৎ সেই ‘হ য ব র ল’-র পৃথিবীর মতোই অপার বিস্ময়ের। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ছিল, ‘ মনে করো জুতো হাঁটছে, পা রয়েছে স্থির’ —- এই বাস্তবতা একমাত্র সম্ভব হতে পারে কোয়ান্টাম রাজ্যে। একইভাবে কসমোলজি থেকে জানা যায় ব্রহ্মান্ডের উৎস বিষয়ে নানা মতের খবর, তারাদের গতিবিধি, তাদের জন্ম-মৃত্যুর হদিশ —--- কোন নক্ষত্র বিস্ফোরিত হবে সুপারনোভার বিস্ফোরণে অথবা সঙ্কুচিত হতে হতে হয়ে যাবে ‘শ্বেত বামন’ (white dwarf) এসবের রীতিমতোন হিসেব-নিকেশ বার করে ফেলতে পারেন কসমোলজিস্টরা যার মূল ভরকেন্দ্র গণিত। খুব যে সহজ তা নয়, বেশ কঠিন — আর এর জন্য দরকার হয় নতুন রকমের গাণিতিক বীক্ষা। ‘টেন্সর থিওরি’ বলে একটা ব্যাপারের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় এই সূত্রে, বিশদ বুঝিনি, ওই একটা ভাসা ভাসা ধারণা আর কি —- তবে এই থিওরি না কাজে লাগালে সাধারণ আপেক্ষিকতার অঙ্ক বোঝা যাবে না। সব মিলিয়ে একটা নতুন কিছু। অনেকদিন পর বেশ ভাল লাগছে এইসব। 

        আর, একটা জিনিস ভেবে বেশ শিহরিত হলাম যে কোয়ান্টামের আসল ম্যাজিক কাজ করে  পরমাণুর ক্ষুদ্রতম বাস্তবতার ভিতর, যেখানে প্রতিটি কণার মাপই নিত্যদিনের ইঞ্চি-সেন্টিমিটারের থেকে কয়েক মিলিয়নগুণ ছোট ।   কখনো কণা , কখনো তরঙ্গ এমন একটা মিলমিশের মধ্যেই তার ব্যাপ্তি — আর এগুলোকে চেনা দুনিয়ায় দেখা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের গানের কথায় বললে, ‘কিছু তার বুঝি না বা, কিছু পাই অনুমানে’ —--  সম্পূর্ণ এক অদেখা জগৎ । এও যেন এক নিরাকার বিমূর্ত বিশ্বের আঁকিবুঁকি যাকে শ্রডিংগার নামের এক বিশ্রুত বিজ্ঞানী ধরতে চেয়েছিলেন তাঁর ‘বন্ধ বাক্স ও বেড়াল’ এর সেই সুবিখ্যাত থট এক্সপেরিমেন্টে। আমরা স্মরণ করতেই পারি, বিমূর্ত ও চেতনজগতের এই বিরোধাভাস কিভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল রবীন্দ্রনাথকেও। আইনস্টাইনের সঙ্গে আমাদের কবির সাক্ষাৎকার বিশদে প্রকাশিত হয়েছে মাত্রই কয়েক বছর আগে (বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি খন্ডিত) —-- সেখানে বিশশতকের দুই আলোকসামান্য প্রতিভা যেভাবে বিনিময় করেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা, সেটা প্রায় স্বতন্ত্রভাবে এক চর্চার বিষয়।  অন্যদিকে, কসমোলজির ভুবনে প্রতিটি  গ্রহ-গ্রহাণু-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি সবই হল আকারে আয়তনে প্রকান্ড, তাদের কারোর কারোর দূরত্ব আমাদের থেকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে —-- হয়তো আজ এইমাত্র যে আলো এসে পৌছাল আমার চোখে, সেই আলো আসলে তার যাত্রা শুরু করেছিল এক কোটি আলোকবর্ষ আগে, ইতিমধ্যে হয়তো সেই নক্ষত্র মৃতদের দলে নাম লিখিয়েছে এতদিনে  ! কী সাংঘাতিক রকমের ফ্যাসিনেটিং ! একদিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর অন্দরমহল,  বিপরীতে বি-শা-ল মাপের মহাজাগতিক বস্তুর নিজস্ব ক্রমপ্রসারণশীল মহাবিশ্ব ! এরই মাঝে আমাদের খন্ডিত মানবজন্ম, আমাদের সুখ-দুঃখ-বিষাদ-আনন্দ-প্রেম-বিচ্ছেদ-বিপ্লব ও আপোস! এই এক বোধ যেন ক্রমশ আমার মধ্যে ঘনিয়ে আসতে লাগল গণিত -চর্চার মধ্যবর্তিতায়। জানি, গণিত এক নৈর্ব্যক্তিক বিষয় তবু তার আশ্চর্য আলো আমাদেরই মনের জানলায় টাঙিয়ে দেয় কীরকম সব কুয়াশামাখা ক্যানভাস।

