এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  টুকরো খাবার

  • পান্তাকোলাজ 

    শক্তি দত্ত রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    টুকরো খাবার | ০৫ আগস্ট ২০২১ | ২০৯১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • পান্তা নিয়ে কী সুন্দর সুন্দর লেখা পড়ছি - আমি একটা পান্তাকোলাজ সেঁটে দিলাম আমার দেয়ালে --


    ~~~~


    স্বপ্নে একথালা পান্তাভাত সানকিতে বেড়ে নিয়ে মা আজও স্বপ্নে ডেকেছিলো---নন্দু ও নন্দু একগাল খেয়ে যা বাছা, খালিপেটে যাসনি, পিত্তি পড়ে পেট জ্বলবে বাপ।


    সানকিতে ভেজা ভাত হাতভরা সবুজ কাঁচের চূড়ি - সকালবেলার গন্ধ মেখে বৌটি মিটিমটি হাসে - ঘোমটা টানে মলিন শাড়ির মাছ নকসা আঁকা আঁচলে।


    ভাতের কোলে গোলাপরঙের পেঁয়াজ কুচি সোহাগ ছড়ায় চাষীর ক্ষুধার আস্বাদে।


    পেঁয়াজ কুচির আদরে ঝাঁজালো সবুজলঙ্কার  মীনেকারি। পান্তা শুধু ভাত নাকি? সাজাতে জানলে পান্তাভাতের সানকিতে পদ্মপুকুর শাপলা হাওর আঁকা যায়। মণিরা বিবি গুণগুণায় তুমি হও গহীন গাঙ.....তবে না আমাগো ডুইব‍্যা মরলে চলবো না,বাঁচতে হইবো। আবুডারে বাঁচাইতে হইবো।নৌকা থামলে চলবো না।


    পান্তার জলে এতো যে সোয়াদ একি আর এমনি এমনি।মায়ের যত্ন বৌএর আল্হাদ,ঝিয়ের আদুরে বায়না,সব টক টক ঝাল ঝাল মিষ্টি মিষ্টি অনুপানে  পান্তা ভোরের স্বপ্নে আসে,দুপুরের গরমে সোহাগী শীতলতা,সন্ধ‍্যারাতের ক্ষুধাও ঘুমের নেশায় জড়িয়ে থাকে।


    কোলাজের ছোটছোট টুকরোর মতো পান্তার সানকি, পান্তাভেজানোর পাথরবাটি, কাঁসার বগীথালা রান্নাঘর  রসুইঘর আর নিরামিষ ঘরকে শোভা করে। মণিরার সানকিতে কাঁচালঙ্কা শুকনোলঙ্কা পোড়ার মীনেকারিকে আরো লোভনীয় করে কুঁচো চিংড়ি বেগুন ভাজা।


    সোনাঠাকুরমার পান্তা খেতে নেই। চৌদ্দবছরে বিধবা।একসন্ধ‍্যা কাঁচাকলা সেদ্ধভাতে হবিষ‍্যি করতে হয় হবে। এই সন্ধ‍্যা মানে দুপুর বারোটার আগে। ভুলে যাননি পান্তভাতে চিংড়ি দিয়ে কচুশাকের স্বাদ, বিজয়ার দিনে। সোনাঠাকুমা মাছ ছোঁন না তবুও ছেলে বৌমা নাতি পুতিদের জন্য পান্তার আয়োজন করেন পরিপাটি। আশ্বিনের সংক্রান্তিতে রান্না হবে।আশ্বিনে রানধে কার্তিকে খায়---এই নিয়ম। কোন্ শাস্ত্র? গ্রামবাংলার দুঃখিনী মেয়েদের পরম্পরগত শাস্ত্র।


    মুরুব্বি পুরুষেরা হাসেন,চতুর্মুখ ব্রহ্মা শাস্ত্র পাঁচটা। একটা শাস্ত্র মেয়েদের মুখে মুখে। মেয়েরা ভলো মন্দ খেতে পাবে বলে ব্রতপার্বন করে। আহারে! কে বোঝে ব্রত মানেই একবেলা উপোস একবেলা সংযম। তবু একটা কিছু নিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা তো চাই। সোনাঠাকুমার পান্তা সংক্রান্তির আয়োজনে তাই উৎসবের আলো ঝলমল করে। এইদিনে হালের জিনিস জালের জিনিস চলে না। পাহাড় থেকে ভূমিপুত্ররা বেচতে আসে জুমের ছোট্ট আর গোলদানার লালচে চাল। বড় সোনালি রঙের পাথরবাটি যেটি দুপুরুষ আগে দ্বারকায় তীর্থ করতে গিয়ে কেনা হয়েছিল তার ওপর নূতন ধোয়া জলগামছা বিছিয়ে গরম ভাত বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর জগন্নাথ দীঘির মিষ্টি জল ঢালবেন। গন্ধরাজ লেবুর ষোলটা পাতা ষোলটুকরা লেবু দিতে হবে।পরের দিন সকালে নারকেল কোরা ছড়িয়ে ছেঁকে নেওয়া পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঠের খুন্তি নেড়ে মিশিয়ে দিতে হবে। গুড়ের ডেলা সাজানো থাকবে কালো পাথরের রেকাবীতে। লাল শাকের টক,গাঁঠিকচু আর সর্ষেপোস্ত,তিল বাটা তিলের মুচমুচে বড়া। আর আছে কাঁচা তেঁতুলের টক। শেষ পাতে আমআদা দিয়ে নারকেল বাটার সন্দেশ। কয়েকদিন ধরে যোগাড়যন্ত্র করে ঠাকুমা ব‍্যতিব‍্যস্ত।


    ভারতের প্রায় সব অঞ্চলে নানা ভাবে ছড়িয়ে আছে পান্তা প্রিয়তার ছবি। ওড়িয়ারা পান্তাভাতে তুষ্ট। উত্তর পূর্বাঞ্চলে গরীবের প্রাতরাশে পুষ্টির জোগান দেয় পেঁয়াজ শুকনোলঙ্কা পোড়া বা সবুজ কাঁচা লঙ্কা।অঞ্চল বিশেষে সিঁদল বা শুকনো পুঁটিমাছের লাল টুকটুকে ভর্তা।


    এই আয়োজনে মাধুরী মেশায় মায়ের যত্ন প্রিয়ার সযত্ন পরিবেশন। আমি অবশ‍্য আনুষ্ঠানিক পান্তা পরিবেশন নিয়েই বলি। আমার পরিবারে এসব অনুষ্ঠান খুব একটা দেখিনি। নানাজনের কাছে শোনা কথার মাধুকরী।


    এইতো এখন আমার যেখানে বাস--দক্ষিন চব্বিশ পরগণা এখানে ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে গ্রামীন গৃহস্থ ঘরে সাজ সাজ রব। রান্নাপুজোর বিরাট আয়োজন। হেঁশেল পরিষ্কার করে আগের দিন রাতে নানা রকম পদ রান্না হবে।মাছ তো হবেই। শাক সব্জী মিষ্টান্ন।আর হবে পান্তা ভাত। আগের দিনের ভাতে জল দিয়ে রাখা হবে ডাল শুকনো রান্না হবে। আত্মীয় পরিজনকে খাওয়ানো হবে। আমাদের কেয়ারটেকার ভূতনাথ তো রান্নাপুজো উপলক্ষে ফ্ল‍্যাটের সবাইকে থালাভরা রান্না পাঠায়। তার মূল সুর বাঁধা পান্তার সুরে।


    ভূতনাথের বৌ, বৌদি সনকা তাদের সুন্দরবনের কাঁকড়ার কষা কষা ঝোল করে। ছোট চিংড়ি লাল করে ভেজে কচু দিয়ে রাঁধে, পান্তা ভাতের জল পরিপাটি করে ঝরিয়ে দেয়। জলটা লেবুপাতায় নুন চিনিতে বাটিতে রেখে সেই পাণীয় দুবছর তিন বছরের বাচ্চাগুলোকে ঝিনুক দিয়ে খাইয়ে দেয়।


    বসন্ত রোগের মরশুমে শীতলামায়ের পুজোর দিনেও গরম খেতে নেই। পান্তাই খেতে হয়।


    বাংলাদেশের নববর্ষ তো উদযাপিত হয় সমারোহ সহকারে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ‍্য দিয়ে।ভোজনের আয়োজনে ইলিশ মাছ ভাজা নানাবিধ ভুনা আর উপাদেয় ভর্তার সঙ্গে পান্তা ভাত।


    দুই প্রজন্ম আগের কবি  লিখেছেন,"পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে কাপড় দিয়ে গায়/তাড়ি বগলে ছেলের দলে পাঠশালাতে যায়।" সে তো আজকে স্মৃতি। পান্তা খেয়ে কেউ আর পাঠশালাতে হয় তো যায় না। কিন্তু ভোরবেলা গ্রামগঞ্জের পথে শ্রমিক বা চাষী গামছায় পান্তাভাত পেঁয়াজের টুকরো আর ঝালঝাল দুটি লঙ্কা সহ বেঁধে নিয়ে কাজে চলেছে, এদৃশ‍্য দেখাই যায়। দুপুর বেলা বালকপুত্র বা বালিকা কন‍্যা বাপের জন‍্য পান্তাভাতের পাত্র যত্ন করে নিয়ে মাঠে নিয়ে চলেছে এও চেনা ছবি। বৌটি স্বামীর জন‍্য আলপথ ধরে এল‍্যুমুনিয়মের কানা উঁচু থালায় পান্তা নিয়ে রোদের তাতে ঘামতে ঘামতে চলেছে এও এক মধুর দৃশ্য। কাছাড়ে দেখেছি কুটি কামলা কি সিদ্দিক চাচা সুপুরির খোলের ব‍্যাগে পরিপাটি করে নিয়ে আসেন …


    সব ছবিতেই গরীবের ও পান্তাসেবনের সুখের চিত্র।বিপরীত ছবিও আছে,ব‍্যাধরমণী ফুল্লরা যার "শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞার বসন।"  "বড় অভাগ‍্য মনে গনে" ফুল্লরা,তার ভোজ্যপাত্র বলতে কিছুই নেই।সে দেখাচ্ছে, "আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ‍্যমান।" মধ‍্যযুগের সেই অশ্রুমুখী তার অভাবের সংসারের ছবি নিয়ে থাকুক কোলাজের শেষে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • টুকরো খাবার | ০৫ আগস্ট ২০২১ | ২০৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ০৬ আগস্ট ২০২১ ০৬:০৬496483
  • অপূর্ব, যেন মায়ের গন্ধ মাখা ❤️

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন