পান্তা নিয়ে কী সুন্দর সুন্দর লেখা পড়ছি - আমি একটা পান্তাকোলাজ সেঁটে দিলাম আমার দেয়ালে --
~~~~
স্বপ্নে একথালা পান্তাভাত সানকিতে বেড়ে নিয়ে মা আজও স্বপ্নে ডেকেছিলো---নন্দু ও নন্দু একগাল খেয়ে যা বাছা, খালিপেটে যাসনি, পিত্তি পড়ে পেট জ্বলবে বাপ।
সানকিতে ভেজা ভাত হাতভরা সবুজ কাঁচের চূড়ি - সকালবেলার গন্ধ মেখে বৌটি মিটিমটি হাসে - ঘোমটা টানে মলিন শাড়ির মাছ নকসা আঁকা আঁচলে।
ভাতের কোলে গোলাপরঙের পেঁয়াজ কুচি সোহাগ ছড়ায় চাষীর ক্ষুধার আস্বাদে।
পেঁয়াজ কুচির আদরে ঝাঁজালো সবুজলঙ্কার মীনেকারি। পান্তা শুধু ভাত নাকি? সাজাতে জানলে পান্তাভাতের সানকিতে পদ্মপুকুর শাপলা হাওর আঁকা যায়। মণিরা বিবি গুণগুণায় তুমি হও গহীন গাঙ.....তবে না আমাগো ডুইব্যা মরলে চলবো না,বাঁচতে হইবো। আবুডারে বাঁচাইতে হইবো।নৌকা থামলে চলবো না।
পান্তার জলে এতো যে সোয়াদ একি আর এমনি এমনি।মায়ের যত্ন বৌএর আল্হাদ,ঝিয়ের আদুরে বায়না,সব টক টক ঝাল ঝাল মিষ্টি মিষ্টি অনুপানে পান্তা ভোরের স্বপ্নে আসে,দুপুরের গরমে সোহাগী শীতলতা,সন্ধ্যারাতের ক্ষুধাও ঘুমের নেশায় জড়িয়ে থাকে।
কোলাজের ছোটছোট টুকরোর মতো পান্তার সানকি, পান্তাভেজানোর পাথরবাটি, কাঁসার বগীথালা রান্নাঘর রসুইঘর আর নিরামিষ ঘরকে শোভা করে। মণিরার সানকিতে কাঁচালঙ্কা শুকনোলঙ্কা পোড়ার মীনেকারিকে আরো লোভনীয় করে কুঁচো চিংড়ি বেগুন ভাজা।
সোনাঠাকুরমার পান্তা খেতে নেই। চৌদ্দবছরে বিধবা।একসন্ধ্যা কাঁচাকলা সেদ্ধভাতে হবিষ্যি করতে হয় হবে। এই সন্ধ্যা মানে দুপুর বারোটার আগে। ভুলে যাননি পান্তভাতে চিংড়ি দিয়ে কচুশাকের স্বাদ, বিজয়ার দিনে। সোনাঠাকুমা মাছ ছোঁন না তবুও ছেলে বৌমা নাতি পুতিদের জন্য পান্তার আয়োজন করেন পরিপাটি। আশ্বিনের সংক্রান্তিতে রান্না হবে।আশ্বিনে রানধে কার্তিকে খায়---এই নিয়ম। কোন্ শাস্ত্র? গ্রামবাংলার দুঃখিনী মেয়েদের পরম্পরগত শাস্ত্র।
মুরুব্বি পুরুষেরা হাসেন,চতুর্মুখ ব্রহ্মা শাস্ত্র পাঁচটা। একটা শাস্ত্র মেয়েদের মুখে মুখে। মেয়েরা ভলো মন্দ খেতে পাবে বলে ব্রতপার্বন করে। আহারে! কে বোঝে ব্রত মানেই একবেলা উপোস একবেলা সংযম। তবু একটা কিছু নিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা তো চাই। সোনাঠাকুমার পান্তা সংক্রান্তির আয়োজনে তাই উৎসবের আলো ঝলমল করে। এইদিনে হালের জিনিস জালের জিনিস চলে না। পাহাড় থেকে ভূমিপুত্ররা বেচতে আসে জুমের ছোট্ট আর গোলদানার লালচে চাল। বড় সোনালি রঙের পাথরবাটি যেটি দুপুরুষ আগে দ্বারকায় তীর্থ করতে গিয়ে কেনা হয়েছিল তার ওপর নূতন ধোয়া জলগামছা বিছিয়ে গরম ভাত বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর জগন্নাথ দীঘির মিষ্টি জল ঢালবেন। গন্ধরাজ লেবুর ষোলটা পাতা ষোলটুকরা লেবু দিতে হবে।পরের দিন সকালে নারকেল কোরা ছড়িয়ে ছেঁকে নেওয়া পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঠের খুন্তি নেড়ে মিশিয়ে দিতে হবে। গুড়ের ডেলা সাজানো থাকবে কালো পাথরের রেকাবীতে। লাল শাকের টক,গাঁঠিকচু আর সর্ষেপোস্ত,তিল বাটা তিলের মুচমুচে বড়া। আর আছে কাঁচা তেঁতুলের টক। শেষ পাতে আমআদা দিয়ে নারকেল বাটার সন্দেশ। কয়েকদিন ধরে যোগাড়যন্ত্র করে ঠাকুমা ব্যতিব্যস্ত।
ভারতের প্রায় সব অঞ্চলে নানা ভাবে ছড়িয়ে আছে পান্তা প্রিয়তার ছবি। ওড়িয়ারা পান্তাভাতে তুষ্ট। উত্তর পূর্বাঞ্চলে গরীবের প্রাতরাশে পুষ্টির জোগান দেয় পেঁয়াজ শুকনোলঙ্কা পোড়া বা সবুজ কাঁচা লঙ্কা।অঞ্চল বিশেষে সিঁদল বা শুকনো পুঁটিমাছের লাল টুকটুকে ভর্তা।
এই আয়োজনে মাধুরী মেশায় মায়ের যত্ন প্রিয়ার সযত্ন পরিবেশন। আমি অবশ্য আনুষ্ঠানিক পান্তা পরিবেশন নিয়েই বলি। আমার পরিবারে এসব অনুষ্ঠান খুব একটা দেখিনি। নানাজনের কাছে শোনা কথার মাধুকরী।
এইতো এখন আমার যেখানে বাস--দক্ষিন চব্বিশ পরগণা এখানে ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে গ্রামীন গৃহস্থ ঘরে সাজ সাজ রব। রান্নাপুজোর বিরাট আয়োজন। হেঁশেল পরিষ্কার করে আগের দিন রাতে নানা রকম পদ রান্না হবে।মাছ তো হবেই। শাক সব্জী মিষ্টান্ন।আর হবে পান্তা ভাত। আগের দিনের ভাতে জল দিয়ে রাখা হবে ডাল শুকনো রান্না হবে। আত্মীয় পরিজনকে খাওয়ানো হবে। আমাদের কেয়ারটেকার ভূতনাথ তো রান্নাপুজো উপলক্ষে ফ্ল্যাটের সবাইকে থালাভরা রান্না পাঠায়। তার মূল সুর বাঁধা পান্তার সুরে।
ভূতনাথের বৌ, বৌদি সনকা তাদের সুন্দরবনের কাঁকড়ার কষা কষা ঝোল করে। ছোট চিংড়ি লাল করে ভেজে কচু দিয়ে রাঁধে, পান্তা ভাতের জল পরিপাটি করে ঝরিয়ে দেয়। জলটা লেবুপাতায় নুন চিনিতে বাটিতে রেখে সেই পাণীয় দুবছর তিন বছরের বাচ্চাগুলোকে ঝিনুক দিয়ে খাইয়ে দেয়।
বসন্ত রোগের মরশুমে শীতলামায়ের পুজোর দিনেও গরম খেতে নেই। পান্তাই খেতে হয়।
বাংলাদেশের নববর্ষ তো উদযাপিত হয় সমারোহ সহকারে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।ভোজনের আয়োজনে ইলিশ মাছ ভাজা নানাবিধ ভুনা আর উপাদেয় ভর্তার সঙ্গে পান্তা ভাত।
দুই প্রজন্ম আগের কবি লিখেছেন,"পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে কাপড় দিয়ে গায়/তাড়ি বগলে ছেলের দলে পাঠশালাতে যায়।" সে তো আজকে স্মৃতি। পান্তা খেয়ে কেউ আর পাঠশালাতে হয় তো যায় না। কিন্তু ভোরবেলা গ্রামগঞ্জের পথে শ্রমিক বা চাষী গামছায় পান্তাভাত পেঁয়াজের টুকরো আর ঝালঝাল দুটি লঙ্কা সহ বেঁধে নিয়ে কাজে চলেছে, এদৃশ্য দেখাই যায়। দুপুর বেলা বালকপুত্র বা বালিকা কন্যা বাপের জন্য পান্তাভাতের পাত্র যত্ন করে নিয়ে মাঠে নিয়ে চলেছে এও চেনা ছবি। বৌটি স্বামীর জন্য আলপথ ধরে এল্যুমুনিয়মের কানা উঁচু থালায় পান্তা নিয়ে রোদের তাতে ঘামতে ঘামতে চলেছে এও এক মধুর দৃশ্য। কাছাড়ে দেখেছি কুটি কামলা কি সিদ্দিক চাচা সুপুরির খোলের ব্যাগে পরিপাটি করে নিয়ে আসেন …
সব ছবিতেই গরীবের ও পান্তাসেবনের সুখের চিত্র।বিপরীত ছবিও আছে,ব্যাধরমণী ফুল্লরা যার "শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞার বসন।" "বড় অভাগ্য মনে গনে" ফুল্লরা,তার ভোজ্যপাত্র বলতে কিছুই নেই।সে দেখাচ্ছে, "আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান।" মধ্যযুগের সেই অশ্রুমুখী তার অভাবের সংসারের ছবি নিয়ে থাকুক কোলাজের শেষে।
অপূর্ব, যেন মায়ের গন্ধ মাখা ❤️