গতকাল নিউ-ইয়র্ক টাইমসে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন বেরিয়েছে, এই যুদ্ধে ভারতীয় মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে। সেটা অনুবাদ করে নিচে দিলাম। তাড়াহ্হুড়োয় সামান্য কিছু ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে, কিন্তু বড় কিছু নেই।
কীভাবে যুদ্ধের দামামার মধ্যে ভারতীয় মিডিয়া মিথ্যেকে বহুগুণ করেছে
প্রতিবেদনে ছিল ভারতের অভূতপূর্ব সাফল্যের বিবরণ: ভারতীয় হামলা একটি পাকিস্তানি পারমাণবিক ঘাঁটিতে আঘাত করেছে, দুটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে এবং পাকিস্তানের করাচি বন্দরের একাংশে আঘাত হেনেছে—যে বন্দর দেশটির তেল ও বাণিজ্যের প্রাণরেখা।
প্রতিটি তথ্য ছিল অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট, কিন্তু এর কোনোটিই সত্য না।
ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক তীব্র সামরিক সংঘাতের সময় ও পরবর্তী কয়েক দিনে সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্যের স্রোত ছিল প্রচণ্ড। সীমান্তের উভয় পাশে সত্য ও মিথ্যার ভেদ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল—কারণ মিথ্যা, অর্ধসত্য, মিম, বিভ্রান্তিকর ভিডিও ফুটেজ এবং অতিরিক্ত মাত্রায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিবর্তিত ভাষণের আধিক্য।
এই বিভ্রান্তিমূলক তথ্যপ্রবাহের কিছু অংশ মূলধারার গণমাধ্যমেও প্রবেশ করে। এটা এমন একটা পরিবর্তন, যা বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে, কারণ ভারতের এমন কিছু সংবাদমাধ্যমের মধ্যে এই বিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যারা আগে নিরপেক্ষতার জন্য পরিচিত ছিল। খবর প্রকাশে প্রতিযোগিতা এবং অতিরঞ্জিত জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে রিপোর্টিং, এই চার দিনের সংঘাতকালীন সময়ে চরমে পৌঁছে যায়, যেখানে সংবাদ উপস্থাপক ও বিশ্লেষকরা পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত দুটি দেশের যুদ্ধের চিয়ার-লিডার হয়ে ওঠেন। কিছু পরিচিত টিভি চ্যানেল যাচাই না করা তথ্য প্রচার করে বা এমনকি সম্পূর্ণ ভুয়া গল্পও প্রকাশ করে, জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার এই প্রাবল্যে।
সংবাদমাধ্যমগুলো একটি তথাকথিত পাকিস্তানি পারমাণবিক ঘাঁটিতে ভারতীয় হামলার খবর প্রচার করেছিল, যা নাকি তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়েছিল। তারা হামলার স্থান চিহ্নিত করে বিস্তারিত মানচিত্রও শেয়ার করেছিল। কিন্তু এই দাবিগুলো সমর্থন করার মতো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভারতীয় নৌবাহিনী করাচিতে হামলা চালিয়েছে—এই গল্পও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, কিন্তু পরে তা অস্বীকৃত হয়েছে।
"আমরা যখন বিভ্রান্তিকর তথ্যের কথা ভাবি, তখন আমাদের মনে পড়ে অজ্ঞাতনামা লোকদের, বা অনলাইনে ছড়ানো বটদের, যাদের উৎস আমরা জানি না," বলেছেন আমেরিকান ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, সুমিত্রা বদ্রিনাথন, যিনি দক্ষিণ এশিয়ায় ভুয়া তথ্য নিয়ে গবেষণা করেন। ২০১৯ সালের ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময়েও সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়েছিল, তবে এবার যা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন ড. বদ্রিনাথন, তা হলো: "পূর্বে যেসব সাংবাদিক ও বড় বড় সংবাদমাধ্যম বিশ্বাসযোগ্য ছিল, এবার তারাই পুরোপুরি মিথ্যা খবর প্রকাশ করেছে।"
"যখন পূর্বে নির্ভরযোগ্য উৎসগুলো বিভ্রান্তিকর তথ্যের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়, তখন সেটি এক বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়," তিনি বলেন।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সংঘাত নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে ছড়ানো বিভ্রান্তিকর তথ্য এক সময়ে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত সাংবাদিকতার দৃশ্যপট থাকা ভারতের জন্য আরেকটি বড় আঘাত।
সশস্ত্র সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকেই বিবদমান পক্ষগুলো মিথ্যা ও প্রচারছড়িয়ে আসছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোও নিজেদের দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন থেকে বিরত থাকেনি কিংবা কখনো কখনো যাচাই না করে ভুল তথ্য দ্রুত প্রচার করেছে।
কিন্তু সামাজিক মাধ্যম বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর সম্ভাবনাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আর ভারতে, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় আসার পর থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমাগত ক্ষয়ে যাচ্ছে। অনেক সংবাদমাধ্যমকে এমন তথ্য প্রকাশ না করার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে, যা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অন্য অনেক বড় টেলিভিশন চ্যানেলসহ কিছু সংবাদমাধ্যম আবার সরাসরি সরকারের নীতিকে প্রচার করতে শুরু করেছে। (অবশ্য কিছু ছোট স্বাধীন অনলাইন সংবাদমাধ্যম দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের প্রভাব সীমিত।)
ভারতের অন্যতম প্রধান সাংবাদিক এবং ইন্ডিয়া টুডে টেলিভিশন চ্যানেলের উপস্থাপক রাজদীপ সরদেশাই গত সপ্তাহে টেলিভিশনে দর্শকদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার বিষয়ে একটি খবর প্রচার করার জন্য, যা “সেই মুহূর্তে প্রমাণিত ছিল না,” বলে তিনি স্বীকার করেন।
শনিবার তাঁর ইউটিউব ভিডিও ব্লগে তিনি আবার ক্ষমা চান এবং বলেন যে কিছু মিথ্যা তথ্য ছিল একটি ইচ্ছাকৃত প্রচারের অংশ, যা “জাতীয় স্বার্থের ছদ্মাবরণে ডানপন্থী বিভ্রান্তিমূলক যন্ত্রের” দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, এবং ২৪ ঘণ্টার সংবাদ চ্যানেলগুলো কখনো কখনো সেই ফাঁদে পড়ে যায়।
বিভ্রান্তিমূলক তথ্য—অর্থাৎ এমন তথ্য যা দূরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়—এটি “প্ররোচিত করার জন্য তৈরি, কখনো কখনো গোপন রাখার উদ্দেশ্যেও, কিন্তু মূলত আবেগ উস্কে দেওয়ার জন্য, যাতে বেশি সংখ্যক মানুষ আকৃষ্ট হয়,” বলেন ড্যানিয়েল সিলভারম্যান, কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, যিনি এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন। ভারত-পাকিস্তান প্রেক্ষাপটে, দুই দেশের দীর্ঘদিনের শত্রুতার কারণে সাধারণ জনগণ এমন মিথ্যা তথ্য সহজেই বিশ্বাস করে ও ছড়িয়ে দেয় বলে জানান ড. সিলভারম্যান।
ভারতে, Alt News নামে একটি স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট, যা সামাজিক মাধ্যম এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ছড়ানো বিভ্রান্তিকর তথ্য শনাক্ত করে, অনেক ভুয়া রিপোর্টের প্রমাণ উপস্থাপন করেছে, যেগুলো প্রধান টিভি চ্যানেলগুলো, যেমন আজ তাক এবং নিউজ১৮, প্রচার করেছে।
“তথ্যের পরিবেশ ভেঙে পড়েছে,” বলেন Alt News-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা। ফ্যাক্ট-চেকিং বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, বলেন তিনি, তবে এর একটা মূল্য আছে: Alt News বর্তমানে একটি মানহানির মামলার মুখোমুখি, যেটি অন্য একটি সংবাদমাধ্যম দায়ের করেছে। তাদের সাংবাদিকরাও হয়রানির শিকার হয়েছেন।
রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডারস অনুযায়ী, ভারতে ২০ কোটির বেশি পরিবার টেলিভিশনের মালিক, এবং প্রায় ৪৫০টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল শুধুমাত্র খবরের জন্য নিবেদিত, যা টেলিভিশনকে দেশের অন্যতম প্রধান তথ্য উৎসে পরিণত করেছে।
গত সপ্তাহে, অনেক পরিচিত টিভি চ্যানেল ভারতীয় নৌবাহিনী করাচিতে হামলা চালিয়েছে—এই গল্প সম্প্রচার করে। সেই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এক্স-এ “Karachi” এবং “Karachi Port” ট্রেন্ড করতে শুরু করে এবং সামাজিক মাধ্যমে করাচি শহরের ওপর বিস্ফোরণে সৃষ্টি হওয়া কালো ধোঁয়ার ছবি ছড়িয়ে পড়ে।
পরে ফ্যাক্ট-চেকাররা খুঁজে পান, সেই ছবিগুলো আসলে গাজার ছিল। সংঘাত শেষ হওয়ার পর ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের বিবৃতিতে জানায়, তারা করাচিতে হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে হামলা চালায়নি।
**অনুপ্রিতা দাস এবং প্রগতি কেবির প্রতিবেদন
মূল রিপোর্টঃ
https://www.nytimes.com/2025/05/17/world/asia/india-news-media-misinformation.html
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।