যে মিছিল কখনও থামে না
শহরের পুরনো গলিতে আলো আর অন্ধকারের অদ্ভুত খেলা। গলির দুভাগে দাঁড়ানো বাড়িগুলো যেন আর নিছক ইট-কাঠ নয়।অনিকেতের মনে হচ্ছিল এই বাড়ি গুলোর মধ্যে প্রাণ আছে। বারান্দা থেকে মাথা বাড়িয়ে থাকা ছায়ারা কারও চোখে লাল আলো, কারও মুখে নীল আভা নিয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তায়। কে জীবিত, কে মৃত—তা বোঝা যাচ্ছে না।
অনিকেত মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। প্রতি বছরই সে এই শোভাযাত্রা দেখে, কিন্তু এবার কিছু যেন আলাদা। ধোঁয়া ঘনিয়ে আসছে, ঢাকের শব্দ বুকের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে।
“আবার একই নাটক,” সে নিজেকে বলে। “প্রতিমা আসবে, আলো ঝলকাবে, শেষে নদীতে ভেসে যাবে। কিছুই বদলায় না।”
ঠিক তখনই পাশেই ভেসে উঠল ঢাকের বোল। বাজাচ্ছে জগা কাকু, আধাঅন্ধ বুড়ো ঢাকী। তার গলা ফিসফিস করে উঠল—
—“ভালো করে দেখিস, অনিকেত। আজ দেয়াল গুলো নিশ্বাস নিচ্ছে।”
অনিকেত চমকে উঠল। সত্যিই, ভাঙা ইটের ফাঁক থেকে কুয়াশার মতো ধোঁয়া উঠছে, যেন মানুষের নিঃশ্বাস।
এমন সময় বারান্দা থেকে মোহিনী বৌদির কণ্ঠ কেঁপে উঠল।
—“ওই দেখ অনিকেত! আলোয় দাঁড়িয়ে আছে আমার রমেন!”
অনিকেতের বুক কেঁপে গেল। রমেন—পাড়ার কিংবদন্তি স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাকে ব্রিটিশরা ধরেছিল এক বৈঠক থেকে। কেউ বলেছিল জেলে মারা গেছে, কেউ বলেছিল ফাঁসিতে। তারপর থেকে মোহিনী বৌদি প্রতিদিন সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে আর ভাবে রমেন দা নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।
কিন্তু আজ ঘটল অন্য ঘটনা—কেউ কেউ দেখল প্রতিমার আলোয় সত্যিই এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। বুক সোজা, চোখে আগুন। ঠিক যেমনটা স্বাধীনতার স্বপ্নে থাকা মানুষের চোখ হয়।
অনিকেত বলতে চাইল—“না বৌদি, ও আলো”—কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বেরোল না। কারণ চোখ দুটোতে যে জেদ ঝলসে উঠছে, সেটা আলো নয়, মানুষের আত্মা।
প্রতিমা এগিয়ে আসছিল। বাঁশে বাঁধা নয়, কারও কাঁধে তোলা নয়—তিনি যেন নিজেই ভেসে চলেছেন। চারপাশে শঙ্খ বাজছে, অথচ কারও হাতে শঙ্খ নেই। বাতাসই যেন বাজাচ্ছে, মৃতদের কণ্ঠে।
অনিকেত ভয়ে জিজ্ঞেস করল—
—“এ কি করে সম্ভব?”
জগা কাকু ঢাক বাজাতে বাজাতে বলল—
—“যাদের মৃত ভেবেছিস, তারাই বাজাচ্ছে। এ শহর তাদের কখনো ভোলে না।”
বারান্দার ছায়াদের ভিড় আরও ঘন হলো। পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া ছাত্র, লাঠির আঘাতে লুটিয়ে পড়া শ্রমিক, ফাঁসির মঞ্চে হাঁটা বিপ্লবী—সবাই দাঁড়িয়ে আছে আজ। প্রতিমার আলোয় তারা জীবিত। আর সামনে দাঁড়িয়ে রমেন, যেন শহরের ইতিহাসের মুখপত্র।
মিছিল এবার নদীর দিকে নামল। কিন্তু নদী আর গঙ্গা নয়—এ যেন কালো কুয়াশার এক বিস্মৃতির স্রোত। প্রতিমা তাতে ঢুকতেই শরীর খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেসে গেল। হাত একদিকে, চোখ অন্যদিকে, আলো ছড়িয়ে গেল চারদিকে।
অনিকেত কেঁপে ফিসফিস করে বলল—
—“এ কোন নদী?”
শহর নিজেই উত্তর দিল, অদৃশ্য কণ্ঠে—
“এ আমার স্মৃতির নদী। আমি যা ভুলে যাই, সব এতে ভেসে যায়। প্রতিবার বিসর্জনে আমি নিজেকে খাই।”
অনিকেত স্তব্ধ। আলো তার বুকের ভেতরে ঢুকে গেছে। মনে হচ্ছে রমেন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, পতাকা হাতে।
জগা কাকু ঢাক থামিয়ে বলল—
—“ভ্রম আর সত্যি আলাদা কোথায় রে? যতদিন আলো বাঁচে মানুষের ভেতর, ততদিন শহর বাঁচে। যেদিন আলো নিভে যাবে, সেদিন শহরও নিভে যাবে।”
অনিকেত তাকাল চারপাশে। ভিড় ছড়িয়ে যাচ্ছে, বারান্দার ছায়ারা মিলিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রতিটি মানুষের চোখে ছোট ছোট দীপশিখা জ্বলছে।
সেই আলোয় অনিকেত বুঝল—এ শুধু প্রতিমার বিসর্জন নয়। এ এক শহরের ইতিহাস, এক স্বাধীনতার মিছিল, যে মিছিল কখনও থামে না। যে মিছিল কখনো থামে না।
কোন্নগর পর্যন্ত
জিরাট থেকে উঠেছি, কোন্নগর যাব। প্রতিদিনই যাই—সকালের আটটা ত্রিশের কাটোয়া–হাওড়া লোকালে। সবাই জানে, আমি পেছনের দিকের লেডিস কামরার আগের কম্পার্টমেন্টে উঠি। নিয়মিত যাত্রী আমি, ডেলি প্যাসেঞ্জার।
শীতের সকাল। কুয়াশা ঝুলছে ধানক্ষেতের ওপর। জানলার বাইরে ঝাপসা আলোয় ভেসে যাচ্ছে আমবাগান, তালগাছ, ছিটেফোঁটা বাড়িঘর। ট্রেনের ছন্দে মনটা একরকম তন্দ্রায় ভাসছে। কানে ইয়ারবার্ড গুঁজে গান শুনছি—পুরনো, পরিচিত সুর। জানলার কাঁচে হঠাৎই নিজের মুখটা অচেনা লাগল। চোখ দুটো যেন অন্য কারও।
পাশের সিটে বসে আছেন দাঁইহাট থেকে ওঠা বিশুদা—রোজকার সহযাত্রী। পায়ের নিচে পুরোনো কালো ব্যাগটা আগের মতোই রাখা। আচমকা তিনি মৃদু গলায় বললেন,
— “মাস্টারমশাই, আপনার ছায়াটা নড়ছে না।”
চমকে নিচে তাকালাম। সত্যিই, পায়ের পাশে পড়ে থাকা ছায়াটা একটুও নড়ছে না! অথচ ট্রেন দুলছে, সকালের আলো বদলাচ্ছে।
বিশুদা হেসে বললেন,
— “সবাই ভাবে, ছায়া তার সঙ্গে থাকে। আসলে মানুষই ছায়ার সঙ্গে থাকে—যতদিন সে চায়।”
আমি কিছু বলার আগেই তিনি চোখ বন্ধ করলেন। মিনিট কয়েক পরে, ।চোখ মেলে দেখি—সিটটা ফাঁকা, বিশুদা নেই শুধু কালো ব্যাগটা পড়ে আছে একা।
ট্রেন আবার চলল। জানলার বাইরে সূর্যের আলো আরও উজ্জ্বল, অথচ কাঁচে আমার কোনো প্রতিচ্ছবি নেই।
কোন্নগরে নেমে দেখি—মাটিতে আমার ছায়া নেই।
ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটছি, কিন্তু টের পাচ্ছি—কেউ যেন আমার পেছনে ধীরে ধীরে পা ফেলছে। নিঃশব্দে, ছায়ার মতো।
জিরাট থেকে কোন্নগর পর্যন্ত আমি আজ খুঁজে ফিরছি আমার ছায়াটাকে। ভাবছি—আমার ছায়া কোথায় গেল?নাকি আমি-ই এখন ছায়া হয়ে বেঁচে আছি, কারও অচেনা রোদের নিচে?