পুজোর ক’দিনের পেট পুজো।
সকালে স্বহস্তে প্রস্তুত চা এর পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে মুঠোফোন সচল করতেই নজরে এলো আমার ভগিনী ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছে। আঙুল ছুঁয়ে তাকে সচল করতেই কানে এলো তাঁর কন্ঠস্বর। বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে সে স্মৃতিচারণ করেছে আমাদের ফেলে আসা কিশোর - কিশোরী বেলা নিয়ে। প্রসঙ্গ: শারদীয়া সাহিত্য পত্রিকা ও পুজোর কদিনের খাওয়া দাওয়া।
সারাবছর তো কথার কচকচানিতেই কেটে যায়,তাই আজ বরং সেকেলে পুজোর কদিনের পেট পুজো নিয়ে দু- চার কথা বলি। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির এই সময়ে সেটাই নেহাৎ মন্দ হবেনা। কী বলেন আপনারা? অবশ্য লেখা পড়ে কত শতাংশ উদরপূর্তি হয় তা আমার জানা নেই।
গোড়াতে অবশ্য আমাদের সেই আদ্যিকালের কথা খানিকটা বলে কয়ে নিই। সকলের মতো আমাদের সংসারটাও আগলে রাখতেন মা। প্রতিদিন তাঁকে বাস ট্রামের ভিড় ঠেলে সরকারি
অফিসে যেতে হতো - সেই ডালহৌসি পাড়ায়। মায়ের ছিল প্রচণ্ড সেলাইয়ের নেশা। পুজোর দিনগুলো এগিয়ে আসতেই তাঁর ব্যস্ততা বেড়ে যেত কয়েকগুণ। মায়ের হাতে তৈরি পুজোর জামাকাপড় পরতে পারা ছিল আমাদের গৌরব আর অস্মিতার কারণ। পরিচিতজনেরাও মুখিয়ে থাকতো আমাদের সাজপোশাক দেখার জন্য। শুধুমাত্র আমাদের তিন ভাই বোনের জন্য তো নয়, আমার তুতো ভাইবোনেদের জন্যও মা বানিয়ে ফেলতেন রকমারি শার্ট প্যান্ট ফ্রক। সেইসব জামাকাপড়ের জন্য তারাও বেশ আগ্রহী হয়ে অপেক্ষায় থাকতো। এই কাজে মায়ের আনন্দ,মনোযোগ ও ব্যস্ততা এতোটাই আন্তরিক ছিলো যে পুজোর কদিন রান্নাঘরে পঞ্চ ব্যঞ্জন রান্না করার ধৈর্য্য আর সময় থাকতো না। তা বলে কি রান্নাবান্না বনধ্ ? মোটেই না। তাও চলতো ঘরোয়া নিয়মে।
একালের তুলনায় সেই কালে হেঁসেল সামলাতে রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হতো আমাদের মা- ঠাকুমা - কাকিমা - জ্যেঠিমাদের। খুব বড়ো একান্নবর্তী পরিবারে রান্নাঘরের রকমারি কাজ ঠিকঠাক সামলে ওঠা তাঁদের কাছে ছিল রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। কেন? সেকালে রান্না ঘরে গ্যাস স্টোভ ছিলোনা। সমস্ত রান্না হতো কয়লার উনোনে। তাকে ঠিকঠাক ধরানোই ছিল এক নৈমিত্তিক শিল্প এবং ঝঞ্ঝাট। এ কাজের জন্য প্রত্যেক বাড়িতেই মজুদ করে রাখা হতো বিচিত্র সব ইন্ধন – কয়লা,কাঠ, ঘুঁটে, কেরোসিন। উনোনেরও ছিল রকমফের – পাতা উনুন এবং তোলা উনুন। আমাদের অবশ্য তোলা উনুনেই কাজ চলে যেত। প্রতিদিনের রান্নার মেনুতে কী কী থাকবে তা আগেভাগে ছকে না রাখলে তাল সামলানো যেতোনা। এই কাজটি করতেন বাড়ির কর্ত্রী। সেই অনুযায়ী বাজার থেকে সবজি আর মাছ কিনে আনতে বলা হতো। তারপর কাটাকুটি করে উনুন অবধি নিয়ে যাওয়াটাও ছিল এক জটিল নিত্যকর্ম। মেনু যাতে একঘেয়ে না হয় তার জন্যও চলতো নানান ভাবনাচিন্তা।
প্রতিদিনের তুলনায় পুজোর কদিনের রান্না যে বিশেষ ধরনের হতো তা বলাই বাহুল্য। নিরামিষ রান্নার ব্যাপারে আমার ঠাকুমা ও পুটুমার জুড়ি ছিলোনা। কত অতি সাধারণ উপকরণ দিয়ে তৈরি বিচিত্র সব পদ তাঁদের যাদু হাতের ছোঁয়ায় অসাধারণ হয়ে উঠতো তা বলে শেষ করা যাবে না। এঁদের দুজনের রক্তেই মিশে ছিল ঐতিহ্যবাহী ঢাকাইয়া এবং বরিশালিয়া রন্ধন ধারার অতুলনীয় পরম্পরা। সেই ধারাই চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে জমা হয়েছে এই প্রজন্মের মধ্যে।
পুজোর কটা দিন আমাদের মেনুতে নিরামিষ আর আমিষের একটা ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা চলতো। ষষ্ঠীর দিন আর দশমীর দিনে আমাদের বাড়িতে নিরামিষ খাবার চল ছিল। আমার পিতৃদেব অবশ্য নির্ভেজাল নিরামিষ আহার খুব পছন্দ করতেন না, তাঁর প্রতিদিনের পাতে মাছ থাকাটা আবশ্যক ছিল। অবশ্য পাতে ঠাকুমার হাতে তৈরি নিরামিষ পদ থাকলে তা পরমানন্দে চেটেপুটে খেয়ে নিতেন।
যাইহোক,ষষ্ঠীর দিন উচ্ছে দিয়ে কাঁচা মুগের ডাল, ভাজা, মটর ডালের ছোট ভাজা বড়ি দিয়ে তৈরি ঢুলা শাক, ভেজানো ছোলা দিয়ে চৌকো চৌকো করে কাটা কুমড়োর ছক্কা সঙ্গে মেশানো হতো নারকেল কোরা ও বিশেষ ভাবে তৈরি ভাজা মশলার গুঁড়ো , নতুন ওঠা ফুলকপির রসা, চাটনি এবং শেষ পাতে রাখা হতো লাল দই। পুজোর প্রথম দিনের মেনুতেই একটা মোচড় থাকতো পরবর্তী উৎসব মুখর দিনগুলোর জন্য।
মায়ের হাতের কাঁচা মুগের ডালের সোয়াদ এখনো মুখে লেগে আছে। সত্যিকথা বলতে কি , পুজোর আগে রান্নাঘরে আটকে থাকা মায়ের খুব একটা পছন্দের কাজ ছিলো না । তিনি নিজেকে সেলাই ফোঁড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত রাখতেই বেশি ভালোবাসতেন। তাঁর এই বিশেষ অভিরুচির কথা টের পেয়ে আমরা বিশেষ করে আমি আর আমার বোন অনেকটাই হেঁসেলের হাঙ্গামা সামলানোর কাজ শিখে নিলাম। একাজে আমরা পাশে পেতাম আমাদের পিতৃদেব আর পিতামহীকে। তাঁরা পাশে থেকে আমাদের উৎসাহ জোগাতেন।
সপ্তমীর দিনের মেনুতে জায়গা করে নিতো প্রতিদিনের চেনা মুসুরির ডাল, লম্বা করে কেটে নেওয়া বেগুন ভাজা, ছানার ডালনা, কাতলা মাছের কালিয়া অথবা কৈ মাছের তেল ঝাল
আর চাটনি। সেই সময় আজকের মতো পনিরের চল ছিলোনা। ফলে দুধ কেটে ছানা বানিয়ে নিতে হতো। ছানা কেটে সাদা ন্যাকড়ায় বেঁধে তাকে ঝুলিয়ে রাখা হতো জল ঝরে যাবার জন্য। তারপর তাকে ভালো করে পিষে নেওয়া হতো। সঙ্গে মেশানো হতো সামান্য ছাতু, ভেতরে দেওয়া হতো এক টুকরো করে কিসমিস। এরফলে ছানার বড়াগুলোতে ঝোল ঢুকতো ভালো আর ছাতু থাকায় ভাজার সময় বড়াগুলো ভেঙে যেতো না। হাতের তালুতে নিয়ে নিখুঁত ভাবে গোল গোল বল তৈরি করে তেলে ভাজা হতো। তারপর শিলে বাটা মশলা দিয়ে ঘী আর গরম মশলা সহযোগে তৈরি করা হতো ছানার ডালনা। কখনো কখনো ডুমো ডুমো করে কাটা আলু দেওয়া হতো তাতে। রান্নার পর তার যা স্বাদ্ হতো তা বলে বোঝাতে পারবো না। চামরমণি চালের গরম গরম ভাতের সঙ্গে এইসব উপাদেয় খাবার খাওয়ার স্মৃতি আজও অমলিন।
অষ্টমী তিথিতে বাবা বাড়িতে চণ্ডী পাঠ করতেন। ফলে এ দিন বাড়িতে খিচুড়ি ভোগ, পাঁচ রকমের ভাজা , শাক, লাবড়া তরকারি, ফুলকপির ডালনা, চাটনি আর পায়েস রান্না হতো। ঐ দিন বেশ কিছু মানুষ আসতেন আমাদের বাড়িতে ভোগের প্রসাদের টানে। তাই ওই দিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যেতো রান্নার বিশেষ পর্বটি। সকাল সকাল স্নান করে আমরা সবাই প্রস্তুত হয়ে যেতাম মহা রন্ধন পর্বের আয়োজনের জন্য। আমাদের বয়স হাতা খুন্তি ধরার মতো হওয়ায় এই কাজটি আমি আর বোন সামলাতে শুরু করি। মা থাকতেন পর্যবেক্ষক হিসেবে। আমরা সোৎসাহে সেই দায়িত্ব সামলে নিতাম। মা বলতেন অন্যকে খাইয়ে তৃপ্তি পাওয়া হলো মহত্তম শান্তি। সেই কথা আজও মাথায় রেখেই চলছে আমাদের হেঁসেল নামচা।
অষ্টমীর খাটাখাটনির পর শরীর সত্যিই বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়তো। তাই ওই দিন সাধারণত হালকা পাতলা ঝোলের মাংস খাওয়া হতো। তবে এটা কোনো অবশ্য অনুসরণীয় রিচুয়াল ছিলো না। বাজারে সুলেমান চাচার দোকানে যদি লম্বা লাইন থাকতো তাহলে মাংসের বদলে বেশ চওড়া পেটির ইলিশ মাছ থলে ভরে নিয়ে আসতেন বাবা। আমাদের বাড়িতে মাংস রান্নাটাও ছিল বিরল ব্যতিক্রম। মা যতদিন পর্যন্ত ছিলেন ততদিন বাড়িতে পেঁয়াজ রসুন এবং চিকেনের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। সেইসময় আমাদের বাড়িতে হুইসেল বাজানো রন্ধনযন্ত্রটিও ছিলোনা। অথচ পেঁয়াজ রসুন ছাড়া নিরামিষ মাংসটি মা এমন কায়দায় বানাতেন যে তার কথা আজও ভুলতে পারিনি। কাঁচা পেঁপে শিলনোড়ায় বেঁটে নিয়ে তার লেইটা মাংসের সঙ্গে মেখে নেওয়া হতো। এর ফলে মাংস যেমন নরম হতো তেমন ঝোলটাও খানিকটা ভারি হতো। আর সোয়াদ? …. আহা, তাহার কথা আর কি কহিব।
ইলিশ মাছ রান্নার সময় মা পছন্দ করতেন বিশুদ্ধ ‘গোয়ালন্দ স্টাইল’। জল থেকে তোলা টাটকা ইলিশ কেটে নিয়ে সামান্য কালোজিরা আর কাঁচালঙ্কা ফোঁড়ন দিয়ে পাতলা ঝোল রান্না করাটা নাকি ছিল স্টিমার ঘাটের আশেপাশের হোটেলের রাঁধুনিদের স্পেশালিটি। সেই স্মৃতি মাকে হয়তো আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বহুকাল। কখনো কখনো ঝোলের মধ্যে লম্বা করে কাটা কুমড়ো অথবা কচি বেগুন দিতেন মা। একগাদা অনুপান ব্যবহারে মা’র আপত্তি ছিল। আজও এই স্টাইলেই ইলিশ মাছ রান্না করে তাঁর ছেলে মেয়ে। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।
দশমীর দিন সকাল থেকেই সকলের মন ভারী হয়ে যেত। রান্নাঘরে ঢুকতেই মন চাইতো না , ফলে সেদিনের মেনুতে উৎসবের ঝাঁঝ সেভাবে থাকতো না। পারশে মাছ বেশ ভালোবাসতেন মা। আমার বোনের অবশ্য পারশে মাছ খাওয়ার ব্যাপারে কেন জানিনা একটু বাছ বিচার ছিল। যাইহোক পারশে মাছের ঝাল - কলাই ডালের বড়ি আর নতুন ওঠা ধনেপাতা, কাঁচা লঙ্কা সহযোগে দশমীর ক্লান্ত রসনার মান রাখতো। কোনো কোনো পারশে মাছের পেটের ভেতর হয়তো সবেমাত্র হালকা ডিমের পরত দেখা দিয়েছে ; কপাল জোরে যার পাতে তেমন একখানি মাছ পড়তো , সে তো সেই দিনের সিকান্দার। তার নাগাল পায় কে?
দশমীর দিন নারকেল কুড়িয়ে তাতে চিনি মিশিয়ে তৈরি করা হতো ধবধবে সাদা নাড়ু আর সন্দেশ। তা দিয়েই মা দেবীবরণে যেতেন। নাড়ু পাকানোর কাজে আমরাও সোৎসাহে হাত লাগাতাম।হাত ঘোরাতে ঘোরাতেই নাকে এসে লাগতো বড়ো এলাচের গন্ধ। গরম গরম নারকেল পাঁক নিটোল গোল করে পাকাতে পাকাতে হাতের তালু লাল হয়ে উঠতো, তবে উৎসাহে ভাটা পড়তো না। দেবী বরণের পর টকটকে লাল সিঁদুরে মাখামাখি হয়ে মা যখন ঘরে ফিরতেন তখন মনে হতো মন্ডপের মা দুগ্গো গুটি গুটি পায়ে আমাদের ঘরে এসে ঢুকলেন। মা হারিয়ে গেছেন অনেক দিন। হায়! হারিয়ে গেছে সেই সোনা ঝরানো দিনগুলোও।
**
এই লেখাটি আমার বোনকে উৎসর্গ করলাম।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।