"বাড়ির ওপর তার যে ছিলো কী টান
মুখের মতো রাখতো পরিপাটি
যাতে বিফল বলে না, বিচ্ছিরি
কিংবা শূন্য সম্মেলনের ঘাঁটি"
গল্প করা মানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বলা। তা না হলে হবে ইতিহাসের ক্লাস। এখন গল্পই হচ্ছে তাই সাব্রুম বাসের গল্পটা ক্রমানুসারী হলো না। পিছিয়ে গেল। গত পর্বের শেষ অধ্যায়ে উদয়পুরের আগে আমরা ছিলাম সাব্রুম।
সাব্রুম
সাব্রুম ত্রিপুরার দক্ষিণতম প্রান্তের শহর। এখন রেলযোগাযোগ হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যানচলাচল হওয়ার পরে নিশ্চয়ই খুব জমজমাট- তখন দুর্গম প্রত্যন্ত একটি ছোট জনপদ ছিল, যদিও প্রাচীন। পাশেই ছোট একটা নদির ওপারে বাংলাদেশের রামগড় শহর। সাব্রুমের অধিবাসীরা অনেকেই বিশ্বাস করেন যে রামগড় ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ারই কথা ছিল। ত্রিপুরার ভারতভুক্তির সময় রিজেন্ট মহারাণির কর্মচারিদের ভুলে পাকিস্তানে চলে গেছে। সাঁতার কেটে দুদেশের ছেলেরাই লিচু খেতে, খেলা দেখতে দুই দেশে যাতায়াত করতো। সীমান্তরক্ষীরা কিছু বলতেন না। রামগড়ে পাটের গুদামে,- বীমাকৃত গুদামে নিয়ম করে আগুন লাগতো, এপারে সাব্রুমে হল্কা ভেসে আসতো। সাব্রুম ছোট ছোট টিলা দিয়ে সাজানো সুন্দর নিসর্গ নিয়েও ভ্রমণপিপাসু মানুষকে টানতে পারেনি তখন - দুর্গমতার কারণেই হবে। সরকারি কর্মচারিদের বদলি তো হতো। তাঁরা পরিবারকে নিজের জায়গায় রেখে একা যাওয়াই শ্রেয় মনে করতেন। সায়নের বছর খানেক বয়স তখন। তার বাবা একদিন অফিস থেকে মুখ চূণ করে ফিরলেন। তিনি সাব্রুম বদলি হয়েছেন। দুটি ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আমাকে আলাদা থাকতে হবে। আমি খুশি মনে বললাম বদলির চাকরি বদলি তো হবেই আমিও বদলি চাইবো ওখানে। যে কথা সেই কাজ। সবাইকে অবাক করে আমরা সপরিবারে বদলি হলাম সাব্রুমে।
সেখানে সম্পন্ন ঘর থাকলেও দরিদ্রের সংখ্যাই বেশি। রাস্তার ধারে বড় কাঁঠাল গাছ। পুরো বর্ষা অনেকের কাটে কাঁঠাল বা কাঁঠালের বীচি খেয়ে। খুব আখ হয়। লোকে আস্ত আখ হাতে নিয়ে খেতে খেতে যায়। বড় বড় গলদা চিংড়ি ছড়ার জলে প্রচুর। সামান্য দাম। সবচেয়ে মজার কথা কালোজিরে ধানের চাহিদা মোটা চালের চেয়ে কম, তাই মোটা চালের চেয়ে দাম কম। ভালো ঘি পাওয়া যায় তবে অল্প কেনা মুশকিল - গৃহস্থের যেটুকু আছে - নিলে সবটাই নিতে হবে। মেলা আছে। প্রাচীন দৈত্যশ্বরী কালীর মন্দিরকে কেন্দ্র করে বৈশাখী মেলা হয়। নদির অন্য পাড়ে বৌদ্ধমঠ আছে। বড় এবং ভালো স্কুল আছে। যাঁরা বাস করেন তাঁরা ভালোই থাকেন। আমরাও একদিন সন্ধ্যায় বাঁশবাগানের মাথার ওপর যখন চাঁদ উঠেছে, শেয়ালরা গলা সাধবে বলে তৈরি হচ্ছে তেমন সময় ট্রাকে মালপত্র সহ পৌঁছলাম গিয়ে দার্জিলিং টীলার কোয়ার্টারের সামনে। এ্যামবেসেডার গাড়িতে। তখন শঙ্খর গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। সঙ্গে আছেন পরমসহায় মিঠুমাসি--ভাগ্যিস। আর আছে মীরা - ছেলেদের দেখাশোনা করতো নেপালি একটি মেয়ে। প্রতিবেশিরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। প্রত্যন্ত শহরে সবাই সহৃদয়। নবাগত কে সুন্দর ভাবে গ্রহণ করতে চায়।
দার্জিলিং টিলার বাড়ি থেকে সাব্রুম বয়েজ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল দেখা যেতো, কিন্তু আমার গার্লস স্কুল একটু দূরে। অনতিউচ্চ টিলার ওপর বেশ বড় বাড়ি। রাস্তার দুপাশে সরকারি কোয়ার্টার- তার পর ঢালু হয়ে নেমে গেছে গ্রাম বা বস্তির দিকে। অনেক নিচে থেকে কুয়োর জল তুলিয়ে পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হতো। চারদিকে গাছপালা। বানর দুলছে ডালে, রাতে ভাম বিড়াল, খাটাস বা বনবিড়ালও আছে। জলবায়ু স্বাস্থ্যকর। পাহাড়ে জলোঘাস নেই, শুকনো ঘাস খেয়ে গরুর দুধ এতো ঘণ যে চালতাফুট তুলে পায়েসের চাল দিলে সিদ্ধ হয় না। শীত গ্রীষ্ম দুইই দাপুটে। আগে নাকি শীতের দিনে কেরোসিন জমে যেতো। মাত্র দু’একটা শৌখিন দোকান। কেনার কিছু নেই, সিনেমা দেখার খরচ নেই। কিছুদিন থাকলে টাকা পয়সা জমে যায়। বহুরূপী শিব কালী সেজে নাচে। মেলায় পুতুল নাচ হয়। বৈজয়ন্তীমালা নামে পুতুল জলাশয়ের ধারে নাচেন, অন্য পুতুল গান গায় ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে- এই বিনোদন। এখন শুনেছি সাব্রুম খুব জমজমাট শহর। ত্রিপুরার গেটওয়ে অব সাউথ। রেল যোগাযোগ হয়েছে। তখন ফেরিনৌকায় গাড়ি নদি পেরুতো। রিক্সা ছিল না। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় তাড়াতাড়ি হেঁটে স্কুলে যেতে দু’একবার পা মচকে গেছে। শঙ্খ সায়ন ছোট ছিল তো- সব কিছুতেই ওদের মজা। মীরা নেপালি ছিল, সায়নকে সারাক্ষণই টুপি পরিয়ে রাখতো। বেড়াতে বেড়াতে দূরে চলে যেতো। অফিস টিলা, কোর্ট অবধি। কেউ জিজ্ঞেস করতো, সায়ন কোর্ট কতদূর? হাত তুলে দেখাতো অনেক দূর। বাড়ির ঠিক সামনে দুটো লেডিস লেসের শক্ত কাঁটাওয়ালা গাছ কেউ লাগিয়ে ছিল। বেশ লাগতো দেখতে। বাড়ির সামনে দিয়ে বস্তির ছেলেরা টুংটাটুংবাজনা বাজিয়ে গান করে যেতো। শঙ্খ একটু দূরত্ব সত্ত্বেও ওদের বন্ধুই ছিল। উল্টোদিকের বাড়িতে আমাদের সহকর্মীর ছেলেমেয়েরাও বন্ধু হলো। আমরা একসঙ্গে পিকনিক করতাম। হেডমাষ্টারমশাইএর স্ত্রী আমাদের সবারই দিদির মতো ছিলেন। ওখানে তখন ইলিশমাছ পাওয়া যেতো না, কেউ অন্য জায়গা থেকে আনলে বেশিই আনতো, চেনাশোনাদের নেমতন্ন করতো। সামাজিক মেলামেশা যথেষ্ট ছিল।
সাব্রুমের ছাত্র ছাত্রীরা তখন পশ্চিমবঙ্গের বোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল করতো। তখন ত্রিপুরা বোর্ড হয়নি। তবে দারিদ্র্যের কারণে স্কুলছুটের সংখ্যা কম ছিল না।
ভালোই কাটলেও একসময় গার্লস স্কুলের লাগোয়া হোস্টেল সুপারের কোয়ার্টার খালি হলে, ছোট ছোট ছেলেদের সুবিধার জন্য, রিক্সাহীন পথে হাঁটতে কম হবে এসব ভেবে আমরা গার্লসস্কুলের বিশাল কোয়ার্টারে চলে এলাম। আগে এটি ছিল একটি ব্যাঙ্ক। সেখানে বহু ঘটনার ঘনঘটা হয়েছিল।
সাব্রুম গার্লসস্কুল ছিল মহারাজার আমলের ছোট একটা অফিস। ওই ছোট্ট দালানে স্কুলের অফিস, স্টাফদের কমনরুম, হেডমিস্ট্রেসের অফিস ইত্যাদি ছিল। ক্লাসরুম সব ত্রিপুরার বিখ্যাত চাম্পাখাম্পা বাঁশের বেড়া দেওয়া। সীমানায় কোন প্রাচীর বা বেড়া নেই। বলা বাহুল্য একহাজার মেয়ে এবং পনের জন মতো লেডিটীচার থাকা সত্ত্বেও কোন ওয়াশরুম নেই। বেশিরভাগ স্কুলেই এই অবস্থা। ওয়াশরুম যদি বা থাকে জলের ব্যবস্থা না থাকায় ব্যবহারযোগ্য নয়। বেশ কয়েকজন মাস্টারমশাই আছেন। ঐ স্কুলে দেখলাম কেউ টিফিন খায় না। আমার ধারণা মাস্টারমশাইরা বাইরে চা খেতে গেলে হয়তো লেড়ো বিস্কুট হলেও খেতেন। দিদিমনিদের রাস্তার চায়ের দোকানে চা খাওয়ার চল নেই। আমার তো প্রথম দিন সেই সকাল ন’টায় নাকেমুখে দুটো গুঁজে আসার পর উপোস থেকে শেষের দিকে বমি হয়ে গেল। নীতিশবাবু বলে একজন খুব ভালো সহকর্মী ছিলেন। ভদ্র, কর্মঠ, কারো বাড়িতে বিদ্যুত চলে গেলে ঠিক করে দিতেন। অনেক উপকার করতেন। তিনি ঘোরতর সাম্যবাদী। তাঁর নেতৃত্বে ফরমান আছে - কমনরুমে কেউ টিফিন খেতে পারবেনা - যেহেতু কেউ কেউ খায়না। নূতন গেছি, কিছু বলিনি। মীরাদি সবার বড়। তিনি তো কিছুই বললেন না। মহা মুশকিল হলো। আর এছাড়া সবই বলা যায় ভালো।
আগে স্কুলের কথাটাই বলে নিলাম, এখন কোয়ার্টার।
আগেই বলেছি এটি ছিল একটি ব্যাঙ্ক। টিনের চাল দেওয়া বড় বড় কোঠাওয়ালা বাড়ি। স্টোররুম লোহার রড দিয়ে ঘেরা। সুরক্ষিত। সামনে সিঁড়ির দুপাশে খুব সুন্দর দুটি কামিনী ফুলের গাছ- বিকেল থেকে ফুটতে শুরু করে। একটু দূরে তপশিলী ছাত্রীদের জন্য হোস্টেল। চলে সম্পূর্ণ সরকারি খরচে। একই প্রেমিসেসে সুপারের কোয়ার্টার আর হোস্টেল। সামনে একটা ফুলে ভরা গুলঞ্চ বা কাঠগোলাপের গাছ। সামনে ছোট্ট নদি ওপারে বাংলাদেশের রামগড়। নদির এপারে সাব্রুমের প্রাচীন দৈত্যশ্বরী কালীমন্দির। অনেক মিথ অনেক বিশ্বাস প্রচলিত দেবীকে নিয়ে। অসুবিধা চিকিৎসা নিয়ে। সরকারি হাসপাতাল আছে। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী শিশু চিকিৎসক। ওষুধপত্র সব সময় প্রয়োজনে মেলে না। বাচ্চাদের তো এটা ওটা লেগেই থাকে। তবে স্থানীয় মায়েরা নানা ওষধি পাতার রসের সঙ্গে দুধ হলুদ এসব টোটকা বলেন, কাজও হয় তবুও ভয় করে। শহর থেকে বেরোনোর একটা মাত্র বাস তখন- তাও কুড়ি মাইল দূরে নদি পেরিয়ে মনুতে গিয়ে ধরতে হয়- শুধু সকাল বা বিকালে। ভালো মিষ্টি পাওয়া গেলেও আগে অর্ডার না করলে বেশি পাওয়া যেতো না। অবিলম্বে এক কুকুর ছানা জোগাড় হলো বাঘা। সায়নের অত্যন্ত প্রিয়। শিলং থেকে এন্টিরেবিস আনিয়ে ওকে পোষ্য করা হলো। এদিকে স্কুলের বাউন্ডারি ওয়াল না থাকাতে আমাদের বাড়িতে অনভিপ্রেত উৎপাত শুরু হলো। দুটি মেয়ে, বিশেষত সুন্দরী নেপালি কিশোরীটি হয়ে উঠেছিল পাড়ার কিছু রোমিওর আকর্ষণের কেন্দ্র। ওরা যখনই দেখে আমি ক্লাসে ঢুকেছি- জানে পঁয়তাল্লিশ মিনিট বেরোতে পারবো না। এরা বাড়ির সামনে এসে জটলা করে। ছেলেরা নিতান্তই ছোট, ওরা খুব বোঝেও না বলেও না। তবু দিন ভালোই কাটছিল বলতে হবে। জলহাওয়া ভালো ছিল ছড়ার বড় বড় কইমাছ চিংড়ি মাছ খাওয়া হচ্ছিল। শীতের দিনে রামগড়ে পাটের দোকানে আগুন লাগলে এপারে একটু আতঙ্ক হতো বটে। মাঝে মাঝে হোস্টেলে বীরনপতি ইন্দুমতীদের মধ্যে ঝগড়া হতো। সরল আবার প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ। ঝগড়া মিটিয়ে শঙ্খের জন্মদিনে পাওয়া চকোলেট খাইয়ে শান্ত করতাম।
সহসা এমন একটা ঘটনা ঘটলো যা গোয়েন্দা গল্পকে হার মানায়।
আমরা তিন চারদিনের ছুটিতে আগরতলা গেছি। কাজের মেয়েদের যার যার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে ঘরের চাবি হারিয়েছিল। গা করিনি। ডুপ্লিকেট দিয়ে কাজ চলছিল। আমরা চলে যাওয়ার পর স্থানীয় মেয়েটি কয়েকটি ছেলেসহ সন্ধ্যায় নাচগানের আসর বসায়। জায়গাটাও নিরিবিলি। হোস্টেলের মেয়েদের ধারণা হলো কোয়ার্টারে ভূত আছে। খালি পেয়ে ভূতের নৃত্য হচ্ছে। কাছাকাছি ছিল ইন্সপেক্টর অফ স্কুলের অফিস, সেখানকার নাইট গার্ড বুদ্ধি করে কয়েকজন প্রভাবশালী ভদ্রলোকের কাছে কথাটা বলে। তাঁরা পরদিন ওদের আনন্দানুষ্ঠান চলাকালীন বাইরের দরজায় তালা দিয়ে থানায় খবর দেন। হাতেনাতে ধরা পড়ে সব লকআপে গেল। পুলিশ দেখে মাংসপোলাও রান্না খাওয়া হয়েছে। কয়েকদিন আগে বিবাহবার্ষকী উপলক্ষে বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। সাব্রুমের প্রথা অনুযায়ী চাল ঘি সবই বেশি কেনা ছিল, পোষা মুরগি ছিল। আর কি লাগে। ওরা ধরা পড়ার পরের দিন আমি ফিরলাম দুই ছেলেকে নিয়ে। ওদের বাবা মনুতে মকপোল ছিল - ওখানে নেমে গেছেন। এসেই দেখি পাড়ার লোকেরা এসেছেন খবর দিতে। ছেলেদের মধ্যে এক ধনীপুত্রও ছিল- সে ছাড়া পেয়ে গেছে। আমি তখন এতখানি জার্নি করে এসে ছেলেদের সামলাই না পড়শিদের সঙ্গে কথা বলি। এই ফাঁকে কখন সায়ন নেমে গেছে বাথরুমের টবে বৃষ্টির জল ধরা ছিল তাতে। ভুগেওছিল সর্দি কাশি শ্বাসকষ্টে। যাই হোক আশিস এলেন। গরীব বাপের অনুরোধে মেয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলোনা। কিন্তু আতঙ্ক হলো।
তবুও যে যার যার কাজ করছিলাম। স্কুলের কথা তো অনেক। একজন মাস্টারমশাই পড়াতেন ভালো, মারতেনও ছাত্রীদের। তখনকার মফঃস্বলে এরকম শিক্ষকদের সুনাম ছিল। তাঁকে দেখতাম একটি আমলকী গাছের তলায় বাঁধানো বেদিতে অঙ্ক না করতে পারা মেয়েদের ঘুরে ঘুরে নাচতে বলতেন। গান গাইতো তারা আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি..... তালে ভুল করলে বেতের বাড়ি। হয়তো জোরে মারতেন না তবে আমার ভালো লাগতো না। তখনও ছাত্রছাত্রীদের মারধোর করা নিয়ে কারো কোন তাপউত্তাপ ছিল না। আর একটি ঘটনা মনে পড়ে, একদিন কোন শুভদিন হবে, স্কুলে আসার আগে কালীবাড়িতে প্রণাম করে স্কুলে এসেছি। ক্লাসে বসে দেখি বাঁধানো শাাঁখায় একটি লাল পাথর বসানো সোনার ফুল কোথায় পড়ে গেছে। বলে ফেললাম ক্লাসে। ক্লাস শেষ হলে সব মেয়েরা খুঁজতে নেমেছে সেই ছোট্ট ফুল। কোথায় পাবে। বাড়ি গিয়ে আবার কালীমন্দিরে গিয়ে দেখি যেখানে প্রণাম করেছি সেখানেই চিকচিক করছে পাথর বসানো সোনার ফুল।
কিছুদিন পর আশিস বদলি হয়ে আবার উদয়পুর। এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে বদলি এতো সহজ কোনদিনই না। আমার বদলি আর হয় না। একদিন দুপুরে মন্ত্রী মানিক ব্যানার্জির বাড়িতে ফোন এলো সায়ন অসুস্থ তাড়াতাড়ি যেতে হবে আমাকে। গোটা সাব্রুমে তখন ঐ একটিই ফোন। কী কষ্টে উদ্বেগে যে উদয়পুর পৌঁছলাম বলার নয়। গিয়ে দেখি গ্যাসট্রোএনট্রাইটিস হয়ে ছেলে কোমায়। কী যে আমাদের অবস্থা তখন। পরের দিনের পরের দিন জ্ঞান ফিরলে খুব মৃদুস্বরে সায়নের প্রথম কথা --মা বাঘা কই? বয়স তখন তার দু’বছর। সায়নের অবস্থা যে এতো খারাপ তার বাবা বুঝতে পারেননি। বন্ধু অহিভূষন নন্দী জোর করে হসপিটালে না নিয়ে গেলে কি হতো ভাবা যায় না। ঠিক করলাম বদলি হতে না পারলে আর চাকরি করবোই না।
সাব্রুমের গার্লস স্কুলের কোয়ার্টারের শঙ্খর শৈশবের দুই বিশেষ স্মৃতি। সাব্রুমে পরীক্ষার রেজাল্ট আউটকে স্থানীয় ভাবে বলে ফল দেওয়া, ফল বেরোনো না। সবাই বলে ওমুক দিন ফল দেবে। সেই দিন সত্যই একদিন আসে। তারপর রেজাল্ট আউট হলে স্কুলে শুরু হয়ে যায় যারা ফেল করেছে তাদের বিলাপ করে কান্না। সঙ্গে যোগ দিয়েছে হয়তো কারো বোন বা দিদি। শঙ্খ অবাক। বলে ফল দিয়েছে তবে কাঁদে কেন?
আরেক মর্মান্তিক কান্না ছোট বেলায় শুনে এখনো ভুলতে পারে না শঙ্খ। কিছু চাকমা শরণার্থী চট্টগ্রাম থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন গার্লস স্কুলে। সরকারের সিদ্ধান্তে এক গভীর রাত্রে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। গভীর রাতে সে কি কান্না।
ঘরহারার কান্না বোঝা যায়, সেদিনের ঘরে ফেরার আতঙ্কের আর্তনাদ এখনো শঙ্খ ভোলেনি।
মানুষের যে কতরকম অসহয়তা।
বদলি হয়ে আবার উদয়পুরেই ফিরে এলাম। সাব্রুমের এই দিনগুলো শঙ্খর কাছে খুবই বর্ণময়। ভালোমন্দ মিলিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সহযোগিতার ভাবটা সাব্রুমের সম্পদ। দুটি কোয়ার্টারই খুব সুন্দর ছিল। আমরা সুখেই ছিলাম।
উদয়পুর থেকে আগরতলা ফেরা হলো, পেছনে রয়ে গেল সিট্রোনেলার ঝাড়, জারবেরার কেয়ারী, লাউ, সীমের মাচা, অসম্পূর্ন পাতকুয়ো, অরহড় গাছে টিয়াপাখির ঝাঁক, দিগন্ত বিস্তৃত দীঘি, ধানক্ষেত, পুরনো হাবেলির ধ্বংসাবশেষ, পোড়ো ভূবনেশ্বরী মন্দির। ফের হলো আশ্রম চৌমুনী, দেবেন্দ্র রোডের বাড়ি।
আশ্রম চৌমুনী, দেবেন্দ্র রোড - দ্বিতীয় পর্ব
ছেলেদের ভর্তি করে দেওয়া হলো আগরতলার স্কুলে। ওদের বাবা আগেই এসে গেছেন বদলি হয়ে। আমরা স্বাভাবিক ভাবেই আশ্রম চৌমুনী দেবেন্দ্র রোডের সুন্দর ফুল ফল পুকুর এবং দালান সমন্বিত বাড়িতেই আছি। আগের ডিসেম্বর মাসে শাশুড়ি মা তাঁর ভরাভর্তি সংসার ছেড়ে চলে গেছেন। সেবারে বাগান ভরা পদ্মফুলের মতো লাল গোলাপ। কুন্দফুল ধপধপ করছে শেষরাতে। ভোরবেলা গরদের লালপাড় শাড়ি পরিয়ে আলতা সিঁদুর পরিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল আশিস আর ননদ রুবি। দুজনের কেউই আর নেই। বন্ধ হয়ে গেছে সকালবেলায় চায়ের কাপে মায়ের চামচের ঝনঝনানি শুনে অর্কিড ঝোলানো বারান্দায় বসে সবাই একসঙ্গে চা খাওয়া। আরো অনেক কিছু। বাবা হয়ে গেছেন একা - ছেলেমেয়দের সযত্ন তত্ত্বাবধানেও বিষন্ন। বাড়ি যেন অন্য বাড়ি। আমার বদলি হলো জুলাই মাসে। দক্ষিণ শহরতলির একটি স্কুলে। হাজার ছাত্র ছাত্রী নিয়ে বড় স্কুল। তখন যাতায়াত ব্যবস্থা অপ্রতুল। ছেলেদের স্কুলে পাঠানোর আগেই আমাদের দুজনকেই বেরিয়ে পড়তে হয়। ছোটছেলে স্কুলে যেতে পারে না অনেক দিন। নানা ঝামেলায় আমি ও খিটখিটে হয়ে গেছি, কাজের লোক টিকাতে না পেরে দুর্নাম হয়ে গেছে। বাবার প্রতিও একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও কর্তব্যে ত্রুটি হচ্ছে। বাবাকে খুলেই বললাম দুজনে। বাবাও বুঝতে পারলেন। আমরা তখন কমদামি একটা জায়গা খুঁজতে লাগলাম। বটতলা বাসস্ট্যান্ড কাছে হয় এমন। একটা বাসার খোঁজ পাওয়া গেল।
মেলারমাঠ
এই অধ্যায় সংক্ষিপ্ত কিন্তু ঘটনাবহুল। বটতলা বাসস্ট্যান্ডের খুব কাছাকাছি বাড়ি। বাঁধের ওপর দিয়ে এলে আরো কাছে। সুন্দর বাড়ি, জলের একটু কষ্ট, বাড়িওয়ালা সজ্জন। কিন্তু পরিবেশ আপাতদৃষ্টিতে ভালো হলেও দেখা গেল অসুবিধাজনক। আমাদের সঙ্গে গেছিল গাবলু কুকুর। তার ওপর কেন জানিনা রোষদৃষ্টি পড়ল পাড়ার বিভীষিকা এক মস্তানের। একদিন তো গাবলুকে মেরেই ফেলবে। চেঁচাতে চেঁচাতে এসেছে। ভয়ংকর মূর্তি। কুকুরেরও সহজাত বুদ্ধি কম না। পাশের বাড়িতে ছিলেন মেশোমশাই ফণী মুখার্জি। গাবলু তো নূতনই দেখলো তাঁকে। প্রবীণ মান্য মানুষ। গিয়ে যে কাঁপতে কাঁপতে বসলো তাঁর চেয়ারের তলায়। মস্তানের নেশা কাটলে সে প্রস্থান করলে উঠলো। বুঝেছিল মেশোমশাই ছাড়া কেউ বাঁচাতে পারবে না। পরে গাবলুকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় করে দিতে হলো। আশ্চর্যের কথা মাঝরাতে ছাদের ওপরে গরু হাঁটতো। কি করে উঠতো কে জানে। পাড়ার ত্রাস ছিল দলবলসহ ওই মস্তান।
অল্পদিনের মধ্যে অসুখ বিসুখও হয়েছে খুব। একদিন গভীর রাতে সায়নের জ্বর আর খিঁচুনি হয়ে মহাবিপদ। পাড়ার শিশুচিকিৎসক বাঁচিয়ে ছিলেন। আমার আর শঙ্খের এক ই সঙ্গে পক্স হলো। শঙ্খ মুখ বুজে যন্ত্রণা সহ্য করতো। অসীম ধৈর্য ছিল তার। আমার মা ঐ বয়সে এসে এসে রান্না করে দিতেন ওদিকে বাবা অসুস্থ। এরমধ্যে শঙ্খ সায়নের বাবা ব্রঙ্কিয়াল অসুখে গুরুতর ভুগতে লাগলেন।
আমরা বাড়ি করে রামনগর চলে গেলাম। পরে অবশ্য মস্তানপ্রবর রাস্তায় দেখা হলে খুব বিনীত হেসে কুশলসংবাদ নিতো। মনোমালিন্যের লেশ ছিল না যখন মেলারমাঠ ছেড়ে এসেছিলাম। এই গেল দশমাস মেলারমাঠ বাসের সুখদুঃখের পাাঁচালি। ঐ বাড়িতে থাকতেই একদিন ভোরে বাবা চিরবিদায় নিয়েছিলেন। কাছাকাছি আমার ভাইএর ভাড়া বাড়িতে। কয়েকদিন বাবা মা-র কাছাকাছি থাকতে পেরেছিলাম। ভাইএর মেয়ে বিকেলে আসতো ওর বাবার সঙ্গে। বেশ কেটে যেতো সন্ধ্যাটা।
রামনগর
আত্মীয় স্বজন শুভাকাংখীরা সবাই বলেন নিজের একটা বাড়ি করো। আমাদেরও সাধ, ধরনীর এক কোনে একটুকু বাসা। সাধ্যের মধ্যে একটা জমি পাওয়া গেল। ঢোকার পথ সরু, সামনে একটা এঁদো ডোবা, গেট যেখানে হবে সেখানে বাঁকা একটা নারকেল গাছ। বৃষ্টি হলেই ঐ ডোবা থেকে জল উঠতো। খলসে পুঁটি কাঁকড়া ওপরে চলে আসতো- জমকুলি পাখিরা মাছ খেতে আসতো।
আমি নিশ্চিত এই জায়গা কেউ পছন্দ করবেনা। তবে এক্ষেত্রে বাস্তববোধের পরিচয় দিলাম। আমাদের টাকা যখন কম পছন্দসই জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে। এটাকে আমরা সাজিয়ে নেবো। জমি তো কেনা হলো। আশিসের অফিসের শুভার্থী কলিগরা বললেন আশিস আর শক্তিকে এইরকম জায়গার খোঁজ কে দিল ওরাও কিনে নিল। সবাই দুঃখিত, আমরা খুশি। বাড়ি করতে অবশ্য বছর খানেক দেরি হয়েছিল। আমরা সুন্দর করে সাজিয়ে নিতে পেরেছিলাম। গৃহপ্রবেশের দিন দই ইলিশ হলো। সবাই প্রশংসাই করলেন।
***
আষাঢ়ের শেষ দুপুরে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মনে পড়ে অঝোরে ঝরছে খারচি পূজার বৃষ্টি। স্কুল ছুটি। জানালার পাশে খাটে বসে দেখছি রঙ্গন ফুলের গাছটা ভেজা ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে। যূথিকাদি ওই রঙ্গনের তোড়া বেঁধে যে কোন অনুষ্ঠানে সাজাতে ভালোবাসতেন। ওরই তলায় ছোট্ট ডুমুর চারার পাতায় বাড়ি বুনেছে দুর্গ টুনটুনি পাখি। বাচ্চারা ঘরে আছে। একটুও জল ঢুকছেনা। রামনগর বাড়ির সৌন্দর্য সম্পাদনে আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি। প্রথমেই হলো একটা লেটার বক্স বসানো গেট। সিঁড়িতে অর্কিড বসানো টব। কয়েকমাসেই ফুল ফুটলো স্থলপদ্ম আর রঙ্গন, অপরাজিতায়। দুচারটি ক্রোটন। সুন্দর গ্রীলে ঘিরে নেওয়া হলো বারান্দা। কাঁচের দরজা জানালায় ডাবল্ পর্দা। হালকা গোলাপী লেস আর ভয়েলে। পর্দার নিচে গোপনে ঘুঙুর সেলাই করে দিলাম। বাতাসে টুংটাং বাজে। সারি বেঁধে আনারস আর গ্ল্যাডিওলাস কিছু দিন পরে। শঙ্খ সায়ন বিকেলে রোজ পাঞ্জাবি পাজামা পরে বেড়াতে যায়। ফেরার পথে দুর্গাচৌমুনি বাজারের সুখশান্তি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে মিষ্টি কিনে আনে। ওদের বাবা খুব ভোরে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে বেরোন। আমি রাজলক্ষ্মীদি প্রণতিদি বা অন্য কারো সঙ্গে একটু হেঁটে এসে চা করি। ড্রইংরুমে সোফায় বসে সবাই একটু গল্প করি, চা খাই। সন্ধ্যায় প্রায়ই ক্রাফট্কাউন্সিলের ছেলেরা আসে। সাহিত্যিক সুবিমল রায়, খ্যাতনামা ফটোগ্রাফার রবীন সেনগুপ্ত বা অন্য কেউ আসেন। মানবী পত্রিকার সদস্যাদের মীটিংএ ঘুগনি লুচি হয়। সহংতি ক্লাবের দুর্গাপূজায় খুব জাঁকজমক হয়। ছোট দেওর গৌতমের বিয়ের পর সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া হলো। শিল্পীকে বেশ সুন্দর করে সাধ দেওয়া হলো। রামনগর চার নম্বরে আমরা ভালোই কাটালাম।
শঙ্খ ওখান থেকেই শিবপুর গেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। বছর চারেক পর সায়নও কোলকাতায় চলে এলো। একা একা ছেলেদের ছেড়ে আবার কই যাই যাই ভাব। শ্বশুরমশাইএরও বয়স আরো বেড়েছে। বড়ছেলে বাড়িতে একটা অংশে বাড়ি করুক চাইছেন। পূবমুখী জমির অংশটি ও সুন্দর। ঠিক হলো ওখানে একটা বাড়ি হবে। যে কথা সেই কাজ। আমার শুধু মনে হলো ছেলেরা দূরে থাকবে আমাদের ওখানেও ভালো লাগবে না। আশিস আবার ছবি আঁকেন, পাহাড়ি ধরনে দরজা তৈরির প্ল্যান করেন আর বলেন সবগুলি বাড়িই কম বাজেটে করতে হলো। একটু বেশি টাকা খরচ করতে পারলে দেখতে।
আশ্রম চৌমুনী, দেবেন্দ্র রোড - তৃতীয় পর্ব
রাখাল রাজমিস্ত্রি আর সাধুকামলা আশিস করভৌমিকের খুব বাধ্য লোক। তারাই ভূমিপূজার ফুল বেলপাতা হব জোগাড় করে আনলো। শুরু হলো বাড়ি তৈরির কাজ। গৃহকর্তা নাওয়া খাওয়া ভুললেন। দুবেলা কাজ দেখতে যান। আমি আগে থাকতেই ডালিম গাছ বেল গাছ সুপুরি চারা কিনে লাগাচ্ছি। বনমহোৎসবের সময় ফরেস্টারবাবুর কাছে পেয়েছি বটল্ ব্রাশ আর বকুল গাছ। রবিদা সামনে দিলেন রাধাচূড়া পেছনের জন্য হাজারি কাঁঠালের চারা। আগরতলায় কাঁঠালগাছ দুবছরেই বড় হয়ে যায় আর কোলবালিশের মতো বড়বড় কাঁঠাল হয়। বাবা তো অনেক চারাই দিলেন। তখনই ঐবছরই আমাদের বাঘাযতীনের ফ্ল্যাটও কেনা হয়েছে। কোলকাতা থেকে আশিস তিন রঙের মুসান্ডা একটা সমুদ্র ঝাউ বা হুইস্পারিংউইলো এনে লাগালেন। শাশুড়িমায়ের পছন্দের হাস্নুহেনা লাগানো হলো জানালার কাছে। জ্যোৎস্নারাতে সৌরভে মাত করে দিতো। ছাদ দেওয়া হলোনা বেশি বৃষ্টির জায়গা তাই সমতল ছাদ ভালো না আমার বাবা বলতেন তাই। আশিসের আবার বৃষ্টির দিনে টিনের চালে রিমঝিম খুব ভালো লাগে। জবা বেল কুন্দ ছাড়াও আমআদা গন্ধরাজ লেবু সব লাগানো হলো। গ্যারেজের পাশে আমার গরজে সিমেন্টের চেয়ার হলো। মনে ইচ্ছা ছেলেরা বড় হচ্ছে। বিয়ের সময় বাজনদারেরা বসবে।
বাড়ি হলো। গৃহপ্রবেশের দিন ঠিক হলো। স্কুলের কমনরুমে স্বদেশবাবু বলছিলেন, দেখে এলাম শক্তিদির বাড়ি থেকে ফ্রিজ আলমারি সব রওয়ানা হচ্ছে। আমার চোখ থেকে নিজে নিজে জল পড়তে লাগলো। অথচ আমিও চেয়েছিলাম আশ্রমচৌমুনীর বাড়িটি হোক।
জীবন বলে একদা ফাজিল ছোঁড়া ড্রাইভার এখন মাঝবয়সী আমাকে স্কুলে দিয়ে আসে, নিয়ে আসে। ছোটখাটো দেখতে মাসি রান্না করে। ছুটিতে ছেলেরা আসে। খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইরা কাছাকাছি বয়স। বন্ধুই তো। প্রতিবেশিরা বেশ কিছু দিনের চেনা। ভালোই চলছিল। শ্বশুরমশাইএর ছেলে মেয়েরাই অবসরপ্রাপ্ত সুতরাং তাঁরও বয়স যথেষ্ট। তিনি প্রয়াত হলেন। তাঁর শ্রাদ্ধের আগের দিন বাড়িতে ক্রিয়াকর্ম চলাকালীন আমি পড়ে গিয়ে প্রচণ্ড চোট পেলাম। আবার নূতন করে অনেক কথা ভাবতে হলো।
শঙ্খ সায়নের বিয়ে ওই বাড়িতেই হয়েছিল। সেইদিনগুলোর আনন্দধ্বনি ওই বাড়িতে বোধহয় এখনো বাজে। প্রচুর তুলসীগাছের পাতা সুগন্ধ ছড়ায়, একটা বেগুনি ফুলেভরা গাছের ফলে দুপুরে পাখিরা টিফিন সারে। হয়তো এখনও তারা আছে। ঝাউগাছটা অনেক লম্বা হয়েছিল, কলেজটিলা থেকে দেখা যেতো। আশিসের প্রিয় সেই গাছ কাটা গেছে, কাটা গেছে গেটের পাশের মহানিম গাছ। সবাই স্বপ্নে শাখা নাড়ে।
এই বৃত্তান্তে অনিবার্য ভাবে এসে যাবে তিনটি বাড়ির গল্প। এই সময়েই একইসঙ্গে কেনা হয়েছে বাঘাযতীন প্লেসের ফ্ল্যাট। শঙ্খ শিবপুর ভর্তি হওয়ার পর আমাদের মাঝেমাঝেই কোলকাতা যেতে হচ্ছিল। সবাই একসঙ্গে দু’চারদিন থাকার মতো বাসস্থান একটা দরকার ছিল। একদিন দুপুরে আমার স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্র ম্যাপ নিয়ে এসে অনুরোধ করলো ও প্রোমোটারি ব্যবসা করবে আমরা যদি একটা নিই। আশিস সদ্য রিটায়ার করেছেন। কিছু টাকা পয়সা এসেছে। আমরা কিছু না দেখেশুনেই একটা ফ্ল্যাট বুক করে নিলাম। আশিস ছবি এঁকে আমাদের চাহিদা বোঝাচ্ছেন। ফ্ল্যাট হয়ে গেলে দেখতে গেলাম। ভাগ্য ভালো বলতে হবে। পছন্দ হয়েছিল। ওই বাড়িতেই আমাদের দুই বৌমা সংসারযাত্রা শুরু করলো। এদিকে আশ্রমচৌমুনীবাড়িতে একান্নবর্তী নয় তাহলেও তিন ভাইএর তিনটি পাশাপাশি বাড়িতে বাস করতে শুরু করা গেল। তিনভাই যখনই সময় পায় একটু গল্পটল্প করে, বাবাও দিনের কোন না কোন সময় আমাদের কাছে পান। আমার রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আমার জায়ের রান্নাঘরের জানালা দেখা যায়। সময় পেলে একটু গল্প বা পিএনপিসিও হয়। সময় বিশেষ হয়ও না।
আমার ছোট ননদ রুবি কিছুদিন ছিল ছেলেকে নিয়ে এই বাড়িতে। সবাই একবাড়িতে থাকলে হর্ষে বিষাদে ভালোই কেটে যায় দিন। ওই বাড়িতে শঙ্খ সায়নের বিয়ে হলো। নূতন দুটি মেয়ে বৌ হয়ে এলো পরিবারে। দুজনেই হাসিখুশি। বিয়ের পর তো তারা বাঘাযতীন বাড়িতে কাঁচা হাতে গুছিয়ে সংসার করতে আরম্ভ করলো। এখন তারা পাকা গৃহিনী। আমাদের তো কন্যাসন্তান নেই, নূতন দুই মেয়ের কেউ যদি কয়েক কাপ চা করে, কেউ এলোভেরা চারা এনে সিঁড়ি সাজায়- আমাদের খুশি ধরেনা। একদিন এক প্রতিবেশী বললেন আপনার বৌমারা তো ঝর্ণার মতো হাসে ঝর্ণার মতো কথা বলে। শুনে ওদের শ্বশুর খুশিতে আত্মহারা। সংসারযাপন তো অসিধারা ব্রত। সামান্য হলেও কখনও কি ছন্দপতন হয় না? "মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়েছিল তার তাই নিয়ে কে বা করে হাহাকার"। দিন কাটছিল এমনি করে। দিনের পায়ে তখন ঘুঙুর বাঁধা ছিল।
ভাবছিলাম আশ্রমচৌমুনির গল্প শেষ হলে চলে আসবো ফ্ল্যাটের গল্পে। এদিকে আশ্রমচৌমুনির বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা চরিত্র মানে যারা ঐ বাড়িতে আমাদের নানা রকম সহযোগিতা করেছে তাদের কথা, বিয়েবাড়ির কথা তো বলাই হলোনা। জীবনের জাফরিকাটা জানালায় জ্যোৎস্নার ছায়ার মতো কতো আকাঙ্ক্ষা আলপনা আঁকে তার সীমা নেই। অনুষষঙ্গ হয় তো বেদনার বা যন্ত্রণার কিন্তু স্বপ্ন তো সুখের।
আশ্রম চৌমুনী, দেবেন্দ্র রোড - আবার প্রথম পর্ব
দেবেন্দ্র রোডের প্রথম পর্বের গল্প কিছু বাদ পড়ে গেছিল, বলে নিই। প্রথম যখন আমরা শ্বশুরমশাই অবসর নেওয়ার পর এই বাড়িতে আসি তার কিছু দিনের মধ্যেই চুরি হলো। চোর ঠাকুরঘর থেকে সব রূপোর বাসন নিল। বারান্দা থেকে দশটা তোয়ালে নিল। শুকোতে দেওয়া দুই কুলো পাকা কুল নিল আর নিল রান্নাঘরের শেলফ্ থেকে কেজি পনেরো চিনি। যুদ্ধের বাজারে পনেরো কেজি চিনি দুর্মূল্য। মা গুড়ের তেজপাতা এলাচ দেওয়া সুস্বাদু চা খাইয়ে ও খেয়ে যক্ষের ধনের মতো জমিয়েছিলেন চিনি- সন্দেশ ইত্যাদি করার সখ ছিল। সকলের অগোচর ঐ ধন হারানোর কি দুঃখ। তখন রঙ্গ নামে এক দাপুটে রাঁধুনি ছিল। লকেটে তার কোনো অজানা দেবতার দুটি সোনার খড়ম। সে খুব শাপশাপান্ত চোরকে। বাটি চালান দিল। লাভ হলোনা।
বাড়ির দালান তো খুবই সুন্দর ছিল। বাবার নিজের হাতে করা বাগান আরো সুন্দর। আমাদের শঙ্খ সায়ন, দেওর মনীষের সম্রাট শিবাজী হৈমন্তী, গৌতমের শিলাজিৎ সবাই ঐ বাড়িতে জন্মেছে। এরমধ্যে ওপরের তিনজন পিঠোপিঠি। ছোট থাকতে কী দুশ্চিন্তা ছিল, বারান্দা শেষ হয়েছে পুকুরের বাঁধানো ঘাটলায়। নূতন হাঁটতে শেখা শিশুদের প্রধান আকর্ষণ চোখকুনি মাছ। যাইহোক দুর্ঘটনা ঘটেনি কিছু। কিন্তু অসুখ বিসুখ তো হয়েছেই। পাড়ায় হোমিওপ্যাথির ডাক্তারবাবু অমলেন্দু চক্রবর্তীর জয়কালী হোমিও হল। আমাদের ধন্বন্তরী। কত সমস্যা যে তিনি মিটিয়েছেন। আজকে সায়নের কান পোকা ঢুকলো, পরশু শঙ্খ পড়ে গেল। শেষ পযর্ন্ত ওদের বিয়ের পৌরহিত্যেও তিনি। পাড়ার সেলুনকাকু আঠারো মাসে চুল কেটেছেন আবার বিয়ের কাজও করেছেন। মুদিদোকানের দোকান কাকু দোকানকাকিমাও বহুদিনের আপনজন।
আবার ফেরা যাক দেবেন্দ্র রোডের তৃতীয় পর্বে। আমাদের ইচ্ছা ছিল সবাইকে নিয়ে আনন্দ হবে। তাই ছেলেরা মোটামুটি উপার্জনশীল হতেই বিয়ের আয়োজন করতে আকাঙ্ক্ষা হলো।
প্রদীপ জ্বালানোর আগে তো সলতে পাকাতে হয়। অনুষ্ঠানের আগে কতো ছোট ছোট লৌকিকতা থাকে।
যেদিন পাকা কথা হবে, শঙ্খর শ্বশুরবাড়ির লোকরা আসবেন। কনের মা পান খান। ছেলের বাবা পথ ভুলে পানবাজারে না ঢুকে কেন যে মাছবাজারে ঢুকেছিলেন। একটা শিংমাছ চুবড়ি থেকে পড়বি তো পড় ছেলের বাবার পায়ে কাঁটা ফুটিয়ে দিল। কী বিষ ঐ মাছের কাঁটায়, সাধ্যমতো ওষুধ ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো। ফল হলোনা। টকটকে লাল হয়ে গেছে মুখ প্রবল জ্বর, কথা বলবে কী? মনই খারাপ হয়ে গেল। বাঁচিয়ে দিল পাড়ার মাছওয়ালা। কাঁটানটের ডাঁটা দিয়ে ঝাড়লো দু’চার দিনে কমে গেল। দেশিয় টোটকার কারিকুরি। তারপর কত নিয়ম- বেশিরভাগ মহিলাদের মুখে মুখে। কোন অনুষ্ঠানই একা করার নিয়ম নেই। আত্মীয় পড়শি অনেকে মিলে জলসইবে, পানখিলি থেকে শুভরাত্রি সবাইকে নিয়ে উৎসব। আমাদের অমিত উৎসাহ। সুগন্ধা/সুনদা একধরনের ঘাস তেলে জ্বাল দিলে সুগন্ধ যতই ছড়াবে ততই বৌয়ের সুযশ ছড়াবে। বিয়ের আগের দিন হলো সেই কাজ। বৌ যেদিন প্রথম শ্বশুরালয়ে পা রাখবে দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে সেই সময় দুধ ওথলাতে থাকবে, পঞ্চব্যঞ্জন অন্ন, মিষ্টান্নে পূর্ণ পাত্র দেখবে,কার সংসার ওথলায়-- বৌমা,-- তোমার শ্বশুরের সংসার। হোক সংস্কারমাত্র, উদ্ভাবন যিনি করেছিলেন তিনি আমারই কোন পূর্বনারী। তাঁকে প্রণাম। ভোরবেলা উঠে গৃহদেবতার পুজো দিয়ে তেলকই, লাউচিংড়ি সব রান্না করেছি। রেকর্ডে বাজছে, এসো মা লক্ষ্মী বসো মা লক্ষ্মী থাকো মা লক্ষ্মী ঘরে।
সেই সঙ্গে চলছে ডিসেম্বরের স্কুলের কাজ। কত উদ্যম তখন।
সায়নকে ছোটবেলায় দেখাশোনা করতো সন্ধ্যা - তার ছিল পাড়া বেড়ানোর অভ্যাস। পাড়ায় বিয়েবাড়ি থাকলে বর যখনই শোভাযাত্রা করে যেতো সায়নকে কোলে নিয়ে দেখতে যেতো, তা দেখে দেখে বিয়েবাড়ির লিচুলাইটের প্রতি সায়নের খুব আকর্ষণ জন্মেছিল। ওর বিয়ের সময় ডেকোরেটরের প্রতি নির্দেশ ছিল আলোয় আলোয়ময় করে দেয় যেন। আমরা আমাদের সীমিত ক্ষমতা আর বিত্ত নিয়ে আনন্দরূপের আশীর্বাদ চেয়েছি ওদের বিবাহ অনুষ্ঠানে। বৈভব ছিল না, প্রদর্শনের ইচ্ছাও না। আজকে গল্প করতে বসে সেদিনের সব ছবি ফুটে উঠেছে থরেথরে। উছলে পড়ে জীবন পাত্র।
বিয়ে তো সুন্দর ভাবেই হলো কিন্তু তার আগেই শ্বশুরমশাইএর শ্রাদ্ধের আগের দিন পড়ে গিয়ে আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এরপর আবার কর্নেল চৌমুনির কাছে পড়ে গিয়ে দুই হাত একসঙ্গে ভেঙ্গে গেল। বহুদিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হলো। দীর্ঘকাল বিপুল, দুরারোগ্য ও অনর্থক অবসাদে ভুগেছি, চিকিৎসা চলেছে। আশিস অনেকদিন সারাদিন একা কাটিয়েছেন। আমি আরও দশবছর পর রিটায়ার করেছি। ইচ্ছা থাকলেও আগে অবসর নেওয়া হয়নি। অসুস্থ হয়ে বা সুস্থ থাকতেও রোজ সন্ধ্যায় বলি ছেলেদের কাছে না থাকলে ভালো লাগে না। ওদের বাবারও শ্বশুরমশাইএর মৃত্যুর পর আর বাড়িতে থাকার তাগিদ রইলো না। আমরা ভাবলাম কোলকাতা আগরতলা মিলিয়ে থাকবো। কিন্তু এই বয়সে তা আর বাস্তবোচিত মনে হলো না। বছর দু-তিন ঐভাবে ছিলাম, তারপর ছেড়ে এলাম আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়ের বাসভূমি। শেষ যেদিন চলে আসি, গেটের মুখে বেরোতেই গিয়ে হঠাৎই খুব বড় একটা আছাড় খেলেন - তাঁর মতো সতর্ক লোকের কেন এমন হলো। কেউ কি পিছু ডেকে বলেছিল -"যেতে নাহি দিব"। কোলকাতা এসেও তাঁর মনে আনন্দই ছিল। বৌ ছেলে নাতনি নিয়ে খুশিই ছিলেন। কিন্তু বাড়ি গুলোর কথা শেষের দিকে বলতেন। বিশেষ করে রম্যাণি বাড়ির কথা। সমুদ্রঝাউ গাছটা কাটা যাওয়ায় খুব মনে কষ্ট পেয়েছিলেন।
এরপর আর বেশিদিন রইলেন না। একএকটা মানুষের সৃজনশীল মন নিরন্তর কিছু নির্মান করতে চায়। আশিসের সেই প্রবণতায় একটার পর একটা বাড়ি তৈরির কারণ। মানুষ আপনার ভেতরে কতো বৈচিত্র্য বহন করে নিজের অজান্তে।
বাড়িবৃত্তান্ত শেষ করার আগে লিখতে হবে আমাদের পাটুলি রম্যাণি ফ্ল্যাটের কথা। সংসার শুরু করার পর এই বাড়িতে সুখে দুঃখে সবচেয়ে বেশি দিন কাটাচ্ছি। এখানেই হারিয়েছি সবচাইতে কাছের যে ছিল। এখানেই পেয়েছি দুই নাতনিকে। এখানেই রোগশয্যায় কাটছে শেষের দিন। এমনি কেটে গেলেই বাঁচি। মনে মনে বলি "আমি আছি তোমার সভার দুয়ারদেশে সময় হলেই বিদায় নেব কেঁদে হেসে।" সময় তো হচ্ছে না।
পুরনো বাড়ির কথা বলতে বলতে বড় বেশি সংপৃক্ত হয়ে পড়লাম হারানো দিনের সঙ্গে। সেই আঙিনায় ঝরে পড়া শিউলি সুবাস, সেই অড়হর গাছের সবুজ ডালে বসা সবুজ টিয়া পাখি, শঙ্খ সায়নের টলোমলো পায়ে প্রথম দাঁড়ানোর চেষ্টা, ওদের বাবার স্কুটারের কাঙ্খিত শব্দ পরতে পরতে মস্তিষ্কের পটভূমিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝাঁকুনি দিতে লাগলো। সিদ্ধান্ত-- থাক, আলোর ঝলকানিতে পেছনে তাকিয়ে মায়ার খেলা দেখে দরকার নেই।
দরকার না থাকলেও দাবি থাকে, আব্দার থাকে। নিজের ইচ্ছাও নেই তা নয়। হারানো সুরে গাওয়া কঠিন তবুও যে টুকু পারা যায়। বলেছিলাম সংক্ষেপে লিখবো। লালির জোরদার দাবি, মানছি না মানবো না। সায়ন বলছে লেখা শেষ করা যায় না। নিজে নিজে শেষ হয়। অতএব সময় নিয়ে আস্তে আস্তে---।
বাঘাযতীন প্লেসের ফ্ল্যাটে সায়ন প্রথম থিতু হয়েছিল কোলকাতায় পড়তে এসে। শঙ্খ শিবপুর বিই কলেজের হোস্টেলে। আসা যাওয়া করতো। সায়নও ছুটির দিনে শিবপুর যেতো কিন্তু প্রায় কিশোর বয়সে অনভিজ্ঞ ছেলেটা নূতন ফ্ল্যাটে বসত গড়েছিল মনে পড়লে এখনো কষ্ট হয়। বাড়িতে থাকতে সে বাবার পিঠে পাউডার মাখিয়ে দিতো ফুল গাছে জল দিতো, আমরাও শঙ্খ পড়তে যাওয়ার পর সায়নকে পাঠিয়ে আগরতলায় আর টিঁকতে পারছিলাম না। পাকাপাকি আসাও সম্ভব ছিল না। দুদিন ছুটি পেলে সঙ্গে দুদিন সি এল নিয়ে কোলকাতা আসতে ইচ্ছা করতো। বাঘাযতীনের ফ্ল্যাটে দুই ভাইয়ের সংসার, কয়েকজন বন্ধুও থেকেছে কিছু দিন করে। ছোট ফ্ল্যাট, দুই কামরা। লালি আর সুকন্যার প্রথম সংসারযাত্রা এখানে শুরু। দরকার ছিল বড় একটি বাসস্থান। আমার পছন্দ ছিল বাড়ি। এখানে ওখানে বাড়ি ফ্ল্যাট দেখা হচ্ছিল। এরমধ্যে একদিন রঙমিস্ত্রি মহীদুল বললো মেশোমশাই পাটুলিতে ফ্ল্যাট হচ্ছে, চলুন না একদিন দেখবেন। আশিস গেলেন, তাঁর ভালোও লাগলো। পরে একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন। ব্যস্ ঠিক হলো ওই বাড়িতেই ফ্ল্যাট কেনা হবে। ততদিনে ছেলেরাও স্বাবলম্বী, তারা সহ, তিনটি ফ্ল্যাট একত্রে কেনা হবে।
"সন্ধ্যাদীপের আলোকে তুমি আর আমি একা
নয়নে আমার অশ্রুজলের চিহ্ন কি যায় দেখা।"
সে দিনও ভেসে গেছে। আর প্রাসঙ্গিক নয়। "আজি এ বরষা নিবিড় তিমির/ ঝরঝর জল জীর্ণ কুটির, বাদলের বায়ে প্রদীপ নিবায়ে জেগে বসে আছি একারে--"। আগরতলা থেকে শঙ্খ সায়ন চলে আসার পর আমরা আমাদের কাজে সামাজিক জীবনে সাহিত্যচর্চা বা ক্রাফট কাউন্সিলের কাজ যে ছেড়ে দিয়েছিলাম তা নয় - আরও বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছিলাম; তবুও সবসময়ই দুজনে থেকেও একা লাগতো। ছেলেদের বিয়ের পর কিছু দিনের জন্য সেই শূন্যতা কাণায় পূর্ণ হয়ে গেল। আমরা নূতন করে স্বপ্ন দেখতে থাকলাম। ছেলে বউদের নিয়ে তিনফ্ল্যাট জুড়ে একটা চাঁদের বাড়ি হবে। আমাদের মাটির কলস ছাপিয়ে যাবে, উছলে পড়বে।
গৃহপ্রবেশের পুজো হলো, বাঘাযতীনে সায়ন একাই বাড়িতে ঢুকেছিল, শঙ্খ এসেছিল, তার বোধহয় তখন পরীক্ষা ছিল। এইবার দুই ভাই বাড়িতে। সুকন্যা অবশ্য ফাইজারে তখন সদ্য ঢুকেছে। গৃহপ্রবেশের আগের রাতে মুম্বাই থেকে ফিরেছিল। লালি বেশ উৎসাহের সঙ্গে নিজের ভূমিকা পালন করলো। আমরা গৃহপ্রবেশের পর আগরতলা গেলাম দুজনে। যেদিন ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন হলো সেদিনই আমি আগরতলার কর্ণেল চৌমুনীতে রাস্তায় পড়ে গিয়ে দুই হাত একদিনে ভেঙ্গে দীর্ঘদিন ভুগলাম - ছেলেরা খবর পেয়ে ছুটে গেল। সে এক বিরাট বিপর্যয়। কাটিয়ে ওঠা গেলেও চিহ্ন মিলালো না।
পাটুলি - রম্যাণি
রম্যাণি ফ্ল্যাটে যেহেতু বেশি দিন থাকলাম তাই অনেক কথা এখানকার কাহিনীর অঙ্গ হতে পারে কিন্তু সবটাই যে লিখতে পারবো তা তো নয়। লিখতে যদি পারতাম গুছিয়ে তবে মানুষের কথা লিখতাম, বাঘাযতীন বাড়ির কেয়ারটেকার পরিবারের কথা। শানু শর্মা বৌ অপর্ণা আর দুটি ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকতো। কুকুর ছিল ভিকি। তাদের কতো মজার কীর্তি। এখানেও কেয়ারটেকাররা বংশী, ভূতনাথ, সঞ্জয়, রাজা তাদের ছেলে মেয়েদের কতো গল্প। কাজল, মালতী, মলিনা সবারই আলাদা জীবন, আলাদা ধরন কিন্তু দুঃখে সুখে সমবেদনায় মানুষ মানুষের জন্য খাটে, ভাবে, নিজের মতো করে ভালোবাসে। কলমে তাদের নিমন্ত্রণ করি আমার সাধ্য কি। আমি অতীতের সুখ দুঃখ নিয়ে আপ্লুত হয়ে বৃথা লেখাটিকে ভারাক্রান্ত করতে চাইনা। জীবনের সবচেয়ে বড় বেদনাটুকু এখানে আমরা পেয়েছি, তা আর হৃদয় খুুঁড়ে জাগাতে চাইনা।
এখানে সবচেয়ে বড় আনন্দময় প্রাপ্তি হলো আমাদের দুই প্রাণাধিক নাতনি তুষ্টু দিঠিকে এখানে পেয়েছি সান্নিধ্যে। তুষ্টুর জন্ম আগরতলায়। আমরাও তখন সেখানে। কয়েকদিন পর কোলকাতা এসেছি। লালি কয়েক মাসের তুষ্টুকে নিয়ে এলো। ঠাকুরদা তো আমার হাত কমজোরি ভেবে তুষ্টুকে আমার কোলে দিতে নারাজ। আবার দিঠি যেদিন প্রথম বাড়ি এলো ওকে কোলে করে চারতলার ঘরে উঠলাম। দিঠির দাদা কী খুশি। হাত ভেঙ্গেও আমি এটুকু পেরেছি। ছাদের বাগানে লেবু পেয়ারা ফলেছে। নাতনিরা খেয়েছে, কত সৌভাগ্য। ওদের নিয়ে আমাদের দিন কাটছে, আবার অসুখ বিসুখ হসপিটাল নার্সিংহোমে যাতায়াতও লেগে আছে। ছেলেদের, বৌমাদের তত্ত্বাবধায়ন, ব্যবস্থাপনা তখন কতখানি স্বস্তি দিয়েছে আমাদের তা বলার না। শঙ্খ লালি তো কোলকাতায় এখনো আছে। তারা তো করেই। সায়নও আমার সঙ্গে হসপিটালে থাকা, আমাদের ওর কাছে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া সব নিখুঁত ভাবে সম্পাদন করেছে। বৌমাদের কথা বলতেই হয় - লালি আমাদের চোখের সামনে গৃহিনীপনায় কেমন দক্ষ হয়ে উঠেছে। এখন সে কলেজছাত্রীর মা। সুকন্যা আমার সুবিধার জন্য পোর্টবল চেয়ার কাঁধে বইমেলায় চলেছে, ব্যারাকপুর থেকে বিরিয়ানি এনে সবাই মিলে বাড়িতে খাওয়া, ছাদে বাচ্চাদের নিয়ে কৃত্রিম পুকুরে স্নান তারপর লাঞ্চ করা, এসব মনে করলে ভালো লাগে। রম্যাণি, মেপলশেড, ব্যাঙ্গালোর সায়নের সব কর্মস্থানেই সুখস্মৃতি আছে। শঙ্খ লালি পুরী, দীঘা, পুরুলিয়া অন্য যেখানেই গেছি সাধ্যের চেয়ে বেশি করেছে। এসবই এই ফ্ল্যাটে থাকাকালীন। এই বাড়িতে আমি একটা বিপর্যয় ঘটাচ্ছিলাম। সরস্বতী পূজার দিন ছোট্ট দিঠিকে নিমহলুদ মাখিয়ে শ্রী তুলতে গেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম একটু নিম হলুদ ছোঁয়াবো, ও মা, মুখটা হলুদের ছোঁয়ায় দুর্গার মুখের ছাপের মতো সুন্দর লাগছে। আর একটু দিতেই এলার্জি। কী আতঙ্ক সেদিন। যাই হোক পাড়ার ডাক্তারবাবু রক্ষা করলেন। চোখ বুজলেই দেখি তুষ্টু ছোট্ট ছোট্ট হাতে তার দাদাকে মিছিমিছি ফেসিয়াল করছে, দাদা আরামে চোখ বুজে আছেন। দিঠি তখন দাদার হাঁটুও নাগাল পায়না, দুহাত বাড়িয়ে বলছে --দাদা কোনে কোনে অর্থাৎ কোলে। দাদা বলছেন,কোন্ গুণে কোন্ গুণে? বলে নিচু হয়ে কোলে নিচ্ছেন। স্মৃতি তুমি বেদনা না কি স্মৃতি সততই সুখের? উত্তর সহজ নয়।
সব স্মৃতির ওপর হেমন্তের গোধূলি ছায়া ধূসর হয়ে মেলা হয়েছে এখন। শিউলি ফোটা তখনও ফুরায়নি। শিউলি তলায় শোয়ানো মানুষটি কিছুই জানেন না। শিউলি ঝরছে তাঁর বুকের ওপর।
এই ছবি চেতনায় ভেসে উঠলেই অতীতে বিচরণ সুকঠিন মনে হয়। আমাদের সবারই। কলম চলেনা, যদিও জানি, "শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা....."। বিশ্ববিধান অমোঘ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।