দোষে গুনেই মানুষ। স্বভাব চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য গনমতে দোষ হিসেবে গ্ৰাহ্য। কিছু আবার আপেক্ষিক। গুণও তাই।
কদোবেগু - গোত্রের মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় কম দোষ, বেশী গুণ। এরা সচরাচর সমাজে মান্যতা পান, সঙ্গী হিসেবেও অন্যকে ঋদ্ধ করেন।
কগুবেদো - ঠিক তার উল্টো - বিছুটি পাতার মতো পরিত্যাজ্য।
কদোকগু গোত্রের নির্বিরোধী মানুষ ঝালে, ঝোলে, অম্বলে দিব্যি মিলেমিশে পাত্রাধারে তৈল সদৃশ থাকতে পারেন। অনেকে তাদের মন্দিরের বাইরে টোকেন নিয়ে র্যাকে না রেখে দ্বারের পাশে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা চটির মতো ভাবেন। তাতেও তাদের কিছু এসে যায় না কারণ এ জাতীয় মানুষের আমিত্ববোধ সচরাচর তীব্র হয় না।
বেদোবেগু গোত্রের মানুষ ঝাঁঝালো চরিত্রের। তাদের লোকে অপছন্দ করে, এড়িয়ে চলে আবার কখনো তাদের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যর জন্য মনে মনে সমীহ করে, তাদের প্রেক্ষিতে নিজে হীনমন্যতায় ভোগে।
বিদোশুগু (বিনা দোষ শুধু গুণ) গোত্রের মানুষ আপামর পরিসরে বাস্তবে দেখতে পাওয়া মুশকিল। সোনার পাথরবাটি সদৃশ। একটু খাদ ছাড়া বিশুদ্ধ সোনায় গয়নাও হয়না। মহামানব, পরমহংস গোছের যুগাবতরগণ অবশ্য আমেরিকান ট্রেজারির ফোর্ট নকস্ ভল্টে রাখা ৯৯.৯% বিশুদ্ধ সোনার বাট - তাদের বহিরঙ্গে অলংকার সদৃশ ঠাটবাট নিষ্প্রয়োজন।
তবে কিছু বেদোকগু গোত্রের মানুষের মধ্যে - পরিমাণে কম হলেও - এমন কিছু বিশেষ গুণ থাকতে পারে যা বৈশিষ্ট্যে অনন্য। তাই অনেক দোষ উপেক্ষা করেও তেমন কিছু গুণের জন্য তাদের অনেকে ত্যাগ করতে পারে না। অনেকে আবার Highly Enigmatic Character - মানে চূড়ান্ত প্রহেলিকাময় ব্যক্তিত্ব। তেনাদের দোষ বা গুণ কিছুই ঠিকমতো বোঝা যায় না। তবু অজ্ঞেয় কারণে আকর্ষণীয় লাগতে পারে। বছর কুড়ি বয়সে Lonely Planet - India Travel Guide এর ভূমিকায় একটা লাইন পড়ে মাথায় গেঁথে আছে - You may love India or hate India but can't ignore India - সেরকমই আরকি।
অনৈতিক আচরণের জন্য খেলার দুনিয়া থেকে খেলোয়াড়দের খ্যাতির শীর্ষে থেকে চিরতরে বাতিল করে দেওয়ার উদাহরণ অনেক আছে। যেমন নিষিদ্ধ স্টেরয়েড নেওয়ার জন্য আমেরিকান সাইক্লিস্ট ল্যান্স আর্মস্ট্রং বা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য আজহারউদ্দিন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিমত - সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আচরণে তাদের ক্ষণিকের কিছু বিচ্যুতির জন্য (তা অভিঘাতের প্রেক্ষিতে তীব্র হলেও) তাকে চিরতরে পরিত্যাগ করা হয়তো ঠিক নয়। সামাজিক প্রেক্ষিতে জনমানুষের (Public figure) ক্ষেত্রেও আমার তাই মনে হয়।
আত্মবিশ্লেষণ করে, আত্মঅনুশোচনার আগুনে পুড়ে চিত্তশুদ্ধির সম্ভাবনা থাকলে, তাকে সে সুযোগ দেওয়া উচিত। তাই আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি - No person should ever be assessed or discarded by his/her momentary aberrations, no matter how bizarre or intense that may be. যদি সে অনুতপ্ত হয়, তাকে অন্ততঃ একবার সংশোধনের সুযোগ দেওয়া উচিত। বারংবার একইধরনের বা বিবিধ বিরক্তিকর বিচ্যুতি দেখলে শ্লেট থেকে ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে লেখা মুছে দেওয়ার মতো তাদের সংসর্গ ত্যাগ করা উচিত। এমন মানুষের সাহচর্য মনের ওপর বোঝা স্বরূপ। আবার নির্ভয়া কান্ডের মতো অতি ঘৃণ্য, নৃশংস বিচ্যূতিতে ক্ষমাই পরম ধর্ম থিয়োরী পালনেও আমি অক্ষম। সেখানে শাস্তি হওয়া উচিত দৃষ্টান্তমূলক।
তবে পারস্পরিক সম্পর্কে বহুদিন ধরে যদি কারুর মধ্যে কিছু কাঙ্ক্ষিত উপাদানের অভাব ও অবাঞ্ছিত উপাদানের আধিক্য পরিলক্ষিত হয় তাহলে ঝগড়াঝাঁটি না হয়েও প্রাকৃতিক নিয়মে সেই সম্পর্ক ক্রমশ শীতল হয়ে অবশেষে কোমায় চলে যেতে পারে। যেমন কারুর স্বভাবে যদি দেখা যায় সুক্ষতা, সৌজন্যবোধ, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতার অভাব এবং ইর্ষা, সংকীর্ণতা, স্পর্শকাতরতার আধিক্য। যদি কারুর নজর হয় শকুনের মতো - গোলাপ বাগিচা বা পদ্মপুকুর ছেড়ে তাদের দৃষ্টি যদি খুঁত ধরার জন্য প্রায়শই নিবদ্ধ থাকে ভাগাড়ে। তজ্জনিত কারণে তাদের মন্তব্য মনে জ্বালা ধরায়। এসব ক্ষেত্রে এমন সংসর্গ পরিত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়। চালে কয়েকটি কাঁকড় থাকলে বেছে খাওয়া যায় - উল্টোটা বৃথা শ্রম।
কখনো আবার বহুদিনের সম্পর্ক একটিমাত্র গুরুতর বিচ্যূতি লক্ষ্য করেও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন তার সযত্নে লালিত পরিশীলিত ঘামতেলের চকলা উঠে হঠাৎ আবিস্কৃত হয় এমন কিছু কদর্য রূপ যার পর তার সাথে আর সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয় না বরং বিষ্ময় জাগে এই যদি এর প্রকৃত স্বরূপ হয় তাহলে এতোদিন এ সম্পর্ক টিকে ছিল কী করে! হয় সে অতি উঁচু দরের অভিনেতা নয়তো আমিই চূড়ান্ত নির্বোধ।
আমি চেষ্টা করি ক্ষণিকের বিচ্যূতির জন্য কারুর সাথে চিরতরে সম্পর্ক ছিন্ন না করতে। তাকে আরো পর্যবেক্ষণ করি। নিজেকেও ঝেড়েঝুড়ে, খুঁড়ে দেখি - আমার বোঝায় কোনো ভুল হচ্ছে না তো? আমার আচরণে কোনো ত্রুটি ছিল না তো? নিজেকে ঠিকমতো প্রকাশ করতে না পেরে বা অন্যকে ঠিকমতো বুঝতে না পেরে একতরফা ভুল বোঝাবুঝিতে অনেক প্রিয় সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। উপন্যাসে, সিনেমায় এটা একটা প্রচলিত থিম। কিছু ক্ষেত্রে আবার পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ছাড়াই এমন কিছু Gut feeling বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র ইশারা অনুভূত হয় যা যুক্তি, বুদ্ধির সীমানার বাইরে থেকে সঠিক সিগন্যাল দিতে পারে।
এমন দুটি ইশারায় সায় দিয়ে আমার দাম্পত্য জীবন মরুভূমি হয়ে যায়নি। একজনের সাথে প্রাকযৌবনকাল থেকে আট বছর মিশেছি অন্তরঙ্গভাবে। একদা কদিন তাকে না দেখলে মন উতলা হোতো। তবু তাকে তিনটি শব্দের বহুল ব্যবহৃত একটি বাক্য কোনোদিন মুখে বলতে পারিনি। কখনো একসাথে দীর্ঘ পথচলার আহ্বানও জানাতে পারিনি। শুধু মনে হয়েছে "এই পথ যদি না শেষ হয়"। কিন্তু ওসব সিনেমায় হয়। বাস্তবে উদ্দেশ্যহীন দীর্ঘ পথচলা সম্ভব নয়। কাউকে বা দুজনকেই একটা বা আলাদা গন্তব্য বেছে নিতেই হয়। সেটাও সিনেম্যাটিক আঙ্গিকে হেমন্তদা গেয়ে গেছেন - "আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে"। তার জন্য কোনো আক্ষেপ নেই। একদা আট বছরের মধুর সাহচর্যের আনন্দ স্মৃতিতে রয়ে গেছে নেভা ধূপের সুবাস হয়ে। জীবনে সব ভালো লাগার মূলে পাওয়া নয়। কিছু ক্ষেত্রে পরিণতির চেয়ে অপূর্ণতা ভালো। অন্য একজনকে আমার আঠাশ বছরের পরিণত দৃষ্টিতে প্রথম আলাপে দীঘায় ছুটির মেজাজে তিনদিনের সান্নিধ্যে পছন্দ করে কেটে গেল তেত্রিশ বছরের মাধূর্যময় সহযাত্রা।
পরিচিত, বন্ধু, আত্মীয়র ক্ষেত্রে সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য, গভীরতা, নির্ভরতার ওপর নির্ভর করে ছিন্ন হয়ে গেলে তার অভিঘাত কেমন বা কতটা হতে পারে। যত কম হবে অভিঘাতের প্রাবল্য - ততো বেশী হতে পারে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। অবশ্য পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন এমন অতিনিকট সম্পর্কের ক্ষেত্রে উপরোক্ত উপাদানগুলি ছাড়াও কাজ করে সংস্কার, অভ্যাস, দায়। এসব ক্ষেত্রে সেই সম্পর্কে কোনো মাধূর্য অবশিষ্ট না থাকলেও, রিক্ততা, তিক্ততা উপেক্ষা করে নিছক কর্তব্যবোধে, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে, ত্যাগ করার অপারগতায়, অপরাধবোধের তাড়নায় বা মনোবলের অভাবে তা বয়ে বেড়াতে হয়।
১৯৯৮ সালে একদিন আয়নায় দেখি গালে একটি সরষে দানার মতো আঁচিল গজিয়েছে। যেমন সম্পর্কে হঠাৎ আবিস্কৃত হয় কিছু ছোটোখাটো বিচ্যূতি। প্রথমে বিশেষ আমল দিইনি। হয়তো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে বা বেশী বাড়বে না। কিন্তু তা হোলো না। সেটা ক্রমশ বড় হয়ে গোটা মুগের দানার আকার নিলো। তাও মেনে নিয়েছিলাম। আমি শ্রীদেবী বা মাধূরী নই যে সৌন্দর্যহানির জন্য একটা আঁচিল নিয়ে অযথা মাথা ঘামাবো। কিন্তু সমস্যা হোলো অন্য জায়গায়। খুব সাবধানে আঁচিল বাঁচিয়ে দাড়ি কামাতে গিয়েও মাঝে মাঝে ব্লেডের ছোঁয়ায় রক্তপাত হোতো। তারপর গালে আফটার শেভ লোশন থেবড়ে সহ্য করো তার জ্বলুনি। এভাবে নিত্য রক্তপাতে আছে সংক্রমণের আশাংকা।
তাই একদিন গেলাম এক পরিচিত আস্থাভাজন হোমিওপ্যাথের কাছে। তিনি আবার Slow but Steady মেথডে বিশ্বাসী। কিন্তু মাস দেড়েক ওষুধ খেয়েও কিছুই হোলো না। তৃতীয় ভিজিটে বললামও সে কথা। অসীম আত্মবিশ্বাসী ডঃ পরাগ কোঠারী বললেন, চিন্তা করবেন না, ওষুধ খেয়ে যান। আশ্চর্যের কথা - দেড়মাস অবিচল থেকে আঁচিলটা একসময় খসে পড়লো মাত্র পাঁচদিনের মধ্যে! সেই পাঁচদিনে তার বিবর্তন চোখে পড়ার মতো। সেই অবাঞ্ছিত আঁচিল ঐ জায়গায় আর কখনো গজায় নি। সে কেন এসেছিলো জানি না। কীভাবে চলে গেল মনে আছে। তার জন্য কোনো অভাববোধ নেই। অবাঞ্ছিত অস্তিত্বর জন্য থাকার কথাও নয়।
বছর পনেরো আগে একদিন নিতম্বে হাত বুলিয়ে টের পেলাম গমের দানার মতো একটি আঁচিল। কবে গজিয়েছে টের পাই নি। আয়নায় নিজের নিতম্ব দেখা যায় না। কেউ দেখে বলেও মনে হয় না। তবে গালের মতো নিতম্বে রোজ রেজর চালানোর প্রয়োজন হয় না। তাই সেবার আর কোনো ডাক্তারের কাছে যাইনি। এতদিনে সেটা ছোট্ট কিসমিসের আকার নিয়েছে। মনে হয় আর বাড়বে না। কখনো আপন মনে পোনুতে (আমাদের পুত্রের শৈশবের লিঙ্গোতে নিতম্বের স্বকৃত প্রতিশব্দ) হাত বুলোতে গিয়ে বুঝি সে আছে। তবে কোনো ব্যাথা, চুলকানি, অস্বস্তি নেই। কদোকগু গোত্রের নিরামিষ মানুষের মতোই সে পড়ে আছে পোনুর এক কোনে।
কিছু একদা পরিচিতজন, অতীতের বন্ধু, আত্মীয়র সাথে সম্পর্কও সময়ের সাথে ক্রমশ পোনুর আঁচিলের মতো হয়ে যায়। কখনো অজান্তে হাত না পড়লে টের পাওয়া যায় না তাদের অস্তিত্ব। তাদের স্মৃতি প্রিয় হলেও বর্তমান সাহচর্য আনন্দময় লাগে না। তাই তাদের সাথে আর যোগাযোগ না থাকলেও কিছু এসে যায় না। পোনুকে একটা স্মার্টফোন আর আঁচিলটা তার কন্ট্যাক্ট লিস্টে পড়ে থাকা, বহুদিন কথা না বলা, কেবল নববর্ষে বা বিজয়ায় তাদের কাছ থেকে ফরোয়ার্ডেড শুভেচ্ছা বার্তা পাওয়া একটি নম্বর ভাবলে “পোনুর আঁচিল” উপমাটির স্বরূপ অনুধাবন করা যায়। যেমন পুরোনো বাড়ির কোনে নোনাধরা দেওয়ালে ঝোলে ভুলে যাওয়া, না বদলানো পুরোনো ক্যালেন্ডার।
ষাটোর্ধ্ব জীবনে এযাবৎ আমি হয়তো গোটা ছয়েক দীর্ঘদিনের পরিচিতজনের সাথে সজ্ঞানে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। বাকি অনেকে পড়ে আছে পোনুর আঁচিল হয়ে মনের কোনে, মুঠোফোনের ঠিকানা বইতে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।