এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • মুখোশ

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ | ২৭ বার পঠিত
  • সুপুকে মুখোশ দেখতে বললাম। অন্ধকার অন্ধকার ঘরে মুখোশ তৈরি হচ্ছিল। নানান মুখ টুকরো টুকরো করে সারা ঘরময় ছড়ানো। সুপু বলল, “আরিব্বাস”।
    -- তুই তো আগেও মুখোশ দেখেছিস।
    -- হ্যাঁ।
    -- তবে আশ্চর্য হচ্ছিস কেন?
    -- আশ্চর্য, কই না তো।
    -- তা হলে?
    -- আমি মুখোশ তৈরি করা দেখে বললাম — আরিব্বাস।
    একটু আগে আমরা দোসা খেয়েছি। বেশ নরম। উল্টো দিকে দেখলাম নতুন পার্টি অফিস খোলা হয়েছে। কয়েকজন লোক সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। কয়েকটা মটোর বাইক। মটোর বাইকের ওপর একজন বসে ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কোন পার্টি করেন”। লোকটা কোন উত্তর দিল না।

    আসপাশের লোকজনও পাত্তা দিচ্ছে না দেখে আমি রাস্তার উল্টো দিকে রেষ্টুরেন্টে আবার চলে এলাম। সেখানে আমরা ভালো দোসা খেয়েছি আর চা- সেটাও ভালো ছিল। এর কিছু পরেই চড়িদা সেখানে মুখোশ তৈরি করা হচ্ছে। পিলু বলল, “বাঘমুণ্ডিতেই কি শুধু মুখোশ তৈরি করা হয়? অন্য কোথাও হয় না?” আমি বলেছি, “নানা তা হবে কেন? মুখোশ তো নানা জায়গাতেই তৈরি হচ্ছে তবে এতো ছৌয়ের মুখোশ, বাঘমুণ্ডিতেই বেশি হয় — চড়িদায় বেশি হয়”। খাবার খেয়ে আমরা চড়িদার দিকে রওনা দিলাম। আমরা গাড়ি করে এসেছি। গাড়ির রঙটা মেটে স্বর্ণাভ, এ এক এমন রঙ যা দিনের নানা সময় দেখতে আলাদা আলাদা লাগে। এখন সকাল, চারদিক ঝকঝক করছে তাই গাড়িও ঝকঝক করতে লাগল সেই দেখে নতুন পার্টি অফিসের সামনে থাকা লোকজন সবাই আমাদের দিকে তাকাল। তারা কি ঝকঝকে রঙ দেখছিল - গাড়ির?

    চড়িদার প্রথম দোকানে সুপু আর পিলুকে রেখে আমি অন্য দোকানগুলো দেখলাম। প্রায় কোন দোকানেই সাইন বোর্ড নেই। ফলে বোঝা যায় না এ গুলো ঘর না দোকান। সে জন্য আমি জিজ্ঞেস করেছি, “আপনাদের এ গুলো ঘর না দোকান?” একজন মুখোশ তৈরি করতে ব্যস্ত ছিল, সে কিছু বলল না আর একজন মুখোশগুলো পরপর সাজিয়ে সোজা করে বা উল্টো করে পরপর রাখছিল রোদে কারণ রঙ শুখোতে হবে - সে বলল, “সে একরকম বলতে পারেন আরকি।”
    -- হ্যাঁ কিন্তু বলবটা কী?
    -- সে ঘরও বলতে পারেন আবার দোকানও একরকম বলতে পারেন।
    -- দোকান যদি হবে তবে দোকানের মতো নয় কেন?
    -- দোকানও বলতে পারেন।
    -- দোকানের মতো না হলে দোকান বলে বুঝব কী করে?
    -- তা বলতে পারব না।

    একটার পর একটা দোকান ঘুরে বেড়ালাম একাই। প্রায় প্রতিটা দোকানই দোকান বলে মনে না হওয়ায় ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম। ছেলেপিলেরাও মুখোশের কাজ করছে - ছৌয়ের মুখোশ। চড়িদার বুক চিরে পিচের রাস্তা চলেছে। পিচের রাস্তার আসপাশে কি গ্রাম আছে? কিন্তু সে গ্রামে ঢোকার রাস্তা খুঁজে পেলাম না। শুধুই রাস্তার ধারে বাড়ি আর বাড়ির ভেতরটা বাইরে এসে দোকানের মতো হয়ে যাচ্ছে। সেখানে সবাই মুখোশ তৈরি করে। একটা ছেলে ডান হাত দিয়ে লম্বা শিক ধরে আছে। সে ধরার জায়গাটা কাপড় দিয়ে মুড়ে রেখেছে। বোঝাই যাচ্ছে শিকটা গরম। সে গরম দিয়ে দিয়ে চোখ তৈরি করছিল - অদ্ভূত মুখোশের। সেই ছৌয়ের মুখোশটা বীভৎস একটা মুখ। বীভৎস আর অদ্ভূত। মুখোশেটায় চোখের জায়গাটা আঁকার পর একটা গর্ত করতে হয় আর ছ্যাঁতততত ছ্যাঁতততত আওয়াজ করে চোখ তৈরি করা চলতে থাকে। চোখের ওপারে সব দেখা যায় কারণ গরম শিক ঢুকিয়েছে। সেখানে বীভৎস চোখ দেখা গেল কারণ তাতে গর্ত করা হল এই এক্ষুণি। পাশ দিয়ে বাইকের আওয়াজ আসছিল অনেকক্ষণ। রাস্তার ওপারে বাইক চলাচল করে, গাড়ি চলাচল করতে থাকে। চড়িদার মুখোশ তৈরির গ্রামের তাতে কিছু এসে যায় না। সে মুখোশ বানাতে থাকে। কখনও কখনও তাতে ছ্যাঁদা করে চোখ বানাতে গরম শিক ঢুকিয়ে দিতে হয়। তখন ওপাশে সব দেখা যায় আর দেখা যাবে রাস্তার পাশে নানা অলিতে গলিতে সবকটা বাড়িতেই মুখোশ তৈরি হচ্ছে। যে ছেলেটা মুখোশের চোখে গরম শিক ঢুকিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ করে ঘোরাচ্ছে সে বেশ লম্বা, বয়স বেশি নয় ফলত আরো লম্বা হবে এটা ধরেই নেওয়া যায়। এ ডান হাত দিয়ে ঘোরাচ্ছে দেখে বলি, “তুমি বাঁ হাত দিয়েও শিক ঘোরাতে পার”।
    -- পারি।
    -- দু হাতেই?
    -- শিক গরম হয়। এমনিই ফুটো হয়ে যায়। শুধু ছেঁদা হওয়া কাগজের গুঁড়ো লেগে থাকে। সে সব ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে হয়। তাহলেই পরিষ্কার।
    এই বলে ছেলেটা মুখোশের আর একটা চোখে গরম শিক ঢুকিয়ে দিল ছ্যাঁতততত ছ্যাঁতততত। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কি ঠাকুরের চোখেও শিক ঢুকিয়ে দাও?” ছেলেটা আর উত্তর করে নি।

    সেই থেকে আমি খুঁজতে লাগলাম কোন কোন মুখোশে চোখের জায়গাটা গর্ত করা আর কোনটায় নেই। দেখেছি কার্তিক, দুর্গা, গণেশ, লক্ষী, সরস্বতী সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিন্তু কারও চোখে গর্ত নেই ফলে সবাই কেবল তাকাতে পারছে কিন্তু দেখতে পারছে কি? চোখ ফুটো করা মুখোশ পরে যখন নাচ হবে কেবল বীভৎস মুখেরা আমাদের দেখবে? এ সময় দেখলাম বড় বড় কথাকলির মুখোশও বানানো হয়েছে। সেগুলো দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে সেলোফেন কাগজ দিয়ে মুড়ে। চড়িদা গ্রামটিতে কথাকলির মুখোশ পাওয়ার কথা নয় তবু তা দেখে সুপুকে আর পুলুকে ডাকতে চললাম গিয়ে দেখি ওরা অনেকগুলো মুখোশ কিনেছে। সবই ছোট ছোট মুখোশ । সে গুলোর চোখে গর্ত নেই দেখে সুপুকে বললাম, “গর্ত নেই কেন?”
    -- কোথায় ?
    -- মুখোশে।
    -- গর্ত থাকবে কেন?
    -- না থাকলে নাচ হবে কী করে?
    -- মানে?
    -- মুখোশ আমরা দেখব কিন্তু মুখোশ আমাদের দেখবে কি?
    পুলুকে বললাম, “চল কথাকলির মুখোশ দেখাই চল।” সুপু বলল, “এখানে কথাকলি!” আমি বললাম, “সব আছে”। কথাকলির মুখোশ দেখে সুপু বলেছে, “আরিব্বাস”।
    -- আশ্চর্য হচ্ছিস কেন?
    -- আশ্চর্য হয়নি তো। এখানে কথাকলির মুখোশ দেখে, চড়িদায় কথাকলির মুখোশ দেখে বললাম আরিব্বাস”।
    সুপুকে বললাম, “কিন্তু চোখের জায়গায় গর্ত আছে কি মুখোশের?”
    -- কোনটার?
    -- কথাকলির।

    সুপু মন দিয়ে কথাকলির মুখোশ দেখতে লাগল। কী জানি কিনেও ফেলতে পারে। অনেকগুলো মুখোশ কিনেছে। কথাকলির মুখোশগুলো খুব বড় বড় গাড়িতে ধরবে কি? এই সব ভাবছি, দেখি পুলু সিগারেট ধরিয়েছে সেই ধোঁয়ার আড়াল থেকে রাস্তায় অনেকগুলো বাইককে আসতে দেখা যাচ্ছে। বাইকের সামনে সামনে পতাকার রঙ পতপত করে উড়ছে। তবে আমার পতাকার রঙ চোখে পড়ল না। বাইক আরোহীদের মুখ দেখতে লাগলাম, সেখানে মুখোশ দেখতে লাগলাম, মুখোশে চোখের গর্ত দেখতে লাগলাম - খুঁজতে লাগলাম। শুনি পুলু এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, সুপুও। না, কথাকলির মুখোশটা কেনে নি।

    প্রজাতন্ত্র দিবসের দীর্ঘ বাইক মিছিল দেখে আমরা সবাই থমকে ছিলাম অনেকক্ষণ আর সুপু বলেছিল, “আরিব্বাস”।
    -- আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? কথাকলির মুখোশটা দেখলি?
    -- কথাকলি নয়, কথাকলি নয় এত বড় বাইক মিছিলটা দেখে বললাম — আরিব্বাস।

    সহমন ওয়েবজিনে ইতিমধ্যে প্রকাশিত
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ | ২৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন