বললে হবেনা, ছোটোবেলায় আমিও দাবা খেলতাম। ঘোড়াই আড়াই চাল, সিসিলিয়ান ডিফেন্সের নাজডর্ফ ভ্যারিয়েশন, সব জানি। হ্যাঁ, তারপর অনেকদিন ওসব ফলো করা হয়না। কিন্তু কাল দেখলাম গুকেশকে। নামটা যেন একটু কেমন মতো, কিন্তু কী চাউনি, বাপরে। ব্যস পুরো দাবা ব্যাপারটাই মনে পড়ে গেল, সাঁতার আর সাইকেল কী কেউ ভোলে রে ভাই। আঠারো বছর ধরে রগড়ানো, বোরিং গলা সাধা, ওসব কী আর লাগে। দাবা হল অ্যাটিটিউড। আসল কথা হল, ক্রিকেট খেলতে হলে লর্ডসের বারান্দায় জামা ওড়ানো আর দাবার বোর্ডে প্রতিপক্ষকে চাউনি দেওয়াটা শিখতে হবে। দৃষ্টিই হল সৃষ্টি। ঘোড়ার আড়াই চাল, সেসব নেহাৎই বা*।
হেঁহে, মিল দিচ্ছে দেখে চমকে যাবেননা, ছোটোবেলায় আমি সাহিত্য টাহিত্যও করতাম। আজি এ প্রভাতে রবির কর। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো সে তরী। কী সব কবিতা। পরের দিকে বোর হয়ে কাটিয়ে দিই। তখন কবিরা কীসব হাবিজাবি জিনিস লিখতে শুরু করল। রাত নাকি মশারির মতো উড়ছে, চুল নাকি বিদিশার নিশা, রোদ নাকি কমলালেবুর মতো। দাদুর লাল টমেটো নিয়ে ওইরকম আমরাও কত লিখেছি। কিন্তু তারপর যা হয়, কাজকর্মের চাপ, আর হয়নি। অনেকদিন পরে একজন আধুনিক কবির একটা লেখা পড়লাম। নবারুণ ভট্টাচার্য। হার্বার্ট না কী একটা লিখে অ্যাকাডেমি পেয়েছিল, সেইটা পড়া হয়নি। কিন্তু ফ্যাতাড়ু পড়েছি। বাপরে বাপ কী খিস্তি, অনুব্রতকেও হারিয়ে দেবে। পড়েই লেখা ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল। আবার লিখতে শুরু করলাম। "দাদুর লাল টমেটো / চাইলে দেবে জোমাটো।" কত্ত লাইক রে ভাই। রবীন্দ্রনাথও পাননি। উনি অবশ্য গাঁয়েগঞ্জে বোটের উপরে থাকতেন, আর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। এইসব লাইক-শেয়ারে মন ছিলনা। সবার তো সব কিছু হয়না।
হ্যাঁ, রবীন্দ্রসঙ্গীত বলতে মনে পড়ে গেল, আমি গান-টানও গাইতাম। না না, ওইসব অ্যাঅ্যা করে কীসব গলা সাধে, ওইগুলো না। নিজের মনে ঝরণার পাশে, জঙ্গলে ঢুকে পাখির সঙ্গে সুর মেলাতাম। ওগুলোই তো আসল গান, প্রকৃতি থেকে এসেছে। গাওয়াও সোজা। সেইজন্য তারপর একটা গিটার কিনে বাউল ধরি। ওটাও বেশ সোজা। ফেঁড়ে চেঁচালেই হয়। বাউলরাও তো গিটারের মতোই বাজায়, ট্যাং ট্যাং করে। ওটাকেই ব্যাঞ্জো বলে কি? না ব্যাঞ্জো তো পিট সিগার বাজাতেন। আঃ কী মহান গায়ক ছিলেন, আমি ছোটো করে ডাকতাম পিটার। সেই নিয়েও একটা গান লিখেছিলাম। "তুমি আমার সিগার / বিগ বিগ বিগ বিগার / তুমি আমার পিটার / বাউলে ধরেছে গিটার। " এর পরেরটা আর লেখা হয়নি। কারণ বাবা গিটারটা ভেঙে দিল। বললাম বটে জঙ্গলে গান গাইতাম, কিন্তু সে তো কথার কথা, আসলে বাড়িই তো জঙ্গল, কংক্রিট জঙ্গল। বাবা ছিল হিংসুটে দৈত্য। যা হোক, বাবা ভেবেছিল গানের ভূত গেছে। কিন্তু জানবে কীকরে যে অনেক দিন পরে রূপমের গান শুনব। শুনিনি ঠিক, ভিডিওতে দেখলাম। উরেত্তারা কী রক, কী মাথা ঝাঁকায়। ব্যস, আমি আমার হারানো সংগীত আবার খুঁজে পেলাম। এখন বাথরুমে রোজ মাথা ঝাঁকাই। বাবা আর নেই, কিছু বলারও নেই। সময় লাগলে বৌ চেঁচায়। কিন্তু শিল্পীদের ওসব সহ্য করতে হয়। কত শিল্পী কত অত্যাচার সহ্য করেছে, শহীদও হয়েছে। নাম ভুলে গেছি, কিন্ত বইপত্রে সব লেখা আছে।
হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। আমি রাজনীতিও করতাম। তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা, এমন দিন এনে দেব। খামোখা প্রিয়তমাকে দিন এনে দেব কেন ঠিক বুঝিনি, রাত হলেই তো ব্যাপারটা ভালো হত, কিন্তু রাজনীতিতে ওসব প্রশ্ন করতে নেই। লোকে প্যাঁক দেবে। রাজনীতি ব্যাপারটা সিম্পল। পাশের ছেলে যদি ইনকিলাব বলে তখন বলতে হবে জিন্দাবাদ। পাশের ছেলে যদি বন্দে বলে, তখন বলতে হবে মাতরম। আর পাশের মেয়ে বললে, উফ। দুগুন জোরে বলতে হবে। বাইক থাকলে পিছনে চাপিয়ে ভোঁ করে উড়ে যেতে হবে। কিন্তু দুঃখের কথা কী বলব, বাইক চালানোটা শেখা হয়নি, গিটার কাণ্ডের পর বাবা আর কিনে দেয়নি। আর মেয়েদের রাজনীতিতে এত ইন্টারেস্ট কম, যে, জোরে-জোরে স্লোগান দেবার উৎসাহও বেশিদিন রইলনা। তখন সবই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু সেখানেও ওই একই কেস। রক্তে যা একবার ঢুকেছে, সে বেরোবে কীকরে। জিনে ঢুকে যাবে তো। এখানেও একদিন দেখলাম উনিজিকে। উরিত্তারা কী নেতা। আমারও উপর দিয়ে যান। আমি তবু ছোটোবেলায় দুলাইন কবিতা পড়েছি, একটু গিটার বাজিয়েছি। কিন্তু ইনি কোনো ট্রেনিং ছাড়াই হেলমেট নিয়ে সোজ ফাইটার প্লেন চালাতে চলে যান। দেখেই রক্তে দোলা লাগল। সেই না-পাওয়া বাইকের স্মৃতি মনে এসে গেল। রাজনীতি কেউ কখনও ভোলে না। জয়শ্রী বলে তাই এবার একটা বাইক কিনে ফেলেছি। না, চালাতে এখনও জানিনা। কিন্তু তাতে কী, কেতার হেলমেটটা তো আছে। হাতে নিয়ে বাইকে বসব। তারপর ভোঁ করে উড়ে যাব। কোথায়? সেটা এখনও ঠিক করিনি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।