এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  ঘুমক্কড়

  • নরোয়র কেল্লা - ১

    সমরেশ মুখার্জী লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | ঘুমক্কড় | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৮২৯ বার পঠিত
  • ১. জিমির সাথে হিচহাইক

    ১৪.০১.২০ - মঙ্গলবার। আজ যাবো শিবপুরীর ভাদিয়াকুন্ড থেকে নরোয়র। গতকালের মতো রাধেশ্বরজীর ধুনি‌র সামনে বসে খিচুড়ি ও চা সহযোগে সারলাম প্রাতরাশ। রাধেশ্বর পুরী মহারাজকে নমস্কার করে বিদায় নেওয়ার আগে পাঁচশো টাকা দিই। বলেন, এসব কেন? বলি, দু রাত থাকলাম, সকালে, রাতে যত্ন করে খাওয়ালেন, তাই সামান্য দক্ষিণা। বাবা বলেন, ঐ ঘরটা তো যাত্রীদের জন‍্য ভক্তরা‌ই বানিয়েছেন। কি‌ই বা আর খেলেন। পয়সা কিসের? বলি, তবু, নিলে খুশি হবো। উনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিলেন। অনাসক্তি‌ বা আগ্ৰহ‌, কিছুই প্রকাশ পেলো না। হয়তো দানধ‍্যান  ভালো‌ই আসে।
     
       কারবালা চকে এসে দাঁড়া‌ই। গত পরশু করেরা থেকে শিবপুরী যাওয়ার বাস এখানেই নামিয়ে দিয়েছিল। রাস্তার পাশে একলা চায়ের দোকান। মালিক বলেন, কোথায় যাবেন? বলি, নরোয়র। ভাবছি বাসে পোহারি বাসস্ট‍্যান্ডে চলে গেলে ওখান থেকে বসে যেতে পারবো। দোকানি বলেন, শিবপুরী‌র সব বাস এখান দিয়ে যায় না। হয়তো আপনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হতে পারে। কিছু করার নেই। তাই বেঞ্চে পিঠের ভারী স‍্যাকটা রাখি। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি‌লেন বয়স্ক স্বাস্থ্য‌বান এক রাশভারী ব‍্যক্তি। চক থেকে মুক্তি ধামের (শ্মশান) রাস্তা‌টা নির্জন। আমি যখন হেঁটে আসছিলাম ঐ রাস্তা‌য় ওনাকে মারুতি ব্রেজা গাড়ি পার্ক করে নামতে দেখেছি। গাড়ি থেকে নেমেছিল একটি বছর দশেকের বালক ও কুকুর। বালকটি গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কালচে খয়েরি রঙের তাগড়া‌ই কুকুর‌টি ফাঁকা রাস্তায় ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
     
        হরি ওম রাঠোর সজ্জন মানুষ। নিজে থেকেই বলেন, আমি ওদিকে‌ই যাবো। আপনাকে বাইপাসে মাধব চকে নামিয়ে দেবো। বাসস্ট্যান্ড থেকে আসা নরোয়রের বাস ঐ চক থেকেই বাঁদিকে যায়। ডিকি খোলা আছে আপনি বড় স‍্যাকটা পিছনে রেখে দিন। আমি চা খেয়ে আসছি। বলি, আপনার কুকুর কিছু বলবে না তো? উনি বলেন, না, না, ছোটু আছে তো। আমাদের কেউ গাড়ির পাশে না থাকলে আপনি একা গিয়ে ডিকি খুলতে গেলে জিমি চেঁচাবে। তার পরেও ডিকি খুলতে গেলে কামড়ে‌ও দিতে পারে। ছোটু ডিকি খোল দে বেটা, বাবুজী সামান রাখেঙ্গে। বুঝলাম ছোটু ওনার হেল্পিং হ‍্যান্ড। ছোটু না থাকলে উনি বললে‌ও আমি একা কখনোই যেতাম না গাড়িতে মাল রাখতে। 
     
        ছোটু ডিকি খোলে। জিমি এসে পাশে দাঁড়ায়। আমি স‍্যাক‌টা রাখি। জিমি বিজ্ঞের মতো নীরবে সব পর্যবেক্ষণ করে। রাঠোরজী এসে বলেন, ছোটু তু পিছে বৈঠ যা। আমায় বললেন, আপনি সামনে আসুন। ছোটু উঠে ডানদিকের দরজা খুলে দিল। জিমি অভ‍্যস্থ ভঙ্গিতে উঠে বসলো। মালিকের পাশে বসেছি তবু সারমেয় প্রবৃত্তি‌তে সে আমার ডানকাঁধ ঘেঁষে কিঞ্চিৎ নিরীক্ষণ করলো। কানের পিছনে ক্ষণিকের জন‍্য ওর ভিজে নাক ও গরম নিশ্বাস টের পেলাম। চুপ করে সিঁটিয়ে বসে থাকি। নিঃশব্দে টুকুন শোঁকাশুঁকি করে পিছনের সীটে গুছিয়ে বসলেন বাবু।
     
     আমি হাঁফ ছেড়ে বলি, জিমি তো রটভয়েলার, গার্ড ডগ, শুনেছি এরা খুব রাগী হয়, তাই কি? কুকুরের মালিক সচরাচর অন‍্য কেউ তাদের কুকুরের প্রজাতি চিনতে পারলে খুশি হন। চিহুয়াহুয়া গোছের  অপ্রচলিত প্রজাতি চিনতে পারলে বা গোল্ডেন রিট্রিভার ও ল‍্যাব্রাডর রিট্রিভারের মধ‍্যে গুলি‌য়ে না ফেললে সেই ব‍্যক্তির সারমেয়জ্ঞান দেখে খুশি হন। তবে তাদের পেয়ারের পোষ‍্যকে বুনো স্বভাবের ভাবলে তার গুণপনার ফিরিস্তি দিতে বসেন। এক্ষেত্রে‌ও তার ব‍্যতিক্রম হলো না। হরিজী বললেন না, না, জিমি খুব ভদ্র। অকারণে চেঁচায় না। কাউকে তেড়ে‌ও যায় না। তবে রটভয়েলার খুব বিশ্বস্ত গার্ড ডগ, মনিব বিপদে পড়লে জান দিয়ে রক্ষা করবে। মনে হোলো, তেমন প্রয়োজনে কারুর জান নেওয়া‌ও ওর কাছে জলভাত। একবার পিছন ফিরে দেখি। বলিষ্ঠ শরীর। মজবুত চোয়ালে ধারালো দাঁতের সারি। জিমি আমার দিকে শান্ত ভাবে তাকিয়ে। তবু ওর কালো চোখের ঠান্ডা দৃষ্টি বেশ ভীতিকর। 
     
       জিমি আদুরে ল‍্যাপ ডগ নয়। ওর রোজ একটু শারীরিক কসরতের প্রয়োজন হয়। তাই রাঠোরজী সকালে ওকে নিয়ে খোলামেলা কারবালা চকে আসেন। ছোটু বল ছোঁড়ে। জিমি দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসে। সাথে ওনার‌ও প্রাতঃভ্রমণ হয়। উনি ব‍্যবসায়ী। কয়েকটি কোল্ড স্টোরেজ আছে। বড়ছেলে হাল ধরেছে ব‍্যবসার। এককালে ব‍্যবসা দাঁড় করাতে অনেক পরিশ্রম করেছেন। এখন ওনার একটু এলায়িত ছন্দে চলছে জীবন।
     
