এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • পূজার পুতুল কদম কলি

    শক্তি দত্ত রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০১ এপ্রিল ২০২৫ | ৩১৬ বার পঠিত
  • আমাদের পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়ে পূজা। তার ছোট্ট পুতুলের কি নাম জানো, কদম কলি। আমাদের শহরে কয়েক ডজন পদ্মকলি, চম্পাকলি আছে। কদমকলি কিন্তু একজনই- পূজার পুতুল।

    পুতুলটি খুব আদরের কিন্তু ঐ আরকি, উলোঝুলো চুল। গায়ে ময়লা। জামা ছেঁড়া। রেশমীর পুতুল রুমেলা খুব ঝকঝকে। ফ্যাশনের জামা, পরিপাটি আঁচড়ানো চুল। তা কি আর করা, রেশমীর মা সময় করতে পারেন।

    রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সেরে রেশমীর পুতুলের যত্নআত্তি করেন। পূজার মা কতদূর মফঃস্বলে চাকুরী করেন। কি করে পারবেন এত সাজগোজ তাও আবার পুতুলের। নিজের মেয়ের যত্নই বলে করতে পারেন না। পূজা নিজেই যা পারে করে। নিজের গ্লাসের দুধ থেকে একটু তুলে নিয়ে কদমের মুখে মাখায়। কমলা খেতে খেতে একটু রস চিপে মাখায়। যেমন দেখে পিঙ্কি মাসীকে মাখতে টাখতে। আর ভাবে পূজা যদি ঐ বুলবুলি পাখীর বাচ্চার মতো হতে পারত আর মা হত বড় ঝুঁটিওয়ালা বুলবুলি পাখিটি, পূজারও স্কুল থাক্ত না। মারও স্কুল থাকত না, সারাদিন গাছে গাছে ওড়াউড়ি। ইচ্ছেমত একটুখানি খাওয়া- কি মজা কি মজা। এরই মধ্যে রাস্তা দিয়ে হাঁক পাড়ে মেঠাই ওয়ালা- “এই রে বর্ধমানের মিঁহিঁ দানা। মিঁহিঁদানারে – ক্ষীঁরের সঁন্দেশ-” যত নাকি সুরের মিষ্টি হাঁক। না, পূজা মিষ্টি ভালবাসে না। মিষ্টি বেশী খেলে সুগার বাড়ে। পূজা শুনেছে। ওর মেসোরই ঐ অসুখটা আছে। পূজা যদি বুলবুলি নেহাৎ নাই হতে পারে, ও হবে চানাচুরওয়ালা। চানাচুর বিক্রি করবে, খাবেও। তা, মার জন্যে নিশ্চিন্ত মনে কিছু ভাবার জো আছে? “পূজা এসো, পড়তে বোসো। সকালবেলা বসে থাকলে চলে?” দূর ভাল্লাগে না। পূজা রাগ হয়ে যায় মার ওপর।

    একদিন হয়েছে কি, কদমকলি খুব কেঁদেছে। ওরও একটা পুতুল চাই। পূজা যত বোঝায় ঐ লাল মাটির পুতুলটাই কদমের পুতুল, না কদম মানবে না। এই মাটির মেয়েটি ওর বোন। ওর পুতুল হচ্ছে পূজার মা সবিতারাণী। সবিতারাণীকেই ও চান করাবে, খাওয়াবে। সাজাবে। তা পূজা আর কি করে? বায়নায় অতিষ্ঠ হয়ে পূজা পাশে শুয়ে থাকা ওর মাকেই ঠেলে দেয় কদমকলির দিকে। কদম খুশি বলে খুশি। সবিতারাণীকে বাটিতে জল নিয়ে ন্যাকড়া দিয়ে মুছে চান করাচ্ছে। গার্ডার দিয়ে চুল বেঁধে দিচ্ছে। বাটিতে পাউডার গুলে সে সেরেল্যাক খাওয়াচ্ছে। তারপর আস্তে আস্তে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। সবিতারাণী অবশ্য আগেই ছুটির দুপুরে তার অভ্যস্ত ঘুমটা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, না হলে কি আর এত অত্যাচার সহ্য করতেন? পূজার খুব স্বস্তি হল। না হলে এক্ষুণি শুরু হত। হয় বলতেন- “পূজা, আজকে খুব গরম, একগ্লাস লেবু চিনির জল খেয়ে নাও, নয়তো এটা প্র্যাক্টিস করো বা ওটা প্র্যাক্টিস করো।” মানুষ মা তো বোঝে না বাচ্চাদের তাঁরা কি জ্বালাতন করেন। মা হলে ঐ দাঁড়কাকের মা। টিভির অ্যান্টেনায় বসে বাচ্চার মাথায় ঠোঁট দিয়ে কেবল আদর। না পড়া, না জোর করে খাওয়ানোর জন্য জেদ। কদম খেলা নিয়ে ব্যস্ত আছে। পূজা উঠে বিকেলের জন্য করে রাখা বিতিকিচ্ছিরি ডিমসেদ্ধটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল হটকেস থেকে। তারপর মায়ের পাশে শুয়ে পড়তেই দুচোখ ঘুমে জুড়িয়ে এল।
     
    ওমা, কখন বৃষ্টি নেমেছে। পাশের বাড়িগুলোতে সন্ধ্যার শাঁখ বাজছে। পাশের গানের স্কুলে গলা সাধা শুরু হয়ে গেছে। পূজার মুখ ধোয়া হয়নি, চুল আঁচড়ানো হয়নি। বিকেলের ইস্ত্রী করা জামাও পড়া হয়নি। পূজা দেখে মা সবিতারাণী পুতুল হয়ে দিব্যি কদমকলি মায়ের পাশে ঘুমোচ্ছেন। পূজা তো ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। মা পুতুল হয়ে গেলে পূজা কি করে বড় হবে? কে ওকে আদর করবে, বকবে? পূজা আকুল হয়ে ডাকতে লাগল- “মা, মা, ওঠো ওঠো। ওঠো না।” সবিতারাণী চোখ খুলে অবাক- “ওমা, কান্না জুড়েছিস কেন?” যতই বলেন, “আমি মোটেই পুতুল হয়ে যাইনি, তোর মা-ই আছি।” কান্না আর থামে না। শেষে যখন রেগে বললেন- “দাঁড়াও থামাচ্ছি তোমার কান্না। চুপ করো, শিগগিরই চোখ মুছে পাঁউরুটি আর ডিম খেয়ে নাও।” পূজা তখন নিশ্চিন্ত হয়ে “হ্যাঁ, মা পুতুল নয়”, আদরে, রাগে, আহ্লাদে মাখামাখি। এই তার মা সবিতারাণী। মা তার চুলে আঙ্গুল বোলান। সন্ধ্যে হয় হয়- দুটো বুলবুলির বাচ্চা পেয়ারাগাছের ডালে বসে বৃষ্টি ভিজছে। মা পূজাকে ভোলাতে বলেন –“দেখ বাচ্চাগুলো বড় হয়ে গেছে কিনা, বুলবুলিটা ওদের বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছে।” পূজা বলে- “বড় কোথায়, ওরা আমার কত ছোট। ওরা এখন মা বাবা ছাড়া বাঁচবে কি করে?” বড় বুলবুলি ওর গোল বাসাটা থেকে টিউই টিউই সুরে বলে- “হুঁ। মানুষের আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না। এত বড় মেয়েকে এত আদর।” সবুজ দেবদারু গেটে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ে- মানুষের চেয়ে ভাল মা হয় না। মানুষের চেয়ে ভাল সন্তান কে হয়। জয় জয় মানুষের জয়। এতক্ষণে পূজার ঘুম ঠিকঠাক ভেঙ্গে যায়।
     
    ****
    দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত (১৯৯৫ -১৯৯৯ এর মধ্যে কখনো)।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০১ এপ্রিল ২০২৫ | ৩১৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    চরকি - Suvasri Roy
    আরও পড়ুন
    লাল রঙ - Nirmalya Nag
    আরও পড়ুন
    বাবর - upal mukhopadhyay
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন