আমাদের কথার মাঝে বাইরে থেকে, ঘর থেকে একে একে উঠোনে এসে জুটলো আরো কয়েকজন :মোহনলাল যাদব - মুখে দীর্ঘ দণ্ড ভোগ করে জীবন সায়াহ্নে পৌঁছানো মানসিকভাবে এক শ্রান্ত মানুষের ছায়া। চার বছর আগে ৫৯ বছর বয়সে এসেছেন এখানে। কাগজ কলমে বয়স কম দেখানো ছিল দুই বছর। এখন ৬৫ বছরের প্রবীণ মোহনলালজী আমাদের আলাপকালে একটি কথাও বলেননি - শুধু নীরবে শুনে গেছেন।
রাজেশ প্রসাদ - আগে ছিলেন স্কুল শিক্ষক। সাজা পেতে সরকারি চাকরি হারিয়েছেন। এখনো খবরের কাগজ পড়েন। ইংরেজিও পড়তে পারেন। মুক্ত বন্দীশালার সবাই - মায় এখানকার সরকারি ইনচার্জ রঘুবীর মীনা - সেও তাকে ডাকে মাস্টারজী বলে। রাজেশ আমায় ভারতীয় বলে উনিজী ও বাঙ্গালী বলে মমব্যান প্রসঙ্গে আমার মতামত জানতে চান। কবে ছাড়া পাবেন তিনি জানেন না কিন্তু দেশের অবস্থা নিয়ে রাজেশ চিন্তিত।
অভয় খোলামেলা স্বভাবের। সে আমায় ডেকেছে। তাই তার সাথে বিশদে কথা হয়েছে। সে তার কৃতকর্মের কথা অকপটে জানিয়েছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও আর কাউকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি কে কোন পরিস্থিতিতে নরহত্যার মতো কাণ্ড করেছিল। কী দরকার। মনে হবে শহুরে মানুষের অন্যের জীবনে উঁকি দেওয়ার অন্যায় কৌতূহল। তাছাড়া বিষয়টি স্পর্শকাতরও বটে। এতোদিন পরে হয়তো তারা সেসব দিন, ঘটনা ভুলে থাকতে চায়। সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়ে তাদের অতীত ক্ষত নিয়ে নাড়াচাড়া করা শোভন মনে হয়নি।
একটু বাদে অভয়ের ছেলে নির্মলও এলো বাইরে থেকে। অভয়কে বলি, আপনার একটা ছবি নেবো আপনার ছেলের সাথে? অভয় ছেলেমানুষের মতো হেসে বলে, তাহলে দাড়িটা আগে কামিয়ে নিই। ওর ফোনেও তুলে দেবেন। বাড়িতে গিয়ে ওর মাকে দেখাবে। শেষবার বাড়ি গেছি গত দশেরাতে। আপনার তোলা আমাদের বাপ বেটার ছবি দেখে ভালো লাগবে ওর মায়ের।
হাতে আয়না ধরে দাড়ি কামালো অভয়। পিছনে উঠোনে ছড়িয়ে আছে নয়নার খেলনা, সাইকেল।
দাড়ি কামিয়ে ছেলের সাথে ভব্যিচুব্যি হয়ে পোজ দিয়েছে অভয়। ছবি দেখে হেসে বলে, এ হে, একটা জামা পরে নিলে ভালো হোতো। আমার এই পালোয়ানি চেহারাই উঠে গেল ছবিতে।
কথাবার্তার মাঝে এলেন রঘুবীর মীনা। বললাম, এসেছিলাম এখানে একটা প্রাচীন কেল্লা দেখতে - কিন্তু তার সাথে বোনাস হিসেবে পেলাম এই সুন্দর অভিজ্ঞতা। আমার একটু লেখালেখির শখ আছে। চলার পথে ইন্টারেস্টিং কিছু দেখলে তা নিয়ে লিখি। এই মুক্ত বন্দীশালা, এখানে কয়েকজনের সাথে কথা বলে বেশ লাগলো। এসব নিয়ে কিছু লিখলে পাবলিক ফোরামে দিতে পারি?