      কারবালা চক থেকে বাইপাস ৩.৫কিমি। চক থেকে খানিকটা গিয়ে বাঁদিকে একটা রাস্তা দেখিয়ে বললেন, এদিকে  একটু গেলেই আমার বাড়ি। তবে পরদেশী পথিককে সুবিধা‌মতো জায়গায় পৌঁছে দিতে উনি আরো দু কিমি গেলেন। একাকী ভ্রমণে অনেকবার হরিজী‌র মতো বড়লোক বা সাধারণ মানুষের অপ্রত্যাশিত সাহায্য পেয়েছি। 
     
    ২. ব্রেজা থেকে বাসে
       মাধব চকে বেশ ভীড়। বাসগুলো আসছে‌ ভরতি হয়ে। বেশীরভাগ গোয়ালিয়রগামী। অল্পবয়সী‌র দল দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়ছে। দুটো স‍্যাক নিয়ে ওভাবে দৌড়ঝাঁপ করে উঠে ৪৪ কিমি দাঁড়িয়ে যাওয়া এখন পোষায় না। নিরুপায় হলে অন‍্য কথা। পোহারি‌গামী একটা খালি অটোয় উঠে বলি, ভাই নরোয়র যাবো, বাসস্ট‍্যান্ডে নিয়ে চলো তো। অটোওয়ালা স্থানীয় যুবক। বাসস্ট‍্যান্ডে‌ ঢোকার আগেই একটা আগত বাসকে হাত দেখিয়ে থামায়। কন্ডাক্টর নেমে আসে। ওর চেনা। জিজ্ঞাসা করে একটা সীট হবে? সে সায় দেয়। ছেলেটি দ্রুত আমার বড় স‍্যাকটা বাসের পিছনে ডিকিতে ঢুকিয়ে দেয়। তাকে ধন‍্যবাদ জানিয়ে বাসে উঠে দেখি গোটা চারেক সীট খালি। ফিরতি পথে আড়াই কিমি দুরে মাধব চকে পৌঁছনোর আগেই বাস ভরে যায়। বুঝি কুড়ি টাকা অটোওলাকে দেওয়া জলে যায় নি।
     
       মাধব চক থেকে ১৭কিমি দুরে সতনয়ারা অবধি নরোয়র ও গোয়ালিয়রে‌র রাস্তা এক‌ -  মুম্বাই-আগ্ৰা জাতীয় সড়ক। তারপর ডানদিকে রাজ‍্যসড়ক ধরে ২৭কিমি গেলে নরোয়র। ঐ রাস্তাই আরো উত্তরে হরশী ড‍্যাম পেরিয়ে চিতোলী থেকে বাঁদিকে বেঁকে আবার গিয়ে মোহনাতে মিলেছে এই শিবপুরী-গোয়ালিয়র রাজপথে। চিতোলী থেকে ডানদিকে বেঁকে অন‍্য রাস্তা‌টা ভিতরয়ার হয়ে ডাবরাতে গিয়ে মিলেছে গোয়ালিয়র ঝাঁসি রাজপথে। দুদিন পরে আমি নরোয়র থেকেই করেরা হয়ে চলে যাবো ঝাঁসি। আর আমায় শিবপুরী আসতে হবে না। অর্থাৎ একটা রাউন্ড ট্রিপ হয়ে হয়ে যাবে। মধ‍্যপ্রদেশে‌র অন্দরমহলে‌ এইসব অচেনা গ্ৰামগঞ্জের মধ‍্যে দিয়ে লোকাল বাসে গুড়গুড় করে যেতে বেশ লাগে। এসব জায়গায় তো এমনি‌তে আসা হবে না। চলার পথে যা দেখা যায়।
     
       অটল সাগর বা মাড়িখেড়া ড‍্যাম দেখতে হলে সতন‌য়ারা থেকে ১৩কিমি দুরে নামতে হবে। রাস্তা থেকে ড‍্যাম এক কিমি। শীতকালে জল ছাড়া‌র ব‍্যাপার‌ নেই। তাই একটা শুকনো ড‍্যাম দেখতে ভর দুপুরে দুটো স‍্যাক নিয়ে দু কিমি হাঁটাহাঁটি‌র কোনো মানে হয় না। টপকেশ্বর মন্দির ওখান থেকে নরোয়রের রাস্তায় আরো তিন কিমি। রাস্তা থেকে মন্দির মাত্র ছশো মিটার দুরে হলে কি হয় প্রায় তিনশো ফুট উঁচুতে পাহাড়ি গুহার মধ‍্যে।  এসব গতকাল‌ই ম‍্যাপ ঘেঁটে দেখে নিয়ে‌ছি। তাই ওখানেও নামবো না। আসলে মূল গন্তব্যে পৌঁছে রাত্রিবাসের ব‍্যবস্থা না করে এভাবে মাঝপথে দুটো স‍্যাক নিয়ে ঘোরাঘুরি করায় আমি নেই। 
     
    ৩. সাশ্রয়ী আশ্রয়ে‌র খোঁজে
      নরোয়রে ঢুকে বাস লোড়ীমাতা মন্দির চকে খানিক দাঁড়ায়। অনেকে ওখানেই নেমে গেল। নরোয়র বাসস্ট্যান্ড নগরীর উত্তর প্রান্তে, ভিতরয়ার বাইপাস ধরে আরো দেড় কিমি দুরে। কয়েকজন বসে র‌ইলো। কয়েকজন উঠলো‌ও। কারণ বাস যাবে আরো সাত কিমি দুরে মগরোনী অবধি। নেট ঘেঁটে  অখিল ভারতীয় কর্ণসমাজের রাজন সিংয়ের সাথে কথা হয়েছিল। সে এখন থাকে ডাবরা তবে তার আদিনিবাস মগরোনী‌। রাজন ঐ মন্দিরের সাথে যুক্ত। উৎসাহের সাথে আশ্বাস দিয়েছিলেন রামজানকী আখাড়া মন্দিরে আমার থাকার ব‍্যবস্থা হয়ে যাবে। তাহলে আমায় আধা কিমি দুরে বাইপাসে‌ মহাদেব চকে নামতে হয়। 
     
    রাজন জানিয়েছিলেন  আগামীকাল ওর মেয়ের বিয়ে হবে ঐ মন্দিরে। ওদের সমাজের অনেকে আসবে। বলেছিল, আপনি আমার 'বিটিয়াকে' আশীর্বাদ করবেন। সে না হয় করা যাবে কিন্তু ভীড়ের সম্ভাবনা‌তে আমার অস্বস্তি বাড়ে। তাই আমি বাসস্ট্যান্ডের পাশে নতুন জৈন মন্দিরে ভাগ‍্যপরীক্ষা করতে যাই। ভাগ‍্য খারাপ। গেটে তালাবদ্ধ। পূজারী বা ম‍্যানেজারের হদিশ পাওয়া গেল না। পা বাড়াই পরবর্তী সম্ভাব‍্য জায়গায়। সোয়া কিমি হেঁটে পৌঁছ‌ই সেই লোড়ীমাতা মন্দিরে, যেখানে বাস প্রথমে দাঁড়িয়ে‌ছিল। 
     
    মন্দির‌টির বেশ মান‍্যতা আছে। শিখর সমেত মন্দিরের বাঁদিকে উঁচু টিনের শেড। সেখানে যজ্ঞ, মুন্ডন, বিবাহ, অন্ন‌প্রাশন অনেক কিছু হয়। বাঁদিকের শেডের পাশে লম্বা দোতলা নির্মাণ। কয়েকটি ঘর। মন্দিরের পিছনে ভাঁড়ার ঘরের সামনে চেয়ার পেতে বসেছিলেন এক বয়স্ক বাবা।  
    বলি, আমি একক যাত্রী, মন্দিরে রাত কাটানোর জায়গা হতে পারে? বাবা বলেন পিছনের হলে দুরাগত যাত্রী‌রা রাত কাটায়। বিছানা পত্র কিছু পাবেন না, ওসব আপনার দায়িত্ব। চাইলে আপনি‌ও ওখানে থাকতে পারেন। কোনো পয়সা লাগে না। শৌচালয় পিছনে। রাতে মন্দিরের গেট বন্ধ হয়ে যায়।  বলি, ওটাতো একদম খোলা, আমি যে আশপাশে যাবো, বড় স‍্যাকটা কোথায় রাখবো? উনি বলেন, এখানে চুরি চামারির ভয় নেই। মালের দায়িত্ব যাত্রী‌র। তবে আপনি পরদেশী, একা মানুষ তাই চাইলে ওটা এই স্টোর রুমে রাখতে পারেন। আমি এখানে চব্বিশ ঘন্টা থাকি। 
     
    বলি, আচ্ছা, ঐ যে দোতলা টানা ঘর দেখছি, ওখানে জায়গা পেতে পারিনা? উনি বলেন, না, ওগুলো বড় হলঘর, বিয়ে বা অন‍্য অনুষ্ঠানে‌র জন‍্য ভাড়া দেওয়া হয়। ভাবি, অন্ততঃ দুজন থাকলে তবু চলতো। নিতান্ত ঠেকায় পড়ে একটা রাত কোনোভাবে কাটানোর হলেও চলতো। কিন্তু নরোয়র কেল্লা‌টা ভালো‌ভাবে দেখতে হবে। তাই এখানে অন্ততঃ দুটো রাত কাটাতে হবে। এই হাটে‌র মাঝে তা পোষাবে না। তবু প্রস্তাব‌টা হাতে রেখে ওনাকে বলি, দেখছি যদি অন‍্য কোথাও ঘর পাই, না হলে এখানেই আসবো। উনি নীরবে ঘাড় নাড়েন। অর্থাৎ, যেমন আপনার মর্জি।
     
    ৪. লোড়ীমাতা‌র প্রেক্ষাপট
       রাত্রি‌বাসের আস্তানা কোথাও একটা জুটে যাবে। আখাড়া মন্দিরের আশ্বাস‌ তো আছে‌ই। তাই এই মন্দিরের পশ্চাৎপট‌টা লোকমুখে শুনে নিলাম। যা শুনলাম তা যেমন অবিশ্বাস্য তেমনি চিত্তাকর্ষক। অতীতে নরোয়র ছিল নিষধরাজ নলের রাজ‍্য। তখন তা নলপুরা নামে পরিচিত ছিল। একবার সেখানে খেলা দেখাতে আসে এক বেদেনী নর্তকী। সে বলে বেড়ায় দড়িতে হাঁটায় তার সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো ভূভারতে কেউ নেই। বিশ্বাস না হয় তো পশ্চিমে পাহাড় শিরের কেল্লা থেকে পূবে হাজিরা পাহাড় অবধি খাটাও দড়ি। দাও উপযুক্ত ইনাম তারপর হাঁ করে চেয়ে দ‍্যাখো, জমি থেকে চারশো ফুট ওপরে বাঁধা দড়ির ওপর দিয়ে কেমন আমি হেলায় হেঁটে চলে যাই। 
     
       কথাটা রাজার কানে যেতে তিনি বলেন, বটে, ডাকো তো তাকে। বেদেনী এসে রাজসমীপে সেলাম করে দাঁড়ায়। রাজা, বলেন, তুমি যা বলেছ, তা যদি করে দেখাতে পারো, তাহলে আমার অর্ধেক রাজত্ব তোমার। বেদেনী বলে, মহারাজ, আপনি যখন এতবড় ইনাম ঘোষণা করলেন, তাহলে আমিও শর্ত বাড়িয়ে দিচ্ছি। কেল্লার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে দড়ি টাঙ্গালে পূবের পাহাড় অবধি দূরত্ব‌টা সবথেকে কম হয় বটে (আমি ম‍্যাপে মেপে দেখলাম ৩০০০ফুট) তবে আপনি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে এই ইনাম ঘোষণা করলেন, আরো লম্বা হলেও দড়ি‌টা এখান থেকেই টাঙ্গানো হোক (সেক্ষেত্রে ৪০০০ফুট)। আর আমি যখন দড়ির ওপর দিয়ে যাবো, আপনি চেষ্টা করেও সে দড়ি কাটতে পারবেন না। রাজা বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে থাকেন বেদেনীর দিকে। সে সেলাম করে চলে যায়।
     
          নির্দিষ্ট দিনে গ্ৰাম লোকে লোকারণ‍্য। ৫০০ ফুট উঁচু দুই পাহাড়ের মধ‍্যে মোটা দড়ি টাঙানো হয়েছে। রাজাকে সেলাম করে বেদেনী কেল্লা থেকে দড়ি ওপর দিয়ে পা টিপে টিপে চলতে শুরু করে পূব পাহাড়ের দিকে। দূর্গ‌প্রাকারে দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠিত রাজা ভাবেন, বেচারা বেদেনী, মোটা ইনামের লোভে এমন মরণপণ বাজী ধরে হয়তো আজ বেঘোরে মরবে। কিন্তু তিনি তো রাজা, তাঁর তো উচিত ছিল কিছু ইনাম দিয়ে তাকে এই মারাত্মক ঝুঁকির খেলা থেকে নিবৃত্ত ক‍রা। 
     
        কিন্তু এ কি! ও তো দিব‍্যি চলে যাচ্ছে! রাজার মনে পড়ে বেদেনীর দ্বিতীয় শর্তের কথা। খাপ থেকে তলোয়ার বার করে তিনি কেল্লার পাঁচিলের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া মোটা দড়িতে ঝপা‍ং করে কোপ বসান। অনেক লড়াইয়ের বিশ্বস্ত সাথী, এক কোপে গর্দান ওড়ানো সেই ধারালো তলোয়ারের কোপেও দড়িতে কোনো দাগ‌ও পড়ে না! তখন তা ভ‍্যাদভ‍্যাদে  ভোঁতা। তবু রাজা উদভ্রান্তের মতো তলোয়ার চালাতে থাকেন। 
     
    সেখানে উপস্থিত ছিল কেল্লার  মুচী। সে বলে, মহারাজ, ঐ বেদেনী নিশ্চিত তন্ত্র মন্ত্র জানে, তাই অমন শর্ত রেখেছিল। ও জাদুটোনা করে আপনার তলোয়ারের ধার বেঁধে দিয়ে‌ছে। কিন্তু আমার চামড়া কাটা রাঁপি (বাটালি) অশৌচ অওজার, ওতে মন্ত্র তন্ত্র খাটে না, নিয়ে আসবো? বিহ্বল রাজা বিড়বিড়িয়ে বলেন, আনো তো দেখি। মুচী দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসে ওর রাঁপি। রাজা সেটা দিয়ে কাটতে যান দড়ি। কাটছে, কাটছে! ঠিক বলেছে মুচী। রাজতরবারি ফেলে দড়িতে  মুচীর রাঁপি ঘষতে ঘষতে রাজা দাঁতে দাঁত পিষে মনে মনে বলেন, ছোটলোক বেদেনী, মন্ত্র পড়ে বেঁধেছিলি আমার তরোয়াল? তোর এতো আস্পর্ধা? এবার তোর কী হয় দেখ?
     
       এই জনশ্রুতি শুনে আমার মনে পড়ে যায় 'জলসাঘর' সিনেমার আত্মম্ভরী জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের কথা। দেউলিয়া জমিদার তাঁর জলসাঘরে শেষবারের মতো নাচের আসর বসিয়েছে‌ন।  নাচ দেখে উঠতি বড়লোক মহিম গাঙ্গুলী উৎফুল্ল হয়ে পকেট থেকে পয়সা বার করতে যায়। হাতি‌র দাঁতের হাতল‌ওয়ালা ছড়ি বাড়িয়ে মহিমের হাত থামিয়ে দেন জমিদার। বলেন, প্রথম ইনাম দেওয়ার অধিকার গৃহস্বামীর। শেষ সম্বল থেকে একটি রৌপ‍্যমূদ্রার থলি তিনি তুলে ধরেন। আমন্ত্রিত নর্তকী সেলাম ঠুকে তা গ্ৰহণ করে। মধ‍্যরাতে শূন্য জলসাঘরে খানসামা অনন্ত‌র কাছে আত্মঘাতী আত্ম‌অহংকারে নিমজ্জিত বিশ্বম্ভর উন্মাদের মতো হাসতে হাসতে বলেন, "পারে নি, পারে নি,  ব‍্যাটা ভুঁইফোড়, সুদখোরের ব‍্যাটা, কত বড় আস্পর্দা, বামন হয়ে চাঁদে হাত!" 
      সেদিন হয়তো নিষধরাজ‌ও এক বেদেনীর কাছে বোকা বনে যাওয়ার তিক্ত‌তায় মূচীর রাঁপি দড়িতে ঘষতে ঘষতে বিস্মৃত হয়েছিলেন যে ক্ষণকাল আগে তাঁর‌ই মনে জেগেছিল ঐ বেদেনীর প্রতি অনুকম্পা। হঠাৎ দড়ি ছিঁড়ে যায়। ঘটনাস্থলে‌ই পড়ে মরে বেদেনী‌। ইন্দ্র, যম, অগ্নি ও বরুণদেবতার বরধন‍্য নিষধরাজের তখন সম্বিত ফেরে - ক্ষণিকের উত্তেজনা‌য় এ কী করে বসলেন তিনি? গভীর মনস্তাপে সেই মৃত বেদেনীকে তিনি আশীর্বাদ করেন যে লোকে তাকে দেবীজ্ঞানে পুজো করবে। সেই ঘটনাস্থলে‌ই আজকের লোড়ীমাতা মন্দির। 
     
     
    প্রথমে মন্দিরে রাখা ছিল একটি বড় নুড়ি পাথর অর্থাৎ লোড়ী, তাই নাম 'লোড়ীমাতা'। মূর্তি হয়েছে হালে, পনেরো বিশ বছর আগে।   স্থানীয়‌দের কাছে ইনি জাগ্ৰতা বলে মান‍্যতাপ্রাপ্ত। দূরদূরান্ত থেকে নিঃসন্তান  দম্পতি এখানে আজ‌ও সন্তান কামনায় মানত করতে আসেন। আর এক অদ্ভুত প্রথার কথা জানলাম - এখানে ফুলের সাথে ডিম দিয়ে বাচ্চা‌র মঙ্গল‌কামনায় মানত পূজা করা হয়! এ জিনিস এযাবৎ আর কোনো মন্দিরে দেখিনি।
     
    ৫. দড়ি‌তে হাঁটার জনশ্রুতির প্রতিধ্বনি
      এই জনশ্রুতিটি ভারতের আরো কিছু জায়গায় চালু আছে। আমার জানায় অন্তত আরো দুটি। একটি মধ‍্যপ্রদেশ ও রাজস্থান সীমান্তে একটি কেল্লার ক্ষেত্রে যার নামটা ভুলে গেছি। সেখানে‌ও এক নর্তকী দুই পাহাড়ের মধ‍্যে বাঁধা দড়ির ওপর দিয়ে যখন প্রায় ওপারে পৌঁছে যায় তখন বাজী হেরে রাজত্বের অর্ধেক দিতে হবে বলে রাজা দড়ি কেটে দেন। নর্তকী মারা যাওয়ার আগে অভিশাপ দেয়, এই ছলনার জন‍্য তোমার রাজত্ব উজার হয়ে যাবে। ঘটনাচক্রে তাই হয়। সেই কেল্লার রাজপাট কিছুদিনের মধ‍্যে অজ্ঞাত কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কেল্লা‌টা অভিশপ্ত পরিগণিত হয়ে পরিত‍্যক্ত হয়।
     
      দ্বিতীয়‌টি‌ উদয়পুরে। মহারাণা জয়ান সিংয়ের সময় উদয়পুরে আসে এক নর্তকী‌দল। গলকি নামে তাদের দলে এক তরুণী নর্তকী দড়ির ওপর এমন নাচে যা জমি‌তে দাঁড়িয়ে‌ও অনেকে পারে না। তার সুখ‍্যাতি শুনে রাণা তাকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন তোমার নাচের কী এমন বৈশিষ্ট্য?  নৃত‍্যকলায় সিদ্ধ গলকি আত্মগর্বে বলে ফেলে, মহারাজ, আপনি তো নাচঘরে নাচ দেখতেই অভ‍্যস্থ, একবার খোলা আকাশের নীচে আমার নাচ দেখলে বুঝবেন আমার নাচের কী বৈশিষ্ট্য। রাণা বলেন, তাই নাকি? যেমন? গলকি বলে, উদয়পুর তো হ্রদের নগরী। মহারাজ যে কোনো হ্রদের এপার ওপার একটা দড়ি বাঁধার ব‍্যবস্থা করুন, আমি এক হাতে তলোয়ার নিয়ে ঐ দড়ির ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে পেরিয়ে যাবো। 
     
      নরোয়রের নল রাজার মতো‌ই রাণা জয়ান সিং স্তম্ভিত হয়ে হয়ে যান এক নটীর আত্মপ্রত‍্যয়ে। বলেন, ঠিক আছে, তুমি যদি পিছোলা লেকের পশ্চিম পার থেকে পূব পারে সিটি প‍্যালেস অবধি দড়িতে হেঁটে চলে যেতে পারো তাহলে আধা মেওয়ার তোমার। গলকি বলে, মহারাজের শর্ত শিরোধার্য। হয় আমার তুচ্ছ প্রাণ, নয়তো আপনার আধা মেওয়ার, কোনো একটা ঠিক যাবে। রাণা ও তাঁর সামন্তদল ভেবেছিলেন আত্মগর্বী নর্তকী বাজী‌টা বেশী‌ই ধরে ফেলেছে। তিন হাজার ফুট দড়িতে হেঁটে যাওয়া কী মুখের কথা? পড়ে গিয়ে সে নির্ঘাত মরবে জলে ডুবে। কিন্তু গলকির চলন দেখে মনে হোলো ও হয়তো চলে‌ও যেতে পারে ওপারে। উপস্থিত সামন্তরা রাণাকে বলেন, মহারাজ ওর ওপর তো মনে হয় আজ কোন দৈবশক্তি ভর করেছে, ও তো পেরিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। রাণা বলেন, তাহলে শর্ত অনুযায়ী ওকে দিতেই হবে আধা মেওয়ার। সামন্তদল ভাবে, আধা মেওয়ারের রাণী হলে তাদের তো তহালে এক নর্তকী‌র হুকুম পালন করতে হবে। রাণা খেয়ালের বসে এমন বাজী ধরলেও এতো কোনোভাবেই হতে দেওয়া যায় না। তারা ষড়যন্ত্র করে দড়ি কেটে দেয়। 
     
      গলকি লেকের জলে ডুবে মারা যাওয়ার আগে অভিশাপ দিয়ে যায় - রাজা, এই শঠতা‌র জন‍্য তুমি অপুত্রক হবে। সে ভেবেছিল চুক্তি ভঙ্গের জন‍্য রাণাই দায়ী। ঘটনা‌চক্রে রাণা জয়ান সিংয়ের কোনো পুত্রসন্তান হয় নি। তাঁর পর উদয়পুরের সিংহাসনে বসেন তাঁর তুতো ভাই সর্দার সিং। পরবর্তী আরো পাঁচজন রাণার কেউ‌ই পূর্ববর্তী রাণার সন্তান ছিলেন না। তাঁরা রাণা হয়েছিলেন দত্তক প্রথায়। পিছোলা লেকের মধ‍্যে সেই ঘটনার স্মৃতি‌তে তৈরি হয়েছে - 'নটীনী চবুতরা' - নৌকায় সেখানে যাওয়া যায়।
     

    ৬. সেই জনশ্রুতির বাস্তবতা অনুধাবন
      'দীর্ঘ দূরত্ব আঁটো দড়িতে উঁচুতে হাঁটন' বা Long Distance High  Level Tight Rope Walk কঠিন কসরৎ। অসীম সাহস ও দক্ষতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এ কলায় বংশপরম্পরায় পারদর্শী 'দ‍্য ফ্লাইং ওয়ালেন্ডা' পরিবারের কথাই ধরা যাক। এই বংশের পূর্বজ ১৭৮০ সালে বোহেমিয়াতে নানান দুঃসাহসিক সার্কাসের খেলা দেখাতো। তারা আমেরিকা‌য় আসে ১৯২৮ সালে। ১৯৭৪ সালে  সেই পরিবারের বিখ্যাত সদস‍্য কার্ল ওয়ালেন্ডা ৬৯ বছর বয়সে সিনসিনাটির কিংস আইল‍্যান্ড এ্যামুউজমেন্ট পার্কে ১৮০০ ফুট লম্বা দড়িতে হেঁটে বিশ্ব রেকর্ড করেন। তার চার বছর পর ১৯৭৮ সালে কার্ল ৭৩ বছর বয়সে পুয়ের্তো রিকোর স‍্যান জুয়ানে মাত্র ১০০ফুট দূরত্ব দড়িতে হাঁটতে গিয়ে ১২১ফুট নীচে রাস্তায় পড়ে মারা যান। না, বয়স‌জনিত কারণে কার্লের দক্ষতায় টান পড়েনি। জোর হাওয়ায় ঠিকমতো না বাঁধা lateral stabilizing rope এর জন‍্য মূল দড়ি আড়াআড়ি নড়তে শুরু করেছিল।


     
      এই প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত হয়তো মন্দ লাগবে না। উপরে লছমনঝুলার ছবিতে সাসপেনশন ব্রীজের মূল ভারবাহী মোটা কেবলদুটি হলুদ তীর চিহ্নিত। সবুজ তীর Vertical Hanger Cables যা সেতু‌টিকে সাসপেনশন কেবল থেকে ঝুলিয়ে রাখে। লাল তীর চিহ্নিত কেবল সিস্টেম হচ্ছে  Lateral Support এর জন‍্য। এগুলো narrow flexible deck সাসপেনশন ব্রীজের দুপাশে বাঁধা থাকে। ঝোড়ো হাওয়ায় সেতু যদি আড়াআড়ি নড়তে শুরু করে তা বন্ধ করার ক্ষমতা সাসপেনশন কেবলের নেই। সেটা তার কাজ‌ও নয়। তা পুরোপুরি রুখতে না পারলেও তার মাত্রা অনেকটা কমিয়ে দিতে পারে নদীর দু পার থেকে নিয়মিত ব‍্যবধানে ডেকের দুপাশে বাঁধা অনেকগুলি অমন LS Cable। 



     
       তবে সব ক্ষেত্রে LS দেওয়া সম্ভব হয় না। যেমন সানফ্রানসিস্কো বের ওপর আইকনিক গোল্ডেন গেট ব্রীজ। তখন উপরের ছবির মতো মজবুত করতে হয় ব্রীজ ডেক - যার ওপর দিয়ে গাড়ি চলে। ছবিটা গোল্ডেন গেট ব্রীজের‌ই। ঐ সেতুর দুপাশে দুটি ভারবাহী যুগ্মস্তম্ভের মাঝের অংশটি (span) ৪২০০ ফুট লম্বা। ব্রীজ ডেক ৯০ ফুট চ‌ওড়া ও ২৫ ফুট উঁচু Truss Structure. এভাবে ডেকটি‌র Lateral Stability বাড়ানোর ফলে প্রবল ঝড়ে তার আড়াআড়ি (Lateral) ও উপরনীচে (Vertical) দুলুনি কম হবে। তা বাস্তবে প্রমাণিত‌ও হয়ে গেছে। ১৯৫১ সালে ঘন্টায় ১১২ কিমি ঝড়ে ব্রীজের মধ‍্যাংশ দুপাশে ১৪ ফুট অবধি নড়েছি‌ল। হাওড়া ব্রীজের সর্বোচ্চ অংশ‌ও প্রবল ঝড়ে ফুটখানেক এপাশ ওপাশ নড়তে পারে - সে‌ই সম্ভাবনা ধরেই ডিজাইন করা তবে হাওড়া ব্রীজ সাসপেনশন ব্রীজ নয়, Rigid Structure বলে উপর নীচে দুলবে না। সেবার গোল্ডেন গেট ব্রীজের ডেকের মধ‍্যাংশ ওপর নীচেও দুলেছিল ভালোরকম। 
     
    এই নড়া (আড়াআড়ি) ও দুলুনি (ওপর নীচে) যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তাহলে সাসপেনশন ব্রীজের ডেক হ‍্যাঙ্গার কেবল ছিঁড়ে ভেঙে পড়তে পারে। এমন দূর্ঘটনা হয়ে‌ওছে। কয়েক হাজার টনের ব্রীজ ডেক হঠাৎ ভেঙে পড়লে সাসপেনশন কেবল‌‌ও ভার কমে গিয়ে স্প্রিং‌য়ের মতো লাফিয়ে উঠবে। তার ফলে দুপাশের মূল স্তম্ভ‌‌ও অনেকটা নড়ে গিয়ে ভেঙে পড়তে পারে।  
     
    তবে ১৯৫১ সালের ঝড়ে গোল্ডেন গেট ব্রীজের  কোনো ক্ষতি হয়নি। এসব সম্ভাবনা ভেবেই সেতু‌টির ডিজাইন করা হয়েছিল ফলে ৪৭০০ টন ওজনের ডেক স্ট্রাকচার সামলাতে পেরেছি‌ল সেই ঝড়। শুধু সে সময় সেতুর ওপর যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিগত আট দশকে দূর্যোগের কারণে মাত্র পাঁচবার সাময়িকভাবে ঐ সেতুতে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৫১ সালের সেই ঝড় ছিল তার মধ‍্যে সবথেকে শক্তিশালী। শুনেছিলাম আমফান সুপার সাইক্লোনের সময়‌ কলকাতা‌য় বিদ‍্যাসাগর ও রবীন্দ্র সেতুতে সাময়িকভাবে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল।
     
      ফিরে আসি কার্লের কথায়। হঠাৎ ওঠা ঘন্টায় ৫৬কিমির সামূদ্রিক হাওয়ার ঝাপটায় (Wind Gust) দড়ি আড়াআড়ি ভাবে ভালো‌রকম নড়ে ওঠে। বিপদ বুঝে নার্ভাস না হয়ে কার্ল দাঁড়ানো অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে দড়িতে বসে‌ পড়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। দড়ি থেকে পা পিছলে যায়। তালু দিয়ে দড়ি‌টি ধরেও ফেলেছিলেন কিন্তু কনুয়ের প‍্যাঁচে শরীরের ওজন রোখার আগেই তালু‌ও ফসকে যায়। বোঁটা ছেঁড়া ডাবের মতো পড়ে যান কার্ল। সাথে পড়ছিল তাঁর বহু কসরতের সঙ্গী ব‍্যালান্সিং পোলটি‌ও। দশতলা উচ্চতা থেকে কঠিন রাস্তায় পড়ে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয় তাঁর। হাসপাতালে শুয়ে দীর্ঘদিন রোগে ভুগে নয়, কার্ল চাইতেন যখন সময় ফুরোবে মৃত্যু যেন এভাবেই আসে - হঠাৎ - খেলাচ্ছলে‌। কার্লের মৃত্যু তাঁর মনোবাঞ্ছা অনুযায়ী হলে‌ও মাত্র ১০০ফুট দড়িতে পার হতে গিয়ে তাঁর পড়ে যাওয়ার সেই অন্তিম মূহুর্ত্তের ভিডিও দেখে আমি খুব মর্মাহত হয়েছিলাম - তা যেন - Insignificant End of a Spectacular Legend. 
       
      রেকর্ড তৈরি‌ই হয় ভাঙার জন‍্য। ডেয়ারডেভিল স্টান্ট প্রদর্শন‌ও ওয়ালেন্ডা বংশের রক্তে। তাই ঐ পরিবারের সপ্তম প্রজন্মের নিকের (কার্লের প্রপৌত্র) দু বছর বয়সে দু ফুট উচ্চতায় বাঁধা দড়িতে এই কলায় পায়ে খড়ি শুরু হয়। সময়ের সাথে সেও তুখোড় হয়ে ওঠে দড়িতে হাঁটায়। তার চালু নাম‌ হয়ে দাঁড়ায় The King of the Wire. নিক ২০০৮ সালে ২৯ বছর বয়সে সেই কিংস আইল‍্যান্ডে তার প্রপিতামহের ৩৪ বছর আগের ১৮০০ ফুটের রেকর্ড ভেঙে তৈরি করে নতুন বিশ্বরেকর্ড - ২০০০ ফুট টাইট রোপ ওয়াকিং, যা আজ‌ও অটূট। এখন ৪১বছর বয়সে নিক এগারোটা গিনেস রেকর্ড‌ধারী। তার মধ‍্যে ২০১৩ সালে গ্ৰ‍্যান্ড ক‍্যানিয়নের বাইরে লিটল কলোরেডো নদীর ১৫০০ ফুট ওপরে ১৩০০ ফুট দীর্ঘ রক্তজল করা দড়ির হাঁটন‌ও আছে।
     
      তবে প্রতিটি প্রদর্শনী‌র আগে নিকের থাকে দীর্ঘ শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি। নিকের কাকা দড়ি খাটানোর প্রধান ইঞ্জিনিয়ার। নিকের বাবা  সেফটি এক্সপার্ট। LS ropeএর সাহায্য পেলে ও দূ্রত্ব বেশী না হলে নিক হাঁটে টানটান করে বাঁধা পৌনে ইঞ্চি‌র স্টিল রোপের ওপর। LS না থাকলে বা দূরত্ব বেশী হলে লোহার দড়ি দু ইঞ্চি অবধি‌ মোটা হতে পারে। তখন সেই দড়ি খাটানোও একটা প্রোজেক্ট হয়ে দাঁড়ায়।
     
       স্থানীয় মানুষ অতীতের ঐসব তিন হাজার, চার হাজার ফুট দূরত্বের 'কচ্চে ধাগায়' হাঁটার 'ঘটনা' নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। তবে ওসব জনশ্রুতি কেন আমার আজগুবি বলে‌‌ মনে হয় সেই প্রেক্ষিতে‌ই দড়িতে হাঁটা নিয়ে বিশদে আলোচনা করলাম। নলরাজা বা জয়ান সিংয়ের সময় স্টীল বা সিন্থেটিক দড়ি‌র চল ছিল না। পাটের বা নারকেল দড়ি তিন হাজার ফুট দূরত্বে খাটালে তা সোজাও থাকবে না, ওল্টানো ধনুকের মতো ঝুলে যাবে। সেক্ষেত্রে শুরুতে ঢালে নামতে ও  শেষে ঢালে উঠতে হবে। এমন অবস্থায় King of the Wire নিক‌কেও বিশেষ ভাবে অভ‍্যাস করতে হয়। ৪৫ পাউন্ড ওজনের ২৩ ফুট লম্বা ব‍্যালান্সিং পোল বেল্ট দিয়ে কাঁধের দুপাশ থেকে ঝুলিয়ে ধরে পা টিপে টিপে হাঁটতে হয়। কপালে ঘাম দেয়। টলমল করলে দড়ি‌র ওপর উবু হয়ে বসে পড়ে স্মরণ করতে হয় প্রভু যীশুর নাম। অতো সোজা নয় টাইট রোপে হাঁটা। তাই পিছোলা‌ লেকের ওপর তিন হাজার ফুট লম্বা দড়িতে গলকির এক হাতে তরোয়াল নিয়ে নাচতে নাচতে চলে যাওয়া - গল্পের গরুর গাছে উঠে নাচার মতোই মনে হয় আমার।
     
       এসব জনশ্রুতি শিবপুরীতে বাণগঙ্গা ধামে ফুলচন্দ দাদাজী‌র অনশন করে কুন্ডে জল আনার মতো ব‍্যাপার। এমন অবিশ্বাস্য গালগল্প বিশ্বাস করায় সাধারণ মানুষের প্রবল প্রবণতা। ফেক নিউজের বন‍্যা যেমন বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার অবদান অতীতের এমন নানান জনশ্রুতি‌ও তেমনি অলৌকিক, আজগুবি কাহিনী‌র ভাঁড়ার। মহাভারতের বিবরণ অনুযায়ী নল ছিলেন সদাচারী, গুণবান, প্রজাবৎসল রাজা। তিনি কেন হিতাহিত‌জ্ঞানশূন‍্য হয়ে মূচীর রাঁপি দিয়ে দড়ি কাটতে যাবেন তা‌ বোধগম্য হয় না। 
     
    ৭. অবশেষে পেলাম রাত্রি‌বাসের ঠিকানা
      লোড়ীমাতা মন্দিরের অদূরে অমর শান্তি গেস্ট‌হাউসে কম খরচে একটা রুম পেলাম। ক্লান্ত ছিলাম বলে একটু দিবানিদ্রা দিয়ে চারটে নাগাদ নীচে নামি। রাস্তার পাশে ঠেলায় চা বিক্রি হচ্ছে। পরদেশী পাবলিক ওরা চেহারা দেখেই বোঝে। দোকানী আপ‍্যায়ন করে একটা টুল দেখিয়ে বলে, বসুন বাবুজী। স্থানীয় এক মানুষের পাশে টুলে বসে করেরা যাওয়ার বাসের খোঁজখবর নিই। একথা সেকথা হয়। একাকী ভ্রমণে স্থানীয় মানুষের সাথে আলাপচারিতায় বেশ আনন্দ পাই। কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করেও তাদের কথাবার্তায় বিতৃষ্ণা, অতৃপ্তি‌ কম দেখেছি‌। অনুভব করেছি নিয়তি‌বাদী আত্মসন্তুষ্টি।
     
       পাঁচ টাকার ছোট চা, আদা দিয়ে দারুণ বানিয়ে‌ছিল। বলি, চা টা বেশ হয়েছিল ভায়া, বানাও দেখি আর এক কাপ। এমন চা এক কাপ খেয়ে আশ মেটে না। দোকানীর মুখে খেলে যায় তৃপ্তির হাসি। জোরে হাপরের হ‍্যান্ডেল ঘোরায়। গোল পুঁচকে উনুনে কয়লার আগুন ফুলকি মেরে তাতিয়ে তোলে সসপ‍্যান। উৎসাহে হাতা নাড়ে দোকানী। পাশের লোকটি বলে, এই ওর গুণ। ও চা বানিয়ে রাখে না। এক কাপ হোক বা দশ কাপ, যে যেমন চাইবে ও চটপট বানিয়ে দেবে, কিন্তু প্রতিবার এক‌ই রকম খেতে লাগবে। চা খেয়ে পয়সা দিতে গেলে দোকানী হাতজোড় করে বলে, বাবুজী, আপনি পরদেশী, এখানে বেড়াতে এসেছেন, এটা না হয় আমার তরফে হোক। আপনি তো এখানে থাকবেন বললেন দুদিন, পরের বার না হয় দেবেন। 
     
      অভিভূত  হয়ে যাই। চতুর্দিকে লোভের তাড়নায় যখন লোকে অন‍্যায‍্য পথে হাঁটতে‌ও পিছপা নয়  তখন এহেন নিম্ন‌বিত্ত মানুষরা অন্তরে‌ এমন ঐশ্বর্য বাঁচিয়ে রাখে কী করে! বলি, তা হয় না ভায়া, এটা তোমার ব‍্যবসা, তোমার সংসার চলে এতে, পয়সা দেওয়ার ক্ষমতা‌ও আমার আছে, যত্ন নিয়ে বানালে, ভরা কাপে চা দিলে, এই তো যথেষ্ট। সে অমায়িক হাসে। তখন বৌনির সময় নয়। তবু সে দশ টাকার নোটটা কপালে ঠেকিয়ে কৌটোয় রাখে। আমি গা তুলি।
     
    ৮. সান্ধ‍্য‌ ভ্রমণে আশেপাশে
       হালকা পায়ে আশপাশটা দেখতে বেরোই। ভেবেছিলাম চৌদহ (চোদ্দ) মহাদেব মন্দির‌টা ঘুরে আসবো। তাতে মোহিনী সাগর থেকে আসা উকেলিয়া ক‍্যানালের সেতু পেরিয়ে যাতায়াতে প্রায় পাঁচ কিমি হাঁটতে হবে। মেঘলা বিকেলে আজ হয়তো তাড়াতাড়ি‌ই সন্ধ্যা নামবে। মন্দির‌টা জনপদের পূর্ব প্রান্তে একটু নির্জন জায়গায়। দুপুরে না ঘুমিয়ে বেরোলে যাওয়া যেতো। মনে হোলো এখন সেখানে একা যাওয়া উচিত হবে না। অবশ‍্য কোথাও বেড়াতে গিয়ে যে লন্ড্রি লিস্ট মিলিয়ে সব  দ্রষ্টব্য স্থান‌ই দেখতে‌ই হবে তেমন তাড়না আমার নেই। বুঝি অনেক কিছুই এ জীবনে অদেখা রয়ে যাবে, যেটুকু দেখতে পাই তা‌ই স‌ই‌। ভাবি যেখানে আজ প্রথমে ওঠার কথা ছিলো সেই রামজানকী আখাড়া মন্দির‌টা বরং ঘুরে আসি। দেখে আসি আগামীকাল তার মেয়ের বিয়ের জন‍্য রাজন ভাই সেখানে কেমন আয়োজন করেছেন।
     
      দুপুরে বাস থেকে নেমে আশ্রয়ে‌র সন্ধানে প্রাচীন নগরীর সরু রাস্তা ধরে এসেছিলাম। এখন শহরের বাইরে দিয়ে চ‌ওড়া কংক্রিটের বাইপাস ধরে হাঁটতে থাকি। বাঁদিকে শহরের সীমানায় পাঁচশো ফুট পাহাড়ের মাথায় উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত বিশাল কেল্লা। রীতিমতো সমীহ জাগানো সাইজ। এক মতে নরোয়র কেল্লা, জনপদের প্রতিষ্ঠাতা কুশ‌ওয়াহা রাজপুত বংশ। সে গড়ের  অতীত গৌরব বর্তমানে ম্রিয়মাণ। কিছু অংশ ভগ্নপ্রায়। অনেকাংশে‌ই জঙ্গলাকীর্ণ। তবু মূলতঃ সেই কেল্লা‌র আকর্ষণে‌ই আমার নরোয়র যাওয়া। 
    ডানদিকে আর একটি উঁচু, খাড়া পাহাড়। ওটার নাম হাজিরা হিল। টঙে কিছু প্রাচীন স্থাপত্য চোখে পড়লো। এক দোকানী বললেন ওখানে আছে দুটি মসজিদ ও একটি শিবমন্দির। মুঘল জমানায় তৈরি। এখন পরিত্যক্ত। বিশেষ কেউ যায় না। ওদিকটায় বেশ জঙ্গল হয়ে গেছে। একা না যাওয়া‌ই ভালো।
     
    ৯. আখাড়া মন্দির
      রামজানকী আখাড়া হনুমান মন্দিরটি জনপদের একান্তে। পুজো পার্ব্বন না থাকলে বিশেষ কেউ আসে‌ না ওখানে। নির্জন শান্ত পরিবেশ। কিন্তু আগামীকাল যে এখানে কোনো বিয়ে হবে তার কোনো লক্ষণ‌ই দেখলাম না। সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে একটা সাদামাটা ধর্মশালা‌। তিনটে বড় ঘর। সিমেন্টের মেঝে। একপাশে কয়েকটি কমন বাথরুম। জলের ব‍্যবস্থা আছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। বড় প্রাঙ্গণে বেশ কিছু গাছপালা। 
     
    আশি ছুঁইছুঁই পূজারী ভরতজীর সাথে আলাপ হোলো।  বললাম আচ্ছা কাল কী এখানে আপনাদের কর্ণসমাজের রাজন সিং বলে কারুর মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হ‌ওয়ার কথা আছে? বললেন, এখন তো মলমাস, পৌষ সংক্রান্তি‌র পরে হবে। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? বলি, ওনার সাথে ফোনে কথা হয়েছিল। উনি‌ই বলেছিলেন এখানে এসে উঠতে, বিয়েতে থাকতে। ভরতজী বলেন, হয়তো আপনার আসার তারিখটা উনি ঠিক বুঝতে পারে‌ননি ফোনে। বেশ তো, বিয়ে নাই বা হোলো এখানে, আপনি চলে আসুন কাল‍। ধর্মশালার মেঝেতে এখন‌ও টাইল বসেনি। আপনি আমার পাশের ঘরে থাকবেন নিঃশুল্ক। মন্দিরের চৌকিদার‌‌ আমার রান্না করে। আর কেউ নেই এখানে। আপনি‌ আমাদের সাথেই খাবেন।    
     
      দুপুরে গরু খোঁজা করে জৈন ধর্মশালা পেয়েও থাকতে পেলাম না।  PWD বাংলো নিয়ম দেখিয়ে হাঁকিয়ে দিল। মাতারাণীর থানে তবু যা একটু গতি হয়েছিল। আর এখন মেঘ না চাইতে জল! থাকা এবং খাওয়া‌র যুগ্ম আহ্বান! অভাবনীয় ব‍্যাপার! তবু বলি, পণ্ডিত‌জী আপনার আমন্ত্রণ শিরোধার্য, কিন্তু এখন আর তা হয় না, কারণ আমি যখন হাক্লান্ত হয়ে ঐ লজে গেছিলাম, উনি খুব‌ই কম ভাড়ায় আমায় থাকতে দিয়েছেন। আমি বলেছি দুদিন থাকবো। তবে আবার যদি কখোনো আসি, জায়গা পেলে এখানে উঠবো। উনি বলেন, আমি বুঝেছি, আপনি ঠিক‌ই বলেছেন। 
     
      মধ‍্যতিরিশের এক প্রাথমিক শিক্ষক প্রদীপ তখন মন্দিরে ছিলেন। আমাদের আলোচনা শুনছি‌লেন চুপচাপ। তিনি ঐ মন্দিরের পাশে ছোট একটা ঘরভাড়া করে স্ত্রী ও নবম শ্রেণীতে পাঠরতা একমাত্র মেয়েকে নিয়ে থাকেন। তার পড়ার জন‍্য‌ই এখানে থাকা। তাঁর গাঁয়ে ভালো মাধ‍্যমিক স্কুল নেই। তিনি যে স্কুলে পড়ান সেটি দশ কিমি দুরে তাঁর‌ই গ্ৰামে। রোজ আর এক শিক্ষকের সাথে উনি বাইকে যাতায়াত করেন। খরচ ভাগাভাগি হয়ে যায়। এভাবেই চলছে বিগত দু বছর। মেয়ের মাধ‍্যমিক পরীক্ষার পর গ্ৰামে চলে যাবেন। দশ বছর আগে যখন এই চাকরিটা পেয়েছিলেন তখন তা ছিল টেম্পোরারি, মাস মাইনে পাঁচ হাজার। তিন বছর পর চাকরি পাকা হয়। এখন পান মাসে আটাশ হাজার।
     
     
     বলি আগামী বছর যে গ্ৰামে চলে যাবেন তখন ওর পড়াশোনা‌র কী হবে? বলেন, শিবপুরী‌তে কথা বলেছি। ওখানে হোস্টেলে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পড়বে। তাতে খরচা একটু বেশি হলেও বাবা হিসেবে আমায় তা করতেই হবে। আমি নিজে পড়াই, তাই বুঝি মেয়েটা‌র পড়ায় মাথা আছে, লগন‌ও খুব। আর আমরা দুজনে গ্ৰামে নিজের বাড়িতে থাকবো, ভাড়া লাগবে না, রোজ বাইকে যাতায়াতের খরচ নেই। চলে যাবে যাহোক করে। প্রদীপের কথায় ফুটে ওঠে মেয়েকে নিয়ে ওর স্বপ্ন। খেয়ে পরে তো মানুষ শরীরে বাঁচে। এমন কিছু  স্বপ্ন‌পূরণের আশা মানুষ‌কে মানসিক‌ভাবে বাঁচিয়ে রাখে। 
     
     রোজ সন্ধ্যায় প্রদীপ মন্দিরে আসেন। নিঃসঙ্গ ভরতজী‌কে একটু সঙ্গ দেন। চৌকিদার চা করে আনলেন। ভরতজী ঘর থেকে কয়েকটি বিস্কুট এনে দেন। আয়োজন সামান‍্য। তবে আন্তরিকতা অকৃত্রিম। ভরতজী ও চৌকিদারের সাথে প্রদীপ‌ও রোজ সন্ধ্যায় মন্দিরে সংক্ষিপ্ত, নিরারম্বর দেবারতিতে অংশ নেয়। সেদিন আমি‌ও তাতে যোগ দি‌ই। ওনাদের সাথে হাতজোড় করে মনে মনে এক লয়ে 'জয় রাম, জয় রাম, জয় জয় রাম' জপতে জপতে মন্দির পরিক্রমা করি। কেউ হুংকার দিয়ে বাধ‍্য করেনি। মন্দির দেখে এসে সঙ্গে থাকা শুকনো খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি। কাল যাবো কেল্লায়।

    (পরবর্তী পর্বে সমাপ‍্য)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৮২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Arindam Basu | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০১:১৩527292
  • এই যে মন উঠল তো গাঁঠরি বেঁধে ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে করে ঘুরে বেড়ান, বাড়ি থেকে কিছু বলে না? 
    কি আশ্চর্য রোমান্টিক পরিব্রাজন। 
  • সমরেশ মুখার্জী | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:০৩527305
  • @ অরিন্দম‌বাবু,
    বাড়িতে আমরা তিনজন বাস করি। তাই বলার মধ‍্যে আছে কেবল বৌমণি আর ছেলে। ছেলে থাকে নিজের দুনিয়ায়। বাবা কোথায়, কতোদিন একাকী, দোকাকী বা দলগত ভ্রমণে গেল তাতে তার কিছু এসে যায় না। আমি অসীম ভাগ‍্যবান। বৌমণি‌ও কিছু বলে না। আমার মতো বেড়ানোর নেশাও ওর নেই।  তাই নেই কোনো অভাববোধ বা অভিযোগ। ফলে কিছু মনে‌ও করেনা। এসব প্রসঙ্গ কখনো আসতে পারে কোনো লেখায়।

    তাছাড়া আমি যেভাবে দিনপ্রতি ₹300~500 বাজেটে Hobo style এ জনবাহনে এবং হিচহাইক করে একাকী ঘুরি - তা মহিলা‌বর্জিত হ‌ওয়া‌ই বাঞ্ছনীয়। 
  • Arindam Basu | ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:১৭527325
  • আপনার লেখাগুলো, বিশেষ করে আশ্রম আখড়ায় মোহন্তদের গল্পে, তারপর আরকিটেকচার আর কেল্লার গল্প গুলো পড়তে গিয়ে কথাটা মনে হল। আপনার ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে হয়ত একটা বোহেমিয়ান ম্যাপ বিহীন পরিব্রজনের একটা ভারি আকর্ষণীয় দিক আছে, তবে, এ বাবদ আপনি এক আশ্চর্য রকমের ক্রনিকলার। তাই ভাবছিলাম আপনার কাছের মানুষরা আপনার এই দিকটার সঙ্গে কতটা পরিচিত। এইভাবে ঘুরে বেড়ানোর একটা অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ আছে, যেমন বাইক প্যাকিং করে ঘুরে বেড়ানোর। 
    আপনার চোখ দিয়ে একটা ভারতবর্ষের সঙ্গে পরিচিতি হয়, যে দেশটা এখনো সাবেক, সেখানে ধর্মের কলুষতা প্রবেশ করেনি, সনাতন এক ভারতবর্ষের গল্প। আপনার যাত্রা অন্তহীন হোক, নতুন বছরে এই প্রার্থনা। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন