এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • ট্রেনযাত্রার পাঁচালি - চিত্রকূট থেকে উদুপী - ৪

    সমরেশ মুখার্জী লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ৩৭৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • চিকন হাস‍্যে ভঙ্গ হয় নিদ্রা
     
    রাতে ক্লান্তিতে আবার কখন গভীর ঘুমিয়ে পড়েছি কেজানে। সকালে পাতলা হয়ে আসা ঘুমের আবেশে মধুর চামর বোলায় রিনরিনে মৃদুহাস‍্য। চোখ বুঁজে ছেঁড়া স্বপ্ন জোড়া লাগিয়ে কান জুড়ানো হাস‍্য‍সুধা আর একটু পান করতে চাই। কিন্তু স্বপ্ন তো নয়? এতো আসছে নীচ থেকে! আর শুয়ে থাকা গেল না। মুখ নীচু করে দেখি, হাসির উৎস সেই বিদেশীনি মা ও মেয়ে। সাইড বার্থে বসে আন্দাজ বছর কুড়ির এক দেশীয় তরুণের সাথে তিন মুন্ডু এক করে মোবাইলে কিছু দেখছে আর মাঝে মাঝে সরু গলায় হেসে উঠছে। সেটাই আমার মধুর লয়ে নিদ্রাভঙ্গের কারণ।
     
    প্রথম দর্শনে, টাইটানিকে লিয়োনার্ডো ডিক‍্যাপ্রিওর মতো ছাঁটের চুল কাটা ছেলেটিকে একটু বকাটে গোছের লেগেছিল। বডি হাগিং জিনস ও টপ পড়া মা ও মেয়ের ক্ষীণকটি, মেদহীন, সুঠাম চেহারা চোখে পড়ার মতো আকর্ষণীয়। কোনো ভারতীয় মহিলা হয়তো ওইরকম সাধারণ দর্শন অচেনা ছেলেটিকে পাত্তাই দিতো না। মাকে তো আবার হাসতে হাসতে মাঝে মাঝে উল্লসিত হয়ে ছেলেটির বাড়ানো তালুতে চাঁটি‌ও মারতে দেখলাম। এমন মনোরম দুই সহযাত্রীনির সাহচর্য‌্যে ছেলেটিও খুব খুশী। মুখে তার কাসুন্দি হাসি। 
     
    কোন এক স্টেশন আসতে ছেলেটির সাথে মা ও মেয়ে হৈ হৈ করে প্ল‍্যাটফর্মে নেমে পড়লো। ছেলেটি তার মোবাইল পকেটে নিয়ে নেমেছে কিন্তু মা তার স্লীপিং ব‍্যাগের ওপর দামি মোবাইল, ইয়ারফোন রেখেই নেমে পড়েছে। আমি ভারতীয়। এতো সরলতা দেখতে অভ‍্যস্থ ন‌ই। জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে চোখের নিমেষে ওগুলো হাওয়া হয়ে যেতে পারে। দারুণ অস্বস্তি হচ্ছে। কেউ বলেনি আমায় তবু নীচে নেমে ওদের সীটের পাশে বসলাম। একটু পরে ওরা দুজনে খবরের কাগজে করে বড়া পাও ও কাগজের কাপে চা নিয়ে ফিরে এলো। কোনো সুন্দরী ভারতীয় মহিলা হলে হয়তো নিজে সীটে গ‍্যাঁট হয়ে বসে মিষ্টি হাসিতে বশীভূত করে ছেলেটিকেই ফরমাস করে চা নাস্তা আনাতো। ছেলেটি বোধহয় সিগারেট ফুঁকতে গেছে। পরে আসবে। 
     
    আলাপ করলাম। ঠিক ভেবেছি। মা ও মেয়ে। ফরাসী। উসেল থেকে এসেছে। ট্রেনেই পরে নেট ঘেঁটে জেনেছি উসেল মধ‍্য ফ্রান্সের এক ছোট্ট পাহাড়ী গ্ৰাম। সাকুল‍্যে হাজার দশেক লোকের বাস। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় জায়গা। ওরকম গ্ৰাম‍্য পরিবেশে থাকার ফলেই বোধহয় কোনো ঠাট্‌বাট্ নেই। সরল ভাবে অচেনা এক যুবকের সাথে ট্রেনে মিশে যেতে পারে। চুরি ছ‍্যাঁচরামিতেও বিশেষ অভ‍্যস্থ নয় বলে বোধহয় মোবাইল নিয়ে নামার কথাও মনে ছিল না। স্বামী সেনা বাহিনীতে। মাস খানেকের ছুটি নিয়ে মা-মেয়ে ভারত ভ্রমনে এসেছে। 
     
    ওরা মোটামুটি ইংরেজি বলতে পারে। পড়তেও পারে। জিজ্ঞাসা করি, তোমরা কি দেখে এত হাসছিলে? বলে, আমির খানের পিকে সিনেমা। শুধোই, কাহিনী বুঝতে পারছিলে? মেয়েটি জানায়, ছেলেটি WiKi তে সিনেমার প্লটটা দেখাতে ওরা পড়ে নিয়ে‌ছে আগে। বাকিটা ছবি দেখে আন্দাজ করেছে। ভেবে ভালো লাগলো যে ভাষা না বুঝেও সিনেমার আবেদন তাহলে বিশ্বজনীন। কিন্তু আমি তো আমার দেশকে জানি। মোবাইল চুরি হয়ে গেলে বিদেশে অযথা হয়রানি হতে হবে। তাই খারাপ লাগলেও মৃদু ভাবে জানাই, এর পরে প্ল‍্যাটফর্মে নামলে, মোবাইল ওরকম জানলার ধারে সীটের ওপর রেখে যেওনা, চুরি হয়ে যেতে পারে। অবাক, লাজুক, কৃতজ্ঞতা মেশানো মিশ্র অনুভূতির একটা বিচিত্র হাসির সাথে আমায় প্রভূত ধন‍্যবাদ জানালো মা ও মেয়ে।
     
    কোঙ্কন মায়ায় আবার ভুলে যায় তারা
     
    বিকেলে পশ্চিম উপকূল ধরে কোঙ্কন রেলের অনবদ‍্য নৈসর্গিক শোভার মধ‍্যে দিয়ে যখন ট্রেন যাচ্ছে ওদের খুশি আর ধরে না। একবার এই দরজায় একবার ওই দরজায় মা, মেয়ে ছুটোছুটি করে গিয়ে দেখছে বাইরের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ‍্য। হয়তো নিজেদের দেশের প্রকৃতির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওদের। অরণ্য, পাহাড়, নদী, উন্মুক্ত আকাশ এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক দেশেই প্রায় এক‌ই রকম। ট্রেন‌ তিন ঘন্টার মতো লেট চলছে। 
     
    রত্নগিরি পেরিয়ে এক জায়গায় ট্রেনটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। সিঙ্গল লাইন। বোধহয় সিগন‍্যাল পায় নি। জানুয়ারী শেষের বিকেল। চারপাশে নিবিড় সবুজ অরণ‍্য, দুরে দিগন্ত বিস্তারি ঢেউ খেলানো সুউচ্চ পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সারি, অনেকটা নীচে বড় এক শান্ত নদী। নীলচে জল। পাশ থেকে আর একটি নদী এসে মিলেছে। অপূর্ব দৃশ‍্য। যেন পিকচার পোষ্টকার্ড। মনে হয় থাকুক দাঁড়িয়ে ট্রেন এখানে খানিকক্ষণ। দুচোখ ভরে দেখি। শায়িকা শ্রেণীর এই সুবিধা। ময়লা, কালো কাঁচ আঁটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় বসে এ মাধুর্য‌ উপভোগ করা যেতো না।
     

     
    কিছু যাত্রী আছে যাদের ট্রেন দাঁড়ালেই নামার জন‍্য পা সুড়সুড় করে। সেরকম কিছু লোক নীচে নেমে পড়লো। তাই দেখে ঐ ফরাসী মা মেয়েও টপাটপ নীচে নেমে এদিক সেদিক ফুরফুর করে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো‌। প্ল‍্যাটফর্ম নেইতো তাতে কি। দুজনের‌ই ফিনফিনে শরীর। মায়ের চলাফেরা‍তে এখনও যেন তারুণ্যের চাঞ্চল্য রয়ে গেছে। পিছন থেকে শুধু চেহারা দেখে দুর হতে মা মেয়েকে তফাৎ করা‌ মুশকিল। এবারেও দেখি দুজনের‌ই মোবাইল‌ পড়ে আছে সীটে। এতদিনের পুরোনো স্বভাব কি এতো সহজে যায়। যেমন আমরা হয়তো প‍্যারিসে গেলেও ট্রেনে সীটের তলায় স‍্যুটকেশ রেখে চেন তালা লাগাবো। 
     
    আমি আবার আড়চোখে তাকিয়ে থাকি ওদের মোবাইলের দিকে, যাতে কেউ মেরে না দেয়। এতো আচ্ছা গেরো! মা মেয়ে সীটে মোবাইল রেখে ধৈ ধৈ করে যেখানে সেখানে নেমে পড়বে আর আমায় বসে তা পাহারা দিতে হবে? অবশ‍্য আমায় কেউ চৌকিদার হিসেবে নিযুক্ত করেনি ওদের মোবাইল পাহারা দিতে। কিন্তু কি করি। আমাদের দেশের সৌন্দর্য দেখে ওদের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস অনুভব করে আমার‌ও যে বেশ ভালো লাগছে। যদি মোবাইল চুরি হয়ে ওদের আনন্দ মাটি হয়ে যায়, তাহলে তো আমার‌ও খারাপ লাগবে। তাই এটুকু নৈতিক দায়িত্ব আমি স্বেচ্ছায় মেনে নি‌ই।
     
    এবার উঠলো অন্য ছয়
     
    মাঢ়গাঁওতে ট্রেন পৌছল সন্ধ‍্যে সাতটার বদলে রাত সাড়ে নটায়। ভোপালের সেই আটজনের দল নেমে গেল। বদলে ছ’জনের অন‍্য একটা দল হৈ হৈ করতে করতে উঠে পড়লো ওদের‌ই জায়গায়। তিনটি ছেলে, তিনটি মেয়ে। সবার বয়স প্রায় এক‌ই রকম, কুড়ি একুশের কোঠায়। ওই বয়েসের ছয়টি ছেলেমেয়ে এক জায়গায় হলে নানান ধ্বনি ও শব্দসমাহারে বিচিত্র এক সম্মিলিত কলতান অনিবার্য। আমার স্টেশন উদুপী আসবে রাত প্রায় দুটোয়। বিচ্ছিরি সময়। না যায় ঘুমোনো, না থাকা যায় জেগে। তবু চিত্রককূট স্টেশনের মত মটকা মেরে শুয়ে এক খামচা আধোঘুমের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পাশের খোপের তারুণ‍্যচ্ছলতায় সে চেষ্টা মাঠে মারা গেল। 
     
    উঠে পড়লাম। রাত প্রায় একটা। ওদের পাশে গিয়ে বসলাম। মেন বার্থে দুপাশে চারটি ছেলেমেয়ে কাটোয়া লোকালের নিত‍্যযাত্রীদের মতো মাঝে চাদর ঝুলিয়ে তাস খেলছে। খেলার চেয়ে বেশী অবশ্য হচ্ছে চেঁচামেচি আর হ‍্যা হ‍্যা হি হি। তবে বয়সটাই যে ওরকম। এ বয়েসে কারণে অকারণে সোডার বোতল খোলার মত হাসি উপছে পড়ে। 
     
    আমায় ওখানে বসতে দেখে উল্টো দিকে বসা একটি মেয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। জগদ্ধাত্রীর মতো নিটোল মুখ, দীঘল কালো চোখের চাউনীতে কোনো জড়তা নেই, কেবল নীরব কৌতূহল। চিত্রকূট স্টেশনে‌ সরল গ্ৰাম‍্য মহিলা শ্রীমতী “নেহি নেহি”র সৌন্দর্যৈ ছিল বৃষ্টি ভেজা ঘাসের মতো স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা‌। মিস জগদ্ধাত্রী‌র চর্চিত ডালিয়ার মতো সৌন্দর্য বনেদী আভিজাত্য‌ময়। কিছুটা পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার নায়িকা অরুন্ধতী দেবী‌র মতো। তবে অল্প বয়স বলে তেমন রাশভারী নয়। হাসিখুশী। 
     
    বলি, তোমাদের বোধহয় শোওয়ার কোনো প্ল্যান নেই, কিন্তু রাত তো অনেক হয়েছে। ট্রেনের বাকি যাত্রীরা সব আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছেন। তোমাদের ঘুম না পেলে, খেলতে চাইলে খেলো, কিন্তু আওয়াজ একটু কম করলে অন‍্যদের অসুবিধা হয় না। আমার কথা শুনে সবাই থমকে যায়। মুখে চাপা অপরাধবোধের ছায়া খেলা করে। 
     
    মিস জগদ্ধাত্রী নীচু স্বরে একটি ছেলেকে বলে, তেরে কো কবসে বোল রাহা থা, ইতনা হল্লা মত কর। ঐ ছেলেটির কথা, হাসিই ছিল সবচেয়ে উচ্চগ্রামে। মিস জগদ্ধাত্রী‍র ধমকে ছেলেটার মুখটা একটু চুপসে যায়। আমার খারাপ লাগে। মনে পড়ে আশির দশকের শুরুতে পুরুলিয়ায় রক ক্লাইম্বিং কোর্সে বা প্রাকটিসে যাওয়ার সময় রাতের হাওড়া আদ্রা-চক্রধরপুর প‍্যাসেঞ্জারের জেনারেল ডাব্বায় আমাদের দলের গভীর রাত অবধি হৈ হুল্লোরের কথা। দামাল যৌবনের উচ্ছলতায় পারিপার্শ্বিকের খেয়াল থাকে না। আমি ম‍্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করি। না, না তোমরা খেলো, নিজেদের মধ‍্যে গল্পগুজব‌ও করো, তাতে কি, তবে যারা ঘুমোচ্ছে তাদের কথা ভেবে একটু আস্তে কথাবার্তা বললেই চলবে। 
     
    মিস জগদ্ধাত্রী আন্তরিক দুঃখিত মুখ করে বলে, সরি, আঙ্কল, হামলোগোসে গলতি হো গ‍্যায়া। এবার আমার লজ্জা লাগে। কেন বলতে গেলাম! যদি কলকাতার ছেলে মেয়ে হতো, হয়তো বলে বসতো, দুর মশাই, স্লিপার ক্লাসে এমনিতেই কতো আওয়াজ, আমরা রাত জেগে খেলি, হাসি আপনি বলার কে? অসুবিধা হলে এসিতে যেতে পারতেন। কিন্তু ওদের মার্জিত আচরণ দেখে মনে হয় ওরা সবাই ভালো বাড়ীর ছেলেমেয়ে। তাই সহবৎবোধ আছে। 
     
    প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলি, তোমরা সবাই কি গোয়াতে কাছাকাছিই থাকো? জানা গেল ওরা সবাই গোয়া মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রী। তিনদিনের ছুটিতে সবাই মিলে কোচিন বেড়াতে যাচ্ছে। তাই আনন্দের আতিশয‍্যে হুল্লোড়‌টা একটু বেশী‌ই হয়ে গেছে। ওদের ছ জনের দলের বাকি দুটি মেয়ে ওপরের দুটি বার্থে শুয়ে পড়েছে।
     
    বিনদাস মাইনার
     
    আর শোওয়ার মানে হয় না। উদুপী‌তে মাত্র মিনিট চারেক স্টপ। ঘুমিয়ে পড়লে মুশকিল। দরজার পাশে একটা মাত্র লোয়ার বার্থ। ট্রেনের কর্মচারীদের শোয়া বসার জন‍্য। দিনের বেলা ভাঁজ করে তোলা থাকে। এখন সেটা ফেলা আছে কিন্তু কেউ নেই। খালি দেখে তাতে বসলাম। পাহাড়, জঙ্গল, নদী পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে ট্রেন ছুটে চলেছে। ঝাঁসীতে যা ঠান্ডা পেয়েছিলাম কোঙ্কন উপকূলে তার লেশ মাত্র নেই। ভাবছি দিব‍্যি হোলো আমার প্রথম দু সপ্তাহের একাকী ভ্রমণ। এবার বাড়ি ফিরে তাই নিয়ে‌ই চলবে বেশ কিছুদিন স্মৃতি রোমন্থন। 
     
    হাঁটু অবধি লম্বা বারমুডা পরা আন্দাজ মধ‍্য তিরিশের একটি বিদেশী পুরুষ এলো ভিতর থেকে। টয়লেটে যেতে গিয়ে ক্ষণিকের জন‍্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। বেসিন থেকে লিক করে মেঝেতে জল থ‌ই থ‌ই করছে। একটু দাঁড়িয়ে হয়তো বুঝতে চাইলো জলটা কলের না হিসির। তারপর ল‍্যাপ‌উইগ পাখির মতো লম্বা লম্বা ঠ‍্যাং ফেলে নির্বিকার মুখে জায়গাটা পেরিয়ে, বাথরুম ঘুরে এসে আমার পাশে বসলো। 
     
    ওর সীট ছিল ওই গোয়ার দলটির পাশে সাইড বার্থের নীচে। সেও শোয়নি। আমি যখন ওদের সাথে কথা বলছিলাম ও সীটে পা লম্বা করে ব্যাকরেস্টে হেলান দিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিল। আমাদের ভাষা না বুঝলেও হঠাৎ পাশের খোপ থেকে এক বয়স্ক যাত্রী এসে ওদের সাথে কী আলোচনা করছে তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। গভীর রাতের অন্ধকারে বাইরে অতো নিবিষ্ট হয়ে ও কী দেখছি‍ল কে জানে। হয়তো দেখছি‍ল না কিছু‍ই। নিজের ঘোরে ছিল।
     
    জিজ্ঞাসা করি, আলো জ্বলছে বলে ঘুম এলো না? সে বলে, না, তা নয়, রাতে ট্রেনে আমার এমনি‌তেই ঘুম আসে না। তা, তুমি কেন এত রাতে বসে আছো এখানে? বলি, আমি উদুপীতে নামবো, এখন শুলে ঘুমিয়ে পড়তে পারি। তাই বসে আছি। তারপর কিছু মামূলী কথাবার্তা হোলো। আলাপকালে জানলাম ও আমেরিকার নেভাদার বাসিন্দা। বিয়ে থা করেনি। বছর দেড়েক আগে বাংলাদেশের দিনাজপুর কয়লাখনিতে মাইন সেফটি সুপারভাইজার হিসাবে তিন বছরের চুক্তিতে এসেছে। অনেকদিনের ইচ্ছে ভারতভ্রমণের। তাই ছুটি পেলেই চলে আসে ভারতে। এই নিয়ে তিনবার হোলো। এবারে গোয়া ঘুরে যাচ্ছে কেরালা। 
     
    একথা সেকথার পর বলি, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো, একটু ব‍্যক্তিগত, যদি কিছু মনে না করো? ওর ভরসা পেয়ে বলি, তুমি বিদেশী, ডলারে মাইনে পাও, তাও স্লীপার ক্লাসে যাচ্ছো কেন? একটু চুপ করে থাকে ও। কিঞ্চিৎ ভাবিত দেখায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে, তুমি যা ভাবছো আমি সেরকম বিশাল কিছু রোজগার করিনা। আমি নেভাডার গরমে বড় হয়েছি। ভারত, বাংলাদেশের গরম আমায় কাবু করতে পারেনি। আর এখন তো জানুয়ারী, কোনো অসুবিধা‍ই হচ্ছে না। তাছাড়া আমার খুব বেড়ানোর শখ জানো। তাই আমি যথাসম্ভব কম খরচে বেড়াই। 
     
    বলি, মেঝেয় ঐ জল ছপছপ ব‍্যাপার দেখে কি তোমার ঘেন্না করছিল? থমকে দাঁড়িয়ে গেছিলে কিনা, তাই বলছি। ও বলে, আরে না, না। সেসব কিছু নয়। আমি ভিয়েতনাম, বালি, সুদানে কাজ করতে গিয়ে এর থেকে অনেক খারাপ পরিস্থিতি দেখেছি। আমি তো কয়লা খনির নীচে, অন্ধকার, স‍্যাঁতস‍্যাঁতে জায়গায় কাজ করে অভ‍্যস্থ। এসবে আমার কিছু যায় আসে না। তবে সেফটির কাজ করে করে এমন অভ‍্যেস হয়ে গেছে যে, বাথরুম স্লিপার পরে আছি তো, তাই সাবধানে পা টা কোথায় ফেলবো, যাতে পিছলে না যাই, তাই দেখছিলাম। সরল হেসে বলে সে। 
     
    আমি চুপ করে যাই। লোকটির চেহারায় যা জন্মগত জাঁক, কোট প‍্যান্ট, টাই পরে দাঁড়ালে কোনো কোম্পানির এম.ডি বলে‌ও মনে হতে পারে। তাও কি অবলীলায় সে একটা হাফ প‍্যান্ট পরে জল ছপছপে স্লীপার ক্লাসে নির্বিকার চিত্তে চলেছে। ওদের নিজের দেশে তো এরকম অব‍্যবস্থায় ওরা অভ‍্যস্থ নয়, তাও যস্মিন দেশে যদাচার প্রবাদের জলজ্যান্ত উদাহরণের মতো ওর ভাবভঙ্গি। মনে মনে আমি তার সহিষ্ণুতার তারিফ না করে পারলাম না। উদুপী আসতে ওর সাথে করমর্দন করে নেমে গেলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ও আমায় বিদায় জানালো।
     
    সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরির ধকলের পর পরশু রাতে চিত্রকূট স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা‍য় সারা রাত প্রায় জেগেই ছিলাম। গত রাতে‍ও গলু এ্যান্ড কোম্পানির দৌলতে ছেঁড়াখোঁড়া ঘুম হয়েছে। আজ‍ও গোয়া টিমের সৌজন্যে এবং গভীর রাতে নামতে হবে বলে ঠিকমতো রেস্ট হোলোনা। ২০১৭ সালের জানুয়ারি‍তে ১৬ দিনের সেই একাকী ভ্রমণের শেষপাতে শরীরে একটু অনিদ্রা‍জনিত ক্লান্তি জানান দিলেও কিছু আকর্ষণীয় মানুষের ক্ষণিক সাহচর্যে বেশ আনন্দ পেয়েছি। যার রেশ এখন‌ও রয়ে গেছে। এসবই একাকী ভ্রমণের মধুর প্রাপ্তি।
     
    (সমাপ্ত) 
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ৩৭৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:০৬540785
  • দারুণ লাগল, হীরেনবাবু ঠিক বলেছেন, পুরো চোখের সামনে দেখতে পেলাম সিনেমার মতো। আপনার সাথে সাথে আমারও দিব্যি ট্রেনে ঘুরে আসা হয়ে গেল।
  • বিপ্লব রহমান | ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:১৩540793
  • দারুণ ভ্রমণ,  রিপোর্টার্জ লেখনি উপভোগ্য yes
  • সমরেশ মুখার্জী | ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:০৭540801
  • নামকরণের মধ্যেই এই ফোরামের আত্মা লুকিয়ে আছে। অর্থাৎ (বুবুভা বাদে) অনিয়ন্ত্রিত ফোরাম বলে এখানে বহু উচ্চ‌মানের লেখার সাথে কিছু সাধারণ লেখাও আসতে পারে। কোনো বিশেষ প্রসঙ্গ, বিষয়, সমসাময়িক / সামাজিক / ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সমস্যা বা বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, আধ্যাত্মিক‍তা, চলচ্চিত্র, শিল্প, সাহিত্য, কোনো মহাজীবনের মূল্যায়ন… এমন কোনো কিছু নিয়েই আলোচনামূলক লেখা‍র জন্য যে বোধ, পড়াশোনা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রয়োজন - আমার তা নেই। এটা অযথা বিনয় নয়, নিজেকে যতটুকু বুঝেছি তার প্রেক্ষিতে অকপট আত্মমূল্যায়ন। আমার অধিকাংশ লেখা তাই নিছক কিছু ভাবনা বা অভিজ্ঞতার বিবরণ মাত্র। 
     
    তবু যে সব অচেনা পাঠক লেখাটি পড়েছেন এবং যোষিতা, কেকে, অমিতাভ, রমিত, বিপ্লব‍বাবু, হীরেনদার মত পাঠক -  যাঁরা পড়ে কিছু মন্তব্য‍ করেছেন এবং যাঁরা অলক্ষ্যে থেকে প্রতি‍ক্রিয়া জানিয়েছেন - সবাই‍কে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। এমন উৎসাহ প্রদান কিছু মনে দাগ রেখে যাওয়া ব্যক্তি অভিজ্ঞতা মুষ্টিমেয় সমষ্টির সাথে ভাগ করতে প্রেরণা দেয়। 
     
    ভালো থাকবেন সবাই। 
     
  • Animesh Chakraborty | ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:১৫540839
  • অনেক দিন পরে আপনার ভ্রমণ এর উপরে লেখা পোরে খুবই ভালো লাগলো। এইভাবেই আপনার প্রিয় পাঠকবৃন্দ কে আনন্দ বর্ধন করুন এই কামনা করি।
  • সমরেশ মুখার্জী | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:০৫541264
  • @অনিমেষবাবু - মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন