এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  রাজনীতি

  • ২১শে জুলাই 

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | রাজনীতি | ২১ জুলাই ২০২৫ | ৯১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সমস্ত ইতিহাসের মধ্যে এই একুশে জুলাইয়ের ইতিহাসটাই একদম স্মৃতি থেকে বলতে পারি। তখন ৯৩ সাল।  এক বছর আগে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়ে গেছে, দাঙ্গা-টাঙ্গাও, হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কোথায় বিজেপি? লোকে বলত, ওসব তো গোবলয়ের অসভ্য কাণ্ডকারখানা, এখানে শুধু সিপিএম-কংগ্রেস। সিপিএম তখনও ৭২-৭৭ এর কংগ্রেসি গুণ্ডামি আর ১১০০ কর্মী খুন হবার কথা নিয়ে ব্যস্ত। এখন যেমন ৩৪ বছর, তখন ছিল ৭২-৭৭। আর কংগ্রেস ভাবত, এত খুন-জখম-ধর্ষণ-টর্ষনের পরেও, এই সিপিএম ব্যাটারা জেতে কীকরে। গনিখান সোজাসাপ্টা লোক ছিলেন। ভোট-টোটের চক্করে না গিয়ে স্টেনগান হাতে নিয়ে সিপিএমকে বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বলেছিলেন। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের ধারণা ছিল লোকে ভোট দিতে পারলেই তিনি জিতবেন। ওইজন্যই ৯৩ সালে বাধ্যতামূলক ভোটার কার্ডের দাবীতে মিছিল ডেকেছিলেন ২১ জুলাই। 

    তখন মমতা মিটিং ডাকলেই গুছিয়ে ভিড় হত। তার একটা কারণ হল, তিনি ক বছর আগে হাজরা মোড়ে সিপিএমের হাতে মার খেয়ে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে ছিলেন। অতএব তিনি লড়াকু আর সিপিএম বিরোধী। বাকি সব কংগ্রেসি নেতাদের, দলের কর্মীরাই বলত তরমুজ। ফলে সেই মিটিংএও প্রচুর লোক হল। দিদির ভাইরাও সেই সময় ছিল খুব জঙ্গী। ঘটনাস্থলে ছিলামনা বলে গ্যারান্টি দিতে পারবনা, তবে শুনেছি, তারা পুলিশ কর্ডন ভাঙার প্রচুর চেষ্টা করে। ইট-পাটকেলও ছোঁড়ে। পুলিশরা আহত হয়। এবং  পুলিশ সেসময় ছিল আরও জঙ্গী। তারা দুচাট্টে ইট খেলেই, প্রথমে একটু কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে, সোজা দড়াদ্দম গুলিতে চলে যেত। সেবারও যায়, এবং খান তেরো-চোদ্দো লোককে মেরে ফেলে।

    পরের বছর থেকেই শুরু হয় ২১ জুলাই শহীদ দিবস পালন। এর আগে শহীদের ব্যাপারটা একচেটিয়া ছিল সিপিএমের। ৭২ থেকে ৭৭, একটা-দুটো না, ১১০০ শহীদ। তখন দেয়ালে ইন্দিরা গান্ধির বড় বড় নখ আঁকা হত, আর সেই নখ থেকে রক্ত ঝরত। পাল্টা কোনো শহীদ ছিলনা। ২১ জুলাই কংগ্রেসকে কিছু শহীদ দেয়। তরমুজ কংগ্রেস নেতারাই হইহই করে পালন করতে শুরু করেন। 

    এইভাবে কয়েক বছর চলে। তারপরই নাটকীয় পটপরিবর্তন। ১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করে ফেলে কংগ্রেসকে দক্ষিণবঙ্গে প্রায় সাইনবোর্ডে পরিণত করেন। বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধেন। বিজেপির সভাপতি তপন শিকদার, সবাইকে আশ্চর্য করে দমদম থেকে জিতেও যান লোকসভায়। সেই জয় নিয়ে লোকে বহুদিন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করত। কনস্পিরেসি থিয়োরিস্টরা বলত, এতে সুভাষ চক্রবর্তীর হাত আছে। সুভাষবাবু কখনও আমাকে কোনো গোপন মিটিং এ না ডাকায় সত্যাসত্য বলতে পারবনা। 

    কে জানে কেন, সেই বছর থেকেই ২১ জুলাই তৃণমূলের শহীদ দিবসে পরিণত হয়। কংগ্রেস আর ওই বস্তু কখনও পালন করেনি। ভাগাভাগি হলে সব শহীদই নির্ঘাত তৃণমূলে চলে যেতেন, এটা হয়তো তাঁরা জানতেন। কী আত্মবিশ্বাস, ভাবা যায়না। ওদিকে সেই সময়ই চলতে থাকে সিপিএমের সোনার সময়। ১৯৯৬ থেকে ২০০৭। ৯৬ সালে জ্যোতিবাবুকে সারা ভারতের সব দল মিলে ঝোলাঝুলি করতে থাকে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য, কিন্তু সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি দুবার মিটিং করে বলে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী  হওয়াটা একদমই ভালো ব্যাপার না।  ২০০৪ এ বামপন্থীরা ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আসন পায় লোকসভায়। ২০০৬ সালে বুদ্ধবাবু পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সিপিএম নেতা হিসেবে আনন্দবাজারের খেতাব ( ব্র‌্যান্ড বুদ্ধ) পান। উল্টোদিকে মমতা সেবার লোকসভায় নিজে ছাড়া আর কাউকে জেতাতে পারেননি। বিজেপির সঙ্গেও ঝগড়া করে ছেড়ে চলে এসেছেন কদিন বাদে। তখন ২১ জুলাই হত খুবই টিমটিম করে। কীভাবে হত, কে জানে, ঠিক মনেও নেই। 

    ২০০৭ সাল থেকে মমতার কপাল ফেরে। বুদ্ধবাবু ঠিক করেন  পশ্চিমবঙ্গকে সিঙ্গাপুর বানিয়ে দেবেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন শুরু হয়। পুলিশ আবার গুলি করে ১৪ জনকে মারে নন্দীগ্রামে। ২০১১ সালে মমতা ক্ষমতায় আসেন। ২১ এ জুলাইয়ের  সময় যিনি পুলিশ কর্তা ছিলেন, তিনিও সোজা চলে আসেন তৃণমূলে। মমতা জ্যোতিবাবুকে গিয়ে প্রণামও করে আসেন। কোনটা সৌজন্য, কোনটা কী, জানিনা, কিন্তু ২১শে জুলাইও আকার-প্রকারে বাড়তে থাকে। কংগ্রেস সেই সময় মমতার সঙ্গে জোট করেছিল। কিন্তু ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চে কেউ থাকতেন শুনেছি বলে মনে পড়ছেনা। হয়তো থাকতেন, কিন্তু শহীদ দিবসটা তৃণমূলেরই ছিল। 
    কংগ্রেস শহীদ দিবসের সর্বসত্ত্ব ত্যাগ করে সিপিএমের সঙ্গে জোট করে ২০১৬ সালে । অধীররঞ্জন খালি 'সিপিএমের শহীদ আমাদের শহীদ' বলতে বাকি রেখেছিলেন। সিপিএমও পাল্টা হিসেবে নিজেদের ১১০০ শহীদকে ছেড়ে দেয়। শহীদে শহীদে কাটাকুটি হয়ে যায়। সিপিএমের ব্রিগেডে অধীর, নৌশাদ, এদেরকে দেখা যেতে শুরু করে। বাংলাদেশে যেমন জেনজি ইতিহাস শুরু হচ্ছে ২০২৪ থেকে, বাম-কংগ্রেস জোটও অতীত রিসেট করে ইতিহাস শুরু করে ২০১৬ থেকে। 

    এই সময় ক্রমশ ২১ জুলাইয়ের আকার বাড়তে থাকে, আর ডিম্ভাত জোক শুরু হয়। সিপিএম আমলেও মাছভাত (মার্ক্সবাদ) জোক ছিল, কিন্তু খুবই সামান্য। ২০১৯ থেকে সিপিএমে শূন্য যুগ শুরু হয়, আর ২১শে জুলাই এলেই এই ডিম্ভাত জোক, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।  এইটাই মোটামুটি চলছে বছর পাঁচ ধরে। 

    তার মানে অবশ্য এই নয়, যে, ব্যাপারটা একঘেয়ে হয়ে গেছে। প্রতিবারই নানা চমক থাকে। এবারের চমক এই, যে, মোটামুটি এত বছর ধরে চলার পর ২০২৫ সালে অবশেষে কলকাতা হাইকোর্ট বুঝতে পেরেছে, যে, ২১ শে জুলাই সমাবেশ করলে যানজট হয়। আমি অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে অনেকদিন ধরেই এই গোপন ব্যাপারটা জানতাম। বললে বিশ্বাস করবেন না, এসপ্ল্যানেডের সব বড় মিটিংয়েই হয়, এটাও আমি জানি। 

    যাহোক, তাতেও দুগ্গা দুগ্গা করে ২১শে জুলাই হচ্ছে। আদালত পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে উদ্যোক্তারা যেন এই মিটিং অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাবার কথা বিবেচনা করেন। সে, ইচ্ছে হলে নিয়ে যান, কিন্তু বন্ধ যেন না করেন। সিপিএমের ব্রিগেড আর তৃণমূলের ২১শে জুলাই বাংলার ঐতিহ্য। গানের জগতে যেমন ডোভার লেন। এর কোনো একটায় ডাক না পেলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মান থাকেনা। কেউ দুটোতেই ডাক পেলে আমরা সেটাকে গ্র‌্যান্ড স্লাম বলতে পারি। নৌশাদ আর কং সভাপতি কি কেরিয়ার স্লাম পাবেন? দিলীপ ঘোষ কি হঠাৎ মঞ্চে উপস্থিত হবেন? এইসব চমক দেখার জন্যই  বছর বছর ধরে এই মিটিংগুলো হয়ে চলা দরকার। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২১ জুলাই ২০২৫ | ৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sambuddha Bisi | ২১ জুলাই ২০২৫ ১৩:৫৪732591
  • টাইমলাইন কে জিপ করে ফেলায় যে জাদুবাস্তবতা জন্মায়, এটা আগেও দেখেছি। বন্দরের সান্ধ্যভাষাতেও।
     
    আলঝেইমার সুলভ বিস্মৃতির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা  একটা জাতির কিছু ইতিউতি মানুষ চিরকুটে কিসব লিখে রাখে, নইলে যদি ভুলে যায়? সে গল্প কি আর্কেদিও না আর্কেদিও বুয়েন্দিয়ার? অরেলিয়ানো না অরেলিয়ানো হোসের? এত বছর বাদে সে আর মনে পড়ে না।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন