এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কটন ক্যান্ডি।

    ARIJIT MUKHOPADHYAY লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ মে ২০২৫ | ৩০ বার পঠিত

  •  
    রান্নাঘর থেকে এক ছুটে বেরিয়ে এসে বিছানার ওপরে রিং হতে থাকা ফোনটা রিসিভ করে ঋতু জিজ্ঞেস করল,"হ্যালো, কে বলছেন?"
    উত্তর এল,"কী রে? এর মধ্যেই ভুলে গেলি?"
    "আরে! অর্ক? তুই! কী খবর? এত দিন পর! ওওওওও.....তুই তো এখন বিদেশী! দেশের লোকজনকে মনেই বা রাখবি কেন বল?", ওপারের গলার আওয়াজ শুনেই ঋতু চিনতে পারল যে সে অর্ক ছাড়া আর কেও নয়।
    "এই তো? লেগ পুল শুরু করলি? আচ্ছা এই নম্বরটা সেভ করে নে, এটা আমার নতুন নম্বর।"
    "কেন আগের টা কী হল?"
    "আরে, আগেরটা লন্ডনের নম্বর ছিল। আজই তো ইন্ডিয়া এলাম। ভোরের ফ্লাইটেই ল্যান্ড করলাম। নেমেই আগে এই সিমকার্ডটা নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাড়ি, তারপর একটা ন্যাপ। সিমটা অ্যাক্টিভেট হতেই তোকে কল করলাম।"
    "আরিব্বাস! আমার আর কিছু হল না রে! তোরাই সব চাকরি টাকরি পেয়ে বিদেশে টিডেশে গিয়ে সেটেল্ড হয়ে গেলি!"
    "ওসব ছাড়! কাকু কাকিমা কেমন আছেন রে? মা বলল কাকুর নাকি শরীর খারাপ?"
    "হ্যাঁ, ওই....বয়স হলে যা হয় আর কী! বড় জায়গায় চিকিৎসা করাতে গেলেও দুবার ভাবতে হয় রে!"
    "এই, শোন না? আজ দেখা করবি একবার?"
    "আজ.....? মানে....ইয়ে.... বিকেলে একটা টিউশন ছিল আর তারপর মায়ের.......!", মায়ের ওষুধ কেনার মত জরুরি কথাটা অর্ককে বলতে গিয়েও শেষ করে উঠতে পারল না ঋতু।
    "একটা দিন ম্যানেজ করে নে। প্লিস! আমি তাহলে বিকেল পাঁচটায় ওয়েট করব.....আর্কেডের ফুড প্লাজায়.....।", বলেই ফোনটা কেটে দিল অর্ক।
    "অর্ক, শোন....হ্যালো....হ্যালো....অর্ক....?", নাহ! কোনো সাড়া পেল না ঋতু। অর্ক ফোন রেখে দিয়েছে।
    অর্ক আর ঋতু সেই ছেলেবেলার বন্ধু। তখন ওরা স্কুলে পড়ত । বন্ধুত্বের বেড়া ভেঙে ওরা কখনও কখনও ঘনিষ্ঠ হয়েছিল বটে। তবে ঘনিষ্ঠতার গভীরতা বাড়তে না বাড়তেই ছেদ পড়ে সে সম্পর্কে। মাধ্যমিক শেষ হয়, অর্ক বাইরে সায়েন্স নিয়ে পড়তে চলে যায় আর ঋতু আর্টস নিয়ে গ্রামের স্কুলেই চালিয়ে যায় পড়াশোনা। অর্ক বি টেক কমপ্লিট করে এম টেকে ভর্তি হয়। এম টেকের ফাইনাল ইয়ারেই প্লেসমেন্ট পেয়ে যায় অর্ক। ফার্স্ট পোস্টিং কলকাতা হলেও বছর দুয়েকের মধ্যেই প্রমোশন নিয়ে লন্ডন চলে যায় সে। এখন ওখানেই সেটেল্ড, তবে বিয়ে থা এখনো হয়নি। অর্কর বাড়ির অবস্থা বেশ ভাল। বাবার ব্যবসা, মায়ের চাকরি সব মিলিয়ে অর্ক কোনোদিনই অভাব টের পায়নি। গ্রামের বিরাট বাড়ি অবশ্য এখন খাঁ খাঁ করছে, মাধ্যমিকের পর সেই যে ওরা বর্ধমানে শিফট করল, তারপর দেশের বাড়ি আর ফেরা হয়ে ওঠেনি ওদের।
    ঋতু, মানে ঋতুপর্ণা অবশ্য মাধ্যমিকের পরে এইচ এস ও গ্রামের স্কুল থেকেই কমপ্লিট করে। কলেজে পড়ার সময় গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে বর্ধমানে চলে আসে ওরা। একটা ছোট ভাড়া বাড়িতে এসে ওঠে। ঋতুর বাবা পুলক বাবু একটা রাইস মিলে কাজ করতেন। লক ডাউনে মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওনার কাজ চলে যায়। তখন থেকেই ওদের অর্থনৈতিক অবস্থার বেশ ভাটা পড়ে। কাজ চলে যাওয়ার পর থেকেই শরীরটারও অবনতি হতে থাকে ক্রমশ। একটা মাইল্ড অপারেশনও হয়েছে রিসেন্ট। ঋতুর মায়েরও ওষুধ চলে বারো মাস - থাইরয়েড, প্রেসার, মাইগ্রেন এসবের সমস্যা লেগেই আছে। উপার্জন বলতে সেরকম কিছুই নেই। ঋতু দু চারটে টিউশন করে বলেই সংসারটা কোনরকমে টিকে আছে। মাস্টার্স করেও এস এস সি তে পেল না সেবার। আর কোন রিক্রুটমেন্টও হয়নি তার পরে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার সে।
    ফোনটা হাতে নিয়েই বেশি কয়েকমিনিট বিছানায় বসে কী যেন ভাবল ঋতু! আজ হঠাৎ অর্ক দেখা করতে চাইছে! কিছুই বুঝতে পারলনা সে! বেশ কয়েকবছর ওদের দেখা সাক্ষাৎ নেই। মাধ্যমিকের পরে ওদের মধ্যে বছর চারেক কথাই হয়নি। তখন মোবাইল ছিলনা, ছিল চিঠি আদান প্রদান। ঋতু বেশ কয়েকবার চিঠি লিখলেও তার উত্তর অর্ক কোনোদিনই দেয়নি সে সময়। কলেজে পড়ার সময় অর্কর নাকি একটা গার্ল ফ্রেন্ডও ছিল - এমনটাই শুনেছিল ঋতু। তখন থেকে ঋতুও আর এসবের মধ্যে ঢোকেনি। লন্ডনে চলে যাওয়ার খবরটা অবশ্য অর্কর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারে ঋতু। মাস খানেক আগে ফেসবুকে ওদের কথা হয়, সেখান থেকেই নম্বর আদান প্রদান ও নতুন করে বন্ধুত্বের সূত্রপাত। কিন্তু হঠাৎ অর্ক যে দেখা করতে চাইবে এটা ঋতু স্বপ্নেও ভাবেনি!
    অনেক ভেবে ঋতু আজ দেখা করবে ঠিক করল। অর্কর প্রতি ঋতুর যে দুর্বলতা আছে - সেটা সে ভাল করেই জানে। সমস্ত কাজ ফেলে অর্কর এক ডাকে তার কাছে ছুটে যায় সে। এ অভ্যেস শুধু আজকের নয়, ছোটবেলায় অর্ক যখন ডাকত, তখন বাড়ির বারণ সত্তেও ছুটে বেরিয়ে যেত বাড়ি থেকে। ঘুরে বেড়াত পাড়ায় পাড়ায়! কখনও অন্যের গাছের আম পাড়ত ঢিল ছুঁড়ে! কখনও তেঁতুল তলায় বসে নুন লঙ্কা মাখিয়ে কাঁচা তেঁতুল খেত! কখনও মাঠে গিয়ে তরমুজ তুলে সেখানেই খেত সবাই মিলে!
    আজ দুপুরে অঙ্কনা কে পড়ানো আছে। পাড়ার মোড়েই ওদের বাড়িতে পড়াতে যায় ঋতু, সপ্তাহে দুদিন। সেখান থেকে সোজা বর্ধমান আর্কেড যাবে সে। বিকেলের টিউশনটা আজ অফ রেখেছে।
    গোলাপি সালোয়ার পরেছে আজ ঋতু। চুল টা খোলা, পিঠে সুবিন্যস্ত হয়ে রয়েছে। ওর সাদা ধপধপে গায়ের রং যেন লালচে হয়ে উঠেছে আজ! গোলাপি ঠোঁটের আগায় পুরোনো হাসি ফুটে উঠেছে যেন বহুদিন পর! একটু বেশীই চঞ্চল লাগছে আজ ওকে! সখের পারফিউমটা গলার ভাঁজে আর কব্জির নিচের দিকে স্প্রে করে নিজে একবার গন্ধটা যাচাই করে আয়নার সামনে একবার দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ঋতু!
    তখন ঘড়িতে প্রায় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। অঙ্কনাকে পড়ানো শেষ করে একটা টোটো করে ঋতু পৌঁছে গেল বর্ধমান আর্কেডের ফোর্থ ফ্লোরে। অনেকদিন আগে অবশ্য বন্ধুদের সাথে এখানে এসেছিল সে। কিন্তু এখন জায়গাটা অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। অনেক নতুন দোকান হয়েছে, বসার বেঞ্চগুলোও আগের মত আর প্লাস্টিকের নেই। পাশেই আইনক্সের বক্স অফিস আর এন্ট্রি গেট। ভিড়ও আগের চেয়ে অনেক বেশি। জায়গাটা কেমন অচেনা মনে হল ঋতুর। আগের সঙ্গে জায়গাটার যেন কোন মিলই খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
    লিফট থেকে বেরিয়েই বেশ কয়েকবার এদিক ওদিক তাকিয়ে ঋতুর মনে হল শেষের দিকের একটা বেঞ্চে বসে থাকা ছেলেটাই অর্ক। ছেলেটার মুখ উল্টোদিকে থাকায় শুধু পিছন দিকটাই ঠাহর হচ্ছে ঋতুর। অর্কর হাইট আর চেহারা বেশ মনে আছে তার। এগিয়ে গেল ঋতু। মনে একটু 'কিন্তু' থাকলেও ওটা যে অর্কই তা নিয়ে ঋতুর সন্দেহ ছিলনা।
     ছেলেটার পিছনে এসে "অর্ক?" বলে ডাকতেই পিছন ফিরে তাকাল ছেলেটা।
    বিদেশে থাকলেও ওর চেহারার সেরকম পরিবর্তন হয়নি। ফেসবুকে যেমনটা দেখেছিল, বাস্তবে তার চেয়েও ঢের সুন্দর দেখতে অর্ক। শুধু সাহেবদের মত হেয়ার স্টাইল আর চশমাটা বাদ দিলে বাকি সবটাই সেই পুরোনো অর্ক - ই। যেমন সুন্দর গায়ের রং, তেমন চোখের গড়ন! কলেজে পড়ার সময় থেকেই নিয়মমাফিক প্রত্যহ জিম করায় শরীরের স্ফীত মাসলগুলো জামার ওপর থেকেও বেশ বোঝা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে একটা বিদেশী ছোঁয়া এসেছে বটে, তবে কথাবার্তা এখনো সেই ছেলেবেলার মতোই। হয়ত ঋতুর সাথে দেখা হবে বলেই পুরোনো আদব কায়দা ধরে রাখতে চেয়েছে অর্ক।
    "হ্যাঁ, আয়, বোস। দেরি হল যে?", ঋতুর ডাকে সাড়া দিয়ে পিছনে ফিরে উঠে দাঁড়িয়ে অর্ক বলল।
    ঋতু সামনের চেয়ারে বসতেই অর্ক জিজ্ঞেস করল,"কী খাবি?"
    "কিছু না। বল.....ডাকলি কেন?"
    "বাহ রে? ডাকলেই আসতে হবে বুঝি?"
    "টিউশন টা গেলাম না। ওর সামনে পরীক্ষা।"
    "একদিন এক্সট্রা পড়িয়ে দিস। ব্যাস, প্রবলেম সলভড!"
    "সেটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়। ইম্পর্ট্যান্ট ইস ডিসিপ্লিন। বুঝলি?"
    "জানি জানি। তুই যে কত ডিসিপ্লিন্ড ছিলি - আমি তো জানি। স্কুলে না গিয়ে পুকুর পারে বসে পেয়ারা মাখা খেতিস।"
    "তখন সময়টা অন্যরকম ছিল। আর এখন পুরো আলাদা। বাবার কাজ নেই, সংসার চলে না ঠিকঠাক। ওষুধ, বাড়ি ভাড়া, ইলেক্ট্রিক বিল - সব দায়িত্ব আমার ওপর। একটা টিউশন চলে গেলে পরের দিন কী খাব জানি না।"
    "ওকে বাবা, সরি। বেশি সময় নেব না। কী খাবি সেটা তো বল?"
    "এনিথিং, তুই যা খাবি সেটাই অর্ডার দে।"
    অর্ক ওয়েটার কে ডেকে দুটো চিকেন স্প্রিং রোল আর দুটো কোক অর্ডার দিল।
    ঋতু প্রশ্ন করল,"এতদিন পর কী এমন মনে হল যে আমার সাথে দেখা করলি?"
    "টু বি এক্সাক্ট - এতদিন পর নয়! ষোল বছর চার মাস একুশ দিন! শেষ যেদিন তোর সাথে দেখা হয়েছিল, দিনটা ছিল মঙ্গলবার, তারিখ ঊনিশে মার্চ ২০০৬।"
    অর্কর মুখে এক্সাট সময়ের হিসেবটা শুনে ঋতু একটু অবাকই হয়েছিল, তারপর বলল,"হ্যাঁ, তুইই চলে গিয়েছিলি। আমি তো আমার জায়গাতেই ছিলাম।"
    ওয়েটার একটা ট্রে তে অর্ডার করা চিকেন স্প্রিং রোল আর কোক দিয়ে গেল।
    অর্ক ঋতুর দিকে খাবারটা এগিয়ে দিয়ে বলল,"হ্যাপী বার্থডে ঋতু! মেনি মেনি হ্যাপী রিটার্নস অফ দ্যা ডে! খুব ভাল থাক। তোর সব ইচ্ছে পূরণ হোক।"
    হকচকিয়ে গেল ঋতু! মোবাইলটা বের করে একবার ডেটটা দেখল! তারপর নিজেই একটু লজ্জিত বোধ করল! কাজের চাপে আর সংসারের বেড়াজালে নিজের জন্মদিনটাও ভুলে গেছে ঋতু! নিজেকে নিয়ে আর তেমন ভেবে ওঠা হয়না তার! কিন্তু অর্ক? ওর তো মনে আছে? তাহলে কি এইজন্যই অর্ক দেখা করতে চেয়েছিল? অর্ক কি ওকে এখনও ভালবাসে? আগের মত? ছেলেবেলার মত? টেস্ট পরীক্ষার পর ঠিক যেমন লুকোচুরি খেলার ছলে খড়ের পালুইয়ের আড়ালে আদর করেছিল অর্ক? ঠিক সেভাবে? ক্লাস টেনে পড়ার সময় সরস্বতী পুজোর দিন স্কুলের ছাদের চিলেকোঠায় যেমন চুমু খেয়েছিল সে? ঠিক তেমন?
    একটু ইতস্তত হয়ে ঋতু বলল,"ইসস, একদম ভুলেই গেছি। নিজের জন্মদিনটাও মনে নেই আমার! অর্ক? থ্যাংকস অ্যা লট! আমার জন্মদিন এইভাবে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য!"
    অর্ক এবার ব্যাগ থেকে একটা কটন ক্যান্ডি বের করে ঋতুকে দিতেই সে একেবারে চেয়ার থেকে উঠে চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্কর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মোড়ানো পলিথিন টা খুলে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে মুখে পুড়ে চোখ বন্ধ করে "আহঃ" বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল!
    চোখ খুলেই ঋতু নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে দেখে ফুড কোর্টের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে আর অর্ক ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
    গোলাপি কটন ক্যান্ডি খেতে খেতে ঋতু বলল,"অর্ক, দিস ইস দ্যা বেস্ট বার্থডে গিফট! থ্যাংকস এগেইন।"
    অর্ক খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,"এটাই তুই ঋতু! এটাই আসল তুই! নিজেকে হারিয়ে ফেলিসনা। ছোটবেলার তুই - তে ফিরে আয়! তোর কটন ক্যান্ডি ফেভারিট আমি জানি, কিন্তু এর মাঝে তুই কি কখনও নিজের থেকে কিনে খেয়েছিস? না। খাসনি। কেন? কারণ তুই নিজেকে হারিয়ে ফেলছিস ঋতু।"
    "শ্রীতমার কী হল?", কটন ক্যান্ডি খেতে খেতে ঋতু প্রশ্ন করল।
    "শ্রীতমা আমার জীবনে বছর দুয়েকের জন্য এসেছিল। কলেজ শেষ হতেই ওর সাথে কোন সম্পর্ক ছিলনা। সি ইস ম্যারেড নাও।"
    "কাল ফ্রি তুই?", ঋতু প্রশ্ন করল।
    "হ্যাঁ, এখন কদিন ছুটিতে।"
    "সিনেমা যাবি?"
    "হ্যাঁ..... মানে দেখাই যায়। কতদিন হল হলে গিয়ে সিনেমা দেখিনি।"
    "বেশ, চল টিকিটটা কেটে নি।" বলে অর্কর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ঋতু।
    উল্টোদিকেই আইনক্সের এন্ট্রান্স আর তার পাশেই টিকিট কাউন্টার। আগামীকাল বিকেল সাড়ে চারটার শোয়ের টিকিট কাটল ওরা।
    "বেশ তবে কাল দেখা হচ্ছে? আজ আসি।", ঋতু বলল।
    "এক মিনিট?", বলে অর্ক ওর ব্যাগ থেকে একটা ক্যারি ব্যাগ সমেত কয়েকটা ওষুধ ওকে দিল।
    "কী এগুলো?"
    "সকালে অরুন কাকুর দোকানে গিয়েছিলাম। কাকু বললেন, তোর মায়ের ওষুধগুলো তুই নাকি বিকেলে নিতে যাবি? কিন্তু তুই তো এখানে আমার সাথে। কী করে যেতিস? তাই আমিই নিয়ে নিলাম। চল বাই। সি ইউ টুমরো।", বলে অর্ক মিলিয়ে গেল ভিড়ের মাঝে।
    ক্যারি ব্যাগ ভর্তি ওষুধ গুলো নিয়ে ঋতু বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। কী করবে কিছু বুঝতে পারলনা। তারপর গুটি গুটি পায়ে সেখান থেকে নেমে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে তুলে দিল ওষুধগুলো। সারারাত ঘুম হলনা ঋতুর। সে কি নতুন করে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে? অর্কর প্রতি দুর্বলতা কি তাকে বাধ্য করছে প্রেমে পড়তে? না চাইলেও কেন বার বার সে কাছে যায় অর্কর?
    পরের দিন বিকেল ওরা সাড়ে চারটার শোয়ের সিনেমা দেখতে ঢুকল আইনক্সে। কোনের দুটো সিট। বাকি সিটগুলো একটু দূরে। আলো নিভে গেল, কেমন যেন ভয় করছে ঋতুর! অর্কর এত কাছে সে! অর্কর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে! গভীর সে শব্দ! মায়াবী! যেন বহুকাল ঋতু এ শব্দ শোনার অপেক্ষাতেই ছিল। হঠাৎ অর্ক যেন হাত রাখল ওর হাতের ওপর! তারপর ওর পুরুষালি হাতের স্পর্শ উঠতে লাগল ওপর দিকে! হাত, কাঁধ, গলা হয়ে কানের পাশে খেলা করতে লাগল ওর হাতটা! যেন স্বর্গের কোন পালকের ছোঁয়া! যেন ভরসার ইস্তেহার! যেন কতকালের না পাওয়া আবদার! ঋতু নিজেকে চাইলেও বেঁধে রাখতে পারল না! ঢলে পড়ল অর্কর শক্ত কাঁধে! দুটো ঠোঁট এগিয়ে এল! ঋতুর গাল, কপাল, গলা অর্কর ঠোঁটের ছোঁয়ায় যেন প্রাণ ফিরে পেল! ফিরে পেল ছেলেবেলার স্মৃতি!
    ঋতু অর্কর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,"স্বপ্ন দেখিস তুই?"
    "হ্যাঁ, তোর স্বপ্ন! তোর সাথে সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন! একটা ছোট্ট ঘর, সংসার, একটা ছোট্ট বাচ্চা - সারাদিন খেলে বেড়াবে গোটা ঘরে! আমি অফিস থেকে এসেই তোকে আদর করব অনেক! তুই রাতে আমার বুকের ওপর মাথা রেখে ঘুমাবি আর আমি তোর চুলের মাঝে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দেব!"
    "তাহলে কেন চলে গিয়েছিলি দূরে?"
    "ফিরে আসব বলে?"
    ঋতুর চোখের কোণ থেকে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল গালে! অর্কর বাহুর আড়ালে সেদিন লুকিয়ে ছিল হেরেও জিতে যাওয়া সেই হার না মানা মেয়েটা!
    সিনেমা শেষ হতেই অর্ক ঋতুকে নিয়ে টাউন হলে গেল। বাইকটা স্ট্যান্ড করে একটা গাছতলায় সিমেন্টের বসার জায়গায় বসল ওরা। অর্ক ঋতুর হাত ধরল, ঋতু অর্কর কাঁধে মাথা রেখে আকাশ দেখতে লাগল। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে! মেঘগুলো এখনো দৌড়ে বেড়াচ্ছে! তারা ফুটছে আকাশে! চাঁদটা কি উজ্জ্বল!
    একটা লোক ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে এদিকেই আসছে! এ কি! এ তো কটন ক্যান্ডি! লোকটার কাঁধে একটা লাঠি! লাঠির দুপাশে পলিথিনে মোড়া গোলাপী তুলোর মত কটন ক্যান্ডি!
    ঋতু হাত দেখিয়ে অর্ককে বলল,"খাবি?"
    লোকটা এগিয়ে এল। অর্ক দুটো কিনে একটা নিজে নিয়ে আর একটা ঋতুকে দিল।
    একটা সুন্দর সন্ধ্যে নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে! একটা সুন্দর আকাশ! একটা সুন্দর স্বপ্ন! ছেলেবেলার স্মৃতি! পুরোনো গায়ের গন্ধ! পুরোনো চুমু! এসবই মনে পড়তে লাগল ঋতুর! চোখ বন্ধ হয়ে এল ঋতুর! আবার একফোঁটা জল বুঝি গড়িয়ে পড়ল চোখের কোণে! সে জলে মিশে ছিল ফেলে আসা ঘেমো ছেলেবেলার প্রেম!
    কটন ক্যান্ডি বিক্রি করা লোকটা তখনও ঘণ্টা বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে! ঘণ্টার শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে সময়ের ভিড়ে, গাড়িঘোড়ার শব্দে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় বা প্রেমের অছিলায়! হয়ত বা নতুন করে জীবন শুরু করার তাগিদে?
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন