তরতরিয়ে রথের টানে
রথের কথা, মেলার কথা মাথায় এলেই আমার মন ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় সেই ফেলে আসা শিশু কিশোর বেলায়। আমাদের মতো প্রবীণ, বুড়িয়ে যাওয়া মানুষগুলোর এমনটাই নাকি দস্তুর। তা কি আর করা যাবে? বোষ্টম ঠাকুরের ঝোলার মতো আমারও যে অনেক গল্প অমন একটা মন ঝোলার মধ্যে জমা রয়েছে। ফুরসৎ পেলেই কেবল ঝোলা হাতড়ে হাতড়ে যুৎসই কোনো কাহিনি খুঁজে এনে গপ্পো ফেঁদে বসি।
রথ দেখা, ভিড় ঠেলে ঠেলে মেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরঘুর করার পর্যায়ে বয়স গাড়ি পৌঁছনোর আগের সময়টা কেটেছে ঠাকুমা আর বাবার মুখে রথের গপ্পো শুনে শুনে। ঠাকুমা বলতেন – রথ হইলো গিয়া আমাগো ধামরাইয়ের রথ। একথা বলেই ঠাকুমা কেমন যেন উদাস হয়ে যেতেন! অনেক পড়ে বুঝেছি এক ছিন্নমূল পরিবারের মানুষের দুঃখটা ঠিক কোথায়? সামান্য এক স্থান নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুখ দুখের অনন্ত স্মৃতি। এই সময়টা এলেই ঠাকুমাকে গপ্পের হারিয়ে যাওয়া খেইটা মনে করিয়ে দিতে হতো। ও ঠাকুমা, কথা কওনা ক্যান? চাকাগুলান কি কাদায় ডাইবা গেল? সম্বিত ফিরে পেয়েই ঠাকুমা আবার নতুন করে শুরু করেন। রথের দিন যশোমাধবরে নিয়া কি উৎসব আমাগো। মাধব বাড়ি আছিলো আমাগো………। রথ গড়িয়ে চলে।জমে ওঠে মেলাও।
গপ্পো শোনার পর্ব শেষ করে যখন পায়ে পায়ে ভিড়ে ঠাসা সত্যিকারের মেলায় হাজির হবার যোগ্য হয়ে উঠলাম তখন থেকেই শরীর আর মনের সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে জুড়ে গেলো নাগেরবাজারের রথের মেলা। কাঠের তৈরি রথ। মেরেকেটে ফুট পনেরো তার উচ্চতা ; কিন্তু তাতে কি? আমরাও যে তখন চার - সাড়ে চার ফুটি। আমাদের কাছে তাইই ঢের বড়ো। সেবার অবশ্য আমাদের এক বন্ধু মাহেশের রথ দেখে এসে বললো – ফুঁ! এ আবার রথ নাকি? মনে খুব ঝড় তুলেছিল বন্ধুটির অমন বক্তব্য। তখন আর ছড়া কেটে বলতে পারিনি –
যতই হোকনা বড়ো মাহেশের রথ
সবসেরা আমরাই, এই মোর মত।
সারাবছর রথটা রাখা থাকতো বাবুতলার মন্দিরের ভেতরে। রোজ তাতে ফুল তুলসীপাতা দেওয়া হতো বটে, তবে রথের দিন এগিয়ে এলেই রথকে ঘিরে বিশেষ তৎপরতা শুরু হয়ে যেতো। ঘষেমেজে তাকে পরিস্কার করে রেখে দেওয়া হতো দিন কতক। তারপর প্রতিমার ঐ একমেটে দোমেটে করার মতো করে তার অঙ্গসজ্জার পর্ব চলতো বেশ কয়েকদিন ধরে। প্রথমে গোটা রথটাকেই সাদা প্রাইমার রঙে রাঙিয়ে নিয়ে পরে চলতো নানান আল্পনা আঁকার কাজ। আমরা স্কুল ফেরত মাঝে মাঝেই ঢু মারতাম ঐ মন্দিরে কতদূর এগলো রঙের কাজ তা সরজমিনে দেখতে। তেমন এগোচ্ছে না মনে হলে মন্দিরে থাকা উড়িয়া ঠাকুরমশাইদের তাড়া দিয়ে বলতাম – কি গো? রথ তো এসে গেল! রঙ শেষ হবে কবে? তাঁরাও হেসে উত্তর দিত – হেবে,হেবে।সময়কু হেবে।
সে বছর আমার ভাইকে বাবা একটা দোতলা কাঠের রথ কিনে দিয়েছিলেন। আমি আর বোন বয়সে বড়ো হবার সুবাদে তার দখল নিতে খুব দেরি করিনি। আসলে আমরাও মনে মনে চাইছিলাম অমন একটা রথ আনা হোক বাড়িতে। ভাইয়ের জন্য আনা রথের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতাম সবাই মিলে।দিনক্ষণ মেনে রথের দিনটা এগিয়ে এলেই সেই ডবল ডেকার রথকে নিয়ে আমাদের তিনজনের ব্যস্ততা বেড়ে যেত। রঙিন কাগজ, কাগজের ফুল, পাতা বাহার গাছের ডাল দিয়ে রথকে সাজিয়ে তোলা হতো। সেও এক কর্মযজ্ঞ বটে ! বহু বছর পর নিজের ছেলে -মেয়ে, ভাইপো- ভাইঝির আবদার মেনে রথ সাজানোর অবকাশে বারবার ফিরে ফিরে গিয়েছি আমার কিশোরবেলায়, আমাদের কিশোর বেলায়। এখন বেশ বুঝতে পারি, সেকালে আমাদের অ্যাকটিভিটির অন্ত ছিলোনা। উৎসব ছিল একটা উপলক্ষ যাকে, ঘিরে চলতো আমাদের মজে থাকার হরেক কর্মকাণ্ড। সেইসব কাজের মধ্য দিয়েই এক নীরব নির্মিতির পর্ব চলতো। এমনটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই ঘটেছে তেমনটা নয়, ওই সময়ের সমাজ যাপনটাই অমন ধারার ছিল।
আমি তখন সবে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছি। খবর পেলাম স্কুলের পক্ষ থেকে রথের মেলায় এক বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা যেন সেখানে যাই। কী সেই উদ্যোগ? স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে রথের মেলায় আগত দর্শনার্থীদের জন্য পানীয় জলের সত্র দেওয়া হবে। ছাত্রদের মধ্যে যাতে সমাজমনস্কতা গড়ে ওঠে সেজন্যই এমন প্রচেষ্টা আমাদের হেডমাস্টার মশাইয়ের। কাশীনাথ দা , এক নিরলস বাম রাজনৈতিক কর্মী , একেবারে সাতগাছির মোড়ে আমাদের জন্য জায়গা ঠিক করে রেখেছেন। ওখানেই খোলা হবে জলসত্র। মেলা দেখতে আসা পিপাসার্ত মানুষজনকে জল বিতরণ করা হবে স্কুলের পক্ষ থেকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই সেখানে হাজির হেডমাস্টার মশাই, দিলীপ দা দীপক দা , শঙ্কর দা … আরও অনেক মানুষজন। সো্ৎসাহে জল বিতরণের কাজ সামলে নেয় দায়িত্বে থাকা ভাইয়েরা।
মনে রাখতে হবে সেকালে আজকের মতো পানি বটল ছিলনা, বোতল ভরা ঠাণ্ডা পানির নাগাল পাওয়া খুব যে সহজ ছিল তাও নয় । তাই আমাদের জল দানের কার্যক্রম খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ভিড় ঠেলে হাঁপিয়ে পড়া তৃষ্ণার্ত মানুষেরা ছোট ছোট ছাত্রদের হাত থেকে পানীয় জল পেয়ে মহাখুশি। শুধু জল দেওয়া বিধেয় নয় বলে সঙ্গে বাতাসা দেওয়ার কথা ভাবা হলো। মজার বিষয় এই যে, তার জোগানের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় মাথা পেতে নিয়েছিলেন আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী অভিভাবকেরা। রথের মেলার জলসত্র আমাদের জীবনের এক বড়ো শিক্ষা শিখিয়ে দিল। এখন বেশ বুঝতে পারি, জলসত্রের আয়োজনটা ছিল নিছকই একটা বাহানা। মূল উদ্দেশ্য ছিল গণদেবতার উৎসবের আঁচে নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের শরীর, মন ও ভাবনাকে গড়ে পিটে শক্ত পোক্ত করে নেওয়া। আজ যখন দেখি তাবড় তাবড় শিক্ষাবিদরা শিক্ষার সামাজিকিকরণের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করে নানান পরামর্শ দেন, তখন গর্ব হয় এই ভেবে যে কোন্ কালেই আমাদেরকে তেমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছে ছোট্ট একটা স্কুল, আমাদের প্রাণের বিদ্যালয়।
রথের মেলার কথায় ফিরে আসি। রথের মেলার এক পরিচিত হাঁক ডাকের বুলি ছিল নাগাড়ে চিনি কলা,চিনি কলা বলে জগন্নাথ ঠাকুরের পূজার ডালি ফিরি করা। রথের আগে পিছে গলায় ঝুড়ি ঝুলিয়ে তাতে কাঁঠালি কলা, তুলসী পাতা আর ফুল নিয়ে শাল পাতায় করে তা ভক্তদের কাছে বিক্রি করা। রথের ওপর ঝুলতে থাকা পান্ডাদের হাতে তা তুলে দিলেই তাঁরা দারুস্বামীর কাছে তা নিবেদন করে দিতেন। একেবারেই এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়া, তবে এভাবেই দেবদেবীর কৃপা লাভের পন্থা বহুদিন ধরেই প্রচলিত।
বাড়িতে ফিরে এসেও আমরা সুর করে ওই চিনি কলা বুলি আওড়ে যেতাম মনের আনন্দে। আজ এতদিন পরে রথের কথা লিখতে বসে সেই হারানো সুর মনকে কেমন যেন নাড়া দিয়ে গেল। স্মৃতির সুতোয় একবার টান পড়লেই হলো! মন পর্দায় তা নিরন্তর পেন্ডুলামের মতো দুলতেই থাকে, দুলতেই থাকে। তাকে থামিয়ে দিতে গেলে তার দোলন যায় বেড়ে।
একটু সেয়ানা হয়ে উঠতেই রথের সময় বাবার কাছ থেকে পাব্বনি পাওয়ার সুযোগ হলো। আমার ভাগটা সামান্য বেশিই হতো বড়ো হবার কারণে। পাব্বনির মূল্যমানের কথা শুনলে একালের ছেলেপিলেরা ফুঁ বলে অবজ্ঞার ভঙ্গিতে ফুৎকার তুলবে। তাই সেটা উহ্যই থাক। হাতের মুঠোয় নগদ নারায়ণ এসে পড়ায় একদিকে যেমন মনের ভেতর চাপা উত্তেজনার জোয়ার ,তেমনি অন্যদিকে খরচের ফলে তাতে ভাঁটা পড়ার আশঙ্কা । যাইহোক খরচের পছন্দের ক্ষেত্রগুলোকে আগেভাগে মনে মনে ছকে নিই। ঝুলন সাজানোর পুতুল কেনার জন্য খানিকটা আলাদা রেখে, বাকি বাজেট উদর নারায়ণের সেবায় লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়। তারপর বেড়িয়ে পড়া। তালিকায় থাকে – কটকটি,ঝাল মটর,ঝাল কচু ভাজা, আলু কাবলি, আলুর দম, তেলেভাজা, ফাঁকি মিঠাই, গোলা ……। বাজেট ছাপিয়ে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে বুঝতে পেরেও সংযোজনের আবেগ কখনোই শিথিল হতো না। শেষে আমি আর বোন মিলে রফা করতাম। তাতে ভাগ বাটোয়ারার সমস্যা থাকলেও তখনকার মতো সেটাই শ্রেয় মনে হতো। এসব মজা এখন আছে?
মা অফিস থেকে ফেরার পথে গরম জিলিপি কিনে আনতেন মাদারীপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে। খুব একটা জাঁকালো চেহারার দোকান নয়, তবে বৃদ্ধ হালুইকর দাদুর হাতের জাদুতে আড়াই প্যাঁচের জিলিপি এমন মুচমুচে হয়ে উঠতো যে তার তুলনা পাওয়া ভার। জিলিপির প্যাঁচ পয়জার ভরা থাকতো রসের মধুতে। চ্যাঙারি উল্টে মা’র থালায় ঢেলে দিতে যেটুকু দেরি। পাঁচ হাতের ব্যস্ত ভোগ দখলে থালা খালি হাতে খুব বেশি সময় লাগতো না। সুশীল কাকুর দোকানের সিঙারা রথের সময়ে বিকতো দেদার। আশপাশের এলাকা থেকে যে সমস্ত মানুষ আসতেন রথের মেলায়, তাঁরা ফেরার পথে প্যাকেট ভরে নিয়ে যেতেন সিঙারা, বাড়ি ফিরে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবেন বলে। ছিল অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভান্ডারের কালোজাম - ওপরটা কুচকুচে কালো, আর ভেতরটা ঠিক জাম রঙের। আমার মা খুব পছন্দ করতেন। রথের মেলাকে উপলক্ষ করে এই সবই ঢুকে পড়তো ভোজের উপাচার হয়ে।হায়! নাগেরবাজারের ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে থাকা এইসব দোকান কবেই ঠাঁই নিয়েছে বিস্মৃতির অতলে ! সেই সব যায়গায় এখন রোলের দোকান,মোমোর দোকান এইসব। পোড়া তেলের ঝাঁঝালো গন্ধে গোটা এলাকা সন্ধের সময় থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ম ম করতে থাকে। তার সামনেই জগন্নাথ দেবের রথ সাতদিন জিরোবে। দারুদেব নিজেও হয়তো মাসির বাড়ির পাড়ার এমন উন্নয়ন দেখে কিঞ্চিত মুষড়ে পড়েছেন!
সেই ছোট্ট রথের রশি হাতে নিয়ে সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটা অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। সময়ের সঙ্গে সে এখন বুড়িয়ে গেছে অনেকটাই। তবে সেই বুড়িয়ে যাওয়াটা তাঁর মনের ওপর এখনো সেভাবে চেপে বসেনি। এখনও দূর থেকে ভেসে আসা তালপাতার ভেঁপুর আওয়াজ তাঁর মনে ঝড় তোলে, আজও তাঁর মন ছুটে বেড়াতে চায় রসে টইটুম্বুর জিলিপির আড়াই প্যাঁচে, টালমাটাল পায়ে রথের রশি আঁকড়ে ধরে পথে নামা কোনো সদ্য কিশোর বেলার ছোঁয়া পাওয়া বালকের বুক ভরা আশায় । জীবন তো থেমে থাকেনা। সময় তাকে গড়িয়ে নিয়ে চলে রথের চাকার মতো। সেদিনের সেই কিশোরের মনোরথ আজ সময়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে চলছে তরতরিয়ে কোন্ এক অজানা ঠিকানায়।জয় জগন্নাথ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।