             
        চতুর্থ বছরের পরীক্ষার ফলাফল যেহেতু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি, তাই এক-দিবসীয় ক্রিকেটের পরিভাষায়, আমার ‘আস্কিং রেট’ ছিল বেশ বেশি। প্রান্তীয় বছরের পরীক্ষায় বেশ উঁচু নম্বর না-পেলে সেই ঘাটতি মেটানো যেত না। তবে এই বিশেষ বছরের বড় পাওনা ছিল এইটাই যে, নিজের স্ব-নির্বাচিত  বিষয়গুলোর বাইরেও যেগুলো ছিল আবশ্যিক, সেগুলো নেহাত খারাপ লাগেনি। ইন্টিগ্রাল ইকুয়েশন তো মনে হয়েছিল বেশ সোজা-ই । আর ‘অ্যানালিসিস’ নামক আতঙ্ক-জাগানিয়া বিষয়টার যে একটা মধুর ও স্নিগ্ধ রূপ আছে, তার নাগাল পেলাম ‘নিউম্যারিকাল অ্যানালিসিস’ পড়তে গিয়ে। নিঃসন্দেহে এটি একটি আকর্ষণীয় বিষয়। বিভিন্ন বড় বড় সমীকরণের সমাধান করার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি যে গ্রাহ্য তার সন্ধান দিলেন স্যারেরা, তাদের মুখেই শুনলাম ‘ডাটা অ্যানালিস্ট’ শব্দটা, যা আজকে বোধহয় ক্লাস ফাইভের শিশুও জানে। এই বিষয়টাতেই ছিল ‘প্র্যাক্টিক্যাল’ এর সুযোগ —-- চৌকো চৌকো ঘরকাটা বর্গাকার কাগজের ওপর ক্যাল্কুলেটরে হিসেব করে মান বসানো হত, আর সেইসব মানের বিশ্লেষণ করেই পাওয়া যেত সমাধান। খেয়াল রাখতে হবে, এটা যে সময়ের কথা তখন পারসোন্যাল কম্পিউটার ও মাইক্রোসফট-এর উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম আসেনি । আজকে এই ধরনের হিসেব-নিকেশ অনায়াস হয়ে গেছে, গণিতের কাজে ব্যবহারের জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে নানান গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়ার —-- এখন ‘নিউম্যারিকাল অ্যানালিসিস’ ঠিক কোন পর্যায়ে আছে, তা নিয়ে আমার কোনো ধারণাই নেই। কিন্তু কোনো এক বিশেষ সময়ের পরিসীমায় যখন গণিতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রবল অনিশ্চয়তায় টালমাটাল, তখন অনেক না-বোঝার আড়ষ্টতাকে অতিক্রম  করেও  কিছু কিছু বিষয় যে নতুন করে ভালবাসা জাগিয়ে তুলতে পেরেছিল, এই বিনীত স্বীকারোক্তিটুকু না করে আজ উপায় নেই। ভৈরবীর সুরে আজ সেটুকুই  গাইতে ইচ্ছে করে  :  বুঝেছি কি বুঝি নাই সে তর্কে কাজ নাই / ভাল আমার লেগেছে যে রইল সে কথাই   

           প্রেম সরে গেলেও রেশ থেকে যায় এইসব ভাললাগার। একেক স্মৃতির পালক উড়ে এসে পড়ে বিছানার চাদরে। নির্ভার ঝরা পালকের আঘাতেও আলোড়িত হয় বায়ুস্তর। কাঁপন লাগে সেরিব্রাল কর্টেক্সের কোষে কোষে। মনে পড়ে। মনে পড়ে। মনের দরজার তালা ভেঙে ঢুকে পড়ে ধূসর পান্ডুলিপির আলো। প্রেম আসলে একটা স্নায়বিক অভিজ্ঞতামাত্র, একটু দ্রুত তালে বেজে-ওঠা মৃদঙ্গের বোল। তার কোনও আয়োজন থাকে না, থাকে উদ্ভাস। প্রেমের যে হয়ে-ওঠা থাকবেই, এটা একটা সংস্কার। আসলে সে এক রক্তিম মরীচিকা। এমনকি তার উদ্দিষ্ট মোহময়ী গণিত হলেও। 

    ক্রমশ

    পরবর্তী ও শেষ পর্ব ২৭ মার্চ

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • স্মৃতিচারণ | ১২ মার্চ ২০২৪ | ৬৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন