কবিতার নেশা ম্যালেরিয়া জ্বরের মত। একবার যার এ রোগ ধরেছে তার রক্তে বীজাণু রয়েই গিয়েছে। কোনোদিন ছাড়বে না। মাঝে মাঝে হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে আর তখনি ঝর্ণা কলমের কালো জলে কাগজ ভিজে যায়। কয়েকটা পংক্তি না বেরোনো পর্যন্ত সে জ্বর ছাড়ে না। পঞ্চাশ-ষাট দশকে প্রথম যৌবনে আমরা কয়েকজন সেই জ্বরে ভুগেছিলাম। সেই নেশায় মত্ত হয়ে ছিলাম --- ভবিষ্যতে জীবিকার জন্য কি করব তার জন্য বিশেষ কিছু চিন্তা ছিল না। তবে এ কথা জানতাম কবিতা লিখে ভাত-কাপড়ের সুরাহা হবে না। কলেজ জীবনের প্রথম ধাপের পড়াশুনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাস্তবটা আস্তে আস্তে ধাক্কা দিতে শুরু করল। পত্রিকা বন্দ হল। কিন্তু কবিতার ভূতটা ঘাড় থেকে নামলো না আর।
ষাটের মাঝামাঝি দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে এলাম। নতুন দেশ, নতুন জীবন। ইউনিভারসিটি জীবন, কর্মজীবন, নতুন নতুন মানুষ,নতুন আবহাওয়া, নতুন সমাজ ব্যবস্থা, নতুন সংস্কৃতি। চোখ খুলে, হৃদয় মেলে, প্রাণভরে আস্বাদন করছি। সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে অনুভব করছি। এদেশের অনেককিছুই ভাল লাগছে ---- আবার অনেককিছুই নয়। যা যা আমার ভাল লেগেছিল তার মধ্যে প্রথম সারির প্রথমে যেটা আছে সেটা হচ্ছে এখানকার লাইব্রেরি। যে বই পড়তে চাই সে বই দেশে থাকতে কখনো পাইনি। আমার নাগালের মধ্যে কোনো লাইব্রেরি ছিল না। যেগুলো ছিল সেগুলোর অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না।
লন্ডন শহর কয়েকটি কাউনসিল বা বরো নিয়ে তৈরি। সব বরোতেই (কাউনসিল) একটা প্রধান লাইব্রারি আছে আর আছে পাড়ায় ছোট ছোট লাইব্রেরি। আমরা তখন যে কাউনসিলে থাকতাম তার নাম হ্যারো। এর প্রধান লাইব্রেরিটা বেশ বড় সড়। এটা মূলতঃ তথ্যসন্ধান ও তথ্যনির্দেশক পাঠাগার (Reference Library) ; ওখানে তথ্য সংগ্রহ করা বা বসে পড়ার জন্য। যদিও বই ধার করে বাড়ীতেও আনা যেত। এখানে একটা বিশাল পড়ার ঘর আছে এখানে প্রায় সত্তর-আশি জন মানুষ বসে পড়াশুনা করতে পারে। প্রায় নিঃশব্দ নিরিবিলি পরিবেশ। পড়ুয়ারা কেউ ফিসফিস করেও কথা বলে না পাছে পাশের পাঠকের একাগ্রতায় ব্যাঘাত ঘটে। তাক থেকে মনোমত বই বা পাঠ্য কিছু বেছে নিয়ে বসলে দুদন্ড কেটে যায় শান্তিতে। পড়া শেষে বইটা যথাস্থানে রেখে যাওয়াটাই রীতি।
সব পাড়াতেই একটা করে ছোট লাইব্রেরি আছে। বই, খবরের কাগজ, বিভিন্ন বিষয়ের অজস্র সাময়িক পত্রিকা, পড়ার জায়গা ছাড়াও এই লাইব্রেরিগুলোতে বহুরকমের আলোচনার আসর বা আড্ডা হয়। এটা ছিল স্থানীয় মানুষের অক্সিজেন বা দৈনন্দিনের তাড়না ভুলে অন্যএক পান্থশালায় কিছুক্ষণের আশ্রয় নেওয়া।
সে সময় প্রায়ই শনি রবিবার পুত্রদের নিয়ে লাইব্রেরিতে যেতাম। ওরা ছোটদের কোনে ( চিল্ড্রেন্স কর্ণার ) বই বা কমিক বই নিয়ে বসে যেত। এ দেশে আমার প্রথম যুগে এই লাইব্রেরিগুলো থেকে সাহায্য পেয়েছি অনেক। কলেজে পড়ছিলাম যখন তখন পাঠ্যপুস্তক কেনার সামর্থ্য ছিল না। কলেজ লাইব্রেরি থেকে বই পাওয়া যেত --- কিন্তু চাইবার আগেই অন্য ছাত্ররা সেগুলো ধার নিয়ে যেত। তখন আমার পাড়ার লাইব্রেরিই একমাত্র ভরসা ছিল। কি কি বই চাই সে গুলোর নাম লিখে লাইব্রেরিয়ানকে দিলে তিনি অন্য লাইব্রেরি থেকে সে বইটা আনিয়ে দিতেন। অথবা সে বইটা নতুন কিনে লাইব্রেরির গ্রন্থতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিতেন। বইটা এসে গেলে একটা পোস্টকার্ড দিয়ে জানিয়ে দিতেন ---- বইটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে --- আমি যেন সময় করে নিয়ে যাই।
ইদানীং লোকাল অথোরিটি বা কাউনসিলগুলোর টাকাকড়ির টানাটানি চলছে। লাইব্রেরি পরিষেবার বরাদ্দ অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে। পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট লাইব্রেরির সংখ্যা কমেছে। বেশ কিছুকাল আর নিয়মিত লাইব্রেরি ব্যবহার করি না ; তাই জানি না লাইব্রেরিতে সেই আগের মতো সুযোগ সুবিধা আছে কিনা। তবে আজকাল ডিজিটাল যুগে ছাপার অক্ষরে বই পড়া ছাড়াও অন্য মাধ্যমেও বইর স্বাদ পাওয়া যায়। আমাজন, গুগল, মাইক্রোসফ্টের কল্যাণে বা কিন্ডল (Kindle) প্রভৃতির মাধ্যমে হাজার গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি বন্দি করে রাখা যায় ; আর তা সুবিধামত ট্রেনে বাসে যেতে যেতে বা অল্প অবসরেও পড়া যায়। লাইব্রেরির চেহারাও আর আগের মতো নেই। অনেক আধুনিক হয়েছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। পাড়ার লাইব্রেরিতেও এখন অনেক কম্পিউটার স্ক্রিন ---- পড়ুয়ারা বই পড়া ছাড়াও পুরদমে কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে।
আগের লাইব্রেরির কথায় ফিরে যাই। লাইব্রেরিগুলো শুধু বই ধার দেওয়া ও পড়ার ব্যবস্থাই করত না। প্রধান গ্রন্থগারিক সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চক্রের ব্যবস্থাও করতেন। এবং সাধারণ পাঠকদের এই ধরণের আসরের আয়োজন ও পরিচালনার জন্য উৎসাহ দিতেন। এইরকম দু’একটা আসরে আমি মাঝে মাঝে গিয়ে বসতাম। তবে দুটো আসর আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। একটা হল গল্প উপন্যাস পড়া এবং আলোচনার (রিডিং সার্কল), অন্যটি কবিতার আসর (পোয়েটস কর্ণার)। লাইব্রেরির একটা অংশ খালি করে দেওয়া হত এই আসরের জন্য। সকলে গোল হয়ে বসতো ---- দশ পনেরো জনের বেশি হতো না --- এদের মধ্যেই একজন স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে পরিচালনার দায়িত্ব নিত। রিডিং সার্কলে যারা নিয়মিত আসত তাদের জানিয়ে দেওয়া হত পরের আসরে কি আলোচনা হবে। সাধারণত সেটা হত কোন এক লেখক বা উপন্যাস প্রবন্ধ বা ছোট গল্প।
পোয়েটস কর্ণারটা একটু অন্যরকমের। এখানেও কবি ও কবিতা নিয়ে আলোচনা হত। তবে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হত অংশগ্রহণকারী কবিদের স্বরচিত কবিতা পাঠের উপর। এরকম আসরে আমি প্রায়ই যেতাম এবং মাঝে মাঝে অংশ নিতাম। একবার এমনই এক আসরে গিয়ে একটা নতুন কিছু পেলাম যা আমাকে চমক দিয়েছিল। এখানে কয়েকজন তরুণ তরুণী কবির সঙ্গে আলাপ হল। তাদের এক অভিনব কর্মকান্ড দেখে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।
এদের নাম (মোবাইল পোয়েটস) ‘চলমান কবিচক্র’। এরা লন্ডনের হ্যামস্টেড অঞ্চলের এক রেস্টুরেন্টের সঙ্গে যুক্ত। এ রেস্টুরেন্টটা একটু আলাদা ; এখানে যাঁরা আসেন তাঁরাও, বোধ করি, একটু আলাদা ধরণের মানুষ। চলমান কবিচক্র এই রেস্টুরেন্টে কফি বা ভোজ্যবস্তুর সঙ্গে কবিতা পরিবেশন করে। রেস্টুরেন্টের নাম ‘কাফে রুজ’।
জরুরী চব্বিশ ঘণ্টার এই চলমান কবিচক্র আপনাকে নিয়ে যাবে এক আবেগময় ভ্রমণে, জাদুকরী আসরে, মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতায়, আশ্চর্য ইন্দ্রজালে ঘেরা কল্পনার রাজ্যে ; যুগপথ স্তম্ভিত ও অনুপ্রাণিত করবে।
চলমান কবিচক্র বলছেন, ‘‘ কবিরা পরিবেশন তালিকা থেকে আপনার পছন্দমত কবিতা আপনার খাবার টেবিলে এসে শুধু আপনার জন্যই কবিতা পড়ে শোনাবেন। যখন খাবারের নির্দেশ দেবেন তখন বলুন কি কি কবিতা শুনবেন, কবিরা সময়মত আপনার টেবিলে চলে আসবেন। এই বিশেষ পরিষেবার জন্য অতিরিক্ত মুল্য দিতে হবে না। আবার আসুন, বারবার আসুন ! আমরা এখানে প্রতি মংগলবার সন্ধ্যায় আসি। তাছাড়াও ভুলে যাবেন না যে আপনার পছন্দমত কবির কবিতা পড়ার জন্য আমাদের অনুরোধ করতে পারেন এবং আমাদের কাজের কথা জানতে পারেন। জানতে পারেন কেমন করে আপনিও চলমান কবিচক্রে যোগ দিতে পারেন। এই নাম্বারে ......... আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’’
এদের তালিকায় অনেক কবি ও কবিতার নাম আছে। কয়েকজন কবির নাম দেওয়া যাক--- সেক্সপীয়র, ইয়েটস, রিলকে, রবার্ট ফ্রস্ট, শেলী, ফিলিপ লারকিন এবং আরো অনেকে। রেস্টুরেন্টটা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। একজন উপভোক্তার মন্তব্য উল্লেখ করছি ... ‘’ আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন মোবাইল কবি এন্ড্রু বিন্ডন। কাব্য, পদ্য ও মোবাইল ফোন...আমরা হাসলাম, আমরা কাঁদলাম, তারপর আরো স্যাম্পেনের গ্লাস ভরলাম।‘’
কতদিন স্বপ্ন দেখেছি, আমি কলেজ স্ট্রীটে একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছি। এক তরুণ কবি গোস্ঠীকে আমন্ত্রণ করেছি …। তারা এসে ওই ‘চলমান কবিচক্রে’র মত কবিতা পাঠ করে শোনায়। আমি তাদের সামান্য কিছু সাম্মানিক দিই।
…
বহুকাল আর হ্যামস্টেড অঞ্চলে যাই নি। জানি না এখনো কাফে রূজ আছে কিনা। তবু এখনো স্বপ্ন দেখি…… ; আমার স্বপ্ন নিয়ে অন্য এক বংগসন্তান কলেজস্ট্রীটে এইরকম এক রেস্টুরেন্ট করেছে। সেখানে তরুণ কবিরা এসে খাবার টেবিলে কবিতা পড়ে শোনাচ্ছে।