উনি বললেন, অবশ্যই লিখতে পারেন। ১৯৭২ সালে রাজস্থান সরকারের নেওয়া ওপেন প্রিজন পলিসি কীভাবে নরহত্যার অপরাধে দণ্ডিত অপরাধীকেও - অবশ্যই যদি তাদের স্বভাব ভালো হয় - আবার সমাজের মূল স্রোতে ফিরে যেতে সাহায্য করছে তার প্রচার হলে তো ভালোই। এটা তো খুবই ছোট। জয়পুরে যেটা আছে অনেক বড়। তবে এরা এখনো আইনত সাজা কাটছে। তাই এই জায়গার নাম, এদের আসল নাম লেখায় না দিলেই ভালো। এদের ফেসবুক এ্যাকাউন্ট নেই। তবু আপনি এসব নিয়ে লিখলে ফেসবুকে দেবেন না।
বলি, নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি এমনভাবে লিখবো যাতে এদের তো বটেই, এই শহরও কেউ চিনতে পারবে না। সব নাম বদলে দেবো। আসুন না, আপনাদের একটা ছবি নিই।
কোট পরিহিত এখানকার ইনচার্জ রঘুবীর মীনা
আচ্ছা, আপনি এদের সাথে গল্প করুন, আমি একটু ঘুরে আসি, বলে চলে গেলেন মীনাজী। আর তখনই দোতলা থেকে নেমে এলো লাল জামা পরা একটি যুবক। নাম তার করণ প্রজাপতি। বয়স বত্রিশ। আলাপ হতে অভয়ের মতোই সাবলীলভাবে কথা বলছিল, হাসছিল সে। তাই ওকে বলি, করণ তুমি কী কারণে এখানে? ওরও দফা তিনশো দো কেস। বারো বছর আগে ঘটনার দু বছর আগে বোনের বিয়ের জন্য মহাজনের থেকে ধার নিয়েছিল ওর বাবুজী। আস্তে আস্তে শোধও দিচ্ছিল। কিন্তু মহাজনের আর তর সয় না। তার চ্যালা বাড়িতে এসে প্রায়ই হম্বিতম্বি করতো। বাবুজী বলতো দেরী হলেও সুদ সমেত ধার কিস্তিতে শোধ তো করছি। হাত জোড় করে মহলৎ মাঙতো।
তখন করণের মাস তিনেক হোলো বিয়ে হয়েছে। বোনের বিয়েতে খরচ করে বাপুজীর এই হেনস্থা দেখে করণ বিয়েতে কোনো টাকাপয়সা নেয় নি। অবশ্য ওর বৌয়ের বাবাও ছিল ছোট চাষী। একদিন মহাজনের চ্যালার চোটপাটের সামনে বাবুজীর জোড়হাত করে করুণ মুখ দেখে মাথায় আগুন ধরে গেল করণের। একটা মোটা লাঠি ছিল পাশে দেওয়ালে হেলান দেওয়া। তুলে নিয়ে সপাটে চালিয়ে দিলো মাথায়। তখন বাপুর সাথে মাঠে কাজ করতো করণ। বিশ বছরের সুঠাম যুবকের লাঠির এক ঘায়ে চ্যালা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। মারবো বলে মারেনি করণ। কিন্তু বেমক্কা মরে গেল লোকটা।
- এখন কি আফশোষ হয়?
- হ্যাঁ, খুব আফশোষ হয়।
- কেন?
- আমি জেলে যেতে বৌ শ্বশুরাল ছেড়ে চলে গেছে। আবার বিয়ে হয়েছে তার। একটা ছেলেও হয়েছে বলে শুনেছি। তার দোষ নেই। তখন ওর অল্প বয়স। উমর কয়েদের মেয়াদ খাটা পতির জন্য সে কেন তার জীবন বরবাদ করবে। তবে আফশোষ কেবল আমার জওয়ানীর বারোটা বছর বরবাদ হয়ে গেল বলে নয়, আমার একটা ভুলের জন্য বাপুও বড় একা হয়ে গেল তারপর। গুস্সা ইনসান কো খুদকো খা যাতা হ্যায়। ইয়ে এ্যাহসাস বড়া মেহঙ্গা পড় গয়া বাবুজী। ছাড়া পেলে এ ভুল আর হবে না।
- কবে ছাড়া পাবে? বয়সে অনেক ছোট বলে তুমিই বলি ওকে।
- জানি না। জেলে আমার রেকর্ড ভালো ছিল বলে দশ বছর ওখানে কাটিয়ে দু বছর আগে এসেছি এখানে। রাজেশজী, অভয় চাচা আমার আগে থেকে এখানে আছেন। ওনারা হালে রিহাইয়ের দরখাস্ত করেছেন। আমায় বলেছেন আর বছর দুয়েক পরে করতে। কিছুদিনের মধ্যে মোহনলাল চাচার রিহাইয়ের আবেদন মঞ্জুর হয়ে যাবে শুনছি। বয়স হয়ে গেছে ওনার। বাকি জীবনটা তাহলে গাঁয়ে গিয়ে পরিবারের সাথে কাটাতে পারবেন।
- একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো করণ, যদি তুমি কিছু মনে না করো?
- বলুন না।
- ছাড়া পেয়ে, নিজের গাঁয়ে ফিরে গিয়ে তোমার কী আবার বিয়ে থা করে সংসার করতে ইচ্ছে হয়?
লাজুক হেসে মুখ নামিয়ে করণ বলে, আমি চুরি ডাকাতির মতো ছিঁচোড়াপন বা বলাৎকারের মতো ঘিনোনা জুর্ম করে জেলে আসেনি। গাঁয়ে আমায় সবাই ভালোবাসতো। এখনো তারা বসে আছে আমার ফিরে আসার পথ চেয়ে। আগের বিবি চলে গেছে বলে তার ওপর কোই গিলা সিকোয়া নেই। যদি কেউ আমায় মেনে নেয়, করবো তাহলে বিয়ে। মাজী, বাবুজীর তো বহুর সাথ, সেবাযত্ন পাওয়ার খোয়াব অধুরাই রয়ে গেল - সিরফ্ মেরা এক পল কা গলতি কে বজেসে।
বুঝলাম বেফাঁস প্রশ্ন করে ফেলেছি। একটু ভাবুক হয়ে গেছে করণ। কথা ঘোরানোর জন্য বলি, তুমি ওপর থেকে নেমে এলে দেখলাম। তুমি কোথায়, কীভাবে আছো দেখাবে?
- আসুন না। বলে করণ নিয়ে যায় ওর ঘরে।
৯x১০ ফুটের সাদামাটা ঘর। একটা জানলা। দেওয়ালে একটা তাকে তিনটে থাক। ঘরে দড়ি টাঙানো। তাতে ঝুলছে জামাকাপড়। সরকার থেকে ঘর, আলো, পাখা, নিঃশুল্ক বিজলী দিয়েছে। হীটার জ্বালানো বারণ। চৌপাই, কুলার, গ্যাস, ওভেন, রেশন এসবের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব মুক্ত বন্দীর নিজের। ও নিজে রান্না করে খায়। সবাই তাই। তাতে খরচ কম হয়। চাইলে তারা দিনের বেলা বাইরে কোথাও কাজও করতে পারে।
করণের একটা ছবি নিলাম ওর ঘরে। ও সটান মোবাইলের দিকে তাকিয়েছিল। জুম করে দেখি ওর দৃষ্টি ‘চোখ’ সিনেমায় ওম পুরীর মতো তীব্র। অভয়ের দৃষ্টি কিন্তু নরম, একটু ভাবুক টাইপের। সটান তাকালে যাদের চোখের মণি পুরো খুলে যায় তাদের এমন খরদৃষ্টি লাগতে পারে।
ভাবি ওর আর একটা ছবি নিই। বলি, করণ, তোমার আর একটা ছবি নেবো। তবে তোমার ঘরে নয়। চলো নীচে যাই। তুমি ঐ ছোট গেটে ভর দিয়ে দাঁড়াবে। আমার দিকে সরাসরি তাকাবে না। পাশ ফিরে দুরে তাকাবে আর ভাববে একটা ছোট্ট ভুলে কীভাবে তোমার জীবনটা বদলে গেল।
করণ হেসে বলে, বাবুজী, আপনি তো আমায় সিনেমায় এ্যাক্টিং করার মতো করতে বলছেন। আমি কী পারবো?
বলি, চেষ্টা করে দ্যাখোই না। বেশী চাপ নিয়ো না, এসব আমার নিছক খেয়াল।
ওদের নিস্তরঙ্গ জীবনে বহুদূর থেকে বেড়াতে আসা এক প্রবীণ বাঙ্গালী আঙ্কলের এহেন খেয়াল দেখে করণও বেশ মজা পায়। স্পোর্টিংলি বলে, চলুন তাহলে দেখি, আপনি যা বলছেন, পারি কিনা।
নির্দেশ মতো করণ গিয়ে দাঁড়ায় গেটে হাতের ভর দিয়ে। পোর্ট্রেট ছবির ক্ষেত্রে যার ছবি তোলা হচ্ছে তার সাবলীলতা, সহযোগীতাও খুব জরুরী। যেমন বলেছি, সেভাবেই করণ পাশ ফিরে দুরের দিকে তাকায়। এখন ওর সামান্য কোটরে বসা চোখের দৃষ্টি নরম লাগে। মুখের একপাশে শীতের সকালের মিঠে রোদ পড়েছে। অন্য পাশে ছায়া। এমন ছবি বেশ লাগে দেখতে। ছবিটা তুলে ওকে দেখাই। করণ অবাক হয়ে বলে, সত্যি, তো! আপনার ফটো তোলার হাত কিন্তু বেশক্ ভালো। মোবাইলেই কী সুন্দর উঠেছে।
বলি, তুমি নেবে ছবিটা? পাঠাবো তোমার ফোনে?
করণ লাজুক হেসে পকেট থেকে একটা সস্তার ডাব্বা ফোন বার করে বলে, আমার ছবি দেখার মতো ভালো ফোন নেই। দরকারও নেই। এতে মাঝে মাঝে বাবুজী, মাইজী, বহেন, জীজাজীর ফোন আসে, কথা হয় ওদের সাথে। তাই এটা রেখেছি। এতেই চলে যায়। ফোন করার মতো আর কেউ নেইও আমার।
ওদেরকে হাত নেড়ে বিদায় নিই। সুন্দর কাটলো একটি ঘন্টা এখানে। প্যালেসে গিয়ে এক কোনে বসে মোবাইলে আবার করণের ছবিটা খুলে দেখি। বেশ উঠেছে। মুখে ধার আছে ছেলেটার। এখন খেয়াল হোলো ওর ডানহাতের মজবুত কবজিতে বাঁধা আপেলের এলইডি ওয়াচ। তবে কোনা খাওয়া আপেল নয় - গোটা। অতএব সস্তার মেকী আপেল। স্মার্টফোনের মতোই আসল আপেল ঘড়ি কেনার ক্ষমতাও ওর নেই। প্রয়োজনও নেই ওর নিত্য দিন সময়ের হিসেব রাখা। ও গুনছে বছরের হিসেব। কবে ছাড়া পাবে। ঘড়িটা হয়তো পরেছে নিছক শখে - অলঙ্কারের মতো।
সমাপ্ত
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।