গঙ্গা ! শুকিয়ে যাচ্ছ কেন?
হাজারিকা সাহেবের সেই কালজয়ী গানের কথাগুলো মনে আছে তো!
বিস্তির্ণ দু- পাড়ে , অসংখ্য মানুষের
হাহাকার শুনেও -
ও গঙ্গা তুমি,ও গঙ্গা তুমি
শুকিয়ে যাচ্ছ কেন?
ও গঙ্গা! শুকিয়ে যাচ্ছ কেন?
কি! একটা জোর ধাক্কা খেলেন নাকি। শেষ লাইনটাকে একটু অদল বদল করেছি মাত্র। আর তাতেই বুঝি জোর ঝটকা এসে লাগলো মনে? আজ্ঞে হ্যাঁ,এটাই বাস্তব, এই মুহূর্তের রূঢ় বাস্তব ! জল থাকলে গাঙ্ সজীব,সচ্ছন্দ প্রবাহী। কিন্তু সেই জলের জোগানে যদি টান পড়ে, তাহলে? তাহলে গাঙ্ তার খলখলানি গতি হারিয়ে, শুকনো খটখটে, ফুটিফাটা মাঠ। এমনটাই বুঝি ঘটতে চলেছে আমাদের প্রিয় গঙ্গা মাইয়ার ক্ষেত্রেও। বিষয়টাকে একটু তথ্যের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়া যাক্।
আমরা সবাই যখন উৎসবের উদযাপনে মশগুল ঠিক তখনই সামনে এসেছে এক অতি পরিচিত মার্কিন গবেষণাপত্রিকা Proceedings of the National Academy of Science – থেকে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিবেদন। এই গবেষণা পত্রটিতে আশঙ্কা প্রকাশ করে জানানো হয়েছে যে বিগত ১৩০০ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের জন্য উপমহাদেশের প্রাণদ প্রবাহী নদীটির অববাহিকার হাইড্রোলজিকাল বা ঔদিক স্থিতাবস্থায় বড়ো রকমের নেতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে ক্রমশ বাড়তে থাকা তাপমাত্রার সতর্কবার্তা যা নদীর প্রবাহকে আগামীদিনে আরও সীমিত করবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। গঙ্গা নদীর শুকিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষের জীবনরেখা শুকিয়ে যাওয়া। পর্যবেক্ষণ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে কিন্তু এমনই ভয়ঙ্কর আশঙ্কার ইঙ্গিত রয়েছে। এরফলে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল এলাকার আবাসিকদের জল নিরাপত্তা, কৃষি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সামগ্রিক আর্থ - সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের ওপর গভীর প্রভাব পড়বে সন্দেহাতীতভাবে।
গুজরাটের গান্ধীনগর আই.আই.টি.র একদল গবেষকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। বিগত ১৩০০ বছরের পুরনো বিস্তর নথিপত্র, পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখেছেন তাঁরা– যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ইনস্ট্রুমেন্টাল ডেটা, পুরা আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য এবং আধুনিক হাইড্রোলজিক্যাল মডেলকে কাজে লাগিয়ে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। তাঁদের বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে যে ১৯০০ সালের গোড়ার দিক থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত গঙ্গার প্রবহন মাত্রা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পেয়েছে যা , তাঁদের মতে, ষোড়শ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ভয়ঙ্কর খরা পরিস্থিতির তুলনায় অনেক বেশি। আই .আই .টি. গান্ধীনগরের তরফ থেকে প্রকল্পের অন্যতম গবেষক শ্রী দীপেশ সিং চুফল জানিয়েছেন – “ বিগত তিন দশক সময়কালের মধ্যে গঙ্গার প্রবাহী এলাকা গভীর খরা পরিস্থিতির শিকার হয়েছে, বিশেষ করে ২০০৪– ২০১০ সালের মধ্যবর্তী খরা পরিস্থিতির পর্বটি ছিল ফেলে আসা এক মিলেনিয়াম সময় কালের মধ্যে শুষ্কতম। এই পরিস্থিতিতে নদীর জলের জোগানে টান পড়েছে ভয়ানকভাবে। ঘাটতি এতোটাই যে এই ধরনের পরিস্থিতি চট্ করে কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।”
গবেষকদের পেশ করা আবহাওয়া দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নদীর অববাহিকা অঞ্চলে দুটি - ( ১৯৯১ - ১৯৯৭ ) ও (২০০৪– ২০১০ ) সপ্তবর্ষব্যাপী মহা খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যার তীব্রতা অববাহিকার ১৩০০ বছরের আবহিক ইতিহাসের সমস্ত পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে গেছে। মৌসুমি বায়ুর দেশ হিসেবে মান্যতা প্রাপ্ত ভারতবর্ষে খরা আসে মরশুমি বৃষ্টিপাতের অনিয়মিতির কারণে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে, বদলে গেছে বৃষ্টিপাতের চেনা চরিত্র। ফলে খরার শিকার হতে হচ্ছে আমাদের।
তবে সবটাই কি জলবায়ুর পরিবর্তনের ফল? উঁহু, মোটেই তেমন নয়। এর পেছনেও রয়েছে মনুষ্য তাড়িত বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের ছায়া। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি যে ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সংঘটিত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে প্রায় লাগাতার ভাবে। আবহবিদরা বারংবার সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন যে উপমহাদেশের জলবায়ুর ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তারকারী সমুদ্রের জলের উষ্ণতা ক্রমশই বাড়ছে। এরসাথে যুক্ত হয়েছে বৃষ্টিবিন্দু সৃষ্টির পেছনে অনন্য ভূমিকা পালনকারী এরোসল কণিকাদের দূষণজনিত চরিত্র বদলের বিষয়টি। এই কারণে ১৯৫০’ এর পর থেকে আজ পর্যন্ত অববাহিকায় গড়পড়তা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০% কমেছে। অববাহিকার পশ্চিমাংশের বৃষ্টি হ্রাসের পরিমাণ কমবেশি ৩০% ‘ এর কাছাকাছি।
গবেষকরা সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন যে, উষ্ণতা বৃদ্ধির চলতি হার যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আগামীদিনে অববাহিকার জল ভারসাম্য ব্যাপকভাবে বদলে যাবে। হ্রাসমান গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাতের কারণেই যে অববাহিকার নদীতে জলের পরিমাণ ক্রমশ কমছে সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তাপমাত্রা বেড়ে যাবার প্রভাব এখানে অনেকটাই গৌণ। অবশ্য একই সঙ্গে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং উষ্ণতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে নদীতে জলের প্রবহন মাত্রায় ৫% থেকে ৩৫% ‘ এর মতো ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে গঙ্গা অববাহিকার মধ্যভাগের অংশটি হলো ভারতের সমৃদ্ধতম কৃষি এলাকা- ভারতের শস্যভাণ্ডার। বৃষ্টির ঘাটতির পরিমাণ মেটাতে এই অঞ্চলের কৃষকেরা মাটির নিচের জল পাম্পের সাহায্যে তুলে নেয় অনিয়ন্ত্রিতভাবে। এরফলে নদীতে জলের জোগান আরও কমে যায়, কেননা বৃষ্টির জল যা মাটির গভীরে ঢোকে তার একটা বড়ো অংশই চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে জমা হয় নদী খাতে। এরফলে নদীর জলসীমার শ্রীবৃদ্ধি হয়। কৃষকেরা এই জল তুলে নেবার ফলে নদীধারা এই পুষ্টিকরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং নদী শুকিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। এই দুই কারণেই গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহমানতা কমছে উদ্বেগজনক হারে।
এভাবে নদীর জলের জোগানে টান পড়ার প্রতিফল ইতোমধ্যেই টের পেতে শুরু করেছেন নদীকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকা বিপুল পরিমাণ মানুষজন। গঙ্গার জল আমাদের জীবনের মূল ধারাকে আবহমানকাল সঞ্জীবিত রেখেছে, আজও রাখছে। ফলে নদীতে জলের জোগান কমলে নির্ভরতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার অনিবার্য প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। হয়েছেও ঠিক তেমনটাই।২০১৫ - ২০১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নদীর জলতলের অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে পানীয় জলের জোগান থেকে শুরু করে, কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় সেচের জল,জলপথ পরিবহন পরিষেবা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সবকিছুই নিদারুণ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ১২০ মিলিয়ন মানুষের জীবনে নেমে আসে চরম সংকট। নদীপথ বেয়ে বঙ্গোপসাগরে বিবিধ খণিজ পুষ্টমৌল সমৃদ্ধ জলের জোগান কমে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের একাংশ। হ্রাস পায় মাছের জোগান।
আলোচ্য গবেষণার সবথেকে কঠিন দিক হলো এই যে, কোনো চলতি বৈশ্বিক জলবায়ু মডেলের সাহায্যেই অববাহিকার জলবায়ুর এই পরিবর্তন তথা নদীতে জলের জোগান কমে যাবার কারণের সঠিক উত্তর মিলছে না। চেনা মডেলগুলো সবই এখানে অকেজো হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি বাড়লে জলের জোগান বাড়বে গোছের কথাতেই আটকে গেছে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী। সত্যি বলতে কি, এখানেই প্রবল হয়ে উঠেছে জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কিত মডেলের যৌক্তিকতা।
এই গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বিশেষজ্ঞ আই.আই.টি. গান্ধীনগরের অধ্যাপক বিমল মিশ্রের মতে – “আগামীদিনে গঙ্গা জলের জোগান ও ব্যবহারিক নিশ্চয়তার বিষয়টি অনেকাংশেই নির্ভর করবে, আমরা কীভাবে আবহবিজ্ঞানের মূলসূত্রগুলোকে মাথায় রেখে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে পরিচালনা করবো এবং সর্বস্তরেই জলের ব্যবহারকে মান্যতা দেবো তার ওপর।”
গবেষকরা এখনো আশাবাদী। তাই তাঁদের একাংশের মতে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে যদি অদূর ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যায় তাহলেই হয়তো আগামী ২০৪০ সাল নাগাদ গঙ্গানদী তার স্বাভাবিক প্রবাহ ছন্দকে ফিরে পেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মানুষের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপকে পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে গঙ্গা নদীর ভবিষ্যৎ আরও আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
পাঠকদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন যে গঙ্গার আবার চিন্তা কিসের? হিমালয়ের বরফগলা জল বয়ে নিয়েই তো সে পুণ্যতোয়া ! খুব খাঁটি কথা। তবে কথায় বলেনা,বিপদ কখনো একলা আসেনা। এক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটতে চলেছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বিশৃঙ্খলার কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণে যেমন অনিয়মিতি ঘটছে,তেমনই তাপমাত্রা বেড়ে যাবার কারণে গভীর সংকটময় পরিস্থিতির শিকার হয়েছে পাহাড়তলির হিমবাহরা। এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে পৃথিবীর তাবৎ
হিমবাহ।তাদের সংকোচনে গভীর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে গঙ্গাসহ অন্যান্য নিত্যবহ নদীদের ভবিষ্যৎকে ঘিরে। তাই বিপদ ঘনায়মান এদিক থেকেও। হিমবাহ গলনের ফলে নদীর অস্তিত্বের সংকট যে আরও বাড়বে তাতে আর সন্দেহ নেই।
গঙ্গা, শুধু একটি নদীর নাম নয়। গঙ্গা আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিরূপ। আর্যাবর্তের মানুষের সমাজ সংস্কৃতি অর্থনীতি সংস্কার সব কিছুর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে এই সুরধনী। এই নদীকে অবলম্বন করেই ভারতীয়ত্বের গৌরবময় বিকাশ। অথচ এই নদীর প্রতি আমাদের অবজ্ঞা উদাসীনতা অনাদর মোটেই কম নয়। অভিমানিনী জাহ্নবী তাই হয়তো শুকিয়ে যাচ্ছে নীরবে,সবার অলক্ষ্যে। রাজকাপুর সাহেব বিগত শতকের ষাটের দশকে এক ফিল্ম নির্মাণ করেছিলেন – জিস দেশমে গঙ্গা বহতী হ্যায়। সেই ফিল্মে গঙ্গা হলো আমাদের অস্তিত্ব ও অস্মিতার প্রতীক। আজ গঙ্গা নদী যদি শুকিয়ে যায় তাহলে আমাদের গর্বের পুঁজিতে টান পড়বে না তো? কুলকিনারা পাবনা জানি, তবুও আসুন ভাবতে বসি সবাই মিলে।
তথ্য সূত্র।
বিভিন্ন সর্বভারতীